#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_৩০
#নিশাত_জাহান_নিশি
[নোটঃ গত কয়েক পর্ব যাবত আমি মিশালের মায়ের নাম ও সামান্তার মায়ের নামকে গুলিয়ে ফেলছিলাম! মিশালের মায়ের নাম হচ্ছে শাহনাজ বেগম ও সামান্তার মায়ের নাম জেসমিন বেগম। কিন্তু আমি এতদিন ধরে উল্টো লিখছিলাম। আজকের পর্বে তাঁদের নামটা ঠিক করে দিলাম। অথচ আমার পাঠকরা এই ভুলটা ধরতে পারলনা। আমার মতো তারাও হয়তো চরিত্রের নাম ভুলে যায়! যাই হোক এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য আমি দুঃখীত।]
“জেমসের একটা গানের কথা খুব মনে পরে গেল। ঐযে ঐ লাইনটা আছেনা? তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম কী দোষ দিবি তাতে। বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই সকাল-দুপুর-রাতে। আগুন জ্বেলেও পুড়লাম আমি দিলাম তাতে ঝাপ। তোর আমার প্রেমে ছিলো রে বন্ধু, ছিলো রে পুরোটাই পাপ!”
মিশালের ভগ্ন হৃদয় এবং নেত্রপল্লবে মূর্তমান গভীর ও গাঢ় বিষাদের ছাপ দেখে মুহূর্তেই অন্তর্আত্তা কেঁপে ওঠল সামান্তার। মিশালকে এই বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখার মতো সাহস ও ক্ষমতা কোনোটিই উপস্থিত নেই তার মধ্যে। পৃথিবীতে ধ্বস নেমে আসার মতো ভয়াল পরিস্থিতি অনুভব হয় তার। অজান্তেই ফুঁপিয়ে ওঠল সামান্তা। মিশালের হাতটি দ্বিগুন শক্তপোক্তভাবে চেপে ধরল। নিগড় বেদনা নিয়ে ভাসা ভাসা গলায় বলল,
“না মিশাল ভাইয়া না। ভালোবাসার মতো পবিত্র জিনিসে তুমি পাপ ছিটিও না। আমি জানিনা তুমি কীসের ভিত্তিতে এসব হৃদয় ভাঙার কথা বলছ। কেন আমাদের প্রেমকে পাপ বলছ, আমি কী কোনোভাবে তোমার হৃদয় ভেঙেছি বলো?”
ঝট করে সামান্তার হাত থেকে হাতটি ছাড়িয়ে নিলো মিশাল। আক্রোশিত দৃষ্টিতে তাকালো ভঙ্গুর সামান্তার পনে। বুকে পাথর চেপে রেখে আঙুল উঁচিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
“যেদিন আমি প্রতিষ্ঠিত হতে পারব সেদিনই আমাদের দেখা হবে, কথা হবে! এর আগে আমার ছায়াটিও তুই দেখতে পাবিনা।”
প্রস্থান নিলো মিশাল। সামান্তা একই জায়গায় থম মেরে দাড়িয়ে রইল। চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেল। অনুভূতিশূণ্য প্রায়। নিথর দেহ, নিষ্ক্রিয় চাহনি। মিশালকেও আটকানোর কোনোরকম তাড়াহুড়ো নেই তার। তবে এতোটুকু ঠিকই বুঝতে পারল শাহনাজ বেগমের সাথে হওয়া রান্নাঘরের সমস্ত কথোপকথন মিশাল কোনোভাবে শুনে নিয়েছে! অহেতুক ভুল বুঝেছে তাকে। অভিমান হলো সামান্তার। বড্ড অভিমান হলো। এই বুঝি মিশাল তাকে চিনল? এতোগুলো বছর এতো কাছাকাছি, এতো পাশাপাশি একসাথে থেকেও মিশাল তাকে চিনতে এতোটা ভুল করল? একটু খানিতেই তাকে ভুল বুঝে চলে গেল? দেখা হবেনা, কথা হবেনা এই জটিল শর্তগুলোও তাকে দিয়ে গেল? এতো রাগ, এতো তেজ তার? নিজের জেদের প্রতি এতোটাই আত্মবিশ্বাস তার? তবে তাই হোক! কখনও তাদের দেখা না হোক, কথা না হোক!
হনহনিয়ে হেঁটে সামান্তা মিশালদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। একছুটে তার নিজের বাড়ি চলে এলো। বাড়ির সদর দরোজা খুলে দিলো সাইফা। জেসমিন বেগম ও সায়মা ড্রইংরুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিল। সাইফা দরোজা খুলে সামান্তাকে দেখে বেশ খুশি হয়ে গেল। উচ্ছ্বাস ভরা গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“আপু তুমি?”
সাইফার দিকে তাকানোর কিংবা সাইফার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করলনা সামান্তা। মাথা নুইয়ে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে তার রুমের দিকে রওনা হলো। সামান্তার কার্যকলাপে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল। সামান্তার পিছু নিলেন জেসমিন বেগম। উঁচু গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কী রে? কী হয়েছে? এই রাতে হঠাৎ বাড়ি ফিরলি যে?”
“কিছু হয়নি মা। বিরক্ত করোনা তো আমায়। একটু একা থাকতে দাও প্লিজ।”
সামান্তা তার রুমে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরোজার খিল আটকে দিলো। বহু কষ্টে এতো সময় যাবত সে তার কান্না আটকে রেখেছিল। এইবার যেনো আর সম্ভব হলোনা তার পক্ষে। বিছানার ওপর উবুড় হয়ে শুয়ে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। অশ্রুসজল গলায় বলল,
“আর কখনও, কোনোদিনও আমি তোমাদের বাসায় যাবনা মিশাল। সত্যিই আমাদের মধ্যে আর কখনও দেখা হবেনা, কথাও হবেনা।”
_______________________________
এই রাতেই মিশাল বন্ধুদের সাথে সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। কাউকে কিছু না বলে, না জানিয়ে, অঘোষিতভাবে। গোটা চারদিন ফোন বন্ধ রাখল সে! বাড়ি থেকে কেউ তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলনা। এমনকি সাহিলও অনেকবার যোগাযোগ করতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। পরিবার পরিজনদের বাইরে প্রকৃতির সাথে একান্তে সময় কাটালো মিশাল। এতে তার মনও বেশ ভালো হলো, বন্ধুদের সাথেও ভালো সময় কাটল। টানা দুইবছর পর বন্ধুদের সাথে ট্যুরে বের হয়েছে সে। প্রতিবার তাল বাহানা করে পরিবারের কথা ভেবে, টাকা-পয়সার কথা চিন্তা করে ট্রিপ ক্যান্সেল করেছে সে। কিন্তু এবার তা করেনি। নিজের ইচ্ছে ও ভালো থাকাকে প্রাধান্য দিয়েছে।
এই কয়দিনে সামান্তাও কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। সারাক্ষণ ঘুম আর নীরবে নিভৃতে সময় কাটাতে লাগল। হাসিখুশি ও চঞ্চল সামান্তার এহেন অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে বাড়ির সবাই চিন্তিত। তবে তারা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছিল মিশালের সাথে তার ঠোকাঠুকি হয়েছে! কিন্তু কী নিয়ে ঠোকাঠুকি হয়েছে এই বিষয়ে তারা এখনও অবধি কিছু জানতে পারলনা। মিশালকে নিয়েও তারা চিন্তিত। না বলে কয়ে ছেলেটা কোথায় চলে গেল? তবে এর আগেও মিশাল এমন না বলে নিরুদ্দেশ হয়েছে। ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে ঘুরতে গেছে। তাই তার হঠাৎ লাপাতা হওয়াকে কেউ তেমন গুরুত্বের সাথে নিলো না। সকালে নাশতার টেবিলে বসে নাশতা খেতে খেতে সাইফা তার কৌতূহল থেকে সামান্তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আচ্ছা আপু? তুমি জানো মিশাল ভাইয়া কোথায় গেছে?”
পরোটা খেতে গিয়েও থেমে গেল সামান্তা। হাত থেকে পরোটাটি ছুড়ে ফেলল প্লেটে। রাগী দৃষ্টিতে তাকালো হতবাক সাইফার দিকে। চুল থেকে সামান্তার টুপটাপ জল গিয়ে পরছে। সদ্য শাওয়ার নিয়েছে সে তাই। তেজী গলায় সামান্তা প্রত্যত্তুরে সাইফাকে বলল,
“আমি কী করে জানব কে কোথায় গেছে? আমি তার কী এমন হই যে কোথাও যাওয়ার আগে সে আমাকে বলে যাবে? খবরদার তার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবিনা আমাকে। আমি বিরক্ত হই।”
বেকুব বনে বসে রইল সাইফা। তার পাশে বসে থাকা সায়মা এবার পরোটা না খাওয়ার জেদ ভুলে ভয়ে টপাটপ পরোটাটি গিলতে লাগল ও আঁড়চোখে সামান্তার দিকে তাকাতে লাগল। ইতোমধ্যেই মিজানুর রহমান ও জেসমিন বেগম খাবার টেবিলে এসে বসলেন। সামান্তার রাগী হাবভাব দেখে মিজানুর রহমান গলা ঝাঁকালেন। সামান্তার রাগকে তিনিও বেশ ভয় পান! তবুও সাহসী গলায় তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কোথাও যাবি নাকি তুই? সকাল সকাল শাওয়ার নিলি যে?”
চায়ে চুমুক দিলো সামান্তা। ভাবশূণ্য গলায় বলল,
“হ্যাঁ। চাকরীর ইন্টারভিউ আছে ওখানে যাচ্ছি।”
“কী চাকরী? আর কোথায় এই চাকরী?”
“উইনস্টার কোম্পানির অ্যাকাউন্টেন্স পদে।”
“কোথায় এটা?”
“সিটি কর্পোরেশন।”
“এতো দূরে?”
“দূরে থাকাই ভালো! অন্তত কাছের মানুষের অবহেলা পেতে হবেনা।”
“আজব। কে তোকে অবহেলা করল?
“কেউ না। চাকরিটা হয়ে গেলে আমি বাঁচি।”
“কবে থেকে এই চাকরীর প্রিপারেশন চলছে?”
“দুইদিন আগে থেকেই। আজ সিভি জমা দেওয়ার পর ইন্টারভিউ।”
“সাহিলকে নিয়ে যাস সাথে।”
“কেন? আমি একা চলাফেরা পারিনা? সাথে একজনকে নিতে হবে কেন? সবসময় আমাকে বন্দি করে রাখার চেষ্টা করবেনা। যথেষ্ট বড়ো হয়েছি আমি। নিজের ভালো নিজে বুঝি। চাকরিটা হয়ে গেলে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকব! এতেই সবাই ভালো থাকবে।”
বেশ তেজ ঝাল দেখিয়ে সামান্তা খাবার টেবিল ছেড়ে ওঠে গেল। কার রাগ সামান্তা কার ওপর দিয়ে ঝাড়ল কেউ তা বুঝতে পারলনা। উপস্থিত সবাই সামান্তার আচরণে আশাহত হলো। সামান্তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে জেসমিন বেগম বেশ শান্ত গলায় বললেন,
“আচ্ছা তোর সব কথা না হয় আমরা মানলাম। তবে তোর বাবা তো ভুল কিছু বলেনি মা। সাথে একজন থাকলে তোর সুবিধা হবে, সাহস বাড়বে, আত্নবিশ্বাসও বাড়বে। সাহিলকে নিয়ে যা সাথে। আমাদের এই কথাটা অন্তত রাখ।”
সামান্তা তার মায়ের কোনো কথাই কানে তুললনা। রাগে ফোঁস ফোঁস করে সে সাদা রঙের একটি সালোয়ার কামিজ পরে হালকা সাজে ফাইলে যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল! রাস্তায় বের হয়ে একটি রিকশা করে তার কাঙ্ক্ষিত অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।
মিশালের ফ্রেন্ডদের থেকে খবরাখবর নিয়ে শাহনাজ বেগম জানতে পারলেন মিশাল সাজেক ঘুরতে গেছে। আজ সন্ধ্যার দিকেই নাকি বাড়ি ফিরবে। কিছুটা চিন্তামুক্ত হলেন তিনি। তবে মিশালের প্রতি ক্ষোভ তাঁর কিছুতেই কমলনা। টাকা পয়সা নষ্ট করে সে ঘুরতে গেছে এতেই যেনো রাগে তাঁর গাঁয়ে আগুন জ্বলছে। ইনকাম করেনা দশ টাকা অথচ খরচ করে বিশ টাকা! এবার শুধু মিশালের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা। মিশালকে অপদস্ত করতে তিনি একরত্তি পরিমাণ ছাড়বেন না। সেইসময় হঠাৎ সাহিলের আগমন ঘটল মিশালদের বাড়িতে। তার সাথে একজন মাঝবয়সী ছেলেও ছিল। দু’হাতে তার বাজারের ব্যাগ! সাহিলকে আচমকা দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন শাহনাজ বেগম। সদর দরোজাটি খুলে তিনি জোরপূর্বক হাসলেন। আগত সাহিলের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“আরে সাহিল? কেমন আছো?”
“ভালো আছি মামী। আপনাদের জন্য একটু বাজার নিয়ে এলাম!”
পুরো বাড়িতে একবার সূক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সাহিল। আচানক তার দৃষ্টি গিয়ে থামল সোফায় বসে ফোন টিপতে থাকা জেনিয়ার দিকে! ফোন চাপতে ব্যস্ত জেনিয়া। মিশালের ইনবক্সে লাগাতার মেসেজ করে চলছে সে। বাড়ির কাউকে কেনো কিছু না জানিয়ে মিশাল এতোদিন যাবত নিরুদ্দেশ ছিল তার কৈফিয়ত চাইছে। অথচ মিশাল টানা চারদিন যাবত অফলাইন! তবুও মনের আবেগ থেকে মিশালকে ক্রমাগত মেসেজ করা তার অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। মিশালের ধ্যানে ব্যস্ত থাকায় সাহিলের উপস্থিতি জেনিয়া টের পেলোনা। তবে জেনিয়াকে এক নজর দেখামাত্রই সাহিল কেমন উচ্ছ্বল হয়ে ওঠল! অজান্তেই ঠোঁটের কোণে তার মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠল। এই মুহূর্তে তার সাথে যা যা ঘটতে লাগল সব তার জন্য অকল্পনীয় ছিল। ব্যাগ ভর্তি বাজার সদাই দেখে শাহনাজ বেগমের হাসিখুশি উপচে পরতে লাগল। লোভের বশবর্তী হয়ে তিনি ছেলেটিকে বললেন বাজারের ব্যাগগুলো রান্নাঘরে রেখে আসতে। নমনীয় গলায় তিনি সাহিলকে বললেন ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে। জেনিয়ার থেকে নিবিড় দৃষ্টি সরালো সাহিল। মাথা চুলকে নরম গলায় শাহনাজ বেগমকে বলল,
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না মামী। মিশাল আজ সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসবে।”
“তা তো জানি বাবা। তবে মিশালের অবর্তমানে তুমি আমাদের জন্য এতো ভেবেচিন্তে বাজার সদাই নিয়ে এলে সত্যিই এমন উদারতা আশা করিনি তোমার কাছ থেকে।”
“তেমন কিছুনা মামী। দায়িত্ববোধ থেকেই নিয়ে এলাম। মিশাল যেহেতু আমার ভাই। তাই তার প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব রয়েছে।”
“আচ্ছা বুঝলাম বাবা। প্লিজ ঘরে এসে কথা বলো।”
কলেজ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে জেনিয়া তখন সদর দরোজায় এলো। সাহিলকে আচমকা দেখে সে থতমতিয়ে গেল! ঈষৎ লজ্জাও বোধ করল। সেদিন তাকে কোলে নেওয়ার দৃশ্যটি তার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সাহিল নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লাজুক জেনিয়ার পানে! পাশ ফিরে শাহনাজ বেগম জেনিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কী রে? বের হয়ে যাচ্ছিস নাকি?”
“হ্যাঁ খালামনি। এক্সামের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।”
“আচ্ছা সাবধানে যাস।”
সাহিলকে উপেক্ষা করে জেনিয়া মাথা নুইয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ইতোমধ্যেই সাহিল আচমকা জেনিয়াকে পেছন থেকে ডাকল। কিছু না ভেবেচিন্তেই হঠাৎ বলে ওঠল,
“আমি তোমাকে ড্রপ করে দিই?”
“না আমি পারব!”
হুড়োহুড়ি করে জেনিয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সাহিল বেশ অপমানিত বোধ করল! নিজের প্রতি তার নিজেরই বড্ড রাগ হতে লাগল। আগ বাড়িয়ে অপমানিত হতে যাওয়ার প্রয়োজন কী ছিল তার? সাহিলের চোখের দিকে তাকিয়ে শাহনাজ বেগম কিছু একটা আঁচ করতে পারলেন! এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। জেনিয়াকে পেছন থেকে ডাকলেন তিনি। কড়া গলায় বললেন,
“এই জেনিয়া দাড়া। সাহিল তোকে ড্রপ করে দিবে। মুখের ওপর আর একটা কথাও বাড়াবিনা। যা বললাম তাই শোন।”
থেমে গেল জেনিয়া। শাহনাজ বেগমের প্রতি তার প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল। বিরক্ত হয়ে সে তার হাত-পা কচলাতে লাগল। কিন্তু খালামনির আদেশও সে অগ্রাহ্য করতে পারলনা। তবে সাহিল এবার তার আসল রূপ দেখালো! ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে জেনিয়ার পাশে দাড়ালো। শার্টের কলারটি ঝেরে বেশ গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“সরি। দ্বিতীয়বার আমি কাউকে সুযোগ দিইনা!”
প্রস্থান নিলো সাহিল৷ তার সাথে আসা ছেলেটিকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে গেল। কোমরে হাত গুজে জেনিয়া তেজস্ক্রিয় দৃষ্টিতে সাহিলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল! গাড়ি ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে সাহিল একবার জেনিয়ার দিকে তাকালো। চোখ টিপে দিলো তাকে! রাগে গাঁ পিত্তি জ্বলে ওঠল জেনিয়ার। জেঁচে নিয়ে তাকে এভাবে অপমান করার কোনো মানে হলো? শাহনাজ বেগম তব্দা লেগে গেলেন। সাহিলের এহেন অশোভনীয় ব্যবহারের সাথে যদিও তিনি পূর্ব পরিচিত তবে এইবার অন্তত তিনি ভেবেছিলেন সাহিল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। জেনিয়া উল্টো শাহনাজ বেগমের ওপর চটে গেল! পিছু ফিরে জেনিয়া তীক্ষ্ণ গলায় শাহনাজ বেগমকে বলল,
“হলো তো এবার শান্তি? আমাকে ইনসাল্ট করে শান্তি পেয়েছ তো এবার? পরীক্ষা দেওয়ার মুডটাই নষ্ট করে দিলো আজ!”
হনহনিয়ে হেঁটে জেনিয়া রাস্তায় ওঠে এলো। রিকশা ভাড়া করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। হয়রান হয়ে গেলেন শাহনাজ বেগম। কপাল চাপড়ে বললেন,
“কুকুরের লেজ কখনও সোজা হয়না এটাই তার প্রমাণ!”
______________________________
গুমোট রাত। চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। হায়েনারা যেনো ওঁৎ পেতে রয়েছে সুযোগ পেলে কখন রক্তে মাংসে গড়া মানুষদের চিঁড়ে খাবে! নিজেদের ক্ষুধা মিটাবে। আশপাশটা ঘন জঙ্গলে ঘেরা। যতো দূর অবধি চোখ যাচ্ছে ততোদূরই যেনো নিকষ কালো অন্ধকাররা অন্ধকারকে গিলে খাচ্ছে! তবে ঠাণ্ডা বাতাস প্রচুর। গাঁ কে হিম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সারি বাঁধা গাছপালার মধ্যখান দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে চলছে মিশাল ও সামান্তা! চারিদিকের পরিবেশের ন্যায় নিশ্চুপ দুজন। এলোমেলো চুল সামান্তার। গলায় ও ঘাড়ে নখের আঁচড়! ওড়না দ্বারা ঢেকে রেখেছে তার ফুঁটোফাটা কামিজের হাতা। পাশ ফিরে নিশ্চল দৃষ্টিতে সামান্তার দিকে তাকালো মিশাল। নীরবতা ভাঙল সে। মোলায়েম গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী দরকার ছিল অচেনা, অজানা একটা জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে আসার? তাও আবার একা একা। বড়োদের কথাও তোয়াক্কা করিসনা। নিজেকে খুব বড়ো মনে করিস তাইনা?”
মৌন সামান্তা। মিশালের দিকে তাকানোর প্রয়োজনটুকুও বোধ করলনা সে। মিশাল তার শর্ত ভাঙছে! কথা বলবেনা বলেও বেহায়ার মতো কথা বলছে, দেখা করবেনা বলেও উদ্ভ্রান্তের ন্যায় তাকে খুঁজতে ছুটে এসেছে! কিন্তু সামান্তা তার কথা রাখবে! কথা তো দূর, ফিরেও তাকাবেনা মিশালের দিকে। সামান্তার এহেন গম্ভীরতা সহ্য হলোনা মিশালের। রেগে গেল সে। তেড়ে এসে সামান্তার মুখোমুখি দাড়ালো। চোয়াল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“কথা বলছিস না কেন? এতো দূরে ইন্টারভিউ দিতে আসার প্রয়োজনটা কী ছিল? আমি আর সাহিল ভাই ওখানে সঠিক সময়ে না পৌঁছালে কী অবস্থা হতো তোর ভাবতে পারছিস? এমনিতেই কতো বিপদ লেগে আছে আমার ওপর।”
তবুও নীরব রইল সামান্তা। মিশাল এবার বাধ্য হলো সামান্তার থুতনি চেপে ধরতে। সামান্তার মুখকে জোর করে তার দিকে ফেরাতে। তখনই মেইন রাস্তায় গাড়ির শব্দ শোনা গেল। কেউ লাগাতার গাড়ির হর্ণ বাজাতে লাগল। সামান্তার থুতনী ছেড়ে দিয়ে মিশাল পুনরায় সামান্তার হাত চেপে ধরল। দ্রুত পায়ে হেঁটে দুজন মেইন রাস্তায় ওঠে এলো। হম্বিতম্বি হয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলো সাহিল। উত্তেজিত হয়ে দুজনের মুখোমুখি দাড়ালো। অধীর গলায় বলল,
“স্ক্রাউন্ডেলটাকে হসপিটালে ভর্তি করে এসেছি। ঘাঁ বেশ গভীরেই লেগেছে তার! সামান্তা এতো গভীরে জখম করতে পারবে তা আমার ধারণার বাহিরে ছিল!”
#চলবে…?