#চন্দ্রকিরণ
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৬
সারারাত যমে মানুষের টানাটানি শেষে ভোরবেলা ফিরোজের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে। মাথায় আঘাতের ফলে বারবার বমি করছে। নীহারিকা সেই রাতের গাড়িতে ঢাকা থেকে সোজা হাসপাতালে এসেছে। ফিরোজের শরীরে বেশ কিছু ক্ষত হয়েছে তাই আপাতত কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ইনফেকশন হলে তখন ঠিক হতে সময় লাগবে। নীহারিকা ওকে এখানে রাখতে চাইছে না। ঢাকা মেডিকেলে নিলে ওর জন্য সুবিধা হয়। মেয়েটা সেই থেকে চোখের পানি ঝরিয়ে যাচ্ছে। দশ বছর বয়সে বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মায়ের হাত ধরে মামার বাড়িতে এসে উঠেছিলো। ইব্রাহিম খান চাচাতো বোন আর তার মেয়েকে কখনও কোনো অভাব অভিযোগের সুযোগ দেননি। জাহান যেভাবে সুযোগ সুবিধা পেয়েছে নীরুও তেমন। তবুও আক্ষেপ একটা থেকেই যায়। নীরু চেয়েছিলো স্বামীর ভালোবাসা নিয়ে অতৃপ্ত হৃদয়ের হাহাকার পূরর্ণ করবে। লোকটা ক্ষেপাটে কিন্তু মন থেকে ভীষণ ভালো। ওকে আগলে রাখে। তার এমন পরিণতি ও মানতে পারছে না। জাহানের ভীষণ জ্বর এসেছে পাশের কেবিনে শুয়ে আছে। লাঠির আ*ঘাতে পিঠের বেশ কিছু জায়গা র*ক্ত জমেছে ফুলে আছে। মোমের মতো শরীরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। লতিফা বানু মেয়ের মাথার কাছে বসে আছেন। এদিকে ইব্রাহিম খানের খোঁজ নেই। মেয়ের শরীরের আঘা*তের চিহ্ন মিলে যাওয়ার আগেই উনি সেই নর*পশু*দের জেলে পুরবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। প্রশাসন বেশ উঠেপড়ে লেগেছে। এমপি কন্যা আর জামাই হাসপাতালে বিষয়টা নিয়ে এলাকায় হুল্লোড় পড়ে গেছে। বাইরে সাংবাদিক এসে বারবার ফিরে যাচ্ছে। ফিরোজের যখনই জ্ঞান ফিরছে বমি হচ্ছে। একটা দিন এখানে রেখে যদি অবস্থার উন্নতি না হয় তবে ঢাকা নিতে হবে। জাহান জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকছে। লতিফা বানু কাঁদছেন। মেয়েটা বাংলাদেশে ফিরলেই যত রকমের অশান্তি সব লেগে থাকে। তাছাড়া চৌধুরী পরিবারের লোকজন এখন বাংলাদেশে আছে। বাচ্চারা ফিরে গেছে। ওদের স্কুল কলেজ আছে। পূর্ব আকাশে রক্তিম সূর্যের উদয় হতেই আরিয়ান হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করলো। নামাজ পড়তে পাশের মসজিদে গিয়েছিল। ভাই আর স্ত্রীর জন্য নফল নামাজ পড়ে দোয়া করেছে।ওর নিজেকে কুফা মনে হয়। যখনই মেয়েটার আশেপাশে ঘেঁষার চেষ্টা করে তখনই সমস্যা এসে হাজির হয়। এ জীবনে হয়তো আর স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘর সংসারের স্বপ্ন পূরণ হবে না। আফসোস করতে করতে ফিরোজের কেবিনে উঁকি দিয়ে আলেয়াকে দেখে থমকালো। আলেয়া নীরুর কাছে বসে আছে। এই যে ফিরোজকে আলেয়া দু’চোখে সহ্য করতে পারেনা বাদর ছাড়া কথা বলে না অথচ আজ তার জন্যই সারারাত কেঁদেছে। বোনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। যার সঙ্গে ওর রক্তের সম্পর্ক না আত্মার সম্পর্ক। নীরুকে সবাই ভীষণ ভালোবাসে। মেয়েটা এতো সহজ সরল যে ভালো না বেসে থাকা যায়না। আলেয়া বা জাহান নীরুর কথা ভেবে পাগল প্রায় অবস্থা। ফিরোজের কিছু হলে বোনকে বাঁচাতে পারবে না সেই ভয়ে অস্থির। আরিয়ানের বেশ ভালো লাগলো। ভালোবাসা তো এমনিই হওয়া উচিত যেখানে স্বার্থ থাকবে না। কথাটা ভেবে ও দরজা নক করে কণ্ঠ নামিয়ে বলল,
> এভাবে বসে থাকলে কি ভাইজান সুস্থ হবে?বরং দুজনেই অসুস্থ হবে। পাগলামি না করে বাইরে আসো। জাহানের কক্ষে বেড আছে কিছুটা ঘুমিয়ে নাও আমি আছি এখানে। চিন্তা করোনা ভাইজান সুস্থ হয়ে উঠবেন। এতোটা ভালোবাসা ছেড়ে কেউ যেতে পারে? ভাইয়ের কথাটা একটু শুনো প্লিজ। আর আলেয়া তুমি একটু বোঝাবে তানা তুমিও বসে বসে ওর সঙ্গ দিচ্ছো? ভাইজান উঠেই কিন্তু তোমাকে দোষারোপ করবেন। বলবে আলেয়া তুমি আমার বউকে খেপিয়ে রোগী করে দিয়েছো? তোমাকে আমি ছাড়বো না। ভাইজান জেনো তোমাকে কি নামে ডাকে?
আলেয়া হেসে ফেললো। সত্যি ফিরোজ সুস্থ হয়েই আলেয়ার পিছুনে লাগবে। এটা ওটা বলে রাগানোর চেষ্টা করবে। ইদানীং ওকে খেপাটে হাতি নাম দিয়েছে সেটা শুনে আলেয়া রেগে বো*ম হয়ে যায় কিন্তু আজকে আর রাগ হচ্ছে না বরং খারাপ লাগছে। হাসিখুশি মানুষটার এমন পরিণতি মানতে কষ্ট হচ্ছে। নীরু ওর কাধে মাথা রেখে হেলান দিয়ে বসে আছে। সারারাত কেঁদেছে কণ্ঠ দিয়ে আর আওয়াজ আসছে না। শরীর ক্লান্ত হয়ে আছে। উস্কোখুস্কো চুল আর নরমাল থ্রিপিচে মেয়েটাকে কেমন রোগী মনে হচ্ছে। ওষ্ঠ শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। আলেয়া পর্যবেক্ষণ করে বলল,
> আপা এভাবে কতক্ষণ থাকবে? চলো ফ্রেস হয়ে একটু ঘুমিয়ে নিবে। ভাইজানের যখন জ্ঞান ফিরবে তোমার ঢুলুঢুলু চোখ আর এলোমেলো পোশাক দেখে তাহলে কিন্তু আফসোস করতে করতে আবারও জ্ঞান হারাবে। তাছাড়া তুমি যদি তখন ঘুমে ঢুলতে থাকো তাহলে কেমন হবে বলো? দুটো কথাও বলতে পারবে না। তুমি নিজে ডাক্তার হয়ে এমন পাগলামি করছো আপা?
নীরুর চোখে পানির ফোয়ারা। ওদেরকে ও কিভাবে বোঝাবে এই মানুষটাকে ঘিরে ওর কত স্বপ্ন আশা আর ভালোবাসা রয়েছে? অপূর্ণ কত আশা মনের মধ্যে লালিত হচ্ছে তাদের পরিপূর্ণ করতে ফিরোজকে বড্ড প্রয়োজন। ভালোবাসার কাঙ্গাল যে সেই বুঝবে ওর যন্ত্রণা। আরিয়ান ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। নীরু সেদিকে চেয়ে বলল,
> জান ঠিক আছে? মামি আছে বিধায় যাওয়া হয়নি। মেয়েটা সত্যি পাগল। এই দুই পাগলে মিলে আমাদের একটুও শান্তিতে থাকতে দিবে না। ওরা কি বুঝবে আমাদের যন্ত্রণা। সারাদিন টেনশন নিয়ে ক্লাস করি। পড়াশোনা লাটে উঠেছে। কখন কোন খবর আসে সেই ভয়টা আজ সত্যি হলো। ও সুস্থ হলে আমি কিছুতেই আর এসবের চক্করের পড়তে দিচ্ছি না।
আরিয়ান মলিন হেসে বলল,
> জাহান ঠিক আছে। কিছু হবে না চিন্তা করোনা। ভাইজান মেয়র হচ্ছে এটা নিশ্চিত থাকো। আমি দেখবো সবটা। এখন আসছি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবো।
নীরু মাথা নাড়লো। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। গরম চা পেলে হয়তো আরাম লাগতো কিন্তু ফিরোজের জ্ঞান না ফিরলে গলা দিয়ে কিছু নামবে না। আরিয়ান চুপচাপ ফিরে আসলো। বাইরে গার্ড পাহারা দিচ্ছে। ইব্রাহিম খানের লোকজন সব। আরিয়ান ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে নিরাশ হলো। ডাক্তার নামাজে গিয়ে এখনো আসেনি হয়তো চা নিয়ে বসেছে তাই জাহানের কেবিনের দিকে ফিরলো। লতিফা বানু ওয়াশ রুম থেকে ফিরে জামাইকে দেখে ঘাবড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি মাথায় ওড়না টেনে বললেন,
> বাবা তুমি যদি এখানে একটু থাকতে আমি বাড়িতে গিয়ে খাবার আনতে পারতাম। এখানে কতগুলো মানুষ না খেয়ে রাত জেগে আছে। তুমি কি থাকতে পারবে?
আরিয়ান সুযোগ পেয়ে লুফে নিলো। মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
> থাকবো আম্মা। আপনি যেতে পারেন।
ভদ্রমহিলা খুশী হলেন। উনি চাইছেন মেয়েটা সংসারি হোক তাতে যদি একটু নরম শরম হয়। বাইরে ঘুরাঘুরি রাজনীতি করা উনার খুব একটা পছন্দ না। সব সময় চিন্তা করতে করতে হার্ট দুর্বল হয়ে উঠেছে। একমাত্র মেয়ে। লতিফা বানু ব্যাগ তুলে বেরিয়ে গেলেন। আরিয়ান চেয়ার টেনে জাহানের পাশে এসে বসলো। জ্বরে মেয়েটার নাক লাল হয়ে উঠেছে। ঢিলেঢালা আলখেল্লা টাইপ হাসপাতালের নীল পোশাকে মেয়েটাকে বেশ লাগছে। ফর্সা গাল খানিকটা লাল হয়ে আছে। আরিয়ান ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওষ্ঠ ছুঁয়ে মুখে হাত রাখলো। এই যে খানিকটা ছুঁয়ে দিয়েছে মেয়েটা জানতে পারলে এখুনি বলতো,
> আপনি আমাকে অচেতন পেয়ে চুমু দিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছেন কাজটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। যা করবেন জ্ঞান থাকতে করবেন যাতে আমি সবটা অনুভব করতে পারি।
আরিয়ান হাসলো। পাশে রাখা কাপড়টা ভিজিয়ে ওর মাথায় রেখে আবারও ওর মুখের দিকে চেয়ে ধ্যানমগ্ন হলো। মুখটাতে রাজ্যের মায়া এসে ভিড় করেছে। প্রশ্ন জাগলো, এই মুখখানা এতোটা সুন্দর লাগার কারণ কি? মেয়েটা নিজের একান্ত ব্যক্তিগত তাই, নাকি আসলেই সুন্দর?
***********
বিকাল চারটা নাগাদ ফিরোজের জ্ঞান ফিরলো। এবার আর বমি হয়নি তবে মাথা ভার হয়ে আছে। তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। বেডের চারপাশে বাড়ির সকলে এসে হাজির হয়েছে। চৌধুরী বাড়ির লোকজন সকালে এসেছে। ফিরোজের মা ছেলের জন্য কান্নাকাটি করছেন। নিরুকে ছেলের বউ করতে উনার আপত্তি কোনো কালেই ছিল না। ছেলের পছন্দের মেয়ে তাছাড়া নীরু সুন্দরী শিক্ষিতা কয়েকদিন পরে ডাক্তার হয়ে ফিরবে তাহলে অসুবিধা কোথায়? যুগ পরিবর্তন হয়েছে। বংশ মর্যাদা আর উঁচুনিচু সামাজিক শ্রেণি বৈষম্য এখন চলে না। জীবনে সুখী হওয়াটাই আসল। উনি নীরুকে আগলে রেখেছেন। মেয়েটা স্বামী শোকে কাতর। জাবির চৌধুরী সেই থেকে হম্বিতম্বি করছেন। আরিয়ানকে দোষারোপ করছেন। উনার কথা কেউ আগ্রহ করছে না। ফিরোজ চোখ খুঁলে পাশে মায়ের মুখটা দেখে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> মা তুমি কি কান্নাকাটি করছো? আমি ঠিক আছি। দেখো এভাবে মরা কান্না করে আমাকে কিন্তু দুর্বল করবে না। হবু মেয়রের মা তুমি। কান্নাকাটি ঠিক মানাচ্ছে না।
ভদ্রমহিলা ছেলের হাতে চুমু খেয়ে বলল,
> আমি কান্নাকাটি করছি না বাবা বরং আরেকজন করছে। পারলে ওকে খানিকটা বকে দে। গতকাল রাত থেকে না খেয়ে। ভোরবেলা পানি খেয়ে সে রোজা আছে ভাবতে পারছিস? তাড়াতাড়ি সুষ্ঠু হয়ে বউ নিয়ে বাড়িতে ফিরে চল বাবা। এই বয়সে এতোটা কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। রাজনীতির কি প্রয়োজন আছে আমাদের? কাজকর্ম করলে কি ভাতের অভাব হবে বল?
ফিরোজ হাসলো। মায়ের মমতা মাখা মুখটা দেখে যতটা শান্তি পেয়েছিলো দরজার কাছে মাথা নিচু করে থাকা নীরুকে দেখে ততটাই কষ্ট পেলো। বুকটা কেপে উঠলো। মেয়েটাকে এভাবে অগোছালো দেখবে আশা করেনি। কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কেনো জানি হৃদয়ে সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। ওকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে প্রিয় মানুষগুলো এভাবে কান্নাকাটি করছে ভেবেই ভালো লাগছে।তবুও কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
> মা ভাতের জন্য কি মানুষ রাজনীতি করে? তুমি বুঝবে না। এটা একটা নেশার মতো। যাইহোক দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে ঠিক চিনতে পারছি না। মেয়েটাকে কোথায় জানি দেখেছিলাম?
ফিরোজ কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলো ঠিক তখনই জাহান এসে ভেতরে ঢুকলো। মেয়েটার হাত গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা। জ্বর ব্যাথা দুটোই আছে তবুও একবার দেখার জন্য আসতে হলো। জাহানকে দেখে ফিরোজ হাসলো। হাত উঁচু করে বলল,
> এরকম কেনো করলে বলবে? কি প্রয়োজন ছিল ওভারে ঝামেলার মধ্যে গিয়ে আমাকে বাঁচাতে যাওয়ার? হাত কি ভেঙে গেছে? কোথায় কোথায় লাগেছে? একটু সুস্থ হতে দাও সব গুলোর হচ্ছে। কতকরে বললাম আমার বোনের গায়ে হাত দিসনা পি*শাচ গুলো শুনলোনা।
জাহান ওর হাতটা ধরে পাশে বসলো। মৃদু হেসে বলল,
> বোনেরা কখনও ভাইয়ের বিপদে বসে থাকতে পারেনা। যাইহোক ভাইজান এখন কেমন লাগছে? নীরু আপাকে দেখেছো? গতকাল রাত থেকে কান্নাকাটি করছে। তোমার কপালে শনি আছে। ওভারে গার্ড ছাড়া চলাফেরা করো কেনো তুমি? নিজের সুরক্ষার কথা আগে ভাবতে হয়।
জাহান এক নাগাড়ে কথা বলছে। এদিকে কয়েক জোড়া চোখ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে। ফিরোজ আশেপাশে চেয়ে মলিন হাসলো। জাহান কথা থামানোর আগেই পাশ থেকে এক ভদ্রলোক ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলেন। জাহান হতভম্ভ হয়ে ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। নড়াচড়া করছে না। লোকটা ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর মুখটা নিজের হাতের তালুতে নিয়ে ভেজা কণ্ঠে বললেন,
> আমার মেহেরিন মা।কোথায় ছিলে এতোদিন? বাবার কথা কি একটুও মনে পড়েনি? আমি তোমাদের হারিয়ে কতটা যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি যদি জানতে। আমারই দোষ সকলের কথা অমান্য করে তোমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমিতো ভেবেছিলাম আমার মা ভালো থাকবে। ভালো করতে গিয়ে আমি তোমার ক্ষতি করে ফেলেছি। তোমার মা আমাকে ক্ষমা করতে পারলোনা। আমাকে একা করে শাস্তি দিলো। ভদ্রমহিলা জিদপূর্ণ আজিম চৌধুরীর অহংকার মাটির সঙ্গে লুটিয়ে দিলো।
আজিজ চৌধুরী কান্নাকাটি করছেন। নিখোঁজ ভাইয়ের ফিরে আসার খবর শুনে ভদ্রলোক গতকাল দেশে ফিরেছেন। জাহানের কথা উনাকে কেউ বলেনি। স্ত্রী কন্যা হারিয়ে যখন শোকে দিশেহারা অবস্থা তখন উনার ভাইয়েরা উনার সঙ্গ দিয়েছিলো। উনি এতোকাল অষ্ট্রেলীয়ার এক ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতা করছিলেন। এর মধ্যেই ইব্রাহিম খান ভেতরে প্রবেশ করলো। জাহানের মুখ শুকিয়ে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। বাবাকে দেখে কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ইব্রাহিম খানকে জড়িয়ে ধরে মৃদু কণ্ঠে বলল,
> আব্বাজান
ইব্রাহিম খান বুঝতে পারলেন মেয়ের মনের অবস্থা। তাই মাথায় হাত রেখে বললেন,
> চিন্তা করোনা,তুমি আমার মেয়ে। আব্বাজান আছে সব ঠিক করে ফেলবে। এখানে কেনো এসেছো? নিজের কেবিনে গিয়ে বিশ্রাম করো।
জাহান চলে যেতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। আজিজ চৌধুরী ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ধরে ইব্রাহিম খানের দিকে কঠিন নজরে তাকালেন।
> জমি নিয়ে বিরোধ চলছিলো মানছি তাই বলে তুমি এতোটা নিচে নামতে পারলে? আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সাহস তোমাকে কে দিলো ইব্রাহিম? ওকে তুমি লুকিয়ে রেখেছিলে আমাকে শাস্তি দিতে তাইনা? তুমি সফল ইব্রাহিম ভীষণভাবে সফল। আমি তোমার মতো বাজে এমপির মুখোশ সকলের সামনে আনবো দেখে নিও। আমার মেয়েকে আমি তোমার মতো অ*মানুষের কাছে রাখবো না। আমি বোকার মতো সবাইকে বিশ্বাস করেছি। সকলে মিলে আমাকে ঠকিয়েছো।
আজিম চৌধুরীর গলা কাঁপছে। জাহানের ভীষণ খারাপ লাগছে। জীবনে প্রথমবার কঠিন সমস্যার সম্মুখে পড়তে হলো। দুজন বাবার মধ্যে কার কাছে থাকা উচিত ভাবতে পারছে না। ইব্রাহিম খান প্রতিবাদ করে উঠলেন,
> দুলাভাই একদম আজেবাজে কথাবার্তা বলবেন না। আমি জাহানকে বাঁচা*নোর জন্য নিজের কাছে রেখেছিলাম। আপনি মেহেরকে এতোটা ভালোবাসা দিয়ে বড় করেও শেষ পযর্ন্ত সফল হতে পারেননি। অথচ দেখুন আমি সফল। জাহানকে আমি পড়াশোনা শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছি। আপনি পারতেন সেটা করতে? আমার বোন মৃ*ত্যুর আগ মূহুর্ত পযর্ন্ত চেয়েছিলো জাহান কিছুতেই যেনো চৌধুরী বাড়িতে না থাকে। ওর অস্তিত্বের নাম পৃথিবীর থেকে মুছে যাক। আমি বোনের কথা রেখেছি। আজ পৃথিবীর কাছে জাহান ইব্রাহিম খানের মেয়ে। আপনি কিছুই করতে পারবেন না। চৌধুরী বাড়ির বি*ষাক্ত বাতাস জাহানের শরীরে কখনও লাগবে না। ওই বাড়ির বাতাসে বি*ষ আছে।
> ও চৌধুরী বাড়িতে ফিরবে কে বলেছে? আমরা অষ্ট্রেলিয়া চলে যাব। জাহান আমার সঙ্গে যাবে। এতোদিন তুমি ছিলে আজ থেকে আমি আছি। আমার মেয়েকে কিছুতেই আমি হাতছাড়া করবো না। তুমি আমার সঙ্গে যে অন্যায় করেছো জীবন থাকতে ভুলবো না। কিভাবে পারলে এমন করতে? আমার স্ত্রী সন্তানের উপরে কী আমার অধিকার ছিল না?
ভদ্রলোক বেশ চটে আছেন। ইব্রাহিম খানের মুখটা দেখার মতো হলো। জাহান কিছু বলবে তার আগেই আরিয়ান ভেতরে প্রবেশ করলো। বাইরে থেকে সব কথা ওর কানে এসেছে। সকলের মুখের দিকে চেয়ে বলল,
> ফিরোজ ভাইজানের কক্ষে এমন হৈচৈ করতে ডাক্তার নিষেধ করেছে। ইব্রাহিম আঙ্কেল আপনি ওকে নিয়ে বাইরে জান। আমি এদিকটা দেখছি।
জাহান আরিয়ানের দিকে তাকালো। লোকটার উপরে ওর সীমাহীন রাগ অভিমান জমা হয়ে আছে। যা সহজে কমবে না কিন্তু এই মূহুর্তে রাগ দেখানো বুদ্ধিমানের কাজ না। কথাটা ভেবেই ও বাইরে বেরিয়ে গেলো। আরিয়ান আজিম চৌধুরীর দিকে চেয়ে বলল,
> রাগারাগি না করে একটু ভেবে দেখুন,চৌধুরী বাড়ির মেয়েদের পরিণতি ঠিক কি হয়েছিল? আপনি কি চাইছেন জাহানের তেমন অবস্থা হোক? এমনিতে মেয়েটার উপরে বারবার আ*ক্রমণ হচ্ছে। দাদাজানের কোন পীর সাহেব যেনো বলেছিলেন চৌধুরী বাড়ির মেয়েদের উপরে অভিশাপ লেগেছে তাই বিয়ের উপযুক্ত হলে মা*রা যায়? এই মৃ*ত্যু কেউ আটকাতে পারবে না অথচ দেখুন জাহান আমার স্ত্রী। ওকে বিয়ে করেছি আমি বছর হতে চলেছে। এসব কেউ ইচ্ছে করে করছে বুঝেছেন? জাহান আমাকে বিয়ে করে এটাই সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। এবার মাথা খাটিয়ে চিন্তা করুন এহেন পাপ কোন নরপ*শুর দ্বারা হচ্ছে?
আরিয়ানের কথা শুনে কক্ষের মধ্যে থাকা প্রতিটা মানুষ নড়েচড়ে বসলো। ফিরোজের মা গুনগুন করে কান্না জুড়েছে। নয় বছর বয়সি মৃ*ত বাচ্চা মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ছে। সকলের প্রশ্ন এই কাজের সঙ্গে কে জড়িয়ে আছে আর তার উদ্দেশ্য কি?
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। আগেই বলেছি আমার চোখের অবস্থা ভালো না লিখতে অসুবিধা হচ্ছে। ঝাপসা দেখছি সঙ্গে যন্ত্রণা। অনেকেই বিরক্ত আমার উপরে। বলেছেন অনিয়ম করলে পাঠক হারাবো।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমি যদি অন্ধ হয়ে যায় তবে পাঠক দিয়ে কি করবো বলুন?