#চন্দ্রকিরণ
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
#অন্তিম_পর্ব
চৌধুরী বাড়িতে আবারও জটলা সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রাতে অনলাইনে এক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে জাবির চৌধুরীর অদ্ভুত এক স্বীকারউক্তি আর কিছু জবানবন্দি নেট দুনিয়ায় ঘুরছে। সেটা নিয়ে মিটিং চলছে। মফস্বলের এলাকা জুড়ে চৌধুরী বাড়ির দুই যুগ আগের রহস্য মানুষের মুখেমুখে। জাহান ব্যস্ত সময় পার করছে। চৌধুরী বাড়িতে যাওয়ার সময় হয়নি। আরিয়ান কোর্টে এসেছে জাহানের সঙ্গে। নির্জন কক্ষে ম্যানেজার,কমোলিনি আর জাবির চৌধুরী পাশাপাশি বসে আছে।জাহান, আরিয়ান আর কয়েকজন আইনের লোক ভেতরে প্রবেশ করলো। কয়েকজনের উপস্থিতিতে এদের জবানবন্দি নেওয়া হবে। বাইরে থেকে গাড়ি আর লোকজনের চিৎকার চেচামেচি ভেসে আসছে। নির্জনতা কাটিয়ে জাহান মুখ খুঁললো,
> জাবির চৌধুরী বলবো নাকি দাদু বলা উচিত? একটা অনুমতি দিন। আমার অবশ্য নাম ধরে বলতে বেশি ভালো লাগবে। সোজাসুজি জিঞ্জাসা করি, বলুন কেনো করলেন এসব? এতে লাভ কি হলো? এতগুলো বাচ্চার প্রাণ নিতে আপনার বিবেকে বাঁধা দিলো না?
জাহানের কন্ঠ বেশ নরম। চেষ্টা করছে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার। অযথা রেগে লাভের লাভ কিছুই হবে না। জাবির চৌধুরী মাথা নিচু করে আছে। জাহান পূণরায় বললো,
> কি হলো বলুন? নয়টা প্রা*ণ নিয়েছেন সেগুলো এমনিই নাকি বড় কোনো কারণ ছিল? ভিডিওতে যা বলেছেন সবটা কি সত্যি?
ভদ্রলোক এবার মাথা তুলে চাইলো। জীবনে কখনও মাথানত করতে হয়নি আর আজ এইটুকু মেয়ের সামনে কথা বলতে পারছেন না। উনি ফুলে উঠলেন।
> যা করেছি বেশ করেছি। এইটুকু মেয়ের কাছে আমি কৈফিয়ত দিতে রাজি না। নয়টা প্রাণ? কি দাম আছে ওই প্রাণের? বংশের মাথা হেট করে দুদিন পর কোন এক ছোটলোকের ঘরে বউ হয়ে যাবে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাবার বাড়িতে এসে সম্পত্তির দাবি করবে। আমি মেয়েদের পছন্দ করিনা। বংশের গৌরব বৃদ্ধি করে ঘরের ছেলেরা। আমি চাইনি কোনো মেয়ে আমাদের বংশের নাম খারাপ করুক। তাই সময় থাকতে মে*রে দিয়েছি। এতে কার কি? সমাজের নাকি রাষ্ট্রের কার ক্ষতি করেছি যে পুলিশ আমাকে তুলে এনেছে? আমার বাড়ির র*ক্ত আমি নিজে ঝরিয়েছি। কার কি তাতে?
জাবির চৌধুরীর হুঙ্কার শুনে জাহানের চোখ জ্বলে উঠলো। হাতের মুঠো শক্ত করে নিচের ঠোঁট দাঁতের অগ্রভাগ দিয়ে চেপে ধরলো। মাথা দপদপ করছে। আরিয়ান পেছন থেকে ওর কাধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,
> রাগবেন না। কথা বলুন।
জাহান ঢোক গিলে বলল,
> মেহের আপার তো লাবিব ভাইজানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাহলে ওকে কোনো মা*রলেন? আর আমার মা তাকেই কেনো ম*রতে হলো?
> আমার একটা মেয়ে ছিল আনজুমান। দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও খারাপ ছিল না। ছিপছিপে চিকন শ্যামবর্ণ গায়ের রং। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে হিসেবে তার কদর ছিল বেশ। মেয়ের বয়স আঠারো পেরিয়ে উনিশ বছর তখন আমি জানতে পারি তাঁর এক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বিষয়টা আমি মানতে পারছিলাম না। ছেলের চৌদ্দ পুরুষ আমার বাড়িতে কাজ করে পেট চালিয়েছে সেই ছেলেকে আমি কিভাবে জামাই করে মাথায় তুলে নাচবো? মেয়েকে ঘর বন্ধি করলাম কিন্তু পালিয়ে গেলো। এলাকায় আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি। ঘর থেকে বাইরে যেতে পারিনা। ঘটনার মাস খানিকটা পরে ছেলেটা এসে আমার নামে মামলা করলো। আনজুমানের জায়গা জমি যেনো তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কেমন লাগে? যে মেয়েকে আমি অস্বীকার করেছি তাকে নাকি আমার বাবার কেনা সম্পত্তির অংশ দিতে হবে? কিন্তু স্ত্রীর কথা শুনে ঝামেলা ঝঞ্ঝাট না করে আমি বেশ কিছু জায়গা ওদের দিয়ে দিলাম। ঘটনা এখানেই শেষ না। জায়গা পেয়ে ওরা আরও লোভী হয়ে উঠলো। লোকজনের কাছে আমার নামে বদনাম করতে লাগলো। তার সপ্তাহ খানিকটা পরে শুনি আমার মেয়ে কোন এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। মানে এক ছেলের থেকে অন্য ছেলে? চৌধুরী বাড়ির মেয়ের চরিত্র নিয়ে লোকজন প্রশ্ন তুলতে শুরু করলো। আমার মাথায় কাজ করছিলোনা। পরদিন খরব আসলো ব্রিজের নিচে আনজুমানের লা*শ পাওয়া গেছে। যার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল সে ওর গয়না টাকা পয়সা নিয়ে ওকে খু*ন করে দেশ ছেড়েছে। আমি খোঁজ করলাম কিন্তু তেমন কোনো তথ্য পাইনি। ওরা আমার মেয়েকে টাকা পয়সার জন্য চাপ দিয়েছিল তাই ও নিজ থেকে আত্মহ*ত্যা করে। নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য লা*শ ব্রিজের নিচে ফেলে রাখে। আমি মানতেই পারছিলাম না। লোকজনের মুখে মুখে চৌধুরী বাড়ির বদনাম। সেই থেকে মেয়েদের উপরে আমার রাগ। নি*র্বো*ধ বোকা প্রাণি নিজের ভালো বুঝে না। ওদের বেঁ*চে থাকার মানে হয়না। সন্তানহীন থেকেছি তবুও চাইনি আমার কোনো মেয়ে হোক। ভাইয়ের ছেলেদের যখন কন্যা সন্তান হলো আমার মাথা আবারও বিগড়ে গেলো। ভাবলাম আর কখনও এই পরিবারের সম্মান নষ্ট হতে দিব না। তাই পরিকল্পনা করে সবাইকে মে*রে দিয়েছি। মেহের আমার প্রিয় ছিল কিন্তু ওকে বাঁচাতে হলে আমার সত্যি সকলের সামনে চলে আসতো। তোমার মা বিষয়টা জানতে পেরেছিলো তাই আমার কিছু করার ছিল না। বি*ষাক্ত ওষুধ দিয়ে একটু একটু করে সবাইকে মে*রেছি। তাতে ম্যানেজার আমাকে সাহায্য করেছে। বিনিময়ে আমি ওকে আমাদের বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকতে সাহায্য করেছি। কমোলিনি ওর স্ত্রী। আহিল যখন ওরকম ঘটনা ঘটালো আমার ইচ্ছা করছিলো ওকে খু*ন করি কিন্তু পারলাম না। ওর ছেলেটা দুনিয়ায় এতিম হয়ে যাবে। তাই শাস্তি দিয়েছি। ছেলেটাকে কৌশলে আমাদের বাড়িতে এনে রেখেছি। কখনও প্রশ্ন জাগেনি? কমোলিনি অযথা কেনো বান্ধবীর ছেলের জন্য দরদ দেখাতে গেলো? ওর নামে সম্পত্তি কেনো দিলো? ওসব আমার চাল। আমি চেয়েছিলাম চৌধুরী বাড়ির ছেলে চৌধুরী বাড়িতেই থাকবে। নাম পরিচয় গোপন থাক তবুও চোখের সামনে থাকবে আমি দেখবো। ওর নামে যত সম্পদ আছে সবটা আমার হুকুমে দেওয়া হয়েছে। কোমলিনি এতোটাও উদারচিত্তের মানুষ না। সে এসেছিল চৌধুরী বাড়ির টাকা পয়সার লো*ভে। নয়তো প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে কেউ প্রতারণা করে? আর ম্যানেজারের ওসব খারাপ ব্যবসার কথা আমি জানিনা। ওটা ওদের ব্যক্তিগত।
জাবির সাহেব সংক্ষেপে বিস্তারিত বলে দিলো। জাহানের চোখে পানি। আরিয়ান তেড়ে আসলো,
> আমাদের জীবন নিয়ে আপনি তামাশা করেছেন। আপনাকে খু*ন করলেও কম হবে। এতোগুলো অপরাধ করে এখন গলা চড়িয়ে কথা বলতে লজ্জা করছে না? দুদিন পরে ক*বরে যাবেন আল্লাহর কাছে কি হিসাব দিবেন?
জাহান ওকে থামিয়ে দিলো। হাতের ফোনটা বন্ধ করে বলল,
> নিজের মেয়ের শাস্তি অন্যদের দিয়েছেন ভালো করেছেন এবার বাকীটা জীবন জেলে থাকবেন। চৌধুরী বাড়ির খাসির মাং*স আর চালের রুটি আয়েশ করে খাওয়ার দিন ফুরিয়ে এসেছে। একাকিত্ব যখন আপনাকে পেয়ে বসবে তখন অনুধাবন করবেন কি পা*প আপনি করেছেন। আমি চাইছি না আপনার ফাঁ*সি হোক। তাহলে আমি তৃপ্তি পাবনা। আমি চাই আপনি ধুঁকে ধুকে যন্ত্রণা পেয়ে ম*রুন।
জাহান পাশের ডাক্তারকে বলল,
> এই ভদ্রলোকের রিপোর্টে উল্লেখ করবেন উনি মানুষিকভাবে অসুস্থ। মাথা অযথা আউলে থাকে। কখন কি করে বুঝতে পারেনা।
কক্ষজুড়ে আবারও নির্জনতা ছেয়ে গেলো। কারো মুখে কথা নেই। জাহান আরিয়ানের সঙ্গে বেরিয়ে আসলো। আইনজীবী হিসেব যেটুকু প্রয়োজন জাহান কোনো ত্রুটি রাখেনি। চৌধুরী বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গাড়ি চলছে বাড়ির পথে। আরিয়ান চুপচাপ ড্রাইভ করছে। জাহান পেছনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
> ভিডিওটা আপনি করেছিলেন?
আরিয়ান মলিন হাসলো। মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
> আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার তুলনায় এটা কিছুই না। আমি উনার কক্ষে আগে থেকে ক্যামেরা বসিয়েছিলাম। ফলাফল গতকাল রাতে পেলাম। ভাবলাম আমি একা জেনে কি হবে সবাইকে দেখানোর ব্যবস্থা করি।
জাহান চোখ খুঁলে চাইলো। হাতটা আলগোছে ওর হাতের উপরে রেখে বলল,
> সুন্দর না?
আরিয়ান সেদিকে চেয়ে লাজুক হেসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> আপনি সঙ্গে থাকলে হাতের ন্যায় আমার পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠবে। প্রমিজ আপনাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমি খুব মন দিয়ে পালন করবো। হৃদয়ের কোনে লুকিয়ে রাখা ঐশ্বর্য আপনার পায়ে লুটিয়ে দিব। শুধু একবার আমার হয়ে জান। একান্ত আমার।
> আমি আপনার তাতে সন্দেহ আছে? আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিন আব্বাজানের সঙ্গে আমার জরুরী আলাপ আছে।
আরিয়ান কথা বললো না। চুপচাপ ওকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে চললো।
***
ইব্রাহিম খান মেয়ের মাথায় হাত রেখে বসে আছেন। মুখে কথা নেই অথচ চোখে পানির ফোয়ারা। বোনের অপরাধীর শা*স্তি হয়েছে জানার পর থেকেই উনি চুপচাপ হয়ে গেছেন। চৌধুরী বাড়ি রা*হুর গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়েছে। জাহান মুখ ফুলিয়ে বলল,
> আব্বাজান তুমি কি খুশি না? এভাবে কান্নাকাটি করলে আমি কিন্তু চলে যাব। বুদ্ধি নিতে এসেছি কোথায় বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করবে তানা কান্নাকাটি করে আমাকে ভাসিয়ে দিচ্ছো?আমার এখন তিনটা বাবা। কাকে কোথায় রাখবো মাথায় আসছে না। বুদ্ধি দিন। আপনি আমার ভরসা।
ইব্রাহিম খান এবার হাসলেন। মেয়েটার মন সত্যি অনেক নরম।
> তিন বাবা যার যখন তোমাকে দেখতে মন চাইছে তোমার কাছে চলে আসবে এতো চিন্তা কিসের? আমি সব সময় মিটিং মিছিল নিয়ে ব্যস্ত থাকি বাড়িতে থাকতে পারিনা। তোমার বাবা শুনলাম এখানকার ইউনিভার্সিটিতে জব নিয়েছেন। ভদ্রলোককে বলে দিও আমাদের সঙ্গে থাকতে। দুলাভাই জীবনেও আমার কথা শুনবে না যদি তুমি বলো শুনতে পারে।
জাহান চুপচাপ চলে আসলো। সকলের থেকে মতামত জানতে হবে। একার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবেনা।
**
গভীর রাত, আকাশে চাঁদ উঠেছে। জাহান ব্যালকনির দোলনায় বসে আছে। শাড়ির আচল ফ্লরে গড়াগড়ি করছে। আরিয়ান এখনো বাড়িতে ফিরে আসেনি। জাহান এতোক্ষন মায়ের কাছে ছিল। ইব্রাহিম খান স্ত্রী আর বোনদের নিয়ে আরিয়ানের বাড়ির দোতালায় উঠেছে। আরিয়ানের বাবা আর জাহনের বাবা খান বাড়িতে থাকতে চাইনি তাই জাহানের জন্য সবাইকে নিয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে। ইব্রাহিম খানের ব্যস্ততা বেড়েছে। জাহান নিজের কাজে বেশ সিরিয়াস। সংগঠনের সদস্য বেড়ে লাখ ছাড়িয়েছে। চারদিকে ওর গুণগান ছড়িয়ে পড়ছে। আরিয়ান ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করে । ফিরোজ সিটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হয়েছে সেই সঙ্গে নীলু এখানকার হাসপাতালে জয়েন করেছে। চৌধুরী বাড়িতে অনেকেই আছে। লাবিব বিদেশি সেই মেয়েকে বিয়ে করে চৌধুরী বাড়িতে উঠেছে। নীলু আর ফিরোজ বেশিরভাগ সময় জাহানের সঙ্গে থাকে। মোটামুটি সব ঠিকঠাক কিন্তু জীবন থেকে ঝামেলা চলে যায়নি। কমোলিনি আর ম্যানেজার সকলে জেলে। জাবির চৌধুরী মানুষিক হাসপাতালে আছে। কেউ উনার খোঁজ রাখেনি। লোকটা উন্মাদ। জাহানের সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্ক বেশ ভালো। সবাইকে নিয়ে ওর সংসার। হঠাৎ গাড়ির শব্দে ওর ধ্যান ভাঙলো। কয়েক মিনিট পর আরিয়ান কক্ষে প্রবেশ করলো। জাহান তখনও দোলনায় বসে আছে। আরিয়ান ফ্রেস হয়ে হেলতে দুলতে জাহানের কোলের উপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। চাঁদের আলো সোজাসুজি ওর মুখের উপরে এসে পড়েছে। জাহান ওর চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলল,
> খাবেন না? আজ এতো দেরী হলো?
আরিয়ান ওর কোমর জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
> ফার্ম হাউজে গিয়েছিলাম। কাজকর্ম শেষ করতে লেট হলো। মাথা ব্যাথা করছে। ফিরোজ ভাইজান ফোন করেছিল। বাবা হচ্ছেন সেই খুশীতে মফস্বলের মসজিদে মসজিদে মিষ্টি পাঠিয়েছে। যাকে পাচ্ছে ধরে ওরে বলছে,আমি বাপ হবো। নীরু আপা লজ্জায় বাড়ি ফিরছে না। আমাদের কবে হবে? শাশুড়ি মায়ের উপহার এ জন্মে আর দিতে পারলাম না।
আরিয়ানের কণ্ঠে হতাশা। জাহান মিষ্টি করে হাসলো। আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
> আল্লাহ চাইলে নিশ্চয়ই হবে এতো তাড়া কিসের? আমার সংগঠন আরেকটু বড় হোক। কাজকর্ম গুছিয়ে উঠি।কোর্ট কাচারী করতে করতে আমার অবস্থা খারাপ।
> শুনো না তোমার চিন্তা করতে হবে না।শুধুমাত্র দশ মাস কষ্ট করবে বাকীটা আমি দেখে নিব। বাবুর খাওয়া থেকে গোসল,ঘুম পাড়ানো সব দায়িত্ব আমি পালন করবো। তুমি এইটুকু আবদার রাখো প্লিজ।
আরিয়ান ওকে দুহাতে নাড়িয়ে দিলো। বাচ্চাদের মতো আবদার। জাহানের সামনে বেশ কিছু কেচ আছে। তাছাড়া মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য নানারকম কাজকর্ম করতে হচ্ছে। সেখানে কুটিশিল্পের কাজ যেমন সেলাই, প্রেন্টিং নানারকম হাতের তৈরি গহনা, আসবাবপত্র তৈরী করা হয়। জাহান ভিবিন্ন অঞ্চল থেকে দক্ষ প্রশিক্ষক এনে এদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এখানে সব বয়সী মহিলা আছে। জাহান সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওদের স্থায়ীভাবে থাকার জন্য ঘর তৈরি করবে। ইব্রাহিম খান জমি দিয়েছেন। জাবির চৌধুরী টাকা দিবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। এখন শুধুমাত্র প্রজেক্ট শুরু করার অপেক্ষা। এতো ঝামেলার মধ্যে যদি আবার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে অসুবিধা হয়? জনসেবা করতে হলে মন থেকেই করতে হয়। জাহানকে ভাবতে দেখে আরিয়ান পূণরায় বলল,
> তোমার সব কাজ আমি করে দিবো। চাচাজানের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি কন্টাক্টরের সঙ্গে কথা বলেছি। ফার্ম হাউজে কাজ করছিলো ওরাই সবটা সামলে দিবে। তুমি ঘরে বসেও খোঁজ নিতে পারবে। আমি কি জন্য আছি? সমস্যা আসবে আবার চলে যাবে। কিন্তু এই বিষয়ে লেট করেলে আমি বাবা ডাক শুনতে আরও লেট করে ফেলবো। পরিকল্পনার কিছু নেই। আমার জীবনে যা কিছু হয়েছে সবটা হঠাৎ করে। তাই চলো হঠাৎ বাবা মা হয়ে যায়।
জাহান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> আচ্ছা মানলাম আপনার কথা কিন্তু আমার কাজে অবহেলা করলে খবর আছে। আমি একটা বছর না বরং সবটুকু সময় আপনাদের দিবো সঙ্গে বাইরের কাজও করবো। আমার এক চোখে স্বামী সংসার অন্যচোখে জগত সংসার দেখবো।
আরিয়ান খুশী হলো। হুটকরে নিচে নেমে পড়লো। জাহানের হাতটা টেনে নিয়ে বলল,
> কক্ষে চলো। বর সারাদিন না খেয়ে আছে আর তুমি বসে এমপি হওয়ার কৌশল ভাবছো? আজ সারারাত চন্দ্রকিরণ উপভোগ করবো। পুরো রাতটুকু তোমার আমার।
জাহান প্রতিবাদ করলোনা। ওর পিছু চুপচাপ উঠে গেলো। লোকটা সত্যিই না খেয়ে আছে।
*****
সময় ও স্রত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। ফিরোজ মিটিংয়ে ছিল হঠাৎ ফোন আসলো হাসপাতাল থেকে। বেচারা সব ছেড়ে প্রায় দৌড়ে আসলো। নীরুর শরিরটা একদম ভালো নেই। বেচারী সারাদিন বমি করে। পায়ে মানি জমেছে। হাঁটতে চলতে পারেনা। পুষ্টি কম থাকার জন্য নানারকম জটিলতা দেখা দিয়েছে। আরিয়ান ওর এমন দেখে জাহানকে বলে দিয়েছে বাচ্চার প্রয়োজন নেই। জীবন আগে তারপর বাচ্চা। জাহান এমনিতেই ছটফটে স্থির না। ওকে নিয়ে চিন্তার শেষ থাকবে না। জাহান ওর কথা পাত্তা দেয়নি। বরং নীরুর থেকে পরামর্শ নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছে। ফিরোজ হাপাতে হাপাতে হাসপাতালে এসে উপস্থিত হলো। নীরুর অপারেশন হয়েছে। মেয়ে বাচ্চা হয়েছে কিন্তু বাইরে দেওয়া হয়নি। বাচ্চার অক্সিজেনের সমস্যা হচ্ছে তাই আলাদা রাখা হয়েছে। নীরুর র*ক্ত লাগবে। ফিরোজ চিন্তা করতে করতে শেষ। বাচ্চার কথা শুনেই কেঁদে উঠে বলল
,
> জান কি হবে এখন? আমার নীরু আর বাবু ঠিক হবে তো?
জাহান ভরসা দিলো। ভাইয়ের হাত ধরে বলল,
> চিন্তা করোনা আমি রক্ত দিতে যাচ্ছি। বাবুও সুস্থ আছে একটু সমস্যা আছে ঠিক হয়ে যাবে।
আরিয়ান এখনো রাস্তায়। খবর পেতে লেট হয়েছে তাই আসতে দেরী হচ্ছে। জাহান রক্ত দেওয়ার আগে ডাক্তার ওকে পরীক্ষা করে বলল,
> আদর আমার মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে তোমার র*ক্ত দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। একটা টেস্ট দিয়েছি করিয়ে আসো। এখানে র*ক্তের অভাব হবে না। আমাদের অনেক চেনাশোনা লোকজন আছে আমি ডেকে নিচ্ছি।
জাহান অবাক হয়ে ডাক্তার শিরিনের দিকে চেয়ে আছে। বিষয়টা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,
> আমি যাচ্ছি আপনি অপেক্ষা করুন।
জাহান ছুঁটলো বাইরের দিকে। আরিয়ান হাসপাতালে আসার আগেই ডোনার ঠিক করে ফেলেছে। জাহানের শরীর তেমন ভালো নেই র*ক্ত দিলে অসুবিধা হবে। জাহানের রিপোর্ট আসতে আসতে নীরুর র*ক্ত দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। মোটামুটি ভালো আছে। ডাক্তার বলেছে অসুবিধা হবে না। জাহান রিপোর্ট নিয়ে সোজা আরিয়ানের কাছে গিয়ে বলল,
> এটা নিয়ে আপনার শাশুড়ি আম্মাকে দিয়ে আসুন। সেইতো আপনার মাথার মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করে।
আরিয়ান রিপোর্টের দিকে চেয়ে চোখ বড়বড় করে বলল,
> আল্লাহ ! এটা সত্যি? কিন্তু আমিতো তোমাকে নিষেধ করেছিলাম। নীরু আপার দেখেছো কি অবস্থা? ফিরোজ ভাইজান শুধু ফ্যাচ ফ্যাচ করে মেয়েলী টাইপ কেঁদেছে তোমার কিছু হলে আমিতো গড়াগড়ি করে কাঁদবো। কিযে করোনা তুমি।
হাসপাতালের বারান্দায় বেশ কিছু চেয়ার পাতা আরিয়ান ওকে সেখানে বসিয়ে দিয়ে ভেতরের দিকে ছুটে গেলো। দুই মিনিটের মধ্যেই হৈচৈ পড়ে গেলো। বাড়ির সকলে ছুঁটে আসলো জাহানের কাছে। আধা ঘন্টা পরে আরিয়ান ফিরলো। ঘেমেঘেটে একাকার অবস্থা। জাহান সেখানেই বসে আছে। ওর জানা আছে আরিয়ান ফিরবে। মায়ের কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলো। কি এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আরিয়ান এসে ওর পাশে বসতে বসতে বলল,
> কি গরম বাইরে সূর্যমামা রেগে আছে।
জাহান নাক কুচকে বলল,
> আপনি গোসল করে আসুন। শরীর থেকে গন্ধ আসছে। কোথায় গিয়েছিলেন এমনে?
আরিয়ান মুখটা ভার করে বলল,
> গন্ধ কেনো করবে? কাজে ছিলাম। বাড়িতে চলো। এখানে অনেকেই আছে। আমার অনেক কাজ সব গোছাতে সময় লাগবে। চলো।
জাহান বিরক্ত হলো লোকটার আচরণ দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যে হাসপাতাল জুড়ে হৈচৈ রব মিষ্টি বিতরণ চলছে। জাহান লোকদের মধ্যে একজনকে চিনে। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। জাহান বুঝতে পারলো এই লোকের ব্যস্ততা কিসের। চৌধুরী বাড়ির বাদরের দল সবগুলো একরকম। আলেয়া শশুর বাড়িতে ছিল খবর শুনে বের হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ফিরোজ দৌঁড়ে এসে বলল,
> জান আলেয়া হাতি এখনো আসতে পারলোনা কেনো? ফোন দাও বেচারী নেই শান্তিতে ঝগড়া করতে পারছি না। মনের খুশীতে আজ প্রচুর কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
জাহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। আলেয়াকে এরা বিনোদনের উৎস ভাবে। বেচারী আলেয়া যদি জানতে পারে ফিরোজের চুল একটাও থাকবে না। ঝগড়া ঝামেলা যাইহোক বিপদের দিনে সকলে এক সঙ্গে থেকে মোকাবেলা করবে সেখানেইতো সম্পর্কের স্বার্থকতা। কিছু পাওয়া আর কিছু না পাওয়া নিয়ে মানুষের জীবন। কষ্টের পরে সুখ আসে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আরিয়ান জীবন থেকে যতটা হারিয়েছে ততটাই পেয়েছে। জাহানকে নিয়ে ওর সুখে নীড়। একদিন কেউ বলেছিল আগামী চন্দ্রকিরণ জাহানের জীবনে আর আসবে না কিন্তু ওরা দুজনে হাতে হাত রেখে এমন হাজারো চন্দ্রকিরণ দেখার স্বপ্ন দেখছে।
সমাপ্ত
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। আমার চোখের অবস্থা ভালো না। ডাক্তার কিছুদিনের জন্য ফোন ঘাটাঘাটি করতে নিষেধ করেছেন। নিয়মিত লিখতে পারছি না তাই শেষ করলাম। জানি এলোমেলো লিখেছি তবুও যারা এতোদিন পাশে ছিলেন সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। চোখের সমস্যা ঠিক হলে ইনশাআল্লাহ ফিরবো নতুন গল্প নিয়ে।