বুকে_যে_শ্রাবণ_তার #পর্ব_২১

0
196

#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_২১
#নিশাত_জাহান_নিশি

“তা অবশ্য ঠিক। সেদিন তো স্বীকার করলি তুই না-কি কারো মনের রানী হয়ে বসে আছিস! যেহেতু রাজত্ব তোর, অন্য নারীদের মতো তোর এতো জ্বলবে কেন?”

দস্তুর ন্যায় দাড়িয়ে রইল সামান্তা। মিশাল তার মনের ভাব ধরতে পারল এতেই যেনো সামান্তা আহাম্মক বনে গেল। অঘোষিতভাবে তাদের অনুভূতির আদান-প্রদান হতে লাগল। স্নিগ্ধতায় ভরা মিশালের গভীর দু’চোখের দিকে তাকানোর সাধ্য হলোনা সামান্তার। নিমিষেই দৃষ্টি নুইয়ে এলো তার। ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে মিশালকে উদ্দেশ্য করে কঠিন গলায় বলল,

“রাজত্ব যতোই রাণীর না হোক, রাজার প্রতি একাধিক নারীদের আকর্ষণ রানীর ভেতরকে জ্বালাবেই! রাজাদের সাথে গ্যারান্টি কী? তৎকালীন সময়ে তো রাজাদের একাধিক রাণী ছিল! এই যুগে এসেও যদি এর পুনরাবৃত্তি ঘটে তবে একাধিক রানীতে আসক্ত হওয়া রাজার আমার কোনো প্রয়োজন নেই! তাই রাজাসহ রাজত্বকে পেতে হলে আমাকে সর্তক হতে হবে! রাজাকে চোখে চোখে রাখতে হবে!”

অট্ট হাসল মিশাল! দরোজার সাথে হেলান দিয়ে বাঁকা হয়ে দাড়ালো। বুকের উপর দু’হাত গুজে গম্ভীর সামান্তার পানে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকালো। হেয়ালী গলায় শুধালো,

“তাহলে রাণী হওয়ার শখ মিটে গেল?”
“মানে? কখন বললাম?”
“একজন রাজাকে চোখে চোখে রাখা কী সম্ভব?”
“সম্ভব নয় কেন?”
“রাজার ক্ষমতা সম্পর্কে তোর কোনো ধারণা আছে?”
“এসব বলে তুমি কী বুঝাতে চাইছ? তোমার একাধিক রাণীর প্রয়োজন?”

সামান্তার মাথায় গাড্ডা মেরে মিশাল জায়গায় সোজা হয়ে দাড়ালো। ঝুঁকে এলো ঈষৎ সামান্তার দিকে। আচমকা রাগী ভাব নিলো! শার্টের কলারটা পেছনের দিকে এলিয়ে বলল,

“রাজাকে তো প্রশ্রয় তুইই দিচ্ছিস। জেনিয়া রাগ করেছে আমার কেন তার রাগ ভাঙাতে হবে? আমি তো জানিও না সে আমার সাথে রাগ করেছে। অযথা এরমধ্যে আমাকে টানছিস কেন? এভাবে চলতে থাকলে রাজ্যসহ রাজাকে হারাবি! তাই সাবধান করলাম।”

সামান্তাকে উপেক্ষা করে মিশাল তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজ নিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। মিশালের যাওয়ার পথে তাকিয়ে সামান্তা ক্রুর হাসল! মহা খুশি হলো সে। সন্তোষজনক গলায় বলল,

“আহা। রানী তবে নিশ্চিত হলো রাজার একাধিক রানীর প্রতি কোনো ঝোঁক নেই! জেনিয়াকে নিয়ে আর ভাববই না আমি। রাজা ঠিক তো রাজত্ব ঠিক।”

________________________________

মিশালের দেওয়া লোকেশন অনুযায়ী সামান্তা ও সাইফা রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছালো। রেস্টুরেন্টটিতে এই প্রথম বারই আসা তাদের। তাই রেস্টুরেন্টটি খুঁজে বের করতেও ঈষৎ বেগ পেতে হয়েছিল তাদের। দুপুর তখন বারোটা প্রায়। রেস্টুরেন্টের দু-তলায় ওঠে সূক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে সামান্তা বেশ অনেকক্ষণ যাবত কাউকে খুঁজতে লাগল। বিরক্ত হলো সাইফা। পাশ থেকে সে ছটফটে গলায় বলল,

“হঠাৎ রেস্টুরেন্টে এলাম কেন আপু?”
“চুপচাপ দাড়িয়ে থাক। দেখ আমি কী করি।”
“কাউকে খুঁজছ তুমি?”
“হুম।”
“কাকে?”
“তোর মনে নেই মিশাল ভাইয়ার সাথে আমার ডিল হয়েছিল?”
“কী ডিল?”
“তোর বিয়ে ভাঙার বদলে মিশাল ভাইয়ার ফ্রেন্ডের বিয়ে ভাঙতে হবে।”
“ওহ্ হ্যাঁ, মনে পরেছে। কিন্তু এখানে আমাদের কাজটা কী?”

তখনই সামান্তার স্বচ্ছ ও সর্তক দৃষ্টি পরল রেস্টুরেন্টের দক্ষিণ পাশে থাকা দোলনাটির দিকে। দোলনায় দোল খেয়ে টিকটক করছে প্রিয়া! তার বান্ধবী তার ভিডিও করছে। প্রিয়ার এক্সপ্রেশন দেখে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে সামান্তা। কিরিম আপা প্রো ম্যাক্স দেখাচ্ছে তাকে! কী বিভৎস অভিনয় তার। চোখ মুখ বাঁকা করে যাচ্ছে তাই অবস্থা। সাইফা এখনও কিছু বুঝে ওঠতে পারছেনা। নির্বোধ দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়েই রইল অট্ট হাসতে থাকা সামান্তার দিকে। কৌতূহল এড়ানোর জন্য অবুঝ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী ব্যাপার আপু? তুমি এভাবে হাসছ কেন?”
“ছিঃ! লিওন ভাইয়ার চয়েজ এতো জঘন্য!”
“তার গার্লফ্রেন্ডকে খুঁজে পেয়েছ বুঝি?”
“দক্ষিণ দিকে তাকা। টিকটক করছে দেখ!”

প্রিয়ার দিকে তাকাতে সাইফারও ভীষণ হাসি পেয়ে বসল! মুখ টিপে সেও হাসতে লাগল। কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে হয়ত সম্ভব নয় মুখমণ্ডল বিকৃত করে এভাবে টিকটক করা। যা তাকে রীতিমতো মানুষের কাছে হাসির খোঁড়াক হিসেবে উপস্থাপন করবে। রেস্টুরেন্টে থাকা অধিকাংশ মানুষই প্রিয়া ও তার বান্ধবীর দিকে ঠাট্টার ছলে তাকাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে ব্যঙ্গও করছে! তবে এতে কিছু যায় এলোনা প্রিয়া ও তার বান্ধবীর। টিকটক করা শেষে তারা টেবিলে এসে বসল। দুজনই মুখোমুখি বসে ভিডিওগুলো দেখতে লাগল এবং তা সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগল। অদূরে দাড়িয়ে মিশাল ও লিওন তাদের দূর দৃষ্টিতে সব পর্যবেক্ষণ করছিল। দুজনই মাস্ক পড়ে দাড়িয়ে। প্রিয়া যেনো এখনই তাদের দেখে না ফেলে মূলত এজন্যই এই ব্যবস্থা করা। সামান্তা যে তার কাজ ঠিকঠাকভাবে পালন না করে কেবল খিলখিলিয়ে হাসছিল তাও তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল লিওন। ঘাবড়ানো গলায় মিশালকে বলল,

“সামান্তা কাজটা ঠিকঠাকভাবে করতে পারবে তো?”
“সামান্তা পারেনা এমন কোনো কাজ নেই। তুই নিশ্চিন্তে থাক।”
“হেসে হেসেই তো সময় নষ্ট করে ফেলছে। কাজটা করবে কখন?”

সামান্তাকে তাড়া দেওয়ার জন্য মিশাল বাধ্য হলো সামান্তার নাম্বারে কল করতে। পেটে খিল ধরা হাসি নিয়ে সামান্তা পার্স থেকে ফোনটি বের করে কলটি তুলল। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে মিশাল বলল,

“তোকে কী দাঁত কেলিয়ে হাসার জন্য ওখানে পাঠিয়েছিলাম?”
“তো আর কী করব? পৃথিবীর সবচেয়ে বিচিত্র ও অটিস্টিক প্রাণীদের সাথে দেখা করার জন্য তুমি আমাকে পাঠিয়েছ! এর থেকে বেশী কিছু কী এক্সপেক্ট করো তুমি আমার কাছ থেকে?”
“মানে কী? তুই কাজটা করতে পারবিনা?”
“পারবনা কখন বললাম? মাত্র তো এলাম। সময় তো দিতে হবে না-কি?”
“যা করার তাড়াতাড়ি কর। ঐ মেয়ের সাথে যতো দ্রুত সম্ভব ভাব জমা। আমরা রেস্টুরেন্টের ভেতরেই আছি। প্রয়োজনে কল দিস।”

কলটি কেটে দিলো মিশাল। সামান্তা পারবে লিওনকে আশ্বস্ত করল। ফোনটি পার্সে রেখে সামান্তা তার পাশে দাড়িয়ে থাকা সাইফার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

“অটিস্টিকগুলোর পাশের টেবিলে বসতে হবে আমাদের। চল।”

সাইফাকে টেনে নিয়ে পাশের টেবিলে হুড়োহুড়ি করে বসল সামান্তা। দুজনই আড়চোখে পাশের টেবিলে বসে থাকা প্রিয়া ও তার বান্ধবীর দিয়ে তাকাতে থাকল। ইতোমধ্যেই ওয়েটার এলো সামান্তা ও সাইফার টেবিলে। মেন্যু কার্ড হাতে নিয়ে সামান্তা জোরপূর্বক হেসে ওয়েটারকে বলল,

“আমরা একটু পরে অর্ডার করছি ভাইয়া।”
“ওকে ম্যাম। প্রয়োজনে ডেকে দিবেন।”

ওয়েটার প্রস্থান নিলো। সামান্তার হাত চেপে ধরল সাইফা। চুপিচুপি বলল,

“এই আপু? তুমি কী করতে চাইছ বলো তো? ঐ অটিস্টিকগুলোর সাথে তুমি ভাব জমাবে কী করে?”
“বেশী ভাবিসনা তো। দেখে যা আমি কী করি।”

মুহূর্তের মধ্যেই জায়গা থেকে ওঠে সামান্তা প্রিয়ার টেবিলের পাশে দাড়ালো। প্রিয়া ব্যস্ত তার বান্ধবীর সাথে হেসে হেসে কথা বলতে। তারা দুজন কারো জন্য অপেক্ষা করছে তা স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর তারা রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে তাকাচ্ছে এমনকি হাত ঘড়ির দিকেও তাকাচ্ছে। তাদের দুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সামান্তা গলা ঝাড়লো। জোরপূর্বক হেসে প্রিয়াকে ডেকে বলল,

“হায় আপু? আপনি প্রিয়া না?”

আচানক দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকালো প্রিয়া। সামান্তাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর ভাবশূণ্য গলায় বলল,

“হ্যা আমিই প্রিয়া। কিন্তু আপনি কে?”

হুট করে প্রিয়ার হাত চেপে ধরল সামান্তা! হাতের মুঠোতে হাত বেশ আলতো করে ধরল। পৃথিবীর যতো ন্যাকামি ও নাটকীয়তা সব কণ্ঠে ধারণ করে বলল,

“আমি আপনার বিগ ফ্যান আপু! আপনাকে সবসময় টিকটকে ফলো করি আমি। আপনার এমন কোনো টিকটক ভিডিও বা রিলস নেই যা আমার দেখা হয়নি! ইশশ, আমার কী ভাগ্য বলুন? আপনার সাথে হঠাৎ এভাবে দেখা হয়ে গেল। আচ্ছা আমি স্বপ্ন টপ্ন দেখছি না তো?”

নিমিষেই গলে গেল প্রিয়া! জীবনে প্রথমবার সে তার সম্পর্কে প্রশংসা শুনল। কেউ যে তার টিকটক এতো পছন্দ করে তা তার ধারণা বাইরে ছিল। অল্প পানির মাছ বেশী পানিতে পরলে যেভাবে লাফায় প্রিয়া ভেতরে ভেতরে সেভাবে লাফাতে লাগল! হাত ধরে সামান্তাকে তার পাশে বসালো। লাজুক হেসে সামান্তাকে ছুুঁয়ে বলল,

“উঁহু। স্বপ্ন নয়। দেখো আমি তোমার হাত ছুঁয়ে আছি!”

“হ্যা সত্যিই তো। আপু তুমি জানোনা তোমাকে দেখা আমার কতো বড়ো স্বপ্ন ছিল! আমার একটা কাজিন ভাই আছে জানো? সে যেমন কোটিপতি দেখতে তেমনি শাহরুখ খানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়! টিকটকে তোমাকে দেখার পর থেকে স্বপ্ন ছিল জানো? তোমাকে আমি তার বৌ বানাবো! এতে কী হবে জানো? তোমাকে সবসময় চোখের সামনে দেখতে পারব। তোমার ফ্যান ফলোয়ারস দের গর্ব করে বলতে পারব দেখো দেখো সবাই দেখো তোমরা যাকে দেখার জন্য মরো, সে আমার ভাবি! তার সাথে প্রতিদিন, প্রতিটা মুহূর্তে আমি একই বাড়িতে থাকি। প্লিজ এখন বলোনা যে তুমি মিঙেল!”

গলা ঝেড়ে প্রিয়ার বান্ধবী সিনহা প্রিয়াকে কিছু একটা ইঙ্গিত করল। ঠোঁটে লেগে রয়েছে তাদের দুষ্টু হাসি! সিনহার ইশারাকে সম্মতি জানিয়ে প্রিয়া লাজুক হেসে সামান্তার দিকে তাকালো। মাথা নুইয়ে বলল,

“মিঙেল না অবশ্য! একচুয়েলি আমি বলতে চাইছি যে….
“থাক থাক কিছু বলতে হবেনা তোমার। তুমি মিঙেল নও এতেই আমি শান্তি! আমি কাজিন ভাইয়ার অনেক টাকা-সম্পত্তি জানো? আমাদের এলাকায় একমাত্র কোটিপতি তারাই! তুমি চাইলে তোমার কথা আমি তাকে বলতে পারি! তুমি কী রাজী বলো?”
“কী নাম ধাম তার? বাড়ি কোথায়? তার ইনফরমেশন দিলে আমার বুঝতে একটু সুবিধা হবে আর কী!”
“অফকোর্স। হোয়াই নট? তার নাম হলো সাহিল! সাহিল খান। একবার দেখলেই তুমি তার প্রেমে পরে যাবে। এলাকার সব মেয়েরা তার প্রেমে পাগল!”

সিনহার দিকে তাকিয়ে কুচুটে হাসল প্রিয়া! ছেলেদের ট্রেপে ফালানো তাদের নতুন পেশা নয়। তবে আজ প্রথমবার এমন হলো যেখানে মুরগি নিজে এসে তাদের কাছে ধরা দিলো। লিওনকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই প্রিয়ার! বিয়ের পর ডিভোর্সের মোটা অঙ্কের টাকার জন্যই মূলত লিওনকে বেছে নেওয়া তার!

থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে সাইফা অনুভূতিহীন হয়ে সামান্তার নিঁখুত অভিনয় দেখছিল। অন্যহাতে ফোন তাক করে পুরো ঘটনা ভিডিও করছিল! দূরে হতে দাড়িয়ে মিশাল ব্যগ্র হাসল। বুকের উপর হাত গুটিয়ে লিওনকে বলল,

“দেখলি তো? মুরগি কীভাবে ভাগে আনতে হয়?”
“হুম দেখলাম। সামান্তা সত্যিই জিনিয়াস।”

আচমকাই মিশালের দৃষ্টি পরল রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করা সাহিলের দিকে! সচকিত হয়ে সে পিছু ঘুরে রাগান্বিত গলায় বলল,

“ওহ্ শিট! সাহিল ভাই এখানে কী করছে? সামান্তাকে ফলো করতে করতে এই অবধি পৌঁছে গেছে?”

মাঝপথে সামান্তাকে ডুবানোর জন্য সাহিলের আকস্মিক আগমনে ভড়কে ওঠল সামান্তা! সাহিলের নাম বেচে খাওয়া এই বুঝি তার কাল হয়ে দাড়ালো।

#চলবে…?

[খুবই কষ্টে আমি আজকের পর্বটা লিখেছি। কতটুকু সাজাতে পেরেছি জানিনা। তবে আমি চেষ্টা করেছি জোর করে লিখতে। পাওয়ারফুল ঔষধের প্রভাবে দুদিন ধরে সারাক্ষণ শুধু ঘুমোচ্ছি। চোখ টেনে মেলাও কষ্টকর হয়ে পরছে। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here