#আবার_প্রেম_হোক
#নুসরাত_জাহান_মিম
৭৭.
“ব্যাস!ওখানেই থেমে যাও।আর এক পা ও এগুবেনা”
সবেমাত্রই বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে নিয়েছিলো প্রণয় কিন্তু তার বাবার উচ্চস্বরে বলা কঠিন বাক্যে ভেতরে দিতে নেওয়া ডান পা টা সেখানেই থেমে যায়।অতঃপর পা ফের বাহিরে নিয়ে কপাল কুচকে প্রণয় বলে,
“কিন্তু বাবা…..”
প্রণয়কে থামিয়ে দিয়ে তার বাবা তৌহিদুল চৌধুরী বলেন,
“তোমার মুখে বাবা ডাক শুনতেও আমার বিবেকে বাঁধছে”
অতঃপর সিড়ি দিয়ে নামতে নামতেই তিনি বলতে লাগলেন,
“কোন সাহসে তুমি আমার বাড়ির লক্ষ্মীকে অমন এক জায়গায় ফেলে এসেছো যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষেরাও কখনো পা পর্যন্ত রাখেনি?”
আবারও বাড়ির ভেতরে পা দিতে দিতে প্রণয় বলে,
“বাবা আমার কথাটা….”
“স্টপ!স্টপ দেয়ার।এক পা ও যদি তুমি এগিয়েছো তোমায় আমি ত্যাজ্যপুত্র করবো।এতবড় স্পর্ধা তোমার হলো কী করে?কোন স্পর্ধায় তুমি চাঁদ মামনিকে মিথ্যা অপবাদে আসামী দায়ের করেছো?ঘিনমান,লজ্জাবোধ একটুও কি নেই?বেরিয়ে যাও,এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।তোমায় এ বাড়িতে আর এক সেকেন্ডের জন্যও সহ্য করবোনা আমি”
“বাবা তুমি আমার কথা একবার শুনেতো দেখবে?”
“তোমার কোনো কথাই আমি শুনতে চাচ্ছিনা।আজ থেকে তোমার এ বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ করলাম আমি।আমার কথার খেলাপ কে করে তাও দেখে নেবো।তোমার এই অপরাধীপূর্ণ মুখ আমি আর দেখতে চাইনা।দূর হও,দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।ফের যেনো এ বাড়িতো দূর,বাড়ির ত্রিসীমানায়ও তোমায় আমি না দেখি”
কথাগুলো একদমে বলে ঘনঘন শ্বাস নেন তৌহিদুল চৌধুরী।
বাবার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে দৃষ্টি নত করেই ঘুরে দাঁড়ায় প্রণয়।আর সেভাবে থেকেই সে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিলে শুনতে পায় তার বাবার গম্ভীর কন্ঠস্বর,
“যদি কখনো চাঁদ মামনি তোমায় ক্ষমা করে কেবল সেদিনই তুমি আমার কাছ থেকে ক্ষমা পাবে।আর দুজনে যদি একসাথে ফিরতে পারো তবেই ফিরবে,এর আগে নয়।এবং!অবশ্যই সেটা হবে চাঁদ মামনির স্বেচ্ছায়।যদি সে তোমায় মনেপ্রাণে কোনো কলহ-বিবেদ ছাড়াই গ্রহণ করতে পারে এবং কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়া তবেই!”
বাবার কথা শেষ হওয়ার গুটি কয়েক সেকেন্ড বাদে প্রণয় বেশ ধীর গতিতে হাটা ধরে বাইরের দিকে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
ঘর্মাক্ত দেহ নিয়েই ছুটে এসেছেন চাঁদের বাবা ইহাদুল ইসলাম মেয়েকে একনজর দেখার জন্য।তিনি খবর পেয়েছেন কিছুক্ষণ পূর্বেই।হার্টের রোগী বলে তাকে কেউই কিছু জানায়নি প্রথমে।সবাই ভেবেছিলো জামিনের মাধ্যমে চাঁদকে ছাড়ানো যাবে তবে ইহাদুল ইসলাম টেলিভিশনের বিভিন্ন খবরের চ্যানেলের হেডলাইনসহ খবরের কাগজে দেখেছেন ‘২০০৮ সালের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আটানব্বই পেয়ে প্রথম হওয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের বর্তমান নিউরোলজি বিভাগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে তৎপর শিক্ষার্থী মুহাইমা বিনতে চাঁদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে এক বাচ্চাশিশুর এক্সিডেন্টে গতকাল তারই স্বামী ড.রুহায়ের প্রণয়সহ বাচ্চার বাবা-মা তার নামে মামলা দায়ের করে আটক করে গেছেন।এখনও কোনো রায় ঘোষিত হয়নি।সে কি নির্দোষ নাকি দোষী এখনও তা স্পষ্ট নয় তবে সকল প্রমাণই তার বিরুদ্ধে।কী হবে ইন্টার্ন ডাক্তার চাঁদের?তিনি কি আদোতে তার ডাক্তারী সম্পন্ন করতে পারবেন?নাকি এখানেই থমকে যাবে স্বপ্ন জয়ের পথ?’
দ্রুতগতিতে থানায় এসে বেশ হাপয়ে গেছেন তিনি।শ্বাস তার বেড়ে গেছে।মধ্যবয়স্ক দেখে জেলার তাকে চেয়ারে বসতে দিলে তিনি তাতে না বসেই জিজ্ঞেস করেন,
“আমার মা কোথায়?আমার চাঁদ মা?মুহাইমা বিনতে চাঁদ?তাকে কোথায় রাখা হয়েছে?আমি তার বাবা,তার সাথে দেখা করতে এসেছি”
গম্ভীরভাবে জেলার বিশ্বকুমার রায় বলেন,
“দেখুন আংকেল,আজ এমনিতেই অনেকজন আপনার মেয়ের সাথে দেখা করে গেছে।একইসাথে এতজনকে দেখা করতে দেয়ার অনুমতি আমাদের নেই,ক্ষমা করুন”
দু’হাত জোর করে চাঁদের বাবা বলেন,
“বাবাগো!একটাবার দেখা করতে দিন।মেয়েটার যে এ অবস্থা কেউই আমায় বলেনি।খবরে দেখে জেনেছি।দয়া করে অল্প একটুর জন্য দেখা করতে দিন স্যার”
জেলারের খানিক মায়া হয় ইহাদুল ইসলামের জন্য।তাই তাঁকে কেবল পাঁচ মিনিটের সময় দেয়া হয় চাঁদের সাথে দেখা করার জন্য।হাজতের সামনে এসে ভেতরে মেয়েকে কাত হয়ে শুয়ে থাকাবস্থায় দেখে তিনি ডেকে উঠেন,
“মা রে!”
বাবার এক ডাকে চাঁদ চট করে পিছু ঘুরে তাকায়।অতঃপর গায়ের চাদর সেখানে রেখেই দৌড়ে আসে বাবার দিকে এবং বলে,
“আব্বু?তুমি কেনো আসলে?আমি না সবাইকে….”
চাঁদকে ‘চুপ’ বলে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ইহাদুল ইসলাম কেবলই মেয়ের পানে তাকিয়ে থাকেন নির্নিমেষ।মেয়ের মলিন মুখশ্রী পানে তাকাতে তাকাতেই আঁখিদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়ে আসে তাঁর।তিনি বলেন,
“মা!মা রে আমার!আমায়….আমায় তুই মাফ করে দে রে মা।আমি যদি জানতাম তোর একদিন এই পরিস্থিতি দেখা লাগবে আমি কোনোদিনও সেদিন তোকে বিয়ের জন্য জোর করতাম না রে মা!আমায় তুই ক্ষম….”
বাবার দু’হাত শিকের বাইরে দিয়ে জাপটে ধরে চাঁদ ম্লান হেসে বলে,
“সবই নিয়তি আব্বু।আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছিলেন তাই হচ্ছে,হবে।সেসবে তোয়াক্কা করিনা।নিশ্চয়ই দুঃখের পরেই সুখ আছে”
“কবে আসবে তোর সুখ মা?আব্বুতো তোর সুখের জন্যই বিয়েটা দিয়েছিলাম কিন্তু….”
“সেসব নিয়ে ভেবোনাতো।আর আমার জন্য চিন্তাও করোনা।আমি অবশ্যই এখান থেকে বেরুবো।যেখানে তোমার মেয়ে কিছু করেইনি।সেখানে আল্লাহও তাকে শাস্তি দিতে পারেন না।আমি আমার আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখি”
প্রণয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এসেছে মসজিদে।এশার জামায়াত শুরু হওয়ার আর কয়েক মিনিটই বাকি।সে এসে মসজিদের কলপাড় থেকে ওযু করে শেষের সাড়িতে দাড়িয়েছে।প্রত্যেক রাকাআতে রাকাআতে সকলের হয়ে যাওয়ার পরেও কেবল প্রণয়ের সিজদাহ্ হতে উঠতে সময় লেগেছে।এবং বারংবার সে নাক টানছে।ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে।শেষ রাকাআতের শেষ সিজদাহ্ তে প্রণয় আর মাথা তুলে উঠেনি।একে একে সকলেই মোনাজাত ধরে চলে যাচ্ছে কিন্তু প্রণয় সেভাবেই আছে।কয়েকজন তাকে ডেকেছেও।কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে কেউ কেউ চলে গেছে তো কেউ ধাক্কাধাক্কি শুরু করেছে উঠানোর জন্য।কিন্তু প্রণয় আর উঠছেনা।ফলস্বরূপ সকলে ভয় পেয়ে যায়।কিছু লোক গিয়ে ইমাম সাহেবকে ডেকে আনে প্রণয়কে তোলার জন্য।ইমাম এসেও তাকে কিছুক্ষণ ধীরগতিতে ডাকেন।তবে প্রণয়ের সাড়া নেই।সে সেই যে সিজদাহরত হয়েছে আর একবারের জন্যও এদিক এদিক হয়নি,নড়চড় করেনি।কিন্তু ইমাম সাহেব প্রণয়ের পিঠের উঠানামা লক্ষ্য করে মৃদু হাসেন।অতঃপর তিনিও প্রণয়ের পাশে নামাজের ভঙ্গিমায় বসে চোখবুজে মোনাজাত ধরেন।এবং মনে মনে বলেন,
“হে আল্লাহ,ছেলেটা যেভাবে খাস নিয়তে,পবিত্র মন নিয়ে তোমার দরবারে হাজির হয়ে তোমার নিকটই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে তুমি তার সহায় হয়ো।তার মনোঃকামনা পূর্ণ করো।তার হৃদয়ের ক্ষ*তগুলো মুছে দিও।তার দুআ তুমি কবুল করো আল্লাহ।তোমার এই বান্দার কষ্টগুলো কেবল তুমিই উপশম করতে পারবে।তুমি ছাড়া যে তার আর কোনো ইলাহ নেই।তুমিই শ্রষ্ঠা,তুমিই প্রভু,তুমিই মাওলা,তুমিই সকল কিছুর মালিক।মুখ ফুটে কিছু বলার পূর্বেই যে বুঝে যেতে সক্ষম সে কেবলই তুমি।তোমার বান্দার মনের অবস্থা তুমি ছাড়া আর কে বুঝবে পরম করুনাময় আল্লাহ?ছেলেটার চোখের প্রতিটা অশ্রুবিন্দুর প্রতিদান তুমি দিও।ছেলেটাকে নিরাশ তুমি করোনা হে আল্লাহ!তার যাতনাগুলো দূর করার তৌফিক দান করো আল্লাহ।তাকে তুমি হেদায়েত দান করো।আমিন!”
অতঃপর ইমাম সাহেব চোখ খুলে ফের প্রণয়ের পানে তাকাতেই দেখতে পান এবার সে মোনাজাতরত অবস্থায় চোখবুজে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে।এক মুহুর্তের জন্যও বারিধারা থামছেনা।গাল বেয়ে চিবুক স্পর্শ করে টপটপ করে তা বুকের কাছেত দু’পাশেরই শার্টের অংশ ভিজিয়ে দিচ্ছে।ফর্সা মুখটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে।নাক আর চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে।চোখের পাপড়িগুলো পর্যন্ত ভিজে ঘন কালো হয়ে আছে।বেশকিছুক্ষণ সেভাবে থেকেই ঢোক গিলে দুই হাত মুখের কাছে নিয়ে মোনাজাত শেষ করে প্রণয়।অতঃপর চোখ খুলতেই আশেপাশে কয়েকজন সহ তারই বাম পাশস ইমাম সাহেবকে দেখে সে ভারী কন্ঠে মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলে,
“হুজুর আপনি?”
ইমামসাহেব বলেন,
“তোমার এত দুঃখ কেনো বাবা?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রণয় ভারী কন্ঠেই বলে,
“এ দুঃখ যে আমি নিজ হাতেই নিজের ঝোলায় নিয়েছি হুজুর”
“দুঃখের পরেই সুখ আসে এ কথা বিশ্বাস করোতো?”
“জ্বি হুজুর”
“সেটা আজীবন মনে রাখবে।কখনোই হতাশ হবেনা।আল্লাহ যা করেন অবশ্যই আমার,তোমার এবং সকলের ভালোর জন্যই করেন।সবকিছুর পেছনেই তাঁর এক মহান উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে”
দৃষ্টি মসজিদের টাইলসে রেখে প্রণয় বলে,
“তবে আমি এতই পাপ করেছি যে নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা,আল্লাহ কি আমায় ক্ষমা করবেন?”
“তুমি কি জানোনা?আল্লাহ বান্দার ক্ষমা চাওয়ার অপেক্ষা করেন?তাঁর বান্দা যতবার তাঁর নিকট পূর্ণ ইমানে ক্ষমা চাইবে তিনি তাঁর বান্দাকে ততবার ক্ষমা করবেন?অবশ্যই আল্লাহ তোমায় ক্ষমা করবেন।কেনোনা তিনি পরম দয়ালু,ক্ষমাশীল”
To be continued……