#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৯
শৈলীরা আসেনি। লিফ্ট থেকে বের হলো, মালিহা আর আরেকটা মেয়ে। আকাঙ্ক্ষিত মানুষ কে না দেখতে পেয়ে মনে মনে বিরক্তি নিয়ে মিহরান চোখ ফিরিয়ে বোনের দিকে তাকায়। মালিহা ভাইকে পেয়ে খুশি হয়, তবে পাশের জনের উচ্ছাসের তুলনায় সেটা কিছুই না।
বোনকে দেখে না হাসলেও চোখে উষ্ণতা আনলো মিহরান,
-কি রে, ভার্সিটি থেকে মাত্র ফিরলি নাকি?
-হ্যা ভাইয়া। ইন্টার্নশিপের কাজে অবস্থা বেগতিক।
-ওওও।
দুই ভাইবোন একে অপরকে পেয়ে ভুলেই গেছে যে তাদের ছাড়া করিডোরে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত আছে এবং এই মুহূর্তে তার অবস্থা ভয়াবহ বেগতিক। রীতিমতো শরীর কাঁপাকাঁপির জোড়ে তুরিনের ঠায় দাড়ানোই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মিহরানের সাথে দেখা করতে আসলেও এভাবে দরজার বাইরেই সাক্ষাৎ হবে তা কষ্মিকালেও ওর কল্পনায় ছিল না। এই সুদর্শন মানবের এমন প্রখর দর্শনে তুরিনের মনের গভীরের অনুভূতিগুলো ঝড় তুলছে। কোনো ভাবেও শান্ত হওয়ার নাম নিচ্ছে না।
ততক্ষণে সদর দরজা খুলে গিয়েছে। ড্রইং রুমে প্রবেশ করলো তিনজন। ঠিক সেই সময় মালিহার মনে পরলো তুরিনের কথা। পেছনে আসা বান্ধবীর দিকে ঘুরেই মুচকি হাসলো ও যেন তুরিনের মনের হাল বুঝে গেছে। একটু সরে তুরিন আর মিহরানকে সরাসরি আনলো মালিহা,
-ভাইয়া, আজ তুরিনও এসেছে আমার সাথে। তুরিনকে মনে আছে না তোমার? আগেও তো দেখা হয়েছে।
মিহরান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল, বোনের কথায় আবার ফিরলো। এবার তাকালো। মেয়েটাকে আগে দু একবার দেখেছে বোধহয় তবে সেভাবে চেনে না। নামও ভুলে গেছে। সৌজন্যের এক ছটাক হাসি দিল তুরিনের পানে, যেটা দেখে তুরিন পারলে সেখানেই অজ্ঞান হয়। মিহরান ওর দিকে চেয়েছে! আবার হেসেছেও। আজ ভাগ্য ওর প্রতি এতো প্রশন্ন হলো কিভাবে?
-ভভ…ভালো আছেন?
মিহরানের উত্তর থাকে অপ্রতিভ,
– জ্বি।
এরপর বোনের দিকে তাকায়,
– দুপুরে লাঞ্চ করেছিস?
– আরলি লাঞ্চ করেছিলাম, তবে এখন ক্ষিদে পেয়েছে। তা তুমি কোথাও যাচ্ছো নাকি ভাইয়া?
-হ্যা, আম্মুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, আজকে মনে হয় রুটিন চেকআপ আছে।
মালিহা একটু অবাক হলো,
– কিন্তু এই ডাক্তারের কাছে তো মাহিরা নিয়ে যায় আম্মুকে সবসময়। আজ হঠাৎ তুমি যাচ্ছো যে? মাহিরা ফেরেনি বাসায়?
– না…ওকে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিয়েছি। ওর দেরী হবে আসতে। তোরা থাক, আমি আসি।
মিহরান আর দাড়াল না, তুরিনের দিকেও আর তাকালো না। এতে অবশ্য তুরিনের কিছু আসে যায় না। এতোক্ষণ সামনে ছিল এই ঢেড়। এই প্রথম এতোক্ষণ মানুষটার উপস্থিতি ওর আশেপাশে ছিল। দুই বছর অপেক্ষার মনে হয় এটাই উপহার।
তুরিন মিহরানকে আজ টানা দুই বছর পর দেখলো এবং সরাসরি দেখলো এই নিয়ে চতুর্থবার। দু বছর আগে হলেও বাকি তিন বার কোথায়, কখন দেখেছে, তা ওর মনের খাতায় খোদাই করে লেখা আছে। মানুষটাকে ভীষণ ভাবে পছন্দ যে ওর!
মিহরান সিড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় মাহিরার কথা ভাবছিল। মেয়েটা শৈলীর সাথে আছে তো? নাকি আবার একাই চলে আসছে। না, একা আসলে তো এতোক্ষণে বাসায় থাকতো। একবার কি ও ফোন দিয়ে খোজ নিবে? পরক্ষণে চিন্তাটা বাদ দিল। মাহিরা চঞ্চল স্বভাবের হলেও অনেক ম্যাচিউর্ড। ভাইয়ের কথার হেরফের করবে না। শৈলীকে সাথে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে মানে সে নিয়ে আসবেই। এইটা ভেবেই মিহরানের ঠোটে দাম্ভিক এক হাসির রেখা দেখা দিল। মাহিরা কে নিয়ে হঠাৎ এতো চিন্তাও কিছুটা অবাক করলো ওকে। চিন্তাটা কি আসলে মাহিরা কে নিয়েই? না তো।
…………………………
শৈলীর কাজ শেষ হতে বিকেল পার হয়ে গেল। মাহিরা ওর পাশে ঠায় বসে থাকলেও মেহরাব বাইরে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল। এই সময় বাসায় থাকলে বন্ধুদের সাথে আড্ডাতেই যেত। তবে আজ বোন আর বান্ধবীকে রেখে বাসায় চলে যাওয়াটা ওর সমিচিন মনে হয় নি। তার ওপর মেজো ভাইয়ার ফোনও এসেছিল ওর কাছে। তাই সব মিলিয়ে ও নিজেও থেকে গেছে। শৈলীর শেষ হলে, একসাথে বের হবে।
………………..
মিহরান ওর মাকে নিয়ে সাড়ে ছয়টা নাগাদ বাসায় পৌছালো। এসেই প্রথমে খোজ নিয়েছে মাহিরা মেহরাব ফিরেছে কি না। যখন শুনলো তারা এখনো ফিরেনি, তখন আসলেই চিন্তিত বোধ করলো মিহরান। নিজের দাম্ভিকতার খোলশ খুলে সোজা ফোন লাগালো মাহিরাকে। দুই কলেই অপর পাশের কল রিসিভ হলো,
– হ্যালো ভাইয়া,
– তোরা কোথায়? এখনো বাসায় ফিরিস নি কেন?
– ভাইয়া, শৈলীর কাজ শেষ হতে একটু সময় লেগেছে, এখন আমরা বাসার কাছেই চলে এসেছি প্রায়।
-মেহরাব কই?
-আছে আমাদের সাথেই। দিব?
-না থাক। সাবধানে আসিস।
কল কেটে মিহরান নিজের চুলে আঙ্গুল দিয়ে ব্রাশ করে পিছনে ঠেকালো। এখন একটু শান্তি লাগছে।
……
মাহিরা ফোন রেখেই একবার মেহরাব তো একবার শৈলীর দিকে তাকায়। সন্ধ্যার অন্ধকারেও ওর দৃষ্টির বিস্ময় স্পষ্ট। মেহরাব বুঝে হাসে,
-বলেছিলাম?
– আসলেই তাহলে কিছু ঘটসে রে?
– না হলে কি আমি এমনে এমনে বলি? মাঠে এ নিয়ে ছেলেদের মাঝে বেশ আলোচনা চলছে।
শৈলী দুই ভাইবোনের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না,
-এই তোরা কি নিয়ে কথা বলছিস? আমাকেও বল্।
মাহিরা মেহরাব দুইজনই শৈলীর দিকে তাকায়। মাহিরা কিছুটা সময় নিয়ে শুরু করলো,
– দোস্ত, ক্যাম্পাসে কথা হচ্ছে যে আজকে সকালে অডিটোরিয়ামে মিহরান ভাইয়ার সাথে রিক্ ও ওর বন্ধুদের নাকি কথা হয়েছে। তবে…. সেটা খুব ভালো দিকে গড়ায় নি মেইবি।
শৈলী কপাল সোজা হলো পুরোপুরি। রিক্ এর সাথে স্যারের কথা কি নিয়ে? শুক্না একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো ও
– কি নিয়ে কথা হয়েছে?
এবার মেহরাব উত্তর দিল,
– বিষয় বস্তু কি তা সঠিক কেউই জানে না। একেকজন একেক কথা বলতেসে। তবে এটা শিওর যে… রিকরা মনে হয় কোনো মেয়েকে নিয়ে কথা বলছিল যখন ভাইয়া ওদের আড্ডা ভেঙে দেয়। এরপরের কথপকথন খুব একটা নাকি ভালো ছিল না। রিক্ কে নাকি ভীষণ রাগি মাথায় ক্যাম্পাস ছাড়তে দেখা গিয়েছে।
মেহরাবের কথার শেষে তিন জনের মাঝে কেমন একটা নিরবতা ছেয়ে গেল। তারপর মাহিরা আচমকাই ধরলো শৈলীর হাত,
-এখন বুঝতে পারছি ভাইয়া কেন তোকে নিরাপত্তা দিতে চাইছে। আমার মনে হয়…রিক যেই মেয়েকে নিয়ে কথা বলছিল সেটা…আর কেউ না…তুই শৈলী।
শৈলীর শীরদ্বারা বেয়ে পরলো ঘামের চিকন রেখা। রিকের কথায় যে ও থাকতে পারে এটা অসম্ভব কিছু না। কিন্তু এমন কি বলেছে এই বদ ছেলেটি যার জন্য মিহরান স্যার শৈলী কে আজ একা ছাড়লেন না।
একটু পরেই বাড়ির মূল ফটক দিয়ে ঢুকলো ওরা। রাস্তায় আর কেউ কোনো কথা বলেনি। বিশেষ করে শৈলী অন্যরকম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। মাহিরার মেয়েটার জন্য মায়াই লাগলো। ওর পাশে এসে এক হাতে কাধ পেঁচিয়ে বললো,
-শৈলু, এখন তোর নিজের বাসায় যেয়ে কাজ নেই। চল্ আমাদের বাসায়।
শৈলী আপত্তি জানালো,
– না রে, এখন আর ভালো লাগছে না। দেরীও হয়ে গিয়েছে। আবার কালকের প্রস্তুতিও আছে। এখন বাসায় যাই।
মাহিরা, মেহরাব দুজনেই বুঝলো বান্ধবীর মনের হাল, তাই আর শৈলীকে জোর করলো না। একটা ছোট্ট হাসি দিয়েই শৈলী আগে চলে গেল। পেছনে আসলো দুই ভাইবোন। কিন্তু তিন জনের একজনও খেয়াল করলো না ছয়তলার ছাদে দাড়ানো ওদের অপেক্ষায় ব্যক্তিটিকে। মিহরান, পুলের পাশে দাড়িয়ে নিচে ওদেরকেই দেখছিল। এখন এক দিক দিয়ে মনটা বেশ শান্ত হয়েছে তবে অপর দিকে মস্তিষ্কে উঠেছে ঝড়।
পুলের পাশের চেয়ারে এক প্রকার ফেলে দিল নিজেকে। থুতনি তে আঙ্গুল ঠেকিয়ে কনুই চেয়ারের হাতলে ভর করে পুলের ফিরোজা পানির দিকে এক মনে তাকিয়ে রইলো। চিন্তা চেতনায় একটা মুখ ভাসছে অবিরত। মিহরান অনেক চেষ্টা করেও সেটা সরাতে পারছে না। সেই বৃষ্টিতে মুক্তার ন্যায় বারির ফোটা ছড়ানো মুখশ্রিটা, রোদে ঝলমলে হাসির প্রলেপ মাখানো মুখশ্রিটা, ব্যাকস্টেজে রিকের সামনে রাগে ও বিব্রতবোধে রক্তিম আভা লেপ্টানো মুখশ্রিটা, কবিতার লাইনে ভুল ধরা পরায় বোকা বোকা চাহনীর সেই মুখশ্রিটা। সব রুপেরই এক নাম…
শৈলী……
মিহরান বেশ অস্থির এই মুহূর্তে। আবার উঠে দাড়ালো সে চেয়ার থেকে। পায়চারি করলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার ঠায় দাড়ালো। ঠোটে আপনা আপনি ছেয়ে গেল মুচকি হাসি যা রাতের তিমিরে ডোবা বাতায়নের মাঝেই ভেষে রইলো।
…………………
শৈলী বাসায় এসেও আনমনে ছিল বেশ অনেক্ষণ। রিকের চিন্তাটা মাথা থেকে একেবারেই যাচ্ছে না। দিনে দিনে মনে হয় ছেলেটা আরও বেপরোয়া হচ্ছে নয়তো আজ একজন ফ্যাকাল্টি এতোটা চিন্তিত হওয়ার কথা না। মনে কু ডেকে উঠে শৈলীর। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় সামনে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে।
হঠাৎ কানে আসলো এশার আজানের ধ্বনি। শৈলী আজানের উত্তর দিল, তারপর অজু করে সোজা নামাজের পাটিতে বসলো। নামাজ শেষে অনেক্ষণ ধরে আল্লাহ্ র কাছে দোয়া করলো, নিজের নিরাপত্তার সাহায্য চাইলো। সালাম ফিরিয়ে দেখলো মনটা এখন বেশ হাল্কা লাগছে।
জায়নামায গুছিয়ে শৈলী উপস্থাপনার স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসলো। নজরুল ইসলামের সেই কবিতার লাইনটা পরতে গিয়ে হঠাৎ মিহরানের চেহারাটা মুখের সামনে ভেসে উঠলো ওর। আজ কি বেজ্জতিটাই না হলো ওর। স্যার কি ভাবলেন ওকে? গর্দভ! হ্যা তাই ভেবেছেন হয়তো। ইশ শৈলী! তোর দ্বারা এ ভুল হলো কেমনে? ইজ্জতের পুরা ফালুদা করে ছাড়লি। আনমনেই ছাদের দিকে তাকিয়ে ঠোট টিপে হেসে দিল। ঠিক ওপর তলাতেই তো থাকেন স্যার। আচ্ছা, যাকে নিয়ে ওর ভাবনা বিরাজমান সে তো মনে হয় সেসব তুচ্ছ ব্যাপার ভেবে ভুলেই গেছে, তাই না? হ্যা হ্যা তাই হবে। একজন সাধারণ ছাত্রীর ভুল নিয়ে বসে থাকার সময় আছে নাকি স্যারের?
……………………………
পরদিন সকালে শৈলী উঠেছে বেশ তাড়াতাড়ি। আজ শাড়ি পরতে হবে যে। অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব পরেছে ওর ঘাড়ে, বিশাল গুরু দায়িত্ব বটে। সেটাকেই শুষ্ঠভাবে পালন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে সে আজ জেগেছে। সকাল সকাল গরম দেখে ঝটপট গোসল সেড়ে ফেলেছিল। চুল ব্লো ড্রাই করতে সাহায্য করার জন্য নিপুনকেও উঠিয়ে দিয়েছে সকাল সকাল। মেয়েটা এর জন্য রাগে বোম হয়ে আছে। যে কোনো সময় ফুটতে পারে। তবে এটা দেখার সময় এখন শৈলীর নেই। বোনকে বিকালে এসে মানিয়ে নিবে। এখন তার নিজের কাজ শেষ করাটা ফরজ।
ঝুট ঝামেলা সব পার করে শৈলী ঠিক সময়েই তৈরী হতে সক্ষম হলো। গতকাল রাতে মাহিরা ম্যাসেজ করেছিল যে আজও মিহরান স্যার ওদের তিনজনকে নিয়ে যাবে। সময় প্রায় হয়ে গেছে নিচে নামার, তাই শৈলী আর দেরী করলো না। মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে বের হলো। লিফ্টের বাটান চাপ দিতে দিতে মাহিরাকে কল করলে ও জানালো আর দুই মিনিটে মেহরাবকে নিয়ে ও নিচে নামছে।
শৈলী ভাবলো ও মাহিরার জন্য এখানেই অপেক্ষা করবে। নিচে নেমেই বা কি লাভ? একা একাই তো রোদের মধ্যে দাড়িয়ে থাকা। তারচেয়ে এখানেই ভালো।
কিন্তু সিদ্ধান্ত পরমুহূর্তেই পাল্টে গেল যখন লিফ্টের দরজা হা করে ওর সামনে খুলে মূর্তিয়মান হলো মিহরান। লিফ্টের এক পাশের কার্নিশে ভর দিয়ে দাড়িয়ে মোবাইলে মনোযোগ ছিল মিহরানের। লিফ্ট খোলায় একবার সংক্ষিপ্ত নজর উঠিয়ে নামাতে যেয়েও নামালো না। শৈলীর দিকে সরাসরি তাকালো। শৈলীও তাকানো ওর দিকে তবে চোখে ইতস্ততা ভর করা। তাদের এই দৃষ্টি বিনিময়ের মাঝেই লিফ্টের দরজার ধ্যর্য আর কুলালো না, বন্ধ হতে চাইলো দু দিক থেকে। কিন্তু সেটা হওয়ার আগেই মিহরান এগিয়ে যেয়ে ওপেন বাটন টা ধরে ফেললো। আবার খুলে গেল লিফ্ট, আবার পুরোপুরি দৃশ্যমান হলো শৈলী। মিহরানের কান্ড দেখে মনে মনে হকচকালেও বুঝে নিল যে শৈলীর জন্যই আবার দরজা খোলা হয়েছে, তাই আর দেরী না করে ও প্রবেশ করলো। চুপচাপ যেয়ে মিহরানের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো। মিহরান এক পলক ওর ঢোকার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে চাইলো,
– বাকিরা কোথায়? নিচে নেমে গেছে?
শৈলীকেই যে প্রশ্ন করা হয়েছে তা বুঝতে সময় লাগলো না। তাই অকপটেই উত্তর আসলো,
-না স্যার। মাহিরা বললো একটু পরেই নামবে। মেহরাবও ওর সাথেই আসবে।
– ওওও।
লিফ্টের ওপেন বাটন টা ছেড়ে দিতেই দরজা দুদিক থেকে লেগে গেল। আর সামনে উদিয়মান হল মাথা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা আয়না। শৈলী সামনেই তাকিয়ে ছিল। আয়নায় মিহরানকে দেখা গেল আবার দেয়ালে ঠেশ দিয়ে, এক পা অপর পায়ের সাথে ক্রস দিয়ে দাড়িয়ে মোবাইলে মনোযোগ নিবেশ করতে। মানুষটাকে আজ বেশ সুদর্শন লাগছে, এটা মানতেই হবে শৈলীর। অন্যদিন এতোটা চোখে লাগেনি, তবে আজ আড়চোখে হলেও বার বার ওর দৃষ্টি বেহায়ার মতন ওদিকেই যাচ্ছে। আচ্ছা এর কারণ টা কি? স্যারের আকাশি শার্টটা, নাকি ফরমাল খয়রি চকচকা শু টা? শৈলী ভ্রু কুচকে মনোযোগ দিয়ে এবার সামনের আয়নায় তাকায়। ও গাঢ় নীল রঙের সূতির তান্তুজ শাড়ি পরেছে। ওর শরীরের গাঢ় নীল আর মিহরানের শরীরের আকাশি রঙ কেন যেন পাশাপাশি বেশ মানাচ্ছে ওর কাছে। চিন্তাটা মস্তিষ্কে বাড়ি দিতেই চোখ জোড়া বড় হয়ে গেল ওর। অষ্ট যুগোল একে অপরের সাথে পিশে ফেললো ততক্ষণাৎ। ভীষণ লজ্জায় পরলো ও। স্যারের সাথে এসব কি চিন্তা করছে ও? ধ্যাত!
ইতিমধ্যে লিফ্ট নিচে চলে এসেছে। শৈলী আড়চোখে শেষবার মিহরানকে দেখেই দ্রুত নেমে গেল লিফ্ট থেকে। -যাক বাবা! স্যার এখনো মোবাইলে ব্যস্ত তার মানে উনি আমার চেহারার পরিবর্তনগুলো দেখেননি। ভেরি গুড।
তবে হায়রে বোকা শৈলী, একটু পেছনে ঘুরে তাকালেই মিহরানের ঠোট ঘেষে চলে যাওয়া এক চিলতে হাসি দেখলেই বুঝতে পারতো ও কতোটা ভুল ধারণা করেছে।
মিহরান বের হয়েই আবার সেই গাম্ভীর্য টেনে ধরলো শৈলীর সামনে।
– এখানেই ওয়েট করুন। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।
-জ্বি স্যার।
গ্যারেজের দিকে হাটা দিল মিহরান। শৈলীর থেকে মুখ ফেরাতেই আপনে আপ ডান হাত উঠে গেল বুকে। বেসামাল হৃদযন্ত্র সামলাতে ভয়ংকর বেগ পেতে হচ্ছে এখন। ওপরে যখন প্রথম দরজাটা খুলে শৈলীর শাড়ি পরা আনন, ওর চোখের সামনে পরলো, তখনই তাল হারিয়েছিল মিহরান। মেয়েটাকে সরাসরি না দেখলেও আড়চোখে যে কতোবার অবলকোন করেছে এই কয়েক মুহূর্তে তার হিসেব ওর কাছে নেই। তবে মিহরানের মুখোবয়ব আবার শিথিল হলো এটা মনে করে যে শৈলীও আয়নায় অনেকবার ওকে চেকআউট করেছে। এগুলা সবও খেয়াল করেছে মিহরান। মেয়েটার মুখের প্রতিটা অভিব্যক্তি ওর নজরে আটকিয়েছে। আচ্ছা ও চিন্তা কি করছিল? মাথার ভেতর চলছিল কি এই মেয়েটার?
……………….
মাহিরা আর মেহরাব কিছুসময় পরেই নামলো। শৈলীর কাছে দৌড়ে আসলো মাহি,
– বান্ধবী, তুমি তো পুরা রবীঠাকুরের উপন্যাসের নায়িকা লাগছো। কি সুন্দর মানিয়েছে শাড়িটা তোকে!
মাহিরার ভঙ্গিমায় আর কথাতে হেসে উঠলো শৈলী। মেয়েটার কথায় লজ্জা লাগে না, হাসিই পায়।
মাহিরা এদিক ওদিক তাকিয়ে মেহরাবকে শুধালো,
-ভাইয়া কই রে? নামেনি এখনো? ফোন দে তো।
মেহরাব ফোন বের করার আগেই শৈলী উত্তর দিল,
– স্যার নেমেছেন। গাড়ি আনতে গিয়েছেন।
-ঐ যে ভাইয়া চলে এসেছে।
মেহরাবের কথায় বাকি দুইজন ফিরে তাকালেই দেখতে পেলো গাড়ি। যথারীতি মেহরাব সামনে বসলো আর মাহিরা ও শৈলী বসলো পেছনে। অনতিবিলম্বে মিহরান গাড়ি স্টার্ট দিল। চললো ওরা ওদের গন্তব্যস্থলে।
অনুষ্ঠানের জন্য ক্যাম্পাসের একটা ভাগ সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে। যথারীতি তিনজনকে নামিয়ে দিয়ে মিহরান গাড়ি পার্ক করতে চলে গেল, তবে মেহরাবকে বলে গেল ওদের ভেতরে চলে যেতে। মিহরানের নিজেয কেবিনে কিছু কাজ আছে, সেটা শেষ করে বাকি ফ্যাকাল্টিদের সাথে একেবারে অডিটোরিয়ামে আসবে। শৈলীও তাই আর দেরী না করে স্টেজের দিকে ছুটলো। মাহিরা আর মেহরাব চলে গেল ক্লাসে।
অডিটোরিয়ামের ঝলমলে আলোয় প্রথমেই চোখ ধাধায় শৈলীর। ফটক দিয়ে ঢুকেই সরাসরি চোখ যায় স্টেজের ওপর। মনটা জুড়িয়ে যায় সাথে সাথে। ওর আর ওর টিমের তৈরীকরা রঙিন চিত্রকর্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমগ্র মঞ্চ জুড়ে।ভীষণ সুন্দর লাগছে দৃশ্যপট। শৈলী শান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যাক! ওদের প্রয়াস সার্থক হয়েছে। এটার দায়িত্ব শেষ তবে এখন পালা ওর নিজেস্ব দায়িত্ব ষুষ্ঠ ভাবে পালন করার। উপস্থাপনা।
শৈলী আর দাড়িয়ে না থেকে চলে গেল স্টেজের পেছনে প্র্যাক্টিস করতে।
চলবে
……………………..