#আবার_প্রেম_হোক (২য় খন্ড)
#নুসরাত_জাহান_মিম
১৪.
সাড়ে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা চাঁদ।পেট তার আগের তুলনায় বেশ খানিকটাই ফুলে উঠেছে।দেহের ওজন তেমন একটা বাড়েনি তবে পূর্বের তুলনায় মাতৃত্বের ছোয়ায় ত্বক তার জ্বলজ্বল করে সর্বদা।সকলেই তার যত্ন নেয় অত্যাধিক।চৌধুরী বাড়ির বর্তমান পিড়ির প্রথম সন্তান,সেইসাথে বড় ছেলের ঘরের সন্তান একটু আদর যত্ন তো বেশি হবেই!কোনো কাজকর্মই চাঁদকে করতে দেয়া হয়না।করার মধ্যে কেবল হাসপাতালে যায়,নিজ কেবিনে বসে,টুকটাক রোগী দেখে তারপর চলে আসে।বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকায় নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে তার প্রিয় মানব।তার কথা অবশ্য ফেলেনি চাঁদ।ঘন্টা দু’য়েকের জন্য যায় আবার ফেরত আসে দ্রুতই।বেশি খারাপ লাগলে তার পূর্বেই চলে আসে।প্রণয়ের অনুপস্থিতিতে তাকে আনা নেওয়া করে তার ভাই চৈত্র এবং দেবর উজান।হাসপাতালে নিয়ে যায় দেবর আর বাসায় ফেরত দিয়ে যায় ভাই।বেশ ভাগ্য করেই এরূপ দু’টো পরিবার পেয়েছে চাঁদ।মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করে সে।নিত্যদিনকার ন্যায় আজও নাস্তা সেরে উজানের সহিত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে প্রস্তুত চাঁদ।এমতাবস্থায় তার শাশুড়ি পুষ্পিতা জামান হাতের খাবারের বক্স চাঁদের ব্যাগে ভরতে ভরতে বলেন,
“প্রণয় সাফ বলে দিয়েছে এই মাসের মধ্যেই যেনো ছুটি নাও তুমি”
“কিন্তু মা আমিতো বেশিক্ষণ থাকিনা।আর….”
চাঁদকে মাঝপথে থামিয়ে পুষ্পিতা জামানই বলেন,
“সেটা তোমার আর প্রণয়ের ব্যাপার।আমায় বলতে বলেছে বলে দিলাম।দেখা করে এসো আসার সময়।আর তোমার খাবারের বাটির সাথেই জর্দা রেখেছি।বেশ পছন্দ করে সে”
চাঁদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরকন্ঠে আওড়ায়,
“ঠিক আছে মা।চলো উজান”
“ওকে ভাব্জ!আসো”
অতঃপর দেবর-ভাবি গাড়িতে বসতে বসতেই উজান উৎফুল্লতার সহিত চাঁদকে বলে,
“আ’ম সো মাচ এক্সাইটেড ভাবি!চ্যাম্পকে বলবে জলদি আমার কাছে আসতে”
গাড়ির দরজা আটকে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে চাঁদ প্রশ্ন করে,
“চ্যাম্প?”
চাঁদের পানে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কপাল কুচকে রেখেই উজান বলে,
“আমার ভাতিজা,তোমার ছেলে”
উজানের কথায় খানিক হাসে চাঁদ।অতঃপর উজান গাড়ি স্টার্ট করতেই তার পানে চেয়ে বলে,
“ছেলে হবে তুমি জানো?তোমার ভাইতো পুতুল পুতুল করে অস্থির প্রায়!”
“ছেলেদের তো বাচ্চা হিসেবে মেয়েই পছন্দ কিন্তু আমি চাই ছেলে হোক।আসলে দেখতে চাই ছেলে হলে ঠিক কার মতো হয়!ভাইয়ার মতো হলেতো সেকেন্ড প্রণয়।আর তোমার ন্যায় হলে চাঁদের মেল ভার্সন!”
উজানের কথা শুনে এপ্রোণের উপর দিয়েই নিজের পেটে হাত রেখে চাঁদ বলে,
“দেখেছো সোনা?তোমার চাচ্চু কী ফন্দি এটেছে?তাকে বলো,সে যেনো কার্য চালায় উজানের ফিমেল ভার্সন উৎপাদনে।বিয়ের দিকে যেহেতু এত ফাস্ট সবদিকেই চাচ্চুর ফাস্ট হওয়া উচিত তাইনা আম্মু?”
কপাল মাত্রাতিরিক্ত কুচকে গাড়ি চালাতে চালাতেই উজান বলে,
“তোর মা কি ভুলে গেছে চ্যাম্প?বিয়েটা যে সেই নিজ দায়িত্বে দিয়েছিলো?তোর চাচ্চু বিয়ের জন্য এত ডেস্পারেট ছিলো নাকি?জিজ্ঞেস কর তো মা কে”
প্রসঙ্গ এড়িয়ে চাঁদ উজানকে বলে,
“শোনো,হাসপাতালের দিকে গাড়ি না নিয়ে কলেজ সাইডে যেয়ো তো”
“কেন ভাবি?”
“একটু কাজ ছিলো”
উজানের প্রশ্ন,
“রিদির সাথে?”
চাঁদ হ্যা সূচক জবাব দিতেই উজান বলে,
“এতখানি পথ হেটে কলেজে যাওয়ার দরকার নেই।আমিই রিদিকে বলবো তোমার কেবিনে দেখা করতে”
“আমি যেতে পারবো সমস্যা নেই।তাছাড়া আমিতো আর উপরে উঠছিনা।রিদুকে বলবো ক্যান্টিন অথবা ক্যাম্পাসে আসতে”
“অত লাগবেনা!যা বলেছি তাই হবে”
দেবরের পানে চেয়ে মনে মনে মৃদু হাসে চাঁদ।তার শ্বশুরবাড়ির কেউই তাকে বউ হিসেবে কম,নিজ বাড়ির মেয়ে হিসেবেই দেখে সর্বদা।এই যে এখন উজান ছেলেটাও ভাবির তুলনায় বড় বোনরূপেই চাঁদের যত্ন নিতে এক দন্ড কমতি করছেনা!পাছে প্রণয়ের গম্ভীরতার তোপে পড়ে?নাকি নিজ হৃদয় হতেই তাদের নিংড়ানো এই ভালোবাসা?চাঁদের মন দ্বিতীয় উত্তরেই বেশ সন্তুষ্ট!দেবর ননদদের মাত্রাতিরিক্ত সেও ভালোবাসে।ঠিক নিজ ছোট ভাইবোনের ন্যায়।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
চাঁদের ব্যাপারে আলোচনা করতেই লাঞ্চ টাইমে হাজির হয়েছে চৈত্র বোনের হাসপাতালে,রিহার কেবিনের সামনে।অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কুশল বিনিময় করে চৈত্রকে বসতে বলে রিহা।অতঃপর চৈত্র চেয়ারে বসতে বসতেই বলে,
“আসলে গতকালই প্রণয়ের সাথে কথা হলো।সে চাচ্ছে চাঁদ যেনো দ্রুতই হাসপাতাল থেকে ছুটি নেয়।কিন্তু চাঁদ আবার কয়েকদিন হাসপাতালেই কাটাতে চায়।ও ভাবছে এখানে যতবেশি সময় থাকবে বাচ্চা হওয়ার পর তখন বাড়িতে থাকার যথেষ্ট সময় বেশি পাবে।তো ওর কন্ডিশনটা কীরকম?মানে কোনটা করলে বেটার হয়?প্রণয় বেশ চিন্তিত।সাধারণত বাচ্চা হলে মেয়েরা মোটা হয়,ওজন বাড়ে।চাঁদ আগের ন্যায়ই আছে বলে প্রণয় একটু বেশিই ভাবছে সেটা নিয়ে”
রিহা মৃদু হেসে চৈত্রের দিকে রিপোর্ট এগিয়ে দিতে দিতে বলে,
“হাজবেন্ড হিসেবে ভাবাটাই স্বাভাবিক।কিন্তু অনেক কেসেই অনেক মায়ের ওজন তেমন একটা বাড়েনা।এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।ওজন যে বাড়তেই হবে বিষয়টা তেমন না।হয়তো চাঁদের বানই এমন।আমি প্রণয়ের সাথে কথা বলবো,চিন্তা করবেন না”
“কিন্তু রিহা চাঁদের পেটও তো আহামরি ফোলা না!মানে আমি বুঝাচ্ছি যে…..”
চৈত্রের কথায় খানিক হেসে দিয়েই রিহা বলে,
“যথেষ্ট ফোলা চৈত্র।আর সবে চাঁদের সাড়ে ছয় মাস চলে।সাত-আট মাসে গেলে আরও ফুলবে।শুধু শুধুই চিন্তা করছেন আপনারা।চাঁদকে নিয়ে আমাদের যেই টেনশন ছিলো সেগুলো এখন আর নেই।রিপোর্টে সবকিছু এভারেজ।কোনো ক্রিটিকাল সমস্যা নেই”
“তাহলে চাঁদকে কি হাসপাতাল থেকে ছুটি পরে নিতে বলবো?”
“আরও কয়েকদিন যাক চাঁদের যখন ইচ্ছে হয় নিতে পারবে।আহামরি সমস্যা তো নেই”
রিপোর্ট হাতে নিয়ে চেয়ার ছাড়তে ছাড়তেই চৈত্র বলে,
“আচ্ছা উঠি তবে।ভালো থাকবেন”
চৈত্র উঠে চলে যেতে নিলেই রিহা তাকে পিছু ডাকে,
“চৈত্র?”
চৈত্র ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় তার পানে।অতঃপর রিহা ইতস্তত করছে দেখে চৈত্র ফের চেয়ারে বসে বলে,
“বলুন,শুনছি আমি”
রিহা কোনোকিছু বলার পূর্বেই এদিকওদিক চেয়ে ঘামছে বলে কপাল খানিক কুচকায় চৈত্রের।অতঃপর শান্তস্বরে বলে,
“আমি কিন্তু বাঘও না ভাল্লুকও না।ভয় পাচ্ছেন কেনো?নির্দ্বিধায় বলুন,ভয় পাবেন না”
টিস্যু দিয়ে ডান পাশে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রিহা মেকি হেসে বলে,
“না আসলে আপনি কী না কী মনে করবেন!”
“মনে করার হলে অবশ্যই করবো।বলুন আপনি”
এ কথা শুনে আর কোনোকিছু বলার সাহস হয়না রিহার।সে আমতা আমতা করে বলে,
“না আসলে……আসলে…..”
এবারে বেশ গম্ভীরভাবে ভারী কন্ঠে চৈত্র শুধায়,
“সময় অপচয় আমি বেশ অপছন্দ করি রিহা।আপনার মতো ম্যাচিওর মেয়ের কাছে এরকম কিছুর আশা আমি করছি না।যা বলার ঝটপট বলুন।অফিস আছে আমার”
চোখ খিচে দুই হাত মুঠো করে কাচের ডেস্কের উপর টানটান করে বেশ দ্রুতই রিহা বলে,
“আসলে…..আসলে….আপনি কি আমার সাথে বেরুবেন?”
তৎক্ষণাৎ পাল্টা প্রশ্ন চৈত্রের,
“কোথায়?”
এবারে আরও ঘাবড়ায় রিহা।ডান পাশে চেয়ে গালের ঘাম হাত দিয়ে মুছে নাকে আঙুল ঘষতে ঘষতে ঢোক গিলে ইতস্তত করে দৃষ্টি এলোমেলো করেই বলে,
“আসলে….মানে….আসলে আরকি ঐ যে….. ”
চেয়ার থেকে উঠে গম্ভীরস্বরে যেতে যেতে চৈত্র বলে,
“ভেবে দেখবো”
চৈত্রের জবাবে চোখজোড়া বড় বড় হয় রিহার।শ্বাস তার থমকায়।এক দৃষ্টিতে চৈত্রের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয় সে।যখনই চৈত্র দরজার হাতল ঘুড়িয়ে কেবিনের বাইরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।ছুটে আসে রিহা।দৌড়েই দরজা খুলে চৈত্রের যাওয়ার পানে চেয়ে খানিক উচ্চস্বরেই প্রশ্ন করে,
“সত্যি সত্যি যাবেন আমার সাথে আপনি?”
চৈত্র কোনোকিছু বলেনা,পিছু ঘুরেও চায়না।হাটার গতিও থামায় না।সেভাবেই চলতে চলতে মৃদু ঠোট বাকায়।এরকম ম্যাচিওর ডাক্তার মেয়ের বাচ্চামো স্বভাবে হেসে ফেলে চৈত্র।কন্ঠনালি কাপে খানিক।চোখজোড়া বন্ধ হয়,বাম পাশের গাল খানিক ফুলে উঠে তার।চোখের পলকে নিজেকে স্বাভাবিক করে।তবে মুখে হাসি এখনো বহাল তার।সেভাবেই সে বেরুতে নিলে কপাল কুচকে তার পানে চেয়ে থাকে রিদি।সে এসেছিলো চাঁদের সাথে তার কেবিনে দেখা করতে।তার পূর্বে রিহার সাথে কিছু কাজ ছিলো।সেজন্যই এখানটায় আসা।তবে এরকম কিছুর সম্মুখীন সে হবে ভাবেনি।নিজে থেকেই চৈত্রকে সালাম দিয়ে প্রশ্ন করে রিদি,
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
সালামের জবাব নিয়ে চৈত্র বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ।তোমরা কেমন আছো?মিরের সাথে আজকাল দেখা হয়না।কোথায় থাকে সে?”
বেশ ভদ্রতার সহিত মুচকি হেসে রিদি জবাবে বলে,
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া।মির এইতো হাসপাতাল,রোগী এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে।তাছাড়া মানে…..আজকাল আমার পড়াশুনা নিয়েও খানিক ব্যস্ত থাকা পড়ে।টিউটর রাখা হয়নি তো।সেই পড়ায় আমাকে।তো আরকি মানে….”
রিদিকে থামিয়ে চৈত্র বলে,
“আচ্ছা বুঝেছি”
ইতস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলে রিদি,
“কিন্তু ভাইয়া আপনি এখানে?”
“আমি ঐ চাঁদের রিপোর্টের জন্য এসেছিলাম।আচ্ছা আসি,ভালো থেকো”
চৈত্রের যাওয়ার পানে কপাল কুচকে চেয়ে থাকে রিদি।কিছু জিনিসের হিসাব কষে সে।অতঃপর রিহার সাথে দেখা সাক্ষাৎ শেষে নিউরোলজি বিভাগের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।ভাবির কেবিনের কাছে এসে নক করতেই ভেতর থেকে চাঁদের চিকন কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
“আসুন”
ভেতরে ঢুকে দরজা আটকাতে আটকাতে রিদি বলে,
“ভাবি আমি”
“আসো,বসো”
রিদি বসতেই চাঁদ প্রশ্ন করে,
“কী খাবে?খেয়েছো কিছু?”
“ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নেবো ভাবি।তুমি বলো কোনো সমস্যা?উজান ভাইয়া আসতে বললো”
“হ্যা,দরকার তো ছিলো।তুমি কি ব্যস্ত?”
“না।এখন তো লাঞ্চ টাইম”
“আমার সাথে খাও আর একটু হেল্প করো”
“কী হেল্প ভাবি?”
“আমি খাবার বাড়ছি।ততক্ষণে তুমি আমার জন্য একটা এপ্লিকেশন লেখো”
কপাল সামান্য কুঞ্চিত করে রিদি প্রশ্ন করে,
“কীসের এপ্লিকেশন ভাবি?”
“মাতৃত্বকালীন ছুটির”
খানিক হেসে রিদি বলে,
“ও আচ্ছা তাহলে শেষমেশ ছুটি নিচ্ছো?”
“হ্যা।ভাবলাম বাকি মাসগুলো বাড়িতেই কাটাই।তোমার ভাইতো বেশ চিন্তিত থাকে”
“চিন্তা তো করবেই ভাবি”
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
অরণের অবস্থা এখন আগের তুলনায় বেশ ভালো।মাথার ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে দিন কয়েক পূর্বেই।তবে তাকে চিন্তা মুক্ত থাকার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে চাঁদ।ফায়ান যথেষ্ট চোখে চোখে রাখে তাকে।এখনো অরণকে নিয়ে তাদের বেশ চিন্তা।কখন কে কোথা থেকে ছেলেটার ক্ষ*তি করতে ওঁৎ পেতে রয়েছে জানা নেই কারোরই।সেজন্যই বেশ সাবধানে থাকতে হয় তাকে।কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা শেষে তার ইন্টার্নির প্রসেস ফের শুরু করা হয়েছে।বর্তমানে তার পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন চলছে।আগের ন্যায়ই কার্ডিওলজি বিভাগেই অধ্যয়নরত সে।ধীরে ধীরে মস্তকে কেশরাজির আগমণে অরণ তার মাথায় ক্যাপ পরিধান করে।নাহয় মাথায় বিদ্যমান হালকা চুলের দরুন বেশ বাজে লাগে দেখতে নিজের কাছে নিজেকেই!কাধে ব্যাগ নিয়ে আপনমণেই ক্লাস থেকে হেটে ক্যাম্পাসে বসেছে সে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে।পুরো কলেজ জুড়েই তার এবং বন্ধুমহলের স্মৃতি জড়িত।যেখানে চায় সেখানেই সে নিজেদের কৈশোর হতে নব্য যৌবনকালের হাজারো স্মৃতি দৃশ্যপটে ভাসতে দেখে।কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে দাঁড়ায় অরণ।যেতে নিলেই এক মেয়েলি কন্ঠস্বর কানে ভাসে তার,
“আপনাকেতো কখনো ক্লাসে দেখিনি?”
গম্ভীরকন্ঠে অরণ শুধায়,
“ক্লাসেই ছিলাম খেয়াল করেন নি”
ইতস্তত করে মেয়েটা বলে,
“না মানে বিগত বছরের ক্লাসগুলোয়”
“ও,আমি বেশ পুরোনো ছাত্র।আপনার সিনিয়র।পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করছি কেবল”
বলে যেতে নিলেই মেয়েটা প্রশ্ন করে,
“ব্যাচ?”
“দশ”
অরণের জবাবে মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয় মেয়েটা।সামনে থাকা ছেলেটা যথেষ্ট সিনিয়র তার।তবে হাবভাব,চালচলন,চেহারার আদলে এইটুকু বোঝার সাধ্যি নেই যে সে তার এতটা বড় হবে।তবে নিজের কৌতুহল দমিয়ে অরণকে ফের প্রশ্ন করে মেয়েটা,
“নাম কী আপনার?”
এবারে অরণ বিরক্ত হয়।এত কথা তার পছন্দ নয়।যদিও সে প্রণয়ের ন্যায় মেয়ে এলা!র্জে!টিক নয় তবে এবারে চাপা ক্ষো*ভ হয় মনে।মেয়েগুলো কি আসলেই গায়ে পড়া স্বভাবের হয়?প্রশ্নখানা মনে আসতেই পরক্ষণে ভাবে সবাইতো এক না!অযথা এসব ভাবা অনুচিত।তাই সে নিজ ভাবনাকে পাশে রেখে অতি গম্ভীরস্বরে সামনে এগুতে এগুতে বলে,
“নট ইন্টারেস্টেড টু টক,সরি” [দুঃখিত,কথা বলতে ইচ্ছুক নই]
অতঃপর ব্যাগসহই হেটে হাসপাতাল প্রাঙ্গনে আসে।এসেই খোঁজ নেয় চাঁদের।চাঁদকে না পেয়ে রিহার কাছে গেলে তাকেও সে পায়না।অতঃপর মিরের কেবিনে ঢুকে।সেখানেও সে মিরকে পায়না।রবিনকে খুঁজেও পাবেনা,কেনোনা এতক্ষণে সে টেকনাফের পথে রওয়ানা হয়েছে পরিবার সমেত।অগ্যতা মিরার কেবিনের দিকেই এগুতে হয় তার।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও পা জোড়া চালিয়ে নিচ্ছে সে।তার জানা প্রয়োজন একসাথে সকলে কোথায় গায়েব হয়েছে।সুস্থ হওয়ার পর থেকেই মিরাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে অরণ।দরকার ছাড়া তেমন একটা কথা বলেনা।মেয়েটা চেষ্টা করলে এমনভাবে এড়িয়ে চলে যেনো তার কোনো অস্তিত্বই অরণের জীবনে কখনো ছিলোনা।রোজ রোজ একই ব্যবহারে তিষ্ট হয়ে হাল ছাড়ে মিরা।প্রতিনিয়ত অপমানিত হওয়া তার ব্যক্তিত্ব বহির্ভূত।অরণের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলে।নিজেও এড়ায় তাকে।তবে আজ নিজ কেবিনের বাইরে অরণকে দেখে হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ে মিরার।আজও ছেলেটাকে দেখলে নিজ হৃদয়ের ভারসাম্য হারায় মেয়েটা।মস্তিষ্ক নড়বড়ে হয় তার।তবুও নিজেকে সামলে হাতের রিপোর্টের দিকে নজরাবন্দী করে দৃষ্টি।অরণ কোনোকিছু না বলে ভেতরে ঢুকে চেয়ার টানতে গেলেই গম্ভীরস্বরে কাগজপানে দৃষ্টি রেখেই মিরা বলে,
“ভদ্রলোকের ভদ্র ব্যবহার লুক্কায়িত তার সুমিষ্ট আচাড়ে মি.অরণ”
মিরার কথায় ভড়কানো দৃষ্টিতে মেয়েটাতে আবদ্ধ করে নজর অরণ।এবং আড়চোখে মিরাও চায় তার পানে।তৎক্ষনাৎ নজরে আসে অরণের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃষ্টিতে ঝ!লসে যায় মিরার চিত্ত!তবুও নিজেকে সামলায় সে।আগেও কখনো বিন্দুমাত্র অরণকে বুঝতে দেয়নি তাকে ভালোবাসে,কস্মিনকালেও দেবে না।অরণ মিরার পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই স্মরণে আসে কিছু গরমিল।অতঃপর বাইরে গিয়ে দরজায় নক করে গম্ভীরস্বরে শুধায়,
“মে আয় কাম ইন ডক্টর মিরা?” [আমি কি ভেতরে আসতে পারি ডাক্তার মিরা?]
কানে আসে চিকনস্বরের জবাব,
“কাম”
অতঃপর অরণ ভেতরে আসতেই মিরা বলে,
“সিট”
অরণ চুপচাপ বসতেই অপরিচিতের ন্যায় মিরা প্রশ্ন করে,
“হাউ ক্যান আয় হেল্প ইউ?” [আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?]
অরণও গম্ভীরস্বরে বলে,
“অপরিচিতের মতো ব্যবহার করছিস”
“অপরিচিতদের সাথে অপরিচিতের ন্যায়ই ব্যবহার করে সকলে।আমি তার ব্যতিক্রম নই”
“ওহ আই সি?আপাতত ডক্টর রিহা,চাঁদ আর মিরের ব্যাপারে জানতেই আপনার কাছে আসা”
মিরার তিক্ত কন্ঠস্বর,
“কেনো?আমি কি তাদের জিম্মা নিয়ে রেখেছি?নাকি আমি কোনো ডিটেকটিভ যে চাইলেন আর আমি লোকজন সম্পর্কে ইনফরমেশন দিলাম?”
অরণের আফসোস সুর,
“ঠিকঠাকভাবে রিভেঞ্জও নিতে শিখলি না!”
“আমি কি আপনার মশকরার পাত্রী যে যাচ্ছেতাই বলবেন?”
“স্টপ এক্টিং লাইক স্ট্রেঞ্জার্স!” [অপরিচিতদের ন্যায় ব্যবহার বন্ধ কর!]
“হু দি হেল আর ইউ টু স্টপিং মি?” [আমাকে চুপ করানোর আপনি কে?]
“ওয়ানা সি?” [দেখতে চান?]
অতঃপর চেয়ার ছেড়ে দ্রুত মিরার পাশে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীরকন্ঠে অরণ বলে,
“চুপচাপ সাথে চল নাহয় আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা”
তৎক্ষনাৎ মিরার জবাব,
“আপনার চেয়ে খারাপ আর কেউ হতেও পারেনা!আমি কারো সাথে কোথাও যাবোনা।ইউ মে গো নাও,লিভ”
এবারে অরণের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়।মিরার ডেস্কে হালকা ঘুষি নিক্ষেপ করে মিরার পেছন বরাবর দাঁড়িয়ে আলতো ঝুঁকে ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে কানের কাছে ফিসফিসায় সে,
“আমার রাগ সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়াই নেই।আমাকে অযথা না রাগিয়ে চুপচাপ সাথে চল আদারওয়াইজ তোকে কোলে করে নিয়ে বেরুতে আমি বাধ্য হবো।ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট সাচ ডিজগাস্টিংস দেন জাস্ট কাম আফটার মি অ্যান্ড কিপ কুয়াইট ফর আ হোয়াইল”
অতঃপর অরণের ফিসফিসিয়ে ঠোট নাড়ানোর স্পর্শে সর্বাঙ্গ শিউরায় মিরার।দ্রুতগতিতে সে চেয়ার ছেড়ে দাড়াতেই হাতের কব্জি চেপে তাকে নিয়ে হনহনিয়ে পা বাড়ায় অরণ।ধীরগতিতে মিরা হাটতে গেলে হাতের শক্তি দ্বিগুন করে টানতে লাগে মেয়েটাকে।দাঁতে দাঁত চেপে অরণের পানে পলকহীন চায় মিরা।যতই নিজেকে কঠোর উপস্থিত করুক না কেন অরণের এই রূপের সাথে কখনোই তার সাক্ষাৎ হয়নি।ছেলেটাকে এই পর্যন্ত কখনোই রাগতে অথবা উগ্র আচরণ করতে সে দেখেনি।এই যেনো প্রথম।অতঃপর নজরে আসে চশমা পরহিত সহজ সরল ছেলেটার শুভ্ররঙা মুখশ্রী ধীরে ধীরে হালকা লালচে আভায় পরিণত হচ্ছে।কপাল এবং চোখের দুইপাশ ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে।নাকটাও কি লালচে দেখাচ্ছে?বারংবার দাঁত খিচছে এবং শ্বাস নিচ্ছে অরণ।অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই ছেলেটার ঘাড়ের পানে নজর যায় মিরার।তৎক্ষনাৎ সরাতে চাইলে নজরে আসে সেখানেও লাল বর্ণ ধারণ করেছে,ঘাড়ের রগ ফুলে একটু একটু করে লাফাচ্ছে।অতঃপর মিরা বুঝতে পারে ছেলেটাকে সে মাত্রাতিরিক্ত রাগিয়ে দিয়েছে।এবং এও মানতে বাধ্য হয় সহজ সরল মানুষ সহজে রাগেনা,একদমই রাগেনা।তবে একবার রেগে গেলে ভয়ংকররকম রাগে!এবং তাদের থামানো অতটা সহজও হয়না।এবারে মিরার ভয় হয়।এমনিতেই ছেলেটা তাকে এড়িয়ে চলে।হয়তো জেনে গিয়েছে তার মনের সুপ্ত কথা এজন্যই হয়তো এরকম আচরণ তার প্রতি।বুক ভার হয় মিরার।যা কস্মিনকালেও সে চায়নি,যা হওয়ার ভয়ে সর্বদা তার সুপ্ত অনুভূতি সুপ্তই রেখেছে তাই হচ্ছে তার সনে।সে জানে অরণ কখনোই তাকে বন্ধু ব্যতীত অন্য কোনো নজরে দেখেনি,দেখতে চাইতে পারেওনা।তবুও বেহায়া মন একটুক্ষণের জন্য চেয়েছিলো ছেলেটা তাকে নিয়ে ভাবুক!একটু না হলেও অল্প একটুই ভাবুক?কিন্তু সে ভুল ছিলো।ভালোবাসাতো ভোলা যায়না,প্রথম ভালোবাসাতো একদমই যায়না।হোক তা একপাক্ষিকই অথবা দুইপাক্ষিক।তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণতো সে নিজেই!সে কি পেরেছিলো অরণকে ভুলতে?তাকে ভুলে অন্য কাউকে ভালোবাসতে?কতজনই তো তাকে চেয়েছিলো তবে সে তো পারেনি অরণ নামক সহজ সরল এই পুরুষটাকে ভালোবাসা ছাড়তে।এখনো তো পারেনা।হয়তো কখনো সম্ভব না।তাহলে কী করেইবা সে অরণের থেকে আশা করতে পারে পূর্ণতাকে সে ভালোবাসবেনা?ভালোবাসা ছেড়ে দেবে?ছেড়ে তাকে ভালোবাসবে?নিজের ভাবনায় নিজেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মিরা।অতঃপর অরণের সহিত তাদের কলেজে থাকাকালীন সময়ের নিরিবিলি আড্ডাস্থলে আসতেই ধ্যান ভাঙে তার।চোখ খানিক জ্বলছে।তবে নিজেকে সামলায় সে।অরণ তাকে তার ডানপাশে দাড় করায়।এখনো মিরার কব্জিতে হাত স্থির তার।ছাড়েনি এক মুহূর্তের জন্যও।মিরাও আর চেষ্টা করেনি ছাড়ানোর।ঠাই দাঁড়িয়ে রয় সে।অরণ সেভাবে থেকেই নিজ রাগ দমনের চেষ্টায় মত্ত।অতঃপর শীতলস্বরে প্রশ্ন করে,
“সবকিছুর সোজা সোজা জবাব চাই।একটু ত্যাড়াবাকা হলেই আমি ভুলে যাবো তুই আমার বান্ধবী”
মিরা কিছু বলেনা চুপ করে থাকে।অগ্যতা অরণই প্রশ্ন করে,
“ওরা কোথায়?”
“আমি কী করে জানবো?”
মিরার কথা শুনে বিস্ফোরিত নয়নে তার পানে অরণ চাইতেই অপরপাশে ঘাড় বাকায় মিরা।অতঃপর বলে,
“রিহু আর চাঁদ কোথায় গেছে জানিনা।মির এমন সময় টিউশনে থাকে”
নিজেকে শান্ত করে অরণ বলে,
“এই কথাটা তখন বলা যেতো না?”
ক্ষু*ব্ধ নয়নে অরণের পানে চেয়ে মিরা বলে,
“না যেতো না!হাত ছাড়ুন আমার।কাজ আছে”
“হাত কে*টে নিজের সাথে নিয়ে যাবো,চুপচাপ দাড়া”
“আমার সাথে সখ্যতার জন্যতো আর আপনি আমায় ডাকেননি।যা বলার ছিলো বলে দিয়েছি।আয় ওয়ানা গো নাও”
“বাট আয় ওন্ট অ্যালো।সো স্টে কুয়াইট অ্যান্ড লিসেন” [কিন্তু আমি তা মেনে নেবোনা।তাই চুপচাপ থাকুন আর শুনুন]
অতঃপর ফের মিরাকে চুপ দেখে কপাল কুচকে আড়চোখে চায় তার পানে অরণ।এক্সট্রোভার্ট মেয়েটাকে ইন্ট্রোভার্টরূপে অপছন্দ হচ্ছে অরণের।তবুও সে বলে,
“রবিন টেকনাফ গিয়েছে।অমৃতা ভাবিদের বাসায়।বিয়ের ব্যাপার স্যাপার পাকা করতে জানিস কিছু?”
“সবাইতো আর অপরিচিত নয় যে কোনোকিছুই জানাবেনা।পরিচিতরা জিনিসপত্র অবশ্যই জানায়।তাই জানারই কথা”
মিরার ত্যাড়া বাক্যসমূহ একটুও পছন্দ হচ্ছেনা অরণের।নাসারন্ধ্র প্রসারিত করে কব্জি ছেড়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মিরার দুই বাহুতে হাত রেখে গর্জে উঠে অরণ,
“সমস্যা কী তোর?”
এবারে নিরবতা ভাঙে মিরা।নিজের মিথ্যা খোলস থেকে বেরিয়ে আসে সে।বাহুতে চাপ অনুভব সত্ত্বেও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
“সমস্যা আমার না।সমস্যা হয়তো তোর।ঠিক কোন কারণে আমায় তুই এড়িয়ে চলিস ব্যাস এইটুকু জানতে চাচ্ছি।যদি মনে হয় সত্যিই এড়িয়ে চলাটাই সঠিক আমি কথা দিচ্ছি তোর ত্রিসীমানায় কখনো আসবোনা”
আকস্মিক বুকের মাঝে জ্বলন অনুভব হয় অরণের।ধক করে বুকের ভেতর।চিত্ত চে!ড়ার যাতনা অনুভূত হয় হৃদয়ে।প্রসঙ্গ এড়াতে অরণ বলে,
“সবার কথাই শুনেছি তবে রিহা আর পূর্ণ তো একই ডিপার্টমেন্টের।পূর্ণ কোথায়?”
ফের পূর্ণ!রাগ হয়না মিরার।দুঃখ বাড়ে।হৃদয় যাতনার সাগরে ভাসে।আকস্মিক প্রশ্ন করে সে,
“এখনো ভালোবাসিস পূর্ণকে?”
To be continued……
[বিঃদ্রঃ১ম খন্ডের সমাপ্তির সময় বলেছিলাম দশ পর্বের মধ্যে ২য় খন্ড শেষ হবে।তবে শেষ তো হচ্ছেনা।কিন্তু বিশ পর্বের মাঝেই শেষ হবে এতটুকু শিওর থাকুন।যদি নাও হয়।একটু এদিক সেদিক হবে আরকি।তাই একটু কষ্ট করে অধৈর্য না হয়ে আরেকটু পড়ুন প্লিজ!আর হ্যা গল্পটা কিন্তু কাল্পনিক।]