#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_১২
#নিশাত_জাহান_নিশি
“বাবার কথা হঠাৎ মনে পরে গেল চাচা! মনে হলো তুমিই হয়ত বাবার প্রতিচ্ছবি। লাস্ট বার বাবাকে যখন জড়িয়ে ধরেছিলাম বাবা তখন আমার কাঁধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল। বিশ্বাস করো সেই নিঃশ্বাসের শব্দ আজও আমার কানে বাজে। আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আমি বাবার মৃত্যু ভুলতে পারিনা।”
মিশালের আবেগ মাখানো কথা ও ভেতরে বইতে থাকা কষ্টের পরিধি টের পাওয়া মাত্রই মৃত ভাইয়ের জন্য বুকটা ছ্যাত করে উঠল মিজানুর রহমানের। তাঁর দু-চোখেও নামল অবাধ্য জলের ছড়াছড়ি। তবে নিজের আবেগকে সংযত করে তিনি এই মুহূর্তে মিশালকে শান্তনা দেওয়াটাই অতিব জরুরি মনে করলেন। মিশালকে শক্ত বাঁধনে আঁকড়ে ধরলেন তিনি। ভেজা গলায় বললেন,
“মৃত্যু অনিবার্য মিশাল। আমরা কেউই এই পৃথিবীতে স্থায়ী নই। এমনকি এই চিরাচরিত সত্যের বাহিরেও আমরা কেউ নই। তবে আপনজন হারানোর কষ্ট ভোলবার নয়। প্রতিটি কাজেক্ষেত্রে তাদের মনে পরাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর আমি এ ও জানি, তুই খুবই স্ট্রং একটা ছেলে। নিজের মা এবং বোনের জন্য অন্তত নিজেকে শক্ত রাখবি তুই। শুধু তোর পরিবার নয়, আমরাও কিন্তু তোর উপর ভরসা করেই মুখিয়ে থাকি! আমাদের সবার ভরসার জায়গা একমাত্র তুই। আমাদের বংশের প্রদীপ তুই। তোর থেকে আমাদের অনেক আশা, প্রত্যাশা। তোকে কী ভেঙে পরলে চলবে বল?”
“আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি চাচা নিজেকে শক্ত রাখতে। কাছের মানুষদের ভরসার কেন্দ্র হয়ে থাকতে। কিন্তু যাদের জন্য এতকিছু সেই আপন মানুষরাই যদি আমার পেছনে ছু’রি বসিয়ে দেয়, তখন আমি চেয়েও নিজেকে শক্ত রাখতে পারিনা। আমারও কিছু ব্যক্তিগত কষ্ট আছে চাচা! শুধু প্রকাশ করবার জায়গা নেই। আপন মানুষদের মাঝে থেকেও প্রতিনিয়ত অসহায়ত্ব গ্রাস করে আমায়।”
তৎক্ষণাৎ মিশালকে ছেড়ে মিজানুর রহমান সোজা হয়ে দাড়ালেন। ভরাট দু’চোখে তিনি চোখের কোণে অতি সূক্ষ্মভাবে জল আটকে রাখা বিবস মিশালের দিকে তাকালেন। ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কী বললি তুই? তোর পেছনে কে ছু’রি বসাতে চায়?”
তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ পাল্টাতে উদ্দত হলো মিশাল। অস্থির দৃষ্টি ফেলে তার তৎপর চাচার পানে তাকালো৷ অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিল সে। যা এই মুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন তার। ভরসার জায়গা খুঁজে পেলে মানুষ হয়ত এভাবেই তার গোপন সত্যিগুলোও প্রকাশ করে দেয়! তাৎক্ষণিক ব্যস্ত সুরে মিশাল বলল,
“আমি এখন আসছি চাচা। মায়ের প্রেশারের ঔষধ আনতে হবে। একদিন ভুলক্রমে মিস হয়ে গেলেই মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন।”
তাড়াহুড়ো করে মিশাল বের হয়ে যেতে লাগল। সৎ মা সম্পর্কে কোনো কটু কথা সে নিজের আপন মানুষদেরও অবগত করতে চায়না! এতে তার মায়ের অপমান হবে, অসম্মান হবে। মিজানুর রহমানের সন্দেহ কিছুতেই কাটলনা। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিশালের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন। আবেগী হয়ে জেসমিন বেগম পিছু ডাকলেন মিশালকে! সঙ্গে সঙ্গেই থামলো মিশাল। দ্রুত পায়ে হেঁটে তিনি মিশালের দিকে এগিয়ে গেলেন। মিশালের হাত টেনে ধরে তিনি ডাইনিং টেবিলে এনে বসিয়ে দিলেন। তব্দিত হয়ে থাকা মিশালকে বললেন,
“চাচী আজ সন্দেশ বানিয়েছি মিশু। সন্দেশ তো তোমার খুব ফেভারিট তাইনা?”
“কিন্তু চাচী এখন তো সময় নেই।”
“আরে বসো তো। সন্দেশ খেতে তো আহামরি সময় লাগবেনা।”
মিশালকে বসিয়ে রেখে জেসমিন বেগম তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তখনি মিশালের নাম্বারে সাইফার নাম্বার থেকে ছোট্টো একটি মেসেজ এলো। মেসেজটিতে লিখা ছিল,
“থ্যাংকস মিশাল ভাই। আমি ভাবতেও পারিনি তুমি বিয়েটা এভাবে ভেঙে দিতে পারবে। আ’ম সো হ্যাপি ফর ইউ।”
“শুকনো থ্যাংকস এ কাজ হবেনা ওকে? ট্রিট চাই, ট্রিট!”
ঈষৎ হেসে ফোনটি প্যান্টের পকেটে রেখে দিলো মিশাল৷ মেসেজটি পেয়ে সাইফা মৃদু হাসল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো মিশালকে সত্যিই একটি ট্রিট দেওয়া প্রয়োজন তার। যদিও মিশালকে সবসময় ফ্রি পাওয়া যায়না। কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকবেই সে। তবুও একটু ফ্রি টাইম বের করে মিশালকে ট্রিট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত সে।
__________________________
বুকের উপর দু’হাত গুজে সাহিলের দিকে রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সামান্তা। উল্টোদিকে সামান্তার দিকে সাহিল তাকিয়ে রয়েছে অনিমেষ দৃষ্টিতে! সামান্তা তার হাত ছুঁয়েছে এতেই যেন কাবু সে। দিনদুনিয়া প্রায় ভুলতে বসেছে। মশার কামড়ের ক্ষতিকর কোনো প্রভাবও পরছেনা তার গাঁয়ে! অথচ তার শরীরের তাজা রক্ত খেয়ে হরদমে পেট পূজো হচ্ছে মশাদের রাজ্যে। পরিস্থিতি এমন সামান্তা যদি এখন তার গালে সপাটে দুটো চড়ও বসিয়ে দেয়, এতেও বিশেষ কিছু আসবে যাবেনা তার! তবে মেজাজ হারিয়ে ফেললে সামান্তা হয়ত চড় থাপ্পর লাগাতেও পিছপা হবেনা! সাহিলের উগ্রতা এবং হ্যাংলামির জন্য সামান্তা এখন তার প্রতি ভয়ভীতি হারিয়ে ফেলেছে। যেটুকু সম্মান তার প্রতি অবশিষ্ট ছিল তাও বিসর্জন দিয়েছে। মৌনতা ভাঙল সামান্তা। রগচটা গলায় সাহিলকে শুধালো,
“তুমি ঐসময় কী বললে? তুমি আমার দায়িত্ব নিতে চাও?”
“কেন? তোর কোনো সন্দেহ আছে?”
“কীসের ভিত্তিতে তুমি আমার দায়িত্ব নিতে চাও?”
“বুঝিস না তুই?”
“তুমি আমার ফুফাতো ভাই হও সাহিল ভাই। তোমার সাথে আমার কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এই বিষয়টা তুমি যত ইজিলি বুঝতে পারবে ততই তোমার জন্য ভালো হবে।”
চটে গেল সাহিল! মুহূর্তেই শান্ত দৃষ্টি তার অশান্ত হয়ে উঠল। রাগে রঙিন হয়ে উঠল তার মুখমণ্ডল। আক্রোশিত হয়ে সামান্তার হাতের বাহু চেপে ধরল সে! দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমার সাথে কিছু না হওয়ার কারণ কী? আমাকে সবসময় এড়িয়ে চলার কারণ কী? আমাকে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কারণ কী? কই, মিশালের সাথে তো এসব করতে দেখিনা তোকে!”
চোয়াল উঁচিয়ে সামান্তা চোখের ইশারায় তার বাহু চেপে ধরা জায়গাটি সাহিলকে দেখালো। উঁচু গলায় উগ্র মেজাজ নিয়ে বলল,
“কারণ মিশাল ভাই কখনও আমাকে এভাবে টর্চার করেনি। অকারণে আমার উপর রাগ দেখায়নি। একজন ভালো বন্ধুর মতো বুঝে আমায়! বিপদে আপদে পাশে ঢাল হয়ে দাড়ায়। ভুলটাও আমাকে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলে।অন্যায় করলে সংশোধন করে দেয়। সত্যি বলতে, তোমার মতো উগ্র ছেলেকে কেউই তার জীবনে চায়না সাহিল ভাই! আশা করি তুমি তোমার উত্তর পেয়ে গেছো?”
তৎক্ষনাৎ সামান্তার হাতটি ছেড়ে দিলো সাহিল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে তার পার্ক করে রাখা গাড়িটিতে জোর এক লাথ দিলো! পায়ে কিঞ্চিৎ ব্যথাও পেল। তবুও গ্রাহ্য করলনা সেই ব্যথাকে। আঙুল উঁচিয়ে সামান্তাকে শাসিয়ে বলল,
“মিশালের উপর তোর খুব ভক্তি তাইনা? ওকে। আমিও দেখব মিশালের উপর তোর এই ভক্তি কতদিন থাকে!”
বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল সাহিল। ভাবুক ও ভীতিকর দৃষ্টিতে সামান্তা সাহিলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। সাহিলের চোখে যে প্রতিহিংসা ও আক্রোশ দেখা গেল কারো কোনো ক্ষতি না করা অবধি যে সাহিল থামবেনা তা স্পষ্ট বুঝা গেল। তখনি মিশালের আগমন ঘটল ঘটনাস্থলে। সামান্তাকে চমকে দিয়ে মিশাল প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী রে? সাহিল ভাই কী চলে গেছে?”
থতমত খেয়ে গেল সামান্তা। মিশালের আচানক আগমনে ভয় পেয়ে গেল সে। বুকে থুথু ছিটিয়ে মিশালের মুখোমুখি দাড়ালো। মিশালের চোখে চোখ রাখল। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,
“তুমি একটু সাবধানে থেকো।”
“কেন?”
“এত প্রশ্ন করো কেন?”
“অদ্ভুত। সাবধানে থাকার কারণটা তো জানতে চাইব তাইনা?”
“সাহিল ভাই হুমকি দিয়ে গেল।”
“কী হুমকি?”
“বলল তোমাকে দেখে নিবে।”
“তুই কী বললি?”
“বলার সুযোগ দেয়নি। চলে গেল।”
“তুই কী ভেবেছিস? এই হুমকি সাহিল ভাইয়ার নতুন? সবসময়ই সাহিল ভাইয়া আমাকে এভাবে হুমকি দিয়ে থাকে। বাই দ্য ওয়ে, তুই কী এখন আমাদের বাড়িতে যাবি?”
“কেন সাহিল ভাইয়া তোমাকে হুমকি দিলো জানতে চাইবেনা?”
“নতুন করে জানতে চাওয়ার কিছু নেই। সবদিক থেকেই আমার জীবন হুমকির দিকে! আমি জানি, আমার জীবন এত সহজ নয়। আমার সমস্ত শখ, ইচ্ছে, অনুভূতি ও চাহিদার মতো আমার জীবনটা ও হয়ত খুব শীঘ্রই হারিয়ে যাবে!”
প্রস্থান নিলো মিশাল। মেইন রাস্তায় ওঠে ফার্মেসির দিকে হেঁটে গেল। মিশালের যাওয়ার পথ ধোঁয়াশা। সেই ধোঁয়াশায় তলিয়ে গেল সামান্তা। পায়ে হেঁটে মিশালকে অনুসরণ করতে গিয়েও থেমে গেল! তাকেও মিশালের মতো এভাবে ধোঁয়াশায় হারিয়ে গেলে চলবেনা! পেছন থেকে মিশালকে টেনে ধরে ধোঁয়াশা থেকে বের করে আনতে হবে। তবে মিশাল কী তার সাথে আসতে চাইবে? কঠিন এই প্রশ্ন মস্তিষ্কে বয়ে মিশালদের বাড়ির দিকে রওনা হলো সামান্তা। রুমে ঢুকে দেখল জেনিয়া ঘুমিয়ে। পাশ ফিরে শুয়ে পরল সামান্তা। ইশ, মিশাল যদি একটিবার তার স্বপ্নে আসত! সশরীরে না হোক, অন্তত স্বপ্নে তো মিশাল তার কাছে ধরা দিতে পারে। কল্পনার চেয়েও তো স্বপ্ন সুন্দর।
_________________________
চারিদিকে যখন ফজরের আযান পরল ঠিক তখনি মিশাল বাড়ি ফিরল। দেহের বিভিন্ন অংশ কেটে ছিঁড়ে বিধ্বস্ত অবস্থা তার! সাদা শার্টটিতেও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। অত্যন্ত চুপিসারে সে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। সাবধানে পা ফেলে তার রুমে ঢুকল। সতর্ক এক জোড়া চোখ তাকে বহুক্ষণ যাবত অনুসরণ করছিল! খোলা জানালার গ্রীল দ্বারা লক্ষ্য করল ডেস্কের উপর টাকার একটি বান্ডিল রেখে মিশাল আহত শরীর থেকে শার্টটি খুলল। শাওয়ার নেওয়ার উদ্দেশ্যে সে ওয়াশরুমের দিকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগিয়ে গেল। অমনি দরোজায় টোকা পরল! কড়া গলায় সামান্তা মিশালকে ডেকে বলল,
“এই মিশাল ভাইয়া? দরোজাটা খোলো বলছি।”
#চলবে….?
[পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খানিকটা ডিপ্রেশনে আছি। তাই গল্প দিতে দেরি হলো। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]