#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_২৮
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আ’ম সো সরি। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা!”
জেনিয়া তার অস্বচ্ছ ও অস্ফুটে দৃষ্টিতে অস্থির ভাবাপন্ন সাহিলের পানে তাজ্জব ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। নিরুপায় সাহিল। আগ পাছ না ভেবেই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। মূলত বাধ্য ছিল সে। কাজটি করানোর জন্য তাকে একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছিল। এইমাত্র যা ঘটল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা জেনিয়া! রেগে মেগে সাহিলকে অনেককিছু বলতে চাইলেও শরীরের অস্বস্তির জন্য কিছু বলতে পারলনা সে। অযথা সময় ব্যয় না করে সাহিল তড়িঘড়ি করে রুমে প্রবেশ করে জেনিয়াকে লম্বা করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সাহিল। কপালে দৃশ্যমান বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছল। ক্রুর হেসে সামান্তা ও মিশাল একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। অবশেষে পরিকল্পনা তাদের সফল হলো। খোশ মেজাজে রুমের দরোজায় হেলান দিয়ে দাড়ালো মিশাল। ভ্রু উঁচিয়ে সামান্তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী বুঝলি বল?”
“বুঝলাম সাহিল ভাই জেনিয়ার প্রতি কিছু তো একটা ফিল করছে। যা সে বুঝতে পারছেনা।”
“তোর আবার জেলাস ফিল টিল হচ্ছেনা তো?”
“মানে? আমার আবার জেলাস ফিল হতে যাবে কেন?”
“এইযে সাহিল ভাই অন্য কারো প্রতি কিছু একটা ফিল করছে! তাও আবার রাতারাতি! ইশ, এতদিন তো সাহিল ভাই তোর জন্যই মরত!”
মিশালের দিকে তেড়ে গেল সামান্তা। মুখশ্রীতে ক্ষিপ্ত ভাব ফুটিয়ে মিশালের মুখোমুখি দাড়ালো। অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে ভাবশূণ্য মিশালের পানে তাকিয়ে খরখরে গলায় বলল,
“লিসেন? তুমি তোমার নিজের ফিলিংসটা আমার ওপর চাপিয়ে দিবেনা ওকে? একচুয়েলি জেলাস ফিল তো তোমার হচ্ছে! জেনিয়াকে কেউ পছন্দ করছে, তাকে নিয়ে ভাবছে, হুটহাট তাকে কোলে তুলে নিচ্ছে। আহা, চোখের সামনে এসব সহ্য হচ্ছেনা! একদম সহ্য হচ্ছেনা। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছ। তুমি অস্বীকার করলে কী হবে? পোঁড়া পোঁড়া গন্ধ আমি ঠিকই পাচ্ছি।”
“লুল! নিজের ভেতরের পোঁড়া গন্ধ চেপে রাখতে না পেরে এখন আমার হৃদয়কে পোঁড়া হৃদয় বলা তুইকে আমি বয়কট করলাম! সরে যা আমার সামনে থেকে। হৃদয় পোঁড়ার গন্ধ খুবই বাজে। সহ্য হচ্ছেনা আমার। খবরদার আমার পিছে পিছে আসবিনা তুই।”
সামান্তাকে তুখোর রাগিয়ে দিয়ে মিশাল পাশ কাটিয়ে জেনিয়ার রুমের দিকে পা বাড়ালো। রাগে রি রি করে ওঠল সামান্তা। পেছন থেকে মিশালের গলা চেপে ধরতে গেল! দাঁত গিজগিজিয়ে বলল,
“দাঁড়া মিসাইল বোমা! আজ তোর একদিন কী আমার একদিন। চু’রি’র ওপরে বা’ট’পা’রি করা তাইনা?”
জেনিয়ার রুমে ঢুকে গেল মিশাল। সামান্তার লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পূর্বেই আকস্মিকভাবে তার পেছনে জেসমিন বেগম চলে এলেন! সামান্তাকে ডেকে তিনি শক্ত গলায় বললেন,
“কী রে সামান্তা? তোকে না বললাম সবাইকে ডেকে দিতে? এতোক্ষণ লাগে বুঝি সবাইকে ডাকতে?”
থেমে গেল সামান্তা। পিছু ঘুরে মাথা চুলকালো। অস্থবির দৃষ্টিতে তার চাচির দিকে তাকালো। আমতা আমতা গলায় প্রত্যত্তুরে বলল,
“সরি চাচি। একচুয়েলি জেনিয়ার মাথা ঘুরে গিয়েছিল তো তাই এতোটা দেরি হয়ে গেল।”
মুহূর্তেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠলেন জেসমিন বেগম। ঘাবড়ানো গলায় শুধালেন,
“কী বলিস? হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল কীভাবে? সে এখন কোথায়?”
“রুমেই আছে চাচি। দেখে এসো।”
দ্রুত পায়ে হেঁটে জেসমিন বেগম জেনিয়ার রুমে প্রবেশ করলেন। বিচলিত তিনি। চোখেমুখে অনবরত পানি ছিটানোর ফলে জেনিয়া এখন পূর্বের তুলনায় কিছুটা সুস্থ বোধ করছে। জেসমিন বেগমকে দেখা মাত্রই সাহিল ও মিশাল রুম থেকে বের হয়ে গেল। জেনিয়ার শরীরের কাহিল ও নেতিয়ে যাওয়া অবস্থা দেখে জেসমিন বেগম উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠলেন। সামান্তাকে ডেকে বললেন,
“সামান্তা মা একটা হেল্প কর তো। জেনিয়ার জন্য প্লেটে করে ভাত তরকারি নিয়ে আয়। সকাল থেকে মেয়েটা না খেয়ে আছে এই কারণেই হয়ত শরীরটা এতো দুর্বল হয়ে গেছে।”
“যাচ্ছি চাচি।”
বাধ্য মেয়ের মতো সামান্তা চলে গেল জেনিয়ার জন্য খাবার আনতে। মিশাল ও সাহিল বাড়ির এক কোণায় দাড়ানো। দুই ভাই পাশাপাশি দাঁড়াতেই বলা নেই কওয়া নেই মিশাল হুট করে সাহিলের শার্টের প্রথম দুটো বোতম খুলে সাহিলের উন্মুক্ত বুকে মাথা রাখল! বেশ তৎপর গলায় বলল,
“হাউ স্ট্রেঞ্জ ভাই। তোমার হার্টবিট এতো কাঁপছে কেন? কানের পর্দা ফেটে গেল আমার!”
ক্ষেপে গেল সাহিল। মিশালকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে তার বুকের ওপর থেকে ওঠালো! রক্তিম চক্ষুতে নির্বোধ ভঙ্গিতে দাড়ালো মিশালের দিকে তাকালো। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,
“স্টপ ইট। তুই বা তোরা যা প্রুভ করার চেষ্টা করছিস তা এই জীবনে সফল হবেনা!”
“আরে ভাই তুমি ভুল বুঝছ। একচুয়েলি আমি তোমাকে দিয়ে কিছু মানবিক কাজ করাতে চাইছি। এতে তোমার নিজেরও সুবিধা হবে। এই ধরো বিপদে মানুষের পাশে দাড়ানো, প্রয়োজনে মানুষকে পাঁজা কোলে তুলে নেওয়া, হার্টবিটকে ব্যায়াম করানোর সুযোগ করে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক ইতিবাচক কাজ! অযথা আমাকে ভুল না বুঝে বরং তোমার উচিৎ আমাকে থ্যাংকস দেওয়া!”
“দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা! আমাকে দিয়ে মানবিক কাজ করানো তাইনা? উল্লু পেয়েছিস আমাকে?”
খিলখিলিয়ে হেসে দিলো মিশাল। সাহিল নিজেও হাসতে হাসতে পুরো বাড়ি সুদ্ধ মিশালকে দৌঁড় করাতে লাগল। দুজনের দৌঁড়ঝাপ দেখে খাবার টেবিলে বসে সাইফা, সায়মা ও রুমকিও বেশ জোরে জোরে হাসতে লাগল। তখনি মিশালকে উদ্দেশ্য করে সাইফা বলে ওঠল,
“ভাইয়া আমরাও খেলব। প্লিজ আমাদের তিনজনকে তোমাদের দলে নাও।”
মিশালকে ধরতে না পেরে সাহিল হাঁপিয়ে ওঠল। শক্ত গলায় সাইফাকে বলল,
“ওকে ফাইন তোরা তিনজন আমার দলে। মিশালকে ধরে দিতে পারলে তোদের সবাইকে ফুচকা খাওয়াবো, গ্যারান্টি।”
ফুচকার লোভে তিনজন লাফিয়ে ওঠল। চোখদুটি চকচক করে ওঠল। সাহিলের শর্তে তারা রাজি হয়ে গেল। মিশাল দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। তার পেছনে চারজন লেগে রইল। মিশাল পিছু ফিরে হাঁপানো গলায় রুমকিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই রুমকি তোর দৌড়াতে হবেনা। শ্বাসকষ্ট হয়ে যাবে।”
“হয়ে যাক। কতোদিন দৌঁড়ঝাপ করিনা বলো? একদিন শ্বাসকষ্ট হলে কিছু হবেনা।”
রুমকির কষ্ট হবে সেই ভেবে মিশাল থেমে গেল! মিশালকে হাতে পাওয়া মাত্রই সাহিল উল্টো করে তাকে কাঁধে তুলে নিলো! ঠাট্টার স্বরে ব্যগ্র হেসে বলল,
“আছড়াই তোকে? কী বল?”
“দুই মিনিট পর এমনিই ছেড়ে দিবা! আমার শরীরের ভার রাখা চাট্টিখানি কথা নয়।”
প্রকান্ড হেসে সাহিলকে উদ্দেশ্য করে সায়মা বলল,
“তাহলে আজ বিকেলে আমরা ফুচকা খেতে বের হচ্ছি। কী বলো ডান তো?”
“হাট! কীসের ফুচকা? শর্ত অনুযায়ী মিশালকে তোদের ধরার কথা ছিল। ধরতে পেরেছিস?”
উদাস হয়ে গেল তিনজন। সাইফা যেতে যেতে মুখ বাঁকা করে সাহিলকে বলে গেল,
“কিপ্টুস কোথাকার! তোমার ঐ টাকায় ঘুনে ধরবে ঘুনে!”
“হ্যা যা যা। টাকা এতো সস্তা নয় যে এমনি এমনি ঘুনে ধরতে দিব।”
সুযোগ পেয়ে মিশাল বলল,
“আচ্ছা ওদের না খাওয়াও অন্তত জেনিয়াকে তো পার্সোনালী ডেকে নিয়ে খাওয়াতে পারো! এতে তোমার লাইনও ক্লিয়ার হবে, আমরাও ভাবি পাব!”
সাহিলকে আরও দ্বিগুন রাগিয়ে দিলো মিশাল। রোষাগ্নি হয়ে সাহিল ঝাঁকি দিয়ে মিশালকে নিয়ে গোল গোল করে ঘুরতে লাগল। সেই সময় ওখানে অপ্রত্যাশিতভাবে উপস্থিত হয়ে গেলেন তমাল খান!
_____________________________
জেনিয়ার জন্য সামান্তা খাবার নিয়ে গেল। জেসমিন বেগম খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন জেনিয়াকে। সামান্তাকে বললেন সবাইকে নিয়ে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিতে। সবার পেটে হয়তো এতোক্ষণে ইঁদুর দৌঁড়োচ্ছে। দুপুর পেরিয়ে গেল প্রায়। জেনিয়াকে খাইয়ে তিনি আসছেন। তাঁর জন্য অপেক্ষা না করতে। সম্মতি জানিয়ে সামান্তা রুম থেকে বের হলো। ইতোমধ্যেই রুমের ভেতর থেকে সামান্তা শুনতে পেল জেসমিন বেগম বেশ কর্কশ গলায় জেনিয়াকে বলছেন,
“ব্যাপার কী তোর? খাওয়াদাওয়ায় এমন অনিয়ম করছিস কেন? তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝিনা?”
খাবার মুখে নিলো জেনিয়া। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল সে! প্রত্যত্তুরে তার খালামনিকে অস্ফুটে গলায় বলল,
“সবই যেহেতু বুঝো তবে মিশাল ভাইকে কেন কিছু বলছ না? তুমিতো কথা দিয়েছিলে মিশাল ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হবে!”
“হ্যাঁ। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম মিশালকে বিয়ে করে তুই ঠকবি! কি আছে ঐ ছেলের? না আছে টাকা পয়সা, না আছে বাড়ি গাড়ি সম্পত্তি। এই ভিটে বাড়িটা ছাড়া আর কী আছে তার? দুইদিন পর হয়তো এই ভিটেবাড়িটাও হারাতে হবে তাকে। তুই তো আমার বোনের মেয়ে বল? তোকে কীভাবে এই অশান্তির মধ্যে জড়াই বল?”
#চলবে….?