#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_____৩৫
#নিশাত_জাহান_নিশি
“বি কুল। এতো রাগ দেখানোর মতো আহামরি কিছু হয়নি এখানে। শান্ত হয়ে বলো কী হয়েছে?”
স্থির হলো মিশাল। দৃষ্টি শিথিল হয়ে এলো। মুখের রং বদলাতে লাগল। সামান্তার স্নিগ্ধ মুখের পানে তাকিয়ে সে ধীরে ধীরে কাবু হতে লাগল। সামান্তা এখনও তার গাল ছুঁয়ে আছে। অস্বস্তি হতে লাগল মিশালের! বুকের ভেতরের অস্থিরতা দ্বিগুন বাড়তে লাগল। এই অস্থিরতা সুখের, শান্তির। তবে সুখ বা শান্তি তো দীর্ঘ স্থায়ী হয়না! স্বল্প স্থায়ী এই সুখই যেনো মিশালের ক্ষেত্রে ক্রমশ অসুখের কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। ঝট করে সামান্তার হাতটি মিশাল তার গাল থেকে সরিয়ে দিলো! শান্ত গলায় বলল,
“এতো কাছে আসিস কেন বার বার? বুঝিসনা আমি সম্মোহিত হয়ে যাই? নিজেকে সুখী মানুষ মনে হয়।”
“সুখী মানুষ হতে দোষ কোথায়? তুমি সুখী হতে না চাইলেও আমি তো সুখী হতে চাই। তোমার কোনো রাইট নেই আমার সুখ কেড়ে নেওয়ার। তাছাড়া আমিতো জানি আমি কাছে না আসলে তুমি শান্ত হবেনা! তোমাকে শান্ত করার ঔষধ যে আমি।”
মুখ ঘুরিয়ে নিলো মিশাল। সামান্তার নিমগ্ন দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার সাহস হলোনা তার। সামান্তা যে তাকে নিঁখুতভাবে চিনে এই বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। তবে কোনোকিছুর প্রতি অতিরিক্ত দুর্বলতা কাজ করাটাও যে ব্যক্তিবিশেষে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায় এই বিষয়েও মিশাল অবগত! প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল মিশাল। গম্ভীর গলায় বলল,
“রুমকি একটা ছেলের সাথে প্রেম করছে। আমার মনে হয়না ছেলেটি তার যোগ্য। কোনোদিক থেকেই ছেলেটিকে আমার পার্ফেক্ট মনে হয়নি।”
গভীর চিন্তায় ডুব দিলো সামান্তা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা রুমকি প্রেম করতে পারে। আই থিংক তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আচ্ছা তুমি ছেলেটি সম্পর্কে ডিটেইলস কিছু জানো?”
“না। তবে ছেলেটিকে জানার আগে আমাকে প্রথমে রাফিনের মুখোমুখি হতে হবে।”
“রাফিন কে?”
“মায়ের আগের সংসারের ছেলে।”
“মানে কী? ঐ ছেলের সাথে রুমকির যোগাযোগ আছে?”
“হুম।”
“তাহলে কী ঐ ছেলে কোনোভাবে রুমকির ব্রেন ওয়াশ করছে?”
প্রত্যত্তুরে মিশাল কিছু বলার পূর্বেই অপ্রত্যাশিত ভাবে সাহিলের আগমন ঘটল তাদের দুজনের মাঝখানে! মিশাল ও সামান্তাকে একসাথে দেখে সাহিল মৃদু হাসল। দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে এলো তাদের দুজনের দিকে। কৌতূহলী গলায় উভয়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আমাকে ছেড়ে তোরা দুজন কী এমন জরুরি মিটিং করছিস হুঁ?”
শুকনো গলায় মিশাল বলল,
“ঐ আর কি। বসো, নাশতা করো।”
মিশালের মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসল সাহিল। মিশাল তার প্লেট থেকে একটি নারকেল পিঠে সাহিলের প্লেটে তুলে দিলো। আলতো হেসে সামান্তা বলল,
“মা বানিয়েছে খাও।”
তবে সাহিলের মনোযোগ নেই এদিকে। সারা বাড়ি ময় সে তার সূক্ষ্ণ ও সর্তক দৃষ্টি দ্বারা অন্য কাউকে খুঁজছে! বিশেষ কারো উপস্থিতি উপলব্ধি করতে চাইছে। মন তার বেসামাল হয়ে ওঠছে। মিশাল ও সামান্তা উভয়ই সাহিলের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। তার নয়ন ও মন কাকে খুঁজছে বুঝতে বেশি বাকি নেই তাদের! মিচকে হেসে সামান্তা গলা ঝাকালো। উদাস সাহিলকে লক্ষ্য করে বলল,
“কাউকে খুঁজছ মনে হচ্ছে? ডেকে দিব তাকে?”
ইতোমধ্যেই মিশাল মৃদু আওয়াজে জেনিয়াকে ডাকল! জেনিয়া তার খালামনির রুম থেকে এক ছুটে বের হয়ে এলো। দুরুদুরু বুকে সে সোজা ড্রইংরুমে এলো। ভাবল মিশালের কিছু প্রয়োজন নাকি। কিন্তু হলো তার উল্টো। সাহিলের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেল! মুহূর্তেই সাহিলের অস্থির দৃষ্টি যুগল স্থির হয়ে এলো! ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা ফুটে ওঠল। জেনিয়া রাগে গজগজ করতে লাগল। সেদিনের অপমান তার চোখে ভাসতে লাগল। মেরে সাহিলের নাক ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো! ঝট করে সাহিলের থেকে জেনিয়া দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মিশালকে উদ্দেশ্য করে রাশভারি গলায় বলল,
“কেন ডেকেছ বলো?”
“সাহিল ভাইয়া এসেছে। তোমার হাতের স্পেশাল লেবু শরবত নিয়ে এসো!”
“পারবনা আমি! বড়জোর চা গরম করে আনতে পারি তাও আবার সৌজন্যতার খাতিরে।”
জেনিয়ার বিরূপ ব্যবহারের কারণ মিশাল ও সামান্তা বুঝতে পারলনা। তারা অসন্তুষ্ট হলো জেনিয়ার আচরণে। মিশাল তো রীতিমতো চোখ রাঙাচ্ছিল জেনিয়াকে! তবে সাহিল ঠিক বুঝতে পারল জেনিয়ার বিরূপ আচরণের কারণ। সেই বুঝে ক্রুর হাসল সাহিল। রাগে নিশপিশ করতে থাকা জেনিয়ার দিকে তাকিয়ে আগুন আরও উস্কে দিয়ে বলল,
“এর হাতে চা কী এক গ্লাস পানিও আমি খাবনা! সৌজন্যতা মাই ফুট!”
জেনিয়াকে আরও তেলে বেগুনে রাগিয়ে দিলো সাহিল। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল জেনিয়া। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ডানপিটে সাহিলের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনার মতো ছেলে মাই ফুট!”
হনহনিয়ে হেঁটে জেনিয়া জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! অবুঝ মিশাল ও সামান্তা এবার হয়রান হয়ে গেল। হয়েছেটা কী তাদের মধ্যে? তবে সাহিল তাদের বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখালো। হু হা করে হেসে বলল,
“যাই হয়ে যাক এই মেয়েকে আমার চাই।”
কৌতূহল থেকে সামান্তা এবার সাহিলের দিকে প্রশ্নই ছুড়ে দিলো,
“তোমাদের মধ্যে হচ্ছেটা কী আমাদেরও একটু বলবে?”
হেসে হেসে সাহিল সেদিনকার সব ঘটনা বলতে লাগল মিশাল ও সামান্তাকে। জেনিয়া রুম থেকে বের হয়ে যেতেই শাহনাজ বেগম একটু সুযোগ পেলেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি রাফিনের নাম্বারে কল করলেন। প্রায় কয়েক দফা কল বেজে যাওয়ার পর অবশেষে ঘুম ভেঙে ওঠে রাফিন বেশ বিরক্তি নিয়ে কলটি তুলল। খরখরে গলায় বলল,
“কী সমস্যা তোমার? বার বার কল করছ কেন?”
“রুমকির ঘটনা কী? কার সাথে প্রেম করছে রুমকি?”
“কেন? তোমার সৎ ছেলে বলেনি?”
“শুধু এতটুকুই বলেছে যে তুই রুমকিকে উস্কিয়েছিস। ঘটনা কী সত্যি?”
“হ্যা সত্যি। তবে আমি কোনো ফালতু ছেলের হাতে রুমকিকে তুলে দিতে চাইছিনা। তুমি জানো? ঐ ছেলের বাবা কতো বড়ো পয়সাওয়ালা? টপ বিজনেসম্যান তার বাবা। রুমকির সাথে ঐ ছেলের বিয়ে হলে রুমকির কপাল লেগে যাবে। সাথে আমাদেরও! যদি তুমি আমাদের ফিউচার নিয়ে ভালো কিছু ভাবতে চাও তবে ঐ ছেলে সাথেই রুমকিকে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো!”
লোভে চকচক করে ওঠলেন শাহনাজ বেগম! উচ্ছাসী গলায় তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন,
“তুই শিওর তো ছেলের বাবা অনেক টাকা পয়সা ওয়ালা?”
“আমি শিওর না হয়ে কোনো কথা বলিনা।”
“কিন্তু ছেলে যদি ভালো না হয়? মানে চরিত্রে টরিত্রে যদি কোনো দোষ ত্রুটি থাকে? আমার মেয়ের ভবিষ্যত যদি নষ্ট হয়?”
“এমন কিছুই হবেনা। তুমি মিশালকে ম্যানেজ করো। রুমকি এবং জারিফের মধ্যে সে যেনো এসে না ঢুকে। বাকিটা আমি বুঝে নিব।”
“তুই ছেলেটির সাথে আমাকে একবার দেখা করিয়ে দিতে পারবি?”
“কেন পারবনা? কবে দেখা করতে চাও বলো?”
“কালই।”
“ওকে। আমি ম্যানেজ করে রাখব।”
“এখন রাখি তবে। পরে কথা হবে।”
শাহনাজ বেগম কলটি কেটে দিলেন। তিনি চিন্তায় পরে গেলেন কোনদিকটা বেছে নিলে তাঁদের সবার জন্য ভালো হবে। তবে মিশালের মতের বিরুদ্ধে গেলে যে তাঁদের এই বাড়ি ছাড়া হতে হবে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই! মিশালও যে রুমকির খারাপ চাইবে বিষয়টা এমনও নয়। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই তো মিশালের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে তার! এত গুলো টাকা কোথায় পাবেন তিনি? কোনো একটা উপায় তো বের করতেই হবে।
কিয়ৎক্ষণ বিরতি নিয়ে রুমকি পুনরায় চ্যাঁচাতে লাগল। মিশাল ধুম করে বসা থেকে ওঠে গেল। সাহিল বিচলিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। রুমকির গলার আওয়াজ কোথা থেকে আসছে তার সন্ধান করতে লাগল। উদগ্রীবতা নিয়ে মিশালের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“রুমকির গলার আওয়াজ মনে হচ্ছেনা? কোথায় সে?”
সাহিলের প্রশ্নের কোনোরূপ জবাব দিলো না মিশাল। মেজাজ হারাতে লাগল সে। বোন বলে রুমকি বেঁচে গেল। রুমকির জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে মিশাল তার অবস্থা খারাপ করে ফেলত! মিশালের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে সামান্তা ঘাবড়ে ওঠল। মিশালকে শান্তনা দিয়ে বলল,
“আমি রুমকির সাথে কথা বলছি। তুমি প্লিজ শান্ত হও।এই বয়সে মেয়েরা একটু আধটু এমন করবেই। সময় থাকতে তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে নিলেই হয়।”
সামান্তা এগিয়ে গেল রুমকির রুমের উদ্দেশ্যে। মিশাল তাকে থামালো না। দেখুক না বুঝিয়ে শুনিয়ে কি করা যায়। যা মাঝেমাঝে মারধর করেও হয়না তা দুয়েক কথার বুঝানোতেই হয়ে যায়। সাহিল হতভম্ব হয়ে রইল। ঘটনা আদোতে এখানে কী ঘটছে বুঝে ওঠতে পারছেনা সে। মিশাল অবশেষে সাহিলের খানিকটা কৌতূহল মিটালো। তৎপর গলায় শুধালো,
“তুমি কি এখন বের হবে?”
“কেন? কোথাও যাবি নাকি?”
“হ্যা। একটু বের হতাম। তুমি বের হলে বলো। একসাথে বের হই।”
“বের হবো বাট ব্যাপার হলো যাবিটা কোথায়?”
“গেলেই বুঝতে পারবে। চলো।”
সাহিলকে নিয়ে মিশাল হন্ন হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। উদ্দেশ্য রাফিনের ফ্ল্যাট! ভাই হয়ে রাফিন কীভাবে এই ঘৃণিত কাজ করতে পারে তার হিসেব নিবে প্রথমে। এরপর রুমকির প্রেমিককে দেখে নেওয়া যাবে।
রুমকির রুমের দরজা খুলে দেওয়া মাত্রই রুমকি কান্না ভুলে দরজার সামনে সোজা দাড়িয়ে পরল। নিশ্চুপ সামান্তাকে দেখে সে চোখের জল মুছল। বেশ আশা ভরসা নিয়ে বলল,
“ভাইয়াকে বলো আপু আমাকে অযথা আটকে না রাখতে। আমার ফোনটা ফিরিয়ে দিতে বলো প্লিজ।”
রুমের ভেতর প্রবেশ করল সামান্তা। ভেতর থেকে রুমের ছিটকিনি আটকে দিলো। দ্রুত বেগে রুমকিকে নিয়ে বিছানার ওপর বসল। সংকীর্ণ গলায় রুমকির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“পাগল হয়ে গেছিস তুই? মিশাল ভাইয়ার সিদ্ধান্তের ওপর তুই কথা বলছিস?”
“হ্যা বলছি! কারণ, আমি জারিফকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি আপু।”
“মিশাল ভাইয়ার ভালোবাসার তুলনায় কী ঐ জারিফ তোকে এই কয়েকদিনে এতো বেশী ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছে যে তুই মিশাল ভাইয়ার ভালোবাসাকে তুচ্ছজ্ঞান করছিস? যে ভাই কিনা তোর জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত সেই ভাইয়ের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিস? বুকটা কী একটুও কাঁপছেনা রে তোর?”
#চলবে…?