#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি
“এই মিশাল ভাইয়া? দরোজাটা খোলো বলছি।”
হকচকিয়ে উঠল মিশাল। শঙ্কিত দৃষ্টি ফেলল রুমের দরোজায়। অবিলম্বেই কপাল কুঁচকে এলো তার। মাথায় হাত দিয়ে বিরক্তিকর স্বরে বলল,
“ওহ্ শিট। স্যাম এখানে কী করছে? মেয়েটা সবসময় আমায় ফাঁসাবে। না বলে কয়ে যেখানে সেখানে চলে আসবে। কিন্তু যেখানে আসার প্রয়োজন সেখানে ভুলেও আসবেনা। বাঞ্চাল মেয়ে একটা।”
তাড়াহুড়ো করে শার্টটি পরিধান করলো মিশাল। সামান্তার গলার আওয়াজ ক্রমশ বৃদ্ধি পেল। হামছিতুমছিও ক্রমাগত বাড়ল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। বাড়ির সবাই হয়ত এক্ষণি জেগে যাবে। মহা লঙ্কাকাণ্ড ও বেঁধে যাবে এখন। আ’হ’ত শরীর নিয়ে মিশাল দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরোজাটি খুলে দিলো। আক্রোশভরা গলায় সামান্তা জোরে চ্যাচানোর পূর্বেই মিশাল বাধ্য হয়ে সামান্তার মুখ চেপে ধরল! টেনে এনে সামান্তাকে রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে মুখ থেকে হাতটি সরিয়ে নিলো। ভেতর থেকে রুমের ছিটকিনি আটকে তাজ্জব হয়ে দাড়িয়ে থাকার সামান্তার মুখোমুখি দাড়ালো। রাগে গিজগিজ করে বলল,
“তুই এখানে কী করছিস?”
“আগে বলো তোমার এই অবস্থা কেন?”
“তুই আমাকে ফলো করছিস?”
“আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও আগে মিশাল ভাই!”
“গলা একদম বড়ো করবিনা আমার সাথে!”
বুকের উপর হাত গুটিয়ে পূর্বের তুলনায় অধিক ভাবসাব নিয়ে দাড়ালো সামান্তা। নাক ঘঁষে চওড়া গলায় বলল,
“একশবার করব, হাজারবার করব। কী করবে তুমি?”
“জাস্ট শাট আপ সামান্তা। আর কখনও যেন না দেখি তুই আমাকে ফলো করছিস!”
“এভাবে হুমকি ধমকি দিয়ে আমাকে থামানো যাবেনা মিশাল ভাই। তুমি কিন্তু তা বেশ ভালো ভাবেই জানো।”
“হ্যা জানি। তোর তো বাঘিনীর কলিজা! তোর ভয়ে আমি সারাক্ষণ সিঁটিয়ে থাকি। থরথর করে কাঁপি। এটাইতো বুঝাতে চাচ্ছিস তুই?”
জায়গায় শক্তপোক্তভাবে দাড়িয়ে সামান্তা ভাবশূণ্য গলায় বলল,
“হ্যা তাই বুঝাতে চাইছি! আলতু ফালতু কথা না বলে কাজের কথা বলো! সারারাত কোথায় ছিলে তুমি? এই র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় কোথা থেকে এলে তুমি? আর ঐ টাকার বান্ডিলটা? কোথায় পেলে এত টাকা?”
“উত্তর দিলে চলে যাবি?”
“ভেবে দেখব!”
ধৈর্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেল মিশালের! সামান্তার সাথে না পেরে সে নিজের মাথার চুল নিজে টেনে ধরল! দাঁতে দাঁত চেপে সামান্তাকে শাসিয়ে বলল,
“তুই যদি আমার কাজিন না হয়ে অন্য কেউ হতিসনা? এতক্ষণে তোকে মেরে আমি ফ্ল্যাট করে ফেলতাম!”
অমনি ফিক করে হেসে দিলো সামান্তা! মিশালের রক্তশূল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলল,
“হাসালে মিশাল ভাই! তুমি কার সাথে কতটুকু কী করতে পারো বা না পারো তা আমাকে নতুন করে বুঝতে হবেনা। বাই দ্য ওয়ে, প্রসঙ্গ কিন্তু পাল্টে যাচ্ছে।”
চোয়াল উঁচিয়ে মিশাল খরতর গলায় বলল,
“বাইক রেইস ছিল! সেখান থেকেই টাকাগুলো পেয়েছি। এবার দফা হয়ে যা তুই আমার রুম থেকে।”
“হোয়াট? তুমি জুয়া খেলে টাকা নিয়ে এসেছ?”
“আমি তোর আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছিনা সামান্তা। প্লিজ লিভ মি এলোন।”
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কী আদো এসব কিছু করার দরকার ছিলো মিশালের? যদি তার এরচেয়েও বড়ো কোনে দুর্ঘটনা ঘটে যেতো? তখন কী হতো? কেন মিশাল নিজের জীবনকে এভাবে জুয়ায় লাগিয়ে দিয়েছে? এসব ভাবতেই গলা ভিজে এলো সামান্তার! রুক্ষ গলায় সে বলল,
“এসব করার কী দরকার একটু বলবে?”
মলিন হাসল মিশাল। ভেতরে পুষে রাখা ব্যথা থেকে বলল,
“বাবার রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে আয় তখন বুঝবি পৃথিবী কতটা নির্মম। বাঁচতে হলে এখানে কী কী করতে হয় তোর কোনো ধারণা নেই। মেয়ে হয়ে অবশ্য ছেলেদের অবস্থানটা তুই বুঝবিনা। তবুও বলছি, গোটা একটা পরিবারের দায়িত্ব যখন তোর ঘাড়ে পরবে তখন তুই চাইবি চু’রি, ডা’কা’তি করে হলেও নিজের দায়িত্ব সামলাতে! পরিবারের মানুষদের সুখি রাখতে। তাদের অভাব মেটাতে।”
“পুলিশের হয়ে যে কাজ করো সেখান থেকে কোনো স্যালারি পাওনা?”
“পাচ্ছিনা বলেই তো জীবনে প্রথমবার জুয়ায় যেতে হলো!”
“তাহলে ছেড়ে দিচ্ছনা কেন ঐ কাজ? যে কাজে কোনো বেনিফিটই নেই।”
“আমি তাদের ছাড়তে চাইলেও তারা আমাকে ছাড়বেনা! তুই এসব বুঝবিনা। যা নিজের রুমে যা।”
কিছুটা হলেও মিশালের দুঃখ, কষ্ট, মনের অবস্থাটা টের পাচ্ছে সামান্তা। এসব উপলব্ধি করতে গিয়েই বুকটা কেঁপে উঠল তার। ছুঁতে চাইল মিশালকে। হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল! মনে প্রশ্ন উঁকি দিলো। মিশাল কী তার ছোঁয়াকে আদো স্বাভাবিক ভাবে নিবে?তার ভালোবাসার স্পর্শকে যদি মিশাল অসম্মান করে? তবে যে বড্ড আঘাত পাবে সে৷ হৃদয় ভেঙে যাবে। ভাঙা হৃদয় যে আর জোড়া লাগবেনা তার! কবে ভাঙবে এই দ্বিধার দেয়াল? কবে মিশালকে সে ছুঁয়ে দিতে পারবে? মিশালের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সামান্তা। গলা ঝাঁকিয়ে মিহি স্বরে বলল,
“রুমকিকে ডেকে দিব? কাঁটা জায়গাগুলোতে ঔষধ লাগিয়ে দিতে?”
“উঁহু। রুমকি এখন ঘুমোচ্ছে। আমি লাগিয়ে নিতে পারব। তুই এখন যা।”
নিশ্চুপ হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল সামান্তা। বিষণ্ন মনে তার রুমে ফিরে এলো। চোখে জল নিয়ে উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পরল। কবে সে অধিকার নিয়ে মিশালকে একটুখানি ছুঁতে পারবে! যে ছোঁয়ায় তার মনের অসুখ সারবে! তখনি পাশ থেকে জেনিয়া আচমকা নড়েচড়ে উঠল! ঘুম জড়ানো আধো স্বরে বলল,
“মিশাল ভাইকে তুমি ফলো করো না-কি? ভালো টালো বাসো বোধ হয়?”
হকচকিয়ে উঠল সামান্তা। শোয়া থেকে ওঠে বসল। পাশ ফিরে সরু দৃষ্টিতে জেনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল জেনিয়া চোখ বুজে। মনে হলো গভীর ঘুমে! ঘুমন্ত মানুষ আবার কথা বলে না-কি? তা যাচাই করার জন্য সামান্তা দু-হাত দ্বারা জেনিয়াকে ধাক্কা দিলো। ঘুমের মধ্যেই নাকমুখ কুঁচকে নিলে জেনিয়া! জায়গা থেকে খানিক নড়েচড়ে ওঠে বিব্রতকর গলায় বলল,
“উফফ আপু। ডিস্টার্ব করো না তো! ঘুমোচ্ছি।”
চুপটি করে সামান্তা পুনরায় শুয়ে পরল। ঘুমের মধ্যে কথা বলার অভ্যেস আছে হয়তো জেনিয়ার! তাই হয়তো আবোলতাবোল বকাটাও স্বাভাবিক। সেদিকে কালক্ষেপণ না করে সামান্তা ঘুমানোর চেষ্টা করল।
_________________________
ওয়াশরুম থেকে ভেজা শরীর নিয়ে বের হয়ে এলো মিশাল। কাটাছেঁড়া জায়গাগুলোতে প্রচণ্ড রকম জ্বালা করছে তার। খুবই অসহ্য এই জ্বালা। সমস্ত শরীর বিষের জ্বালার চেয়েও বিষাক্ত হয়ে আছে তার। ভাগ্যিস তার বাবা বেঁচে থাকতে বাইক ট্রেনিং কোর্স করেছিল সে। ট্রিক জানা না থাকলে আজ বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে যেতো। জীবন নিয়ে ফিরে আসাটাও তার পক্ষে মুশকিল হয়ে যেতো। টাওয়াল দ্বারা শরীরটি মুছে সে আয়নার সামনে দাড়ালো। যতটুকু সম্ভব কাটা জায়গাগুলোতে মলম লাগানোর চেষ্টা করল। গভীর আঘাতে চোখমুখ কুঁচকে এলো তার। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমে এলো। জিম খিঁচে থাকার চেষ্টা করল। বুকের ক্ষত জায়গাটিতে মলম লাগাতে গিয়ে মিশাল হঠাৎ কান্না মুখেও হেয়ো হেসে উঠল! আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইউ আর সো সেলফিস সামান্তা। এতোটা ক্ষত দেখার পরেও তুই আমার ক্ষত সারাতে চাইলিনা! তুই সামনে থাকতেও রুমিককে কেন ডাকতে হবে? পারমিশন নিয়ে সবকিছু হয়না সামান্তা। কিছু কিছু জায়গায় অধিকার খাটাতে হয়! প্রয়োজনে জোর করতে হয়। তুই যেদিন কোনো পারমিশন ছাড়া আমাকে ছুঁবি, সেদিনই আমি ভেবে নিবো আমি তোর জন্য যা ফিল করি তুইও আমার জন্য ঠিক তাই-ই ফিল করিস! সেদিন আমাদের মধ্যে আর কোনো দ্বিধার দেয়াল থাকবেনা!”
বেলকনিতে প্রায় পনেরো থেকে বিশ মিনিট পায়চারী করার পর মিশাল বিছানায় শুতে গেল। মেডিসিনগুলোও তখন ক্ষত স্থানগুলোতে পুরোপুরিভাবে মিশে গেল। ক্লান্ত ও বিষাক্ত শরীর নিয়ে মিশাল প্রায় একঘণ্টাও শান্তিমতো ঘুমোতে পারলনা! দরোজায় টোকা পরল। চিৎকার করে রুমকি মিশালকে ডাকতে লাগল! রুমকির কান্নার আওয়াজ মিশালের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই মিশাল ঘুম ভেঙে উঠল। টালমাটাল শরীর নিয়ে ছুটে গিয়ে রুমের দরোজা খুলে দিলো। ভীত মিশালকে দেখে রুমকি কান্নার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলো। শুকনো ঢোঁক গিলে ভরাট গলায় বলল,
“মা যেন কেমন করছে ভাইয়া! মা হয়ত আর বাঁচবেনা।”
“হোয়াট? কী হয়েছে মায়ের?”
“তুমি দেখে এসো প্লিজ।”
তখনি মিশালের মনে পরল কাল রাতে তো তার মা প্রেশারের ঔষধ খায়নি! ফার্মেসীতে সে গিয়েছিল ঠিকই, তবে বারোটার পর ফার্মেসী সব বন্ধ ছিল। মাথায় হাত দিয়ে মিশাল চিন্তিত স্বরে বলল,
“প্রেশার বেড়ে গেছে হয়ত।”
রুমকিকে উপেক্ষা করে মিশাল রুম থেকে প্রস্থান নিলো। দ্রুত গলায় রুমকিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই বেশী করে তেঁতুল গুলে নিয়ে আয় রুমকি। আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি।”
রুমকি ছুটে গেল রান্নাঘরে। মিশাল দৌড়ে তার মায়ের ঘরে গেল। গিয়ে দেখল শাহনাজ বেগম অনর্গল বমি করতে করতে ফ্লোর, বিছানা, নিজের শরীর সব ভাসিয়ে ফেলছেন! বসা থেকে দাড়াতে গিয়েও বার বার মাথা ঘুরিয়ে পরে যাচ্ছেন। পেরেশান হয়ে মিশাল তার মাকে ধরতে গেলেই তিনি ধাক্কা মেরে মিশালকে সরিয়ে দিলেন! অসুস্থ ও দুর্বল গলায় বললেন,
“একদম না। তুই আমার কাছে আসবিনা! যে ছেলের মায়ের প্রতি কোনো দায়িত্ব কর্তব্য নেই সেই ছেলেকে আমি ছেলে হিসেবে মানিনা! আজ থেকে তুই আমার শত্রু।”
#চলবে….?
[শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আমি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।]