#দহন_দ্বিতীয়খন্ড
#পর্ব_০৪
অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে পেসেন্টের মাথায় রক্তক্ষরণ হয়ে স্ট্রোক করছে। আমি আগেই বলেছি পেসেন্টকে চাপমুক্ত রাখতে, এরপরেও আপনারা রোগীকে উত্তেজিত করেছেন। এই নিয়ে তিনবার হলো, জানিনা রোগী রিকোভার করতে পারবে কিনা। রিকোভার করলে মানসিক ভাবে সুস্থ হবে কিনা সব আল্লাহর কাছে। আল্লাহকে ডাকুন আপনারা। আমরা পেসেন্টকে সেবা দিই কিন্তু ঠিক করতে পারে একমাত্র উপর আল্লাহ।
” এইটা হতে পারেনা ডক্টর। আমি আবার আকাশকে সুস্থ অবস্থায় চাই। ঠিক আগের মতো, তার বিনিময়ে আপনার যা চাই সব পাবেন। আকাশ ছাড়া আমি মূল্যহীন। আকাশ আমার পৃথিবী। আমার পৃথিবীকে অন্ধকার করবেন না। আমার পৃথিবীর আলো ফিরিয়ে দিন ডক্টর। ”
” আমিতো বললাম সবটা আল্লাহর ইচ্ছে। সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো আমি। কিন্তু আমিতো একজন মানুষ। আর মানুষ কি মানুষকে ভালো করতে পারে। আমরা ডক্টর হয়েছি মানুষের সেবা করার জন্য। আল্লাহ
তালা সব কিছু করেন আমরা শুধু উচিলা। ”
” নীলা তোমাকে না বললাম আমার ছেলে মানসিক ভাবে অসুস্থ। আস্তে আস্তে সবটা তাকে আমরা জানাবো। কিন্তু তুমি আকাশের কথাগুলো হজম করতে পারলে না। আজকে তোমার জন্য আমার ছেলে তৃতীয়বারের মতো স্ট্রোক করলো। ”
” ম্যাডাম আপনারা তর্কে যাবেন না। আপনারা আল্লাহকে ডাকুন রক্ত জমাট বাধার কারণে মাথা কোনো কাজ করতেছে না। এরজন্য আগেই ওয়ার্নিং দিয়ে রাখছিলাম পেসেন্ট কে কোনো বিষয় তাড়াহুড়ো করবেন না। কিন্তু আপনারা তো নিয়মের মধ্যে রাখেন নাই। বলেছিলাম এইসব পেসেন্ট কে সময় দিয়ে ঠিক করতে হয়। কেউ কাউকে দোষারোপ করবেন না। সবটাই ভাগ্যর খেলা। আল্লাহ তালা আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নানাভাবে নেয়। তাই ভেঙে পড়বেন না। পেসেন্টের জন্য আল্লাহর কাছে দুহাত তুলেন। পেসেন্ট যেনো রিকোভার করে, কোমায় না যায়। ”
নীলা ডক্টরের কথা শুনে কেবিনের বাইরে হাটু গেড়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। রেহেনা শিকদার ওয়ালে হেলান দিয়ে লেপ্টে পড়ে। আশফাকুল রেহেনাকে ধরে নেয়। দিলার খান কাকতাড়ুয়ার মতো সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকে। দাদুকে নিয়ে আসেনাই কারন হার্টের পেসেন্ট কঠোর কথা সহ্য করতে পারেনা। ডক্টর কেবিনে ঢুকে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নাই। সবাই মা নিচু করে ভাবনার জগতে বিলীন হয়ে যায়। এমন সময় ডক্টর এসে বলে আপনাদের শক্ত থাকতে হবে। পেসেন্টের অপারেশন করাতে হবে। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু লাগতে পারে মানসিক ভাবে প্রিপেয়ার থাকেন আপনারা। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জটিল একটা সমস্যা। জমাটবাধা রক্তগুলো বের করতে হবে। নাহলে পেসেন্ট কে রিকোভার করাতে পারবো না। রক্ত যেকোনো মূহুর্তে লাগতে পারে। তাই O পজেটিভ ব্লাড সংগ্রহ করে রাখুন। পেসেন্টকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাচ্ছি। আল্লাহকে ডাকুন। ডক্টরের কথা শুনে সবাই সবার মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। এরপরে নীলা বলে ___
” আমি জানতাম না এরকম কিছু হবে। আমাকে মাফ করবা মা। বুঝতে পারিনাই আকাশ আমার অনুপস্থিতে এতোটা শক ছিলো। আমার জন্য যেহেতু এসব হইছে, আমি ঠিক করবো। আর O পজেটিভ ব্লাড আমার বাবার। ব্লাড লাগলে বাবা দিয়ো। আমি আসছি। ”
কেউ আর নীলাকে পিছন থেকে ডাকেনা। সবাই কেবিনে ঢুকে আল্লাহকে ডাকছে। নীলা নিরিবিলি একটা রুমে চলে আসে। অন্যদিকে আকাশের অপারেশন চলছে। নীলা অযু করে রুমের জানালা বন্ধ করে জায়নামাজ ফ্লোরে বিছায়। এরপরে নীলা আকাশের জন্য ২ রাকাআত নফল নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে আকাশের জন্য দুহাত তুলে ___
” হে আল্লাহ আপনি আমার স্বামীকে সুস্থ করে দেন। আমি বুঝতে পারি নাই আমার স্বামী আমার জন্য এই হাল করতে পারে। মানুষ টা আমাকে অনেক ভালোবাসে। মানুষটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবেন না। বাকি জীবন টা স্বামীর পদসেবা করার সুযোগ দেন আমাকে। আমার স্বামীকে আগের মতো সুস্থ জীবনে ফিরেয়ে আনেন। প্রত্যকটা নারীর কাছে স্বামী হলো অলংকার। আমার অলংকারকে কেড়ে নিবেন না। আমি আমার স্বামীর বুকে মাথা রেখে বাকি জীবনটা পার করে দিতে চাই। আপনার কাছেও যেতে চাই স্বামীর বুকে মাথা রেখে। আমি শুনেছি আপনার কাছে আপনার বান্দা হাত তুললে আপনি বান্দাকে শূন্য হাতে ফিরান না। আমাকেও ফিরাবেন না। আর কতো ধৈর্যের পরীক্ষা নিবেন আল্লাহ। আল্লাহ আমি নিরুপায়। স্বামী হলো ভালোবাসার পরশ পাথর। আমার পরশ পাথরকে ভেঙে দিবেন না। এই পৃথিবীতে আমার স্বামীর উপর আসা বিপদ আমার উপর দিয়ে দেন আল্লাহ। আমার প্রিয়কে এতোটাই ভালোবাসি যে তার আশা বিপদ হাসতে হাসতে স্বীকার করবো আমি। আপনি অসীম, আপনি দয়ালু,আপনি সর্বশক্তিমান, আমার ভালোবাসার মানুষটিকে সুস্থ জীবন দেন আল্লাহ । আমিন। ”
মোনাজাতে নীলা দুচোখ ভর্তি পানি ফেলে। নীলার চোখের পানিতে দুই গাল বেয়ে নীলার জামা ভিজে যায়। নীলা জায়নামাজ গুছিয়ে আবার কেবিনে কাছে আসে । যেয়ে দেখে অপারেশন এখনো চলছে। ডক্টর এখনো বাইরে আসেনাই। সবাই টেনশনে হাত পা আঁচড়া আঁচড়ি করতেছিলো। অপারেশন থিয়েটারের পাশে আশফাকুল পায়চারি করছিলো। এমন সময় নার্স এসে বলে আপনারা ব্লাড সংগ্রহ করছেন। পেসেন্টের অনেক ব্লাড ক্ষরণ হয়েছে। তাই তিন ব্যাগ ব্লাড লাগবে অপারেশন শুর হয়েছে। দ্রুত সংগ্রহ করুন। এই কথা বলে নার্স আবারো অপারেশন থিয়েটারে দৌড় দেয়। আশফাকুল খান কথা বলার সুযোগ পেলোনা।
আশফাকুল বলে নীলা মা আমিতো ১ ব্যাগ ব্লাড দিতে পারবো। এরচেয়ে বেশি দিতে পারবো না। বাকি ২ ব্যাগ ব্লাড কই পাবো আমরা। হসপিটালে খোঁজ নিয়ে দেখছি হসপিটালে এই ব্লাড নাই আজকে। আর তুমিতো জানো O পজেটিভ ব্লাড খুবই রেয়্যার ব্লাড এখন কি হবে?
” মা আমজাদ শিকদারের ব্লাড গ্রুপ কি? ”
” O পজেটিভ নীলা। ”
” তোমরা এখানে থাকো। আমি আমজাদ শিকদারকে আনার ব্যবস্থা করছি দ্রুত। ততক্ষণে অপারেশন শেষ হলে বাবা তুমি তোমার ব্লাড আমার জামাইকে ডোনেট করিয়ো। ”
” নীলা কোর্টে যেয়ে দ্রুত সাময়িক জেলছাড়পত্র নেওয়ার জন্য পিডিএফ তৈরি করে। পিডিএফ ফাইলে যথেষ্ট কারন দেখায়। কারণে বলা হয়েছে কয়েদীর বাড়ির লোক হসপিটালে অপারেশন থিয়েটারে। পেসেন্টকে দেখার জন্য আর্জি চেয়ে অনুরোধ পত্র। এসআই আরিয়ান কে কাগজটা দেয়। আরিয়ান সাহেব ওসিকে দেখিয়ে আবেদন পত্র মঞ্জুর করায়। এরপরে আরিয়ান সহ কয়েকজন পুলিশ আমজাদ শিকদারকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার রওনা হয়। আমজাদ শিকদার বলে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা। কিন্তু কোনো পুলিশ কিছু বলেনা আমজাদ শিকদারকে। আমজাদ শিকদার হসপিটালের কেবিনে বাইরে এসে অবাক হয়ে যায়। এরপরে সবটা জানতে পারে। রেহেনাকে প্রচুর গালি দেয়। রেহেনা কোনো কথা বলেনা আমজাদের সঙ্গে। চোখ বন্ধ করে শুধু আল্লাহকে ডাকে। আশফাকুলের রক্ত নেওয়া শেষ হলে আমজাদ শিকদারকে ব্লাড ডোনেট করার জন্য কেবিনে নিয়ে যায়। এরমধ্যে নার্স এসে বলে আরেকজন ডোনার কই? পেসেন্টকে দ্রুত রক্ত দিতে হবে নাহলে সবশেষ হয়ে যাবে।
” নীলা কেবিনের বাইরে এসে বলে নিয়ে এসেছি আরেকজন ডোনার কিছু হবেনা আমার স্বামীর। নার্স তৃতীয় ডোনারকে ভিতরে নিয়ে যায়। ”
” রেহেনা, দিলারা, আশফাকুল বলে কে ইনি নীলা? ”
” ইনি আমার দ্বিতীয় জীবন দাতা। নতুন করে ইনিই আমাকে পৃথিবী দেখাইছেন। তোমার পরে ইনিই আমার জীবনদাতা বাবা। এই মানুষটি আমাকে অগ্নিদহন থেকে বাচাইছে। এসব পরে বলা যাবে। আল্লাহকে ডাকো। আমার আকাশের যাতে কিছু নাহয়। আর তুমি দাড়িয়ে আছে কেনো? তুমি ব্লাড ডোনেট করেছে যেকোনো মূহুর্তে পড়ে যেতে পারো। বেডে শুয়ে থাকো বাবা। ”
” আমার কিছু হবেনা নীলা। প্রে ফর আকাশ। ”
আমজাদ শিকদার ব্লাড দিয়ে বাইরে আসে। রেহেনা আমজাদের দিকে দেখামাত্রই চোখ বন্ধ করে ফেলে। আমজাদ নীলাকে বলে আমার হাতে সময় কম জেলে যেতে হবে। আমি যে একজন জেলার মা। তুমি এখন আমার ছেলের শেষ ভরসা। প্রেয়সী তো আমার মুখ দেখতেও চায়না। তোমাদের অনেক ভালোবাসি মন থেকে। যত জঘন্যতম অপরাধ করিনা কেনো? তোমাদের জন্য ভালোবাসাটা সত্যি ছিলো। আসি নীলা। আশফাকুল ভাইয়া আমার ছেলেমেয়ে দুটিকে আমার অনুপস্থিতে বাবার মতো আগলে রাখিয়েন।
” আরিয়ান দাড়াও বাবাকে হ্যানকাপ পড়াতে হবেনা। বাবা এতোটাও জঘন্যতম না। আপনাকে বলছি বাবা খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে শিকদার বাড়িতে ফিরিয়ে আনবো আমি। আমাদের জন্য দোয়া করো।আর আমার উপর ভরসা রাখিয়ো। ”
নীলার কথা শুনে রেহেনা চোখ খুলে ফেলে। এসব কি বলছো নীলা। কোনো খুনির জায়গা বাড়িতে হয়না, ওদের জায়গা জেলখানায় হয়।
” আজকে কোনো কথা বাড়াতে চাইনা এখানে। আরিয়ান স্যার বাবাকে দেখে নিয়ে যাবেন। ওনি ব্লাড ডোনেট করেছে। ”
” হুম ম্যাডাম ঠিক আছে। ”
আমজাদ শিকদার পুলিশের গাড়িতে উঠার আগ মূহুর্ত পযন্ত পরিবারের ভালোবাসা গুলো উপলব্ধি করছিলো। মনে মনে বিশ্বাস করা শুরু করলো, আবারো নীলা তাদের সুখী পরিবার বানিয়ে তুলবে। এই বিশ্বাস, ছেলের জন্য দোয়া করে পুলিশ স্টেশনে চলে যায়।
” নার্স তৃতীয় ডোনারকে বাইরে নিয়ে আসে। এরপরে যারা যারা রক্ত দিছে তাদের কিছুদিন রেস্ট নিতে বললো। ভালোভালো ফলমূল খেতে বলে, এই কথা শেষ করেই ভিতরে চলে গেলো। ”
” আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো ভাইয়া। ধন্যবাদ দেওয়ার মতো ভাষা নেই। আপনি আমার দ্বিতীয় জীবনদাতা। সবসময় বিপদে এইভাবে আপনাকে পাশে পাবো কখনো ভাবি নাই। বড় ভাইয়ের ভালোবাসা গুলি বুঝি এমনি হয়। সবসময় নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে পেয়েছি আপনাকে। ”
” বড় ভাই বলছো আবার ধন্যবাদ দিচ্ছো। তোমাকে না বলছি আমি তোমার জয় ভাইয়া। ভাইদের কাছে সাহায্য নিতে এতো হেজিটেশন কেনো? ”
এমন সময় ডক্টর বাইরে এসে বলে আকাশের বাড়ির লোকদের বলছি। অপারেশন সাকসেসফুলি হয়েছে। পেসেন্টের জ্ঞান ফিরবে ১২ ঘন্টা পরে। এরআগে কিছু বলতে পারছি না। তবে পেসেন্ট রিকোভার করবে কোমায় যাওয়ার চান্স নেই। আল্লাহর কাছে হাত তুলুন সকলে।
চলবে,,,,
®️ রিয়া জান্নাত
[ সরি ফর লেইট আপলোড। আসলে আমার পার্সোনাল সমস্যা ছিলো। আপনারা যারা শুরু থেকে পড়েন গল্পটা। ভালো করেই জানেন আমি অনিয়মিত করি কিনা। কথা দিলাম যেগুলো পর্ব ২ দিনে মিস করেছেন পুষিয়ে দিবো। ]