বুকে_যে_শ্রাবণ_তার #পর্ব_______৩২ #নিশাত_জাহান_নিশি

0
165

#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_______৩২
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এই কী হয়েছে তোর? এই রাতের বেলায় তুই এতো সেজেগুজে আছিস কেন?”

থতমত খেয়ে গেল রুমকি। মিশালের সন্দিহান দৃষ্টিতে আড়ষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো তার। জবাবে মিশালকে কী বলবে তা ভেবেই যেনো তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছিল। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য অন্তত কিছু তো একটা বলতে হবে তাকে। কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলল রুমকি। স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করল,

“এমনি মন চাইল একটু সাজতে। এছাড়া আর কোনো কারণ নেই ভাইয়া। যাই হোক, সামান্তা আপুকে খুঁজে পেয়েছ?”

রুমকি যে বেশ তাড়াহুড়োর সহিত প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছে তা বুঝতে বাকী রইলনা মিশালের। রুমকিকে এই শঙ্কিত, অপ্রস্তুত ও হকচকানো অবস্থায় প্রথম দেখছে মিশাল। তাই তার সন্দেহ প্রগাঢ় হচ্ছে। রুমকির প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে মিশাল ক্ষীণ গলায় পাল্টা রুমকির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কাল তোর কলেজ আছে?”
“হুম। কেন?”
“না এমনি। অনেক রাত হয়েছে যা ঘুমিয়ে পড়।”
“আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিলেনা?”
“পেয়েছি। কাল একবার দেখা করে আসিস।”
“যাক বাবা নিশ্চিন্ত হলাম। জানো কতো টেনশন হচ্ছিল?”
“কতোটা টেনশন হচ্ছিল তা তো তোর সাজগোজ দেখেই বুঝা যাচ্ছে! চকচক করছিস একদম!”

রুমকিকে ঠান্ডা মাথায় খোঁচা দিয়ে মিশাল তরতরিয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। এতে করে রুমকির শঙ্কা দ্বিগুন বেড়ে গেল। মিশাল যে তাকে সন্দেহ করছে বুঝতে বেশী সময় ব্যয় করতে হলোনা তার। নিজের মাথায় নিজেই গাড্ডা মারল রুমকি! নিজেকে দোষারোপ করে বিড়বিড় করে বলল,

“ভাইয়া আমাকে সন্দেহ করছে আমি জানি। কিন্তু জারিফকে আমি কোনোভাবেই বুঝাতে পারছিনা যে আমাদের মেলামেশাটা এখন কমিয়ে দেওয়া উচিত! নেক্সট টাইম পান থেকে চুন খসলেই হয়ত ভাইয়ার কাছে আমরা ধরা পরে যাব! আর এখানেই আমাদের লাভ স্টোরির দ্যা ইন্ড হবে।”

মিশাল তার রুমে প্রবেশ করল। গাঁ থেকে শার্টটি খুলে পাখার নিচে বসল। রাগে টগবগ করছে সে। মুখের আদল হিংস্রতার সাথে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছে। রুমকি তার অতি আদরের বলে আজ রুমকির সাথে রূঢ় আচরণ তার দু’বার ভাবতে হয়েছে! চাইলে হয়ত আজই রুমকিকে হুমকি ধমকি দিয়ে গোপন সত্যিটা বের করা যেতো। তবে কাল থেকে রুমকিকে ফলো করার মনোস্থির করল মিশাল! ছেলেটিকে খুঁজে বের করতে হবে তাকে। রুমকি যে শুধু বয়সে ছোটো তা কিন্তু নয়, আক্কেল জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনায়ও সে শূণ্য। আর তা নিয়েই মিশালের এতো ভয় ও চিন্তা।

হেলেদুলে মিশাল ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। উন্মুক্ত সাদা শরীরে ফোঁটা ফোঁটা জলের ছড়াছড়ি। মাথায় পানি ঢেলে সে ভেজা চুলগুলো সেট করতে ব্যস্ত। তখনই মিশালের মনে হলো সামান্তাকে একবার কল করা উচিত! বড্ড মিস করছে যে তাকে। এই কয়েকদিনে সামান্তা এই বাড়িতে থেকে তার অভ্যেস খারাপ করে ফেলেছে! দাপিয়ে রাখা কিছু চাহিদাকে উস্কে দিয়েছে। হৃদয়ের কোণে লুকোনো কিছু সুপ্ত অনুভূতিকে প্রকাশ করতে বাধ্য করেছে। অঘোষিতভাবে দুজনের মধ্যে একটি অদেখা সম্পর্ক তৈরী করে ফেলেছে। বাড়ি ফিরেই যেনো সামান্তাকে দেখাটা তার অনিবার্য কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তাইতো আজ সামান্তার অনুপস্থিতিতে মিশালের ভেতরটা কেমন যেনো হাহাকার করছে, শূণ্য শূণ্য লাগছে, সবকিছু নিরাগ লাগছে। প্যান্টের পকেট থেকে মিশাল তার সেলফোনটি বের করল। আগ পাছ না ভেবেই সামান্তার নাম্বারে কল করল। অবশেষে চতুর্থ বারের কলটি সামান্তা তুলল। গোসল সেরে সামান্তা মাত্র বাথরুম থেকে বের হয়েছিল। ইতোমধ্যেই মিশালের কল। সামান্তা অনেক চেয়েও মিশালের কলটিকে উপেক্ষা করতে পারেনি! নিজের অজান্তেই কলটি তোলা হয়েছিল তার। বিক্ষোভের ঝড় তার আবেগকে আটকাতে পারেনি। কলটি তুলেই সামান্তা ফোঁস করে ওঠল। রাগান্বিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী ব্যাপার? কল করলে কেন?”
“হট হয়ে আছিস মনে হচ্ছে!”
“বাজে না বকে কল করেছ কেন বলো?”
“মানে তুই কী সারাক্ষণই এভাবে হট হয়ে থাকিস? দিন-রাত নেই তোর?”
“অসভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি! কল করেছ কেন বলো?”
“তোকে কুল করতে কল করেছি!”
“তুমি কি একটু ঠিকভাবে কথা বলবে আমার সাথে?”
“ওকে। একটু বেলকনিতে আয়।”
“কী কারণ? যেতে পারবনা এখন।”
“আমি ছাদে দাড়িয়ে আছি।”
“সো হোয়াট? আমি যেতে পারবনা।”
“ওকে!”

ফট করে কলটি কেটে দিলো মিশাল! বাড়ির ছাদে ওঠে সে রাজকীয়ভাবে সিগারেট ধরালো। ছাদ থেকে বেশ স্বচ্ছভাবেই সামান্তার রুমের বেলকনি দেখা যায়। সামান্তা এখনও বেলকনিতে আসেনি। তবে মিশালের বিশ্বাস সে আসবে। কলটি কেটে দিয়ে সামান্তাকে ক্ষেপানোটাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল! এটেনশন না পেলে যে কেউই যে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং প্রাণপনে অপর পাশের মানুষটির এটেনশন নেওয়ার চেষ্টা করে তা মিশালের বেশ ভালোভাবেই জানা। সামান্তার ক্ষেত্রেও এখন ঠিক তাই হবে। মিশালের টোটকা কাজে দিলো! মুখের ওপর কলটি কেটে দেওয়ায় রাগ যেনো তরতরিয়ে বেড়ে গেল সামান্তার। রাগে রি রি করে ওঠে সে মিশালের নাম্বারে কল করল! ব্যগ্র হেসে মিশাল কলটি তুলল। তবে মৌন রইল। একের পর এক সিগারেটে ফুঁক দিতে লাগল। কর্কশ গলায় সামান্তা বলল,

“তুমিই কল দিলা আবার তুমিই না বলে কল কেটে দিলা এটা কোন ধরনের সভ্যতা?”
“অযথা কাউকে জোর করা আমি পছন্দ করিনা!”
“বললে তো একবারই এখানে জোর করা হলো কোথায়? একচুয়েলি তোমার ইগুগত সমস্যা বুঝছ? ইগুর কারণেই তুমি কলটা কাটলে। জোর করার কোনো বিষয় ছিলনা এতে।”
“আশ্চর্য! তুই-ই তো বললি এখন দেখা করতে পারবিনা। সমস্যা ছিল বলেই তো মুখের ওপর না করে দিলি। আমি কী করে এখানে আর প্রসঙ্গ বাড়াই? পরে তো বলবি আমি ছ্যাচড়া!”
“আমি একবার ‘না’ বললে তুমি একশ বার বলে বলে আমাকে ‘হ্যাঁ’ করাবা! কারণ আমি তোমার ওপর রেগে আছি। বিপুল রেগে আছি। তাই তুমি বার বার আমাকে কল করে, জোর করে, বিরক্ত করে আমার রাগ ভাঙাবা, প্রয়োজনে ছ্যাচড়ামি করবা! এসবও তোমাকে বলে কয়ে করাতে হবে ইস্টুপিট কোথাকার।”

রাগে গুঙ্গিয়ে ওঠে সামান্তা কলটি কেটে দিলো। মিশালকে প্রত্যত্তুরে কিছু বলার সুযোগটাই দিলোনা সে। মিশালও তো সামান্তার ওপর কম রেগে নেই। কিন্তু মিশালের বেলায় তো সামান্তা তার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেনি, বরং পাল্টা রাগ দেখাচ্ছে। ছেলে বলে কী তার ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা হবে? তাদের রাগ-অভিমানের কোনো গুরুত্ব নেই?”

ইতোমধ্যেই সামান্তা বেলকনিতে এলো! মিশাল তখনও সূক্ষ্ম ও দূরদৃষ্টিতে সামান্তার বেলকনিতে তাকিয়ে রইল। তার চাহনির কোনো নড়চড় নেই। ছাদে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় মিশালকে কোনোভাবেই দেখতে পারছেনা সামান্তা। বারংবার ব্যর্থ হচ্ছে। অধীর দৃষ্টিতে ছাদের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সামান্তা। কপালে ভাজ পরছে তার। ধীর ও শিথিল দৃষ্টিতে মিশাল তার উদগ্রীবতা দেখছে। মুহূর্ত খানিক আগেই যে মেয়েটি কি-না তার ওপর রাগ করে কল টল কেটে দিলো বকাঝকা করল ক্ষণিকের মধ্যেই সেই মেয়েটিই কি-না তাকে দেখার জন্য ছটফট করতে লাগল? মেয়েদের মন বুঝা কোনো অংশেই সহজ নয়। তাই হয়তো কবিরা বলেন মেয়েদের মন বুঝা বড়ো কঠিন!

ছাদ থেকে নেমে গেল মিশাল। রুমের দিকে অগ্রসর হতেই জেনিয়ার সম্মুখস্থ হলো। হাতে শরবতের গ্লাস জেনিয়ার। মিশালের রুম থেকে ঘুরে এসেছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। মিশালের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালো জেনিয়া। প্রশ্ন ছুড়ল,

“কোথায় ছিলে? তোমার রুম থেকে মাত্র ঘুরে এলাম।”
“কেন? কী দরকার?”
“শরবত নিয়ে এসেছিলাম।”
“আমি কী শরবত চেয়েছি?”
“না চাওনি। তবে মনে হলো বাইরে থেকে এসেছ ঠান্ডা জাতীয় কিছু খেলে ভালো লাগবে।”
“আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবেনা তোমার। বাই দ্য ওয়ে, মা কোথায়?”
“খালামনি তো রুমেই আছে। তবে শরবতটা এতো কষ্ট করে বানিয়ে নিয়ে এলাম তুমি খেলে ভালো লাগতো।”
“এক কাজ করো। শরবতটা তুমি বরং ফ্রিজে রেখে দাও। সাহিল ভাইয়া লেবুর শরবত খেতে খুব পছন্দ করে! কাল যখন ভাইয়া আসবে তখন শরবতটা তুমি তাকে খেতে দিও! খুশি হয়ে যাবে সে। বাই দ্যা ওয়ে, সাহিল ভাইয়ার ফোন নাম্বার কী আছে তোমার কাছে?”

বেকুব বনে গেল জেনিয়া। উজবুক দৃষ্টিতে তার সাথে মশকরা করা মিশালের দিকে তাকিয়ে রইল! প্রসঙ্গ কোথা থেকে কোথায় চলে গেল বুঝে ওঠতে পারলনা সে। তাদের মাঝখানে আবার সাহিল কোত্থেকে এলো? মাথায় গ্যাঞ্জাম লেগে গেল তার। হিমশিম খেয়ে সে সংকীর্ণ গলায় শুধালো,

“সাহিল ভাইয়ার ফোন নাম্বার আমার কাছে কেন থাকবে?”
“তার মানে নেই? এক কাজ করো আমি তোমাকে সাহিল ভাইয়ার ফোন নাম্বারটা দিচ্ছি। তুমি একটু কল করে তার সাথে কথা বলো!”
“এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড আমি তার সাথে কী কথা বলব? আর কেনই বা আমি তাকে কল করব?”
“আরে কথা বলার পরই তো বুঝবা কী কথা বলবা। তোমার সাথে কী এখন ফোন আছে?”
“না নেই। শরবত খেতে হবেনা তোমার। ঘাট হয়েছে আমার, তোমার জন্য শরবত এনে!”

অপদস্ত হয়ে জেনিয়া বাধ্য হলো মিশালের সামনে থেকে প্রস্থান নিতে! জেনিয়ার যাওয়ার পথে তাকিয়ে মিশাল মন খুলে হাসল। বিড়বিড় করে বলল,

“এভাবেই তোমাকে আটকাতে হবে জেনিয়া। আমার প্রতি তোমার যে দুর্বলতাটা কাজ করে তা সাহিল ভাইয়ার দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে। যদিও বিষয়টা এতো ইজি নয়, কিন্তু ট্রাই তো করতে হবে।”

__________________________________

এই রাতেই শাহনাজ বেগমের রুমে প্রবেশ করল মিশাল। বিছানার ওপর বসে সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত তিনি। মিশালকে হঠাৎ দেখামাত্রই বেশ চমকে ওঠলেন তিনি। মিশাল সচরাচর তাঁর রুমে আসেনা। আজ হঠাৎ এলো বলে অনেকটাই অবাক হলেন তিনি। মাথা উঁচিয়ে মিশাল বেশ কঠিন দৃষ্টিতেই শাহনাজ বেগমের দিকে তাকালো! গম্ভীর গলায় বলল,

“মা আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“কী কথা?”
“ইদানিং দেখছি রুমকির প্রতি আপনার উদাসীনতা বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছেনা আপনি তাকে নজরে রাখছেন।”
“হঠাৎ এই প্রশ্নের কারণ?”
“রুমকির হাবভাবের পরিবর্তন কী আপনি খেয়াল করছেননা?”
“না তো। কী পরিবর্তন?”
“আমার মনে হচ্ছে রুমকি কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে। এই বিষয়গুলো আপনার দেখা উচিৎ।”
“হ্যা তো? বয়সটাই তো এমন! তাই এই বয়সে মেয়েদেরকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিৎ। ভালো সম্বন্ধ আসলেও তো বড়ো ভাই বেকার শুনলে লেজ গুটিয়ে পালায়! আছে আমাদের কোনো ভালো অবস্থান? মেয়েকে বিয়ে দিবো কীভাবে আমি?”
“বড়ো ভাই বেকার এই নিয়ে যেহেতু আপনার এতোই সমস্যা তাহলে আপনি নিজে থেকে কিছু ইনভেস্ট করুন না আমার জন্য! মাসে মাসে তো আপনি কম টাকা হাতাননি আমার থেকে! সেই টাকাগুলো বের করুন। না-কি সব টাকাই নিজের ছেলের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছেন? তার কাছে টাকা চালছেন? একদিনের জন্যও কী আপনি আমাকে নিজের ছেলে ভেবেছেন?”

#চলবে______?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here