বুকে_যে_শ্রাবণ_তার #পর্ব_২৫

0
180

#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_২৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হোয়াট? পাগল হয়ে গেছো তুমি? বাড়ি বয়ে এসে পাগলামি করছ?”

সামান্তার কথার বিপরীতে অট্ট হাসল সাহিল। দু’কদম বাড়িয়ে এগিয়ে এলো সামান্তার দিকে। শার্টের কলারটি বেশ তোরজোড়ে ঝাকিয়ে প্রবল চিন্তিত ও শঙ্কিত সামান্তাকে বলল,

“আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি রে। তাও আবার যেনো তেনো পাগল নয়, পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়ার মতো পাগলামি ভর করেছে আমার মধ্যে। যতোক্ষণ অবধি আমার ইগু সেটিসফাইড না হবে, কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির থেকে প্রতিশোধ না নেওয়া হবে ততোক্ষণ অবধি আমার মন শান্তি হবেনা। প্রয়োজনে আমি পৃথিবী ধ্বংস করে দিবো! তবুও প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষান্ত হবোনা।”

মিশালের কারিগরি সাহিল ধরতে পেরে গেছে তা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয়নি সামান্তাকে। মুখভঙ্গি পাল্টে গেল তার। পূর্বের তুলনায় অধিক আতঙ্কিত হয়ে ওঠল সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। ভীরু নেত্র যুগল মেলে তাকালো উদ্ধত সাহিলের দিকে। শুষ্ক ঢোঁক গিলে শুধালো,

“তুমি কার কথা বলতে চাইছ সাহিল ভাই? কার থেকে তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও?”

তাৎক্ষণিক তেতে ওঠল সাহিল। মুখশ্রীতে প্রখর তেজী ভাব ফুটিয়ে তুলল। অচিরেই ঘাড়ের রগ টান টান হয়ে এলো। অত্যধিক রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সে তার পাশে থাকা টি-টেবিলটিতে সজোরে এক লাথ মারল! দাঁত গিজগিজিয়ে মৃদু চিৎকার করে সামান্তাকে বলল,

“ব্লা*ডি মিশালের থেকে! মিথ্যে অপবাদে সে আমাকে ফাঁসিয়েছে। তাই আমি আজ তাকে বাড়ি ছাড়া করব! তার অবস্থান ঠিক কোথায় তা আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিব। ভিখিরির বাচ্চা হয়ে রাজার ছেলের সাথে পাঙা! কতো বড়ো বুকের পাঠা তার।”

সাহিলের চিৎকার চ্যাচাম্যাচি ও শোরগোলের আওয়াজ শুনে মিশাল ছুটে এলো বাড়ির ড্রইংরুমে। তার পেছনে পেছনে জেসমিন বেগম ও রুমকিও যার যার অবস্থান থেকে ছুটে এলো। সবার মধ্যে বেশ আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। সাহিলের উগ্রতায় সামান্তা যতোটা না ভীতু হলো বরং তারচেয়ে অধিক রেগে গেল! রোষাগ্নি দৃষ্টিতে সে উগ্র সাহিলের পানে তাকালো। চোয়াল উঁচিয়ে শুধালো,

“নিজের আপন মামাকে ভিখিরি বলতে তোমার বিবেকে বাঁধলনা? এতোটাই অ’স’ভ্য, বে’য়া’দ’ব, নির্লজ্জ তুমি? বিশ্বাসই হচ্ছেনা তুমি আমার ফুফুর ছেলে। যথেষ্ট শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে ফুফু তোমাকে মানুষ করতে পারেনি।”

“জাস্ট শাট আপ সামান্তা। তুই আমার দুর্বল জায়গা বলে ভাবিসনা যে আমি তোকে ভয় পাই কিংবা তোর মুখের ওপর কিছু বলতে পারবনা। বিবেধটা আমার আর মিশালের মধ্যে। তুই একদম আমাদের মাঝখানে আসবিনা।”

ইতোমধ্যেই মিশাল তাদের দুজনের মাঝখানে চলে এলো। শান্ত মেজাজে সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল। রাগ বা অসন্তুষ্টি বুঝাতে চাইলনা। সামান্তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জায়গা থেকে সরিয়ে দিলো মিশাল। পাশ ফিরে কোমল গলায় সামান্তাকে বলল,

“রুমে যা তুই। আমি সাহিল ভাইয়ার সাথে কথা বলছি।”

উড়নচণ্ডী সামান্তা গিজগিজিয়ে বলে ওঠল,

“না। আমি যাচ্ছি না কোথাও। কারণ তোমাদের দুজনের মাঝে আমিও কোনো না কোনোভাবে ইনভলভড আছি! তাই যা কথা হবে আমার সামনেই হবে। আমারও কিছু বলার থাকতে পারে।”

“অযথা জেদ ধরিসনা সামান্তা। তুই যা এখান থেকে। সাহিল ভাইয়াকে আমি বুঝিয়ে বলছি।”

অমনি সাহিল ধাক্কা মেরে মিশালকে কয়েক ইঞ্চি দূরে ছিটকে ফেলল! ঘটনার আকস্মিকতায় মিশাল তার শরীরের তাল খুঁজে না পেয়ে নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে গেল। মেঝেতে পরে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। তুখোর মেজাজ নিয়ে সাহিল হতবাক মিশালকে বলল,

“তোর সাথে আমার বোঝাবুঝির কোনো ব্যাপার নেই। আমার মধ্যে তেমন কোনো সুসম্পর্ক নেই। লেবার আসছে বাড়ি ভাঙতে তোদের। আসবাবপত্র সব সরিয়ে নে। গত কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা এখানে বাড়ি করব। ভাড়ায় দিব এই বাড়ি। আর এটাই ফাইনাল।”

ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে রুমকি তার চাচার নাম্বারে কল করল। মিজানুর রহমানকে সে সবটা খুলে বলল। খবরটি শোনা মাত্রই তিনি আতঙ্কিত হয়ে ওঠলেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি মিশালদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জেসমিন বেগম তেড়ে এলেন সাহিলের দিকে। রুখে দাঁড়ালেন সাহিলের মুখোমুখি। খরখরে গলায় বললেন,

“কী ব্যাপার সাহিল? রাতারাতি তোমরা সিদ্ধান্ত পাল্টে নিলে কীভাবে? তোমার বড়ো মামা মারা যাওয়ার সময়ও কিন্তু তোমার মা উঁচু গলায় বলেছিল আমাদের সম্পত্তিতে না-কি তার কোনো দাবি দাওয়া নেই। বাপের বাড়ির সম্পত্তিতে তার কোনো লোভ নেই। তাহলে হুট করে এখন আবার লোভ জন্মালো কীভাবে? জায়গা সম্পত্তি কী কম আছে তোমাদের?”

“কাগজে কলমে আমার মা কিন্তু তার সম্পত্তি মামার নামে লিখে দেয়নি মামী! তাই আমরা যখন তখন এসে আমাদের সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে পারি। আপনি এখানে উঁচু গলায় কথা বলার মতো কেউ না। মামলা মোকদ্দমা হলে কিন্তু আপনারাই কিন্তু হেরে যাবেন! তাই আমার সাথে গলা নামিয়ে কথা বলুন। আজ আপনাদের এই অধঃপতন আপনার ছেলের জন্য! আমার সাথে পাঙা নিয়েছে আপনার ছেলে। এই সাহিলের সাথে পাঙা। ভেবে দেখেছেন কতো বড়ো সাহস তার?”

মাথায় আগুন লেগে গেল জেসমিন বেগমের! তেড়ে এলেন তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকা মিশালের দিকে। চোখ রাঙিয়ে গলা উঁচিয়ে তিনি মিশালের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“সাহিলের সাথে কী হয়েছে তোর? ছোটোলোক হয়ে বড়ো লোকের ছেলের সাথে কীসের এতো পাঙা তোর?”

এই সংকটাপন্ন মুহূর্তে যার পাশে থাকা একান্তই কাম্য ছিল মিশালের সেই মানুষটিই যখন মিশালকে একতরফা দোষাতে লাগল তখন নিজের জীবনটা নিজেই দিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল তার! পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। অসহায়ত্ব গ্রাস করতে লাগল। বাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে লাগল। ভাসা ভাসা জল তার চোখের কোণে! ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে পারার সামর্থ্য নেই তার। সাহিলকে টাচ করার ক্ষমতা অবধি নেই তার। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায়ন্তরও নেই। রাগে, দুঃখে, জেদে তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। মাথা গরম হলেও শান্ত রাখার চেষ্টা করল। মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে তখন মানুষ পাথরের মতোই নির্বাক ও নিথর হয়ে যায়।

রুমকি পেছন থেকে ছুটে এলো। তার মাকে সরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মিশালকে জড়িয়ে ধরল! ডুকরে কেঁদে তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“মা প্লিজ আমার ভাইয়াকে কিছু বলোনা। আমি জানি আমার ভাইয়া কখনও অন্যায় করতে পারেনা। আমার ভাইয়ার মতো ভালো ছেলে পৃথিবীতে আর দুটো হয়না। দোহাই লাগে তুমি চুপ করো মা।”

সামান্তার চোখেও তখন জল। মিশালের অসহায়ত্ব তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তবে সে মিশালকে বেশিক্ষণ কষ্টের মাঝে রাখবেনা। সাহিলকে উচিত শিক্ষা দিতে সে একাই যথেষ্ট। ভরসার জায়গা খুঁজে পেয়ে মিশাল জাপটে ধরল রুমকিকে। এই একটুখানি আশ্রয়স্থল প্রয়োজন ছিল তার। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করল মিশালের। তবে নিজের আবেগকে ধরে রাখল সে। এসবে একটুও গললোনা জেসমিন বেগম কিংবা সাহিলের মন! ক্রুর হাসতে লাগল সাহিল। পৈশাচিক আনন্দ হতে লাগল তার। এক টানে জেসমিন বেগম রুমকিকে মিশালের গাঁ থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। চোখ রাঙিয়ে রুমকিকে বললেন,

“তোর ভাই যে দুধের ধোঁয়া তুলসি পাতা নয় তা আমার বেশ ভালোভাবেই জানা! নিশ্চয়ই তোর ভাই এমন কিছু করেছে যার কারণে সাহিল এতো রেগে গেছে। তবে যাই করুক না কেন সাহিলের কাছ থেকে এখন ক্ষমা চেয়ে নিক! তাহলেই তো ব্যাপারটা মিটে যায়।”

সাহিলের মনের ভাব নিমিষেই ধরতে পেরে গেলেন জেসমিন বেগম! মন থেকে জেসমিন বেগমকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে হলো সাহিলের। শার্টের কলারটি ঠিকঠাক করে সাহিল দাম্ভিক ভাব নিলো। গলা ঝাকিয়ে ব্যগ্র হেসে বলল,

“আইডিয়াটা মন্দ নয়! মিশাল আমার পা ধরে ক্ষমা চাইলে তবেই বিষয়টা আমি ভেবে দেখতে পারি!”

আর নিচে নামা সম্ভব হচ্ছিলনা মিশালের পক্ষে! নম্র, ভদ্র ও কোমল ভাবভঙ্গি পাল্টে সে তেড়ে এলো সাহিলের দিকে। উসকো খুসকো চুলগুলো ঠিক করে মুখোমুখি দাড়ালো সাহিলের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো বিভ্রান্ত সাহিলের পানে। এক রোঁখা গলায় বলল,

“ক্ষমা চাইবনা তোর কাছে! কী করবি কর। বাড়ি ভেঙে দিবি? ভেঙে দে! উপর ওয়ালা সামর্থ্য দিলে এমন চার পাঁচ বাড়ির মালিক হওয়ার ক্ষমতা হবে আমার। সেদিন তোর অবস্থান হবে আমার পায়ের তলায়।”

ভড়কে গেল সাহিল। মিশাল সত্যিই তাকে চমকে দিলো। রাগে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল জেসমিন বেগমের! মিশালের ঘাড়ত্যাড়ামোর জন্য এই বুঝি সব হারাতে হলো তাদের। সাহিলের রক্ত গরম হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই সে কল করে যতো দ্রুত সম্ভব লেবারদের আসতে বলল! ভয় পেয়ে মিশালকে টেনে আলাদা জায়গায় নিয়ে এলেন জেসমিন বেগম। রাগ গজগজ করে মিশালকে বললেন,

“পাগল হয়ে গেছিস তুই? কেন সাপের লেজে পা দিচ্ছিস? বাড়িটা ভাঙা পরলে আমাদের অবস্থানটা কী হবে একটু ভেবে দেখেছিস? দুটো রুমে আমরা এডজাস্ট করব কীভাবে? তোর বাবার অসুখ বিসুখের পেছনে তো সব জায়গা সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছিল আমাদের। নিজের বলতে এখন এই বাড়িটাই আছে। দয়া করে আমাদের ভালো থাকা থেকে বঞ্চিত করিসনা তুই। নিজের স্বার্থের জন্য মাঝে মাঝে ছোটো হতে হয়। আর এটাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।”

“আপনাদের ভালো থাকার কথা ভাবতে ভাবতে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি মা! বিশ্বাস করুন আমি নিজেকেই এখন নিজে চিনতে পারিনা। দু’বছর আগের মিশালের সাথে আমি এখনকার মিশালের কোনো মিল খুঁজে পাইনা। কতো নরম হয়ে গেছি আমি। নিজেকে আর কতোটা নিচে নামালে আমি আপনাদের সুখে রাখতে পারব মা? এতোকিছুর পরেও কী আমি আপনাদের সুখে রাখতে পারব? আপনাদের আপন হতে পারব?”

ইতোমধ্যেই ঘটনাস্থলে মিজানুর রহমান ধেয়ে এলেন। সাহিলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন তিনি। উঁচু গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কী সমস্যা তোর? তুই নাকি বাড়ি ভাঙতে এসেছিস?”

প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাড়ালো সাহিল। বেশ ভাবসাব নিয়ে নাক ঘঁষে বলল,

“হুম। লেবার আসছে!”
“সিরিয়াসলি? তুই বাড়ি ভাঙার অর্ডার দেওয়ার কে?”
“এই বাড়িতে আমারও হক আছে মামা। আমার মায়ের হক থাকা যে কথা, আমার হক থাকা একই কথা।”
“এই ব্যাপারে তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই। আগে তোর মাকে নিয়ে আয়। তার সাথে বসে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাছাড়া তোদের মধ্যে হয়েছেটা কী? বাড়ি ভাঙার প্রসঙ্গ এলো কোথা থেকে? হুট করে সম্পত্তি চাওয়ার কারণটাই বা কী?”

সাহিলকে প্রত্যত্তুর করার সুযোগ দিলোনা সামান্তা। তৎক্ষনাৎ সামান্তা তার বাবার পাশে এসে দাড়ালো। তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে সোজাসাপটা গলায় বলল,

“যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে সব আমার কারণে হচ্ছে বাবা! আমিই সেদিন সাহিল ভাইকে আমাদের মাঝখানে জড়িয়েছিলাম। মিশাল ভাইয়ার কোনো দোষ নেই এতে। যদি শাস্তি দিতে হয় তবে আমাকে দেওয়া হোক। মিশাল ভাইকে নয়।”

সেদিনের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা সামান্তা প্রথম থেকে শেষ অবধি তার বাবাকে খুলে বলল।

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here