আনন্দ_অশ্রু #পর্ব_২

0
301

#আনন্দ_অশ্রু
#পর্ব_২
#লেখনীতে_ওয়াসেনাথ_আসফি

আপনার আম্মা অনেক ভালো মানুষ আপনারা শুধু শুধু ওনাকে এতো গুলো কথা শোনালেন। জানেন উনি যদি আজ আমাকে আপনার বউ করে না নিয়ে আসতো তাহলে আমার ফুফু কালকেই আমাকে আবার বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতো।
তাই আপনার আম্মা আমার ফুফুকে দুই লাখ টাকা দিচ্ছে আর আমাকে কিনে নিয়ে আপনার সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আমার বয়স পনেরো না তেরো। আপনার আম্মা আমাকে ফুফুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সবাইকে মিথ্যা কথা বলেছে আর বিয়ের কিছুক্ষণ আগে আমাকে বলেছে আমি যেনো আমার বয়স পনেরো বলি।

খাবার খেতে খেতে এক নাগাড়ে কথা গুলো বললো মায়া। মায়ার কথা শুনে রেহান কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাত্র তেরো বছরের একটা মেয়ে মায়া আর রেহান কিছু দিন পর চব্বিশ বছরে পা দিবে। হতভম্ব হয়ে রেহান বলে, তারাতারি খাবার শেষ করে ওষুধ গুলো খেয়ে শুয়ে পরো অনেক রাত হয়েছে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

হাত ধুয়ে ওষুধ খেয়ে মায়া শুয়ে পরলো, এদিকে রেহান বারান্দায় বসে বসে ভাবছে কেনো তার মা এমন করলো। কাল সকালেই এই বিষয়ে সে তার মায়ের সাথে কথা বলবে।

ফজরের আজান দিচ্ছে মায়া ঘুম থেকে উঠে অজু করে নামায পড়ে রান্না ঘরে ঢুকে। রান্না ঘরে টুং টাং শব্দ শুনে রহিমা বানু রান্না ঘরে যায়, রান্না ঘরে ঢুকে সে অবাক হয়ে মায়াকে জিজ্ঞেস করে,
ও ছোটো বউ তুমি এতো সকাল বেলা রান্না ঘরে কী করো?

আম্মা আমি কাল রাতের থালা বাটি গুলো পরিষ্কার করছি।

এইগুলা তোমার কাম না এইগুলা করার মানুষ আছে, তোমারে কি এই কাজ করতে আনছি নাকি। এইগুলা রাখো আর হাত ধুইয়া ঘরে যাইয়া ঘুমাও।

কিন্তু আম্মা ফুফুর বাড়ীতে তো আমি প্রতিদিনই এইগুলা কাজ করতাম।

রহিমা বানু এইবার ধমক দিয়ে বলে, এইডা তোমার ফুফুর বাড়ি না এইটা আমার বাড়ি আর এইখানে আমি যা কইমূ তাই হইবো এহন বেশি কথা না কইয়া যাও ঘরে গিয়া ঘুমাও।
রহিমা বানুর ধমক শুনে মায়া হাত ধুয়ে ঘরে চলে যায়।

সকাল ৮টা সবাই নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা করছে, সবার খাওয়া প্রায় শেষ তখন রহিমা বানু রেহান, হাইউল আর তানজিলকে নাস্তা শেষে তার ঘরে আসতে বলে কিছু গুরত্বপূর্ণ কথা আছে। মায়ের কথা মতো নাস্তা শেষ করে তারা তিনজন যায় রহিমা বানুর ঘরে।

তোমাগো তিনজনের কাছে আমি কহণই কোনো কথা লুকাই নাই আজও লুকামু না। মায়ার বয়স পনেরো না তেরো। আমি কিছু দিন আগে তোমার ছোটো মামার বাড়ি বেরাইতে গেছিলাম। তোমার মামার বাড়িতে কাম করে মায়ার ফুফা এক দিন মায়ার ফুফা তোমার মামার হাতে ধইরা কইলো সে যেনো মায়ারে বাঁচায়, তাগো কথা শুইনা আমি জিজ্ঞেস করলাম কী হইছে মাইয়াটার তারপর মায়ার ফুফা মায়ার বিষয়ে সব কিছু কইলো কথা গুলা শুইনা আমার খারাপ লাগলো তাই আমি মায়ার ফুফুর বাড়ি যাই মায়ার ফুফুর লাগে কথা কইয়া দুই লাখ টাকা দিয়া মায়ারে কিনি। কিনার আগে আমি মায়ারে দেখি নাই কিন্তু যখন দেখলাম তখন ওরে আমার খুব ভালো লাগে তাই ওরে নিজের কাছে কাছে রাখার জন্য রেহানের লগে বিয়া দেই। অহন তোমরা কও আমি কি কোনো অন্যায় করছি?

রহিমা বানুর কথা শুনে সবাই চুপ করে আছে, সবার নীরবতা ভেঙ্গে তানজিল বলে, আম্মা আপনি কোনো অন্যায় করেনি কিন্তু আপনি একবার আমাদের বিষয়টা জানাতে পারতেন।

বড়ো বউ, আমার যখন তোমার শ্বশুরের সাথে বিয়া হয় তখন আমার বয়স পনেরো ছিলো, বিয়ার দিন রাতে জানতে পারি তোমার শ্বশুরের আগের ঘরে দুইটা পোলা আছে একটার বয়স চার আর একজন দের বছরের শিশু। জানো হেই পোলা দুইডা কে? একটা আমার কলিজার টুকরা হাইউল আর একজন মমিন। এতো ছোট বয়সে দুইটা বাচ্চা সামলানো আবার সংসার সামলানো আমার খুব কষ্টের হইয়া গেছিলো আমার কষ্টের কথা আমি আমার মায় বাপেরে জানাইছি কিন্তু তারা আমার কষ্টটা বুঝলো না কিন্তু তোমার শ্বশুর আমার কষ্ট বুঝতে পারে আর বাড়ির সকলের কাছে বলে, আমি শুধু এই দুইটা পোলার দেখা শোনা করমু আর কোনো কাজ যেনো আমারে না দেওয়া হয়। বাড়ীর সবাই তোমার শ্বশুরের কথায় বিরক্ত হয় কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলার সাহস পায় না। ধীরে ধীরে হাইউল আর মমিন আমারে মায়ের মত সম্মান দিতে শুরু করে আম্মা বইলা ডাক দেয় ওগো ডাক শুইনা আমার খুব আনন্দ লাগতো নিজেরে মা মা মনে হইতো সন্তান জন্ম না দিয়াও আমি মা হওয়ার সুখ পাইছি আমার যখন বিশ বছর বয়স তখন রেহান দুনিয়াতে আসে আমি আমার তিন পোলারে সব সময় নারীকে সম্মান করতে শিখাইছি সব সময় বয়সের মাপ কাঠি বুঝাইছি আর সেই আমি একটা ছোট মেয়েকে নিজের পোলার বউ করতে চাই এটা শুনে যদি তোমরা আমারে ভুল বুজো তাই আমি এমন কাজ করছি তোমরা আমারে ভুল বুইজনা।

কথা গুলো এক নাগাড়ে বলে কান্না করতে থাকে রহিমা বানু। মায়ের কান্না দেখে হাইউল মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,আপনি আমাকে জন্ম না দিলেও আপনি আমার আম্মা আপনার সকল কথা সকল আদেশ মাথা পেতে নিবো আমরা। আজ পর্যন্ত আপনি আমাদের বিষয়ে যা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সব গুলো সঠিক ছিলো শুধু জন্ম দিলেই মা হয় না। আপনি কান্না থামান আমরা আপনার ওপর বিরক্ত না। গতকাল আপনার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছি আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন।

আম্মা আমরা খুব লজ্জিত আপনার সাথে ওমন করে কথা বলার জন্য আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দেন।(রেহান)

আরে কি কইতাছো তোমরা এইগুলা, আমি কোনো কষ্ট পাই নাই মা কহনো সন্তানের ওপর রাগ থাকে। আমি অনেক ভাগ্যবতী মা যে তোমাগো মতো পোলা আর বউ পাইছি।

মায়ের কথা শুনে তিনও জন মাকে জড়িয়ে ধরে, ছেলে আর বউয়ের এমন আবেগ দেখে রহিমা বানু বলে, হইছে আমার দম বন্ধ কইরা দিবা নাকী তোমরা ছাড়ো আমারে।
শাশুড়ির এমন কথা শুনে তানজিল হেসে দেয়।

শোনো বড় বউ, ছোটো বউরে তুমি নাফিসার স্কুলে ভর্তি করাইয়া দিবা আর আজ মার্কেটে যাইয়া ছোটো বউয়ের জন্য কিছু ভালো কাপড় কিনা আনবা আর একটা কথা বাড়ীর সবাইরে জানায় দিবা ছোটো বউরে যেনো কোনো কাজ করতে না দেয়। এখন ওর পড়ার বয়স খেলার বয়স যখন সংসার করার বয়স হইব তখন আস্তে আস্তে সব শিক্ষা লইবো। এখন তোমরা যার যার কাজে যাও।

রহিমা বানুর কথা শুনে সবাই সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরের বাইরে কান পেতে দাড়িয়ে ছিলো মেজো বউ তিশা দরজা খোলার শব্দ পেয়ে দ্রুত সরে দাঁড়ায়। তিশাকে বাইরে দেখে তানজিল বিরক্তি নিয়ে বলে, তিশা দরজার বাইরে কান পেতে দাড়িয়ে না থেকে ভিতরে গেলেই পারতে। আরি পেতে কথা শুনার অভ্যেসটা এবার ছাড়ো।

না না ভাবী আমিতো এইখান দিয়ে যাচ্ছিলাম আপনি ভুল বুঝছেন।(তিশা)

শোনো তিশা, দশ বছর ধরে তোমাকে চিনি তাই নতুন করে আমাকে কিছু বোঝাতে এসো না। যাও গিয়ে নিজের কাজে মন দাও।

তানজিলের কথা শুনে তিশা মুখটা কালো করে চলে গেলো আর তানজিল চলে গেলো মায়ার কাছে।
দরজায় টোকা দিয়ে তানজিল মায়াকে জিজ্ঞেস করলো, মায়া ভিতরে আসবো?

হ্যাঁ, বড় ভাবী আসুন।

তোমাকে দেখতে এলাম, তোমার জর কেমন হয়েছে?

হ্যাঁ, এখন একটু ভালো লাগছে কিন্তু পিঠে খুব ব্যাথা।

কোথায় ব্যাথা আমাকে দেখাও।

জামা খুলে পিঠটা তানজিলের দিকে করে দিল মায়া, মায়ার পিঠে বেতের আঘাতের দাগ কিছু কিছু জায়গায় কেটেও গেছে এগুলো দেখে আতকে উঠলো তানজিল। নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না কিন্তু মায়াকে কিছুই বুঝতে দিলো না মায়াকে বসতে বলে চলে গেলো নিজের ঘরে একটু পরেই আবার ফিরে এলো। মায়ার পিঠে মলম লাগিয়ে দিলো আর কিছু ব্যাথা নাশক টেবলেট খেতে দিলো। কিছু ক্ষন মায়ার সাথে কথা বলে চলে গেলো তানজিল।
——————-
বসার ঘরে টিভিতে কার্টুন দেখছে, মায়া, নাফিসা, আর্শী, নীতুল, আনাম, তাদের পাশে বসে পান চিবুচ্ছে রহিমা বানু। হাতে কিছু চকলেট আর ফুচকা নিয়ে বসার ঘরে আসলো রেহান।সবাই চকলেট ফুচকা খাচ্ছে কিন্তু মায়া খাচ্ছে না। এটা দেখে রহিমা বানু মায়াকে ডেকে নিজের কাছে বসায় আর রেহানকেও বসতে বলে এক পাশে রেহান আর অন্য পাশে মায়া মাঝখানে রহিমা বানু বসে বলতে শুরু করে, শোনো মায়া তুমি আমার ছেলের বউ এই বাড়িতে সবার যেমন সবকিছুতে অধিকার আছে ঠিক তেমন ভাবে তোমারও সব কিছুর অধিকার আছে, তোমার যখন যেইটা মন চাইবো তহন হেইডাই করবা কিন্তু কোনো অন্যায় কাজ কইরো না খুব বড় মুখ কইরা তোমারে আমার বাড়ির বউ কইরা আনছি আমার জবানের সম্মান রাইখো। আর রেহান তুই এখন থাইকা মায়ার সকল বিষয়ে খেয়াল রাখবি কোনো দিন মাইয়াডারে কষ্ট দিবি না ওরে কষ্ট দিলে আল্লাহ্ সইবে না।
কথা গুলো বলে দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেলো রহিমা বানু। রেহান মায়ার কাছে বসে মায়াকে ফুচকা আর চকলেট খেতে বললো মায়াও একবার রেহানের দিকে তাঁকিয়ে খাওয়া শুরু করে।

বিয়ের এক সপ্তাহ হয়ে গেছে মায়া তার প্রতি সবার আদর যত্ন দেখে সবার মিশে গেছে বাড়ির বাচ্চা গুলো সাথে খুব ভাব হয়েছে মায়ার সব থেকে বেশি ভাব হয়েছে নাফিসার সাথে। সারাদিন দুজনে মিলে কত শত গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে। দৌড়াদৌঁড়ি লাফালাফি এসব করেই দিন কাটে মায়ার।দূর থেকে রেহান মায়াকে দেখে আর হাসে মাঝে মাঝে কান্নাও করে এটা ভেবে সে একটা বন্ধি পাখিকে ভয় ছাড়া উড়ার রাস্তা দিয়েছে। কাল থেকে মায়া নতুন স্কুলে যাবে তাই রেহান মায়াকে উপদেশ বাণী দিচ্ছে।

মায়াকন্যা, কাল থেকে তুমি নতুন স্কুলে যাবে, নতুন মানুষের সাথে মিশেবে, নতুন বন্ধু হবে। সব কিছু নতুন তাই সব সময় সতর্ক থাকবে নিজের আর নাফিসার খেয়াল রাখবে, কেউ কিছু বললে বা খারাপ মন্তব্য করলে সোজা আমাকে জানাবে। আমি তোমার বিষয়ে সব জানতে চাই তোমাকে খোলা বইয়ের মত পড়তে চাই তাই তুমি কোনো কথা আমার কাছে লুকাবে না কখনোই আমাকে মিথ্যা বলবে না। আমি আমার সবটা দিয়ে তোমার পাশে থাকবো, আমি তোমার স্বামী কিন্তু তোমার সাথে আগে আমি বন্ধুত্ব করবো। তুমি কি আমাকে নিজের বন্ধু বানাবে?

এতক্ষন এক ধ্যানে কথা গুলো শুনছিল মায়া রেহানের বন্ধু হওয়ার প্রস্তাবে সায় জানালো। মায়ার সায় পেয়ে মায়াকে বললো,
বন্ধু যখন হয়েছি তখন আমি তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি, তোমাকে ছোটো চুলে ভালো লাগে না এখন থেকে বেশি করে চুলের যত্ন নিবে চুল লম্বা করবে।

আমার চুল লম্বা ছিলো, চুলে বেশি তেল লাগতো বলে ফুফু কেটে ছোট করে দিচ্ছে।
মুখটা মলিন করে কথাটা বললো মায়া।

#চলবে………………

আসালামুয়ালাইকুম পাঠক পাঠিকাদের সুবিধার জন্য চরিত্র গুলো বলে দিচ্ছি: রেহান মূল চরিত্র বয়স প্রায় চব্বিশ বুয়েটে পড়ে।
মায়া মূল চরিত্র বয়স তেরো ফুফুর নির্মমতার শিকার হয়ে অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে।

রহিমা বানু: বাড়ির কর্তি। হাইউল, মমিন, রেহানের মা।

হাইউল আমীন বাড়ীর বড় ছেলে, পেশায় একজন আইজীবী। তার বউ তানজিল সুলতানা পেশায় ডাক্তার। তাদের প্রেমের বিয়ে একি কলেজে পড়তো তানজিলের পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নেনি বলে তানজিল পালিয়ে হাইউলের বাড়ী চলে আসে আর রহিমা বানু তাদের বিয়ে দিয়ে দেয় তাদের দুইজন ছেলে মেয়ে আছে, নাফিসা আর নীতুল।নাফিসার বয়স তেরো আর নীতুলের পাঁচ।

মমিন বাশার মেজো ছেলে পারিবারিক ব্যাবসা দেখা শোনা করে তার বউ তিশা তাদেরও দুইজন ছেলে মেয়ে আছে আর্শি আর আনাম। আর্শির বয়স আট আর আনাম এর চার।

গল্পটি সম্পর্কে (রিভিউ) আলোচনা সমালোচনা করুন এই গ্রুপে।(যেকোনো গল্প খুজতে আমাদের গ্রুপটি ব্যবহার করতে পারেন)

গ্রুপ লিঙ্ক👇
https://www.facebook.com/groups/273212672043679/?ref=share_group_link

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here