#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_২৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
জেনিয়া সবে পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। সাহিলের দৃষ্টি কোনোভাবে ঐদিকেই আটকে গেল!
বাড়ির সদর দরোজায় প্রবেশ করার আগ অবধি দূরদৃষ্টিতে যতোটুকু জেনিয়াকে ঠাওর করা গেল ততোটুকুতেই সাহিলের নিষ্পলক দৃষ্টি জারি ছিল! ক্লান্ত, বিষণ্ন, বিমূর্ষ জেনিয়া। মুখশ্রীতে তার নিগূঢ় মন খারাপের ছাপ। পরীক্ষা ভালো হলেও মনে তার শান্তি নেই। কিছু না বলা কষ্ট তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ধীর পায়ে হেঁটে জেনিয়া বাড়ির সদর দরোজায় প্রবেশ করতেই সাহিল ছাদ থেকে উঁকি মেরে জেনিয়াকে পুনরায় দেখার চেষ্টা করল! তবে ব্যর্থ হলো। ঐ অবধি তার দৃষ্টি পৌঁছোচ্ছিলনা। ঝুঁকে যাওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাড়ালো সাহিল। ঘোর থেকে বের হলো। রুদ্ধশ্বাস ফেলে পিছু ঘুরে দাঁড়াতেই আচমকা সে সামান্তা ও মিশালের মুখোমুখি হয়ে গেল! ঝগড়া থামিয়ে মিশাল ও সামান্তা সেই প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিল সাহিলের ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা অন্যদিকে খুব ভালোভাবেই আটকে আছে। তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যই মূলত সামান্তা ও মিশাল সাহিলের পেছনে এসে দাড়িয়েছিল। অতঃপর তারা যা দেখল তার দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা! অপ্রত্যাশিত ও অবিশ্বাস্য ছিল। দুজনের সূক্ষ্ম ও সন্দেহজনক চাহনি দেখে সাহিল থতমত খেয়ে গেল। শার্টের কলারটি ঈষৎ টেনে সে বিব্রতকর গলায় শুধালো,
“কী ব্যাপার? তোরা আমার দিকে এভাবে উঁঁকি ঝুঁকি মেরে তাকিয়ে আছিস কেন?”
গম্ভীর হেসে সামান্তা ফট করে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“কার দিকে তাকাতে তাকাতে তুমি ছাদ থেকে পরে যাচ্ছিলে শুনি? জানেরও তো মায়া থাকা দরকার না-কি?”
ক্রুর হাসল মিশাল। পাশ থেকে ঠাট্টার ছলে বলে ওঠল,
“ফুল দেখছিল, ফুল। জিনিয়া ফুল! ফুলের সুবাসে জানের মায়াকে ত্যাগ করছিল। হয় হয়, এমন হয়। ফুলের সুবাস নিতে মৌমাছি এতোটাই ব্যাকুল হয়!”
অতিশয় বিপাকে পরে সাহিল বোকা বনে গেল। এই অস্থবির পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজতে লাগল। সত্যিই তো সে এখন যা করল আচানক করল! জেনিয়াকে এভাবে ঘুরে ঘুরে দেখার কারণটা কী ছিল? এমন তো নয় যে জিনিয়াকে জীবনে প্রথমবার দেখেছে সে। প্রায় একাধিকবার জেনিয়ার সাথে দেখা হয়েছে তার। তবে আজকের দেখাটা অন্যরকম ছিল। আগের বারের তুলনায় একটু ভিন্ন। মনে আঘাত ছিল বলেই কী যে কাউকেই অতিরঞ্জিত মনে হলো? না পাওয়ার শোক ভোলার বিকল্প কোনো পন্থা উদয় হলো? তার অবাঞ্চনীয় ভাবনাচিন্তাকে এখানেই দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল সাহিল। আমতা আমতা করে যথেষ্ট খরতর গলায় বলার চেষ্টা করল,
“স্টপ ইট। জাস্ট স্টপ ইট। আমার ইন্টেশনকে অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করবিনা তোরা। হুট করেই তার দিকে নজর পরেছিল দেট’স ইট। এই নিয়ে এতো জল ঘোলা করার কোনো প্রয়োজন নেই।”
মিশাল ও সামান্তাকে পাশ কাটিয়ে সাহিল রাগে গজগজ করে ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পেছন থেকে মিশাল কদাচিৎ হাসল। সাহিলকে রাগানোর উদ্দেশ্যে আরও একবার দুষ্টু স্বরে পেছন থেকে সাহিলকে ডেকে বলল,
“বি কেয়ারফুল সাহিল ভাই। ফুলের সুবাস কিন্তু বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। স্মেল নিতে গিয়ে না আবার যেথায় সেথায় হোঁচট খেয়ে পরে যাও বি কেয়ারফুল।”
রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সাহিল পিছু ঘুরে তাকালো। ডান হাতের সবকটি আঙুল গুটিয়ে সে কেবল মধ্যমা আঙুলটি উঁচিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মিশালকে বাজে ইঙ্গিত করল! মুখ থেকে তার অস্ফুটে গালিও বের হলো! হু হা করে হেসে দিলো মিশাল। সাহিলের মুখটা সত্যিই দেখার মতো ছিল। অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গিয়ে সামান্তা পিছু ঘুরে নিলো। এজন্যই ছেলেদের মাঝখানে থাকতে নেই। এদের মধ্যে সভ্যতার লেশ মাত্র নেই। যখন মুখ দিয়ে যা আসে তাই বলে ফেলে। প্রস্থান নিলো সাহিল। মিশালও তার হাসি থামালো। হুট করে সামান্তা ক্ষেপণি ভাব নিয়ে মিশালের শার্টের কলার চেপে ধরল! ঘটনার আকস্মিকতায় মিশাল ভড়কে ওঠল। মিশালের হকচকানো দৃষ্টিতে সামান্তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“সেই কখন থেকে আপনি কাকে ফুল ফুল করছেন? আপনিও কি জেনিয়াকে ফুলের চোখে দেখেন?”
“আরে ধ্যাত। ওটা তো সাহিল ভাইকে জেনিয়ার প্রতি ইমপ্রেস করানোর জন্য বলেছিলাম। আমি কাউকেই কখনও ফুলের চোখে দেখিনি!”
“কাউকেই নয়?”
“না তো! মানুষ কী কখনও ফুল হতে পারে?”
“ফুলের সাথে কাউকে তুলনা করাটা জাস্ট একটা উপমা। সিরিয়াসলি আপনার কোনো নারীকেই ফুল মনে হয়না?”
“না। নারীকে উপমা দেওয়ার জন্য অবশ্যই তাকে ভালোবাসার প্রয়োজন হয়। সেই ভালোবাসা আমার কখনও কারো প্রতি আসেনি!”
“সত্যিই আসেনি?”
“আমি মিথ্যা বলিনা!”
“ওকে। আজকের পর থেকে আপনি আমার সাথে কোনোরূপ কথা বলার চেষ্টাও করবেন না! করবেন না মানে করবেন না। মরে গেলেও করবেন না।”
দুঃখিত, ব্যথিত ও রাশভারী মন নিয়ে সামান্তা মিশালের শার্টের কলারটি ছেড়ে অগ্রে পা বাড়ালো। শার্টের কলারটি ঝেড়ে মিশাল ভাবশূণ্য গলায় পেছন থেকে সামান্তাকে ডাকল। গম্ভীর স্বরে বলল,
“ও হ্যালো। তুমি থেকে আপনিতে আসা নারী! আপনাকেই বলছি, আপনার ‘আপনি’ ডাকটি আমার হৃদয়কে আঘাত করেছে! বিশাল বড়ো এক ঝটকা দিয়েছে। প্রথমবার শুনলাম, এর জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিলাম না! আর একটি কথা, যে ফুলে কাঁটা থাকে সেই ফুলকে আমি উপমা হিসেবে ব্যবহার করিনা। আমি যদিও কাউকে ভালোবাসি তাঁর উপমা হবে কেবল চাঁদের সঙ্গে, সমুদ্রের সঙ্গে কিংবা রূপকথার কোনো রাজকুমারির সঙ্গে।”
সামান্তাকে পাশ কাটিয়ে মিশাল ছাদ থেকে প্রস্থান নিলো। সামান্তাকে একটুখানি বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল। এতো সহজেই সামান্তাকে তার ভালোবাসার অনুভূতির সাথে পরিচয় করানো যাবেনা। কপাল চাপড়ালো সামান্তা। মিশালের যাওয়ার পথে নাজুক দৃষ্টিকে তাকালো। তেজ ঝাল মিশ্রিত গলায় বলল,
“আরে এ তো দেখি সত্যি সত্যিই রাগ হয়ে গেল। আমিতো তার সাথে রাগ করেই তাকে আপনি করে ডেকেছিলাম। তাছাড়া আপনি ডাকে খারাপ কী আছে?এই সামান্য ব্যাপারটিকে এতো সিরিয়াসলি নেওয়ার কী হলো? আজিব তো!”
_______________________________
জামা-কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে জেনিয়া রুম থেকে বের হয়ে এলো। বসার ঘরে সাইফা ও সায়মা থেকে শুরু করে রুমকি ও সামান্তাও উপস্থিত ছিলো। সবাই মিলেমিশে দুপুরের খাবারের জন্য ডাইনিং টেবিল সাজাচ্ছিল। এদিকে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছিল জেনিয়ার। শরীরটাও প্রচন্ড ম্যাচ ম্যাচ করছিল তার। ঘুমের অনিয়মের কারণে মূলত তার শরীর ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করল সে।
বসার ঘরের দিকে অগ্রসর হতেই জেনিয়ার হঠাৎ মাথা ঘুরে এলো। ইতোমধ্যে সাহিলও রুমে নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলনা বলে রুম থেকে বের হয়ে এলো। মিশালই বলল তাকে রুম থেকে বের হলে ভালো নেটওয়ার্ক পাবে। তমাল খান অনেকক্ষণ যাবত কল করছে তাকে! নেটওয়ার্কের দুর্বস্থার কারণে কলটি বার বার কেটে যাচ্ছে। রুম থেকে দু-কদম বাইরে রাখতেই সাহিলের আকস্মিক দৃষ্টি পরল তার থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে দাড়িয়ে থাকা জেনিয়ার দিকে। চোখ বুজে দেয়াল ধরে দাড়িয়ে রয়েছে জেনিয়া। এখনি বুঝি গাঁয়ের ভর ছেড়ে এদিক ওদিক লুটিয়ে পরবে। দৃষ্টির সম্মুখে জেনিয়ার মুমূর্ষু অবস্থা দেখেও সাহিল নিবিড় হয়ে দাড়িয়ে রইল। আসলে সে বুঝে ওঠতে পারছিলনা জেনিয়াকে ধরা তার উচিৎ হবে কি-না!
কোনো কারণে মিশাল তখন রুম থেকে বের হচ্ছিল। গাঁয়ে শার্টটি জড়িয়ে সে সাহিলকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বের হতেই লক্ষ্য করল জেনিয়া মাথা ঘুরে পরে যাচ্ছে প্রায়। সাহিল নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে। এই শুভ মুহূর্তের ফায়দা তোলার চেষ্টা করল মিশাল! আচমকা সাহিলকে ধাক্কা মেরে মিশাল দ্রুত গলায় চ্যাচিয়ে বলল,
“আরে সাহিল ভাই জেনিয়া পরে যাচ্ছে তো। তাকে প্লিজ হেল্প করো।”
মিশালের আচমকা ধাক্কার প্রভাবে সাহিল ছিটকে গিয়ে জেনিয়ার মুখোমুখি গিয়ে থামল। সাত পাঁচ না ভেবে সে জেনিয়াকে তার বাহু দ্বারা আলতো করে চেপে ধরতে বাধ্য হলো! কারণ জেনিয়া প্রায় পরেই যাচ্ছিল। দাড়ানো অবস্থা থেকে পরে যাওয়া তো মোটেও ভালো লক্ষ্মণ নয়। একটুখানি মানবতা তো রক্ষা করতেই হবে। তবে মিশালকে সে পরে দেখে নিবে! তার ধারণামতে মিশাল তাকে জোরপূর্বক জেনিয়ার দিকে ঠেলে দিতে চাইছে! আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে জেনিয়া মাথা উঁচিয়ে কম্পিত ও অস্থির ভাবাপন্ন সাহিলের পানে তাকালো। অমনি সে ভড়কে ওঠল। লাস্ট কবে সে সাহিলকে দেখেছিল মনে নেই। তবে আচানক এই অবস্থায় সাহিলকে দেখে অসুস্থ অবস্থাতেও সে অপ্রস্তুত হয়ে পরল। হা করে কিছু বলার পূর্বেই সাহিল ইতস্তত গলায় বলল,
“সরি। একচুয়েলি তুমি পরে যাচ্ছিলে তাই।”
“না আমি ঠিক আছি।”
এই বলে নিজেকে সাহিলের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো জেনিয়া! জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে সে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে গেল! নীরব হয়ে রইল কিছুক্ষণ। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। অপমানিত বোধ করল সাহিল। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে তাদের থেকে দূরত্বে দাড়িয়ে থাকা মিশালের দিকে তাকালো। অবুঝ ভাব নিয়ে মিশাল মাথা চুলকে সাহিলের দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে এক গালে হাসছিলও বটে! মিশালের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জেনিয়ার দিকে মনোযোগ দিলো সাহিল। আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নরম গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“তুমি কী সত্যিই ঠিক আছো জেনিয়া?”
“হুম আমি ঠিক আছি।”
“দেখে তো মনে হচ্ছেনা তুমি ঠিক আছো। আই থিংক তোমার রেস্টের প্রয়োজন। কাইন্ডলি তুমি ওঠার চেষ্টা করো। রুমে যাও, রেস্ট নাও।”
জেনিয়ার মাথা ভনভন করে ঘুরছিল। আপাতত কিছু শোনার বা বলার পরিস্থিতিতে নেই সে। সাহিলকেও এই মুহূর্তে বিরক্ত লাগছে। খাবার খাওয়ার জন্য জেনিয়াকে ডাকতে আসার উদ্দেশ্যে সামান্তা ঘটনাস্থলে এলো। জেনিয়াকে নিচে বসে থাকা অবস্থায় দেখে সামান্তা ঈষৎ আঁতকে ওঠল। উদ্বিগ্ন হয়ে সে জেনিয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পূর্বেই মিশাল বাঁধ সাধল। পেছন থেকে ছোটো আওয়াজে সামান্তাকে ডেকে বলল,
“এই থাম। সাহিল ভাই আছে ওখানে। তাকে ব্যাপারটা দেখতে দে। দেখি জল কতদূর আগায়।”
বিরক্ত হয়ে সাহিল পুনরায় জেনিয়াকে ডেকে বলল,
“ওঠে দাঁড়াও জেনিয়া। এভাবে তুমি আরও উইক হয়ে পরছ।”
সামান্তা মুখ খুলল। শক্ত গলায় সাহিলকে লক্ষ্য করে বলল,
“আরে আজব তো। জেনিয়া যদি ওঠেই দাড়াতে পারত তবে নিশ্চয়ই শরীরের এই খারাপ কন্ডিশন নিয়ে এখানে বসে থাকতনা। তুমি তাকে হেল্প করো।”
এবার আর জেনিয়ার কোনো বারণ শোনলনা সাহিল! একপ্রকার জোর করেই সে জেনিয়াকে পাঁজা কোলে তুলে নিতে বাধ্য হলো! হকচকানো ও নেতিয়ে পরা জেনিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল,
“আ’ম সো সরি। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা!”
#চলবে….?