#আবার_প্রেম_হোক (২য় খন্ড)
#নুসরাত_জাহান_মিম
১৬.
“তার সাথে যোগাযোগটা সামাজিক মাধ্যমে হলেও,চিত্তজুড়ে তার আনাগোনা সেই প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছিলো।মেয়েদের সাথে কথাবার্তা না বলা অথবা এড়িয়ে চলা যেরকমটা সবাই দেখছে,এটা বর্তমান চৈত্র।পূর্বের চৈত্র মোটেও এমন ছিলোনা।আমি বেশ ফ্রেন্ডলিই ছিলাম।তবে কিছু কারণবশত আমার এই স্বভাব।মেয়ে দেখলেই র*ক্ত টগবগায়।আর গায়ে পড়া মেয়েগুলো বরাবরই বিরক্তিকর।তবে আমার রূপ ছিলো ভিন্ন,বেশ সহজ সরল,সাদামাটা মেয়ে।লাজুক প্রকৃতির।তার আর আমার পরিচয়টা একটা অনলাইন গেইমের দরুন হয়েছিলো।কথাবার্তা হতো সেখানেই।তার কন্ঠের প্রেমে পড়েছিলাম আমি।কোকিলের চেয়েও মিঠা সুর আমার রূপন্তিকার।তার কন্ঠের প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম আমি!এমনি এমনি তার প্রেমে পড়া।একজনের প্রেমেই বারবার পড়তে পড়তে তাকে ভালোবাসা আমার।সেও ভালোবাসতো আমায়।আদোতে বাসতো কিনা জানা নেই!বাসলে কি ছেড়ে যেতো?”
চৈত্র থামতেই প্রশ্ন করে রিহা,
“খুব ভালোবাসতেন রূপন্তিকাকে?”
চৈত্রের মোলায়েম কন্ঠস্বর,
“এখনো বাসি”
অতঃপর ফের সে বলে,
“রূপ আর আমার প্রথম দেখা পরিচয়ের বছর দেড়েক পর হয়েছিলো।তখনো সে জানতো না আমি তাকে ভালোবাসি।তার মনের খবর সম্পর্কেও আমি ছিলাম অনবগত।আমি নাকি তার লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।এই কথাটা যদিও বা আমাদের রিলেশনের অনেক পরে জেনেছিলাম।আর এজন্যই আমি প্রেম জিনিসটা অপছন্দ করি।বিশেষ করে এই প্রেমে পড়া অথবা লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট টাইপের জিনিস।কারণও বলছি।দেখতে শুনতে তো আহামরি খারাপ না।চেহারার প্রেমেই নাকি সে পড়েছিলো।মন টা আমার দেখেনি।অনুভব করার চেষ্টাটুকুও কি করেনি?আমিতো তাকে ভালোবেসেছিলাম তাকে না দেখেও।সে কেনো আমায় দেখার পরই ভালোবাসতে হলো?নাকি কেবলই মোহ?তবে তাতে আমায় না জড়ালেই কি পারতোনা?ছেলেদের নাকি কোনো দুঃখ নেই,কষ্ট নেই।অথচ দিনের পর দিন আমি ছিলাম দুঃখে জর্জরিত।এখনো তাকে ভাবলে হৃদয়ে সূক্ষ্ম ব্যথা জাগ্রত হয়।কোথায়?কেউতো সে খবর রাখেনি।জানার চেষ্টা করেনি।হয়তো আমিই সেই সুযোগটা কাউকে দিইনি।আর দিতে চাইও না”
চৈত্র একটু থামতেই রিহা ফের প্রশ্ন করে,
“আপনাদের মাঝ…..”
রিহাকে থামিয়ে দিয়ে বেশ গুরুগম্ভীরভাবেই চৈত্র বলে,
“কথার মাঝে কথা আমি বেশ অপছন্দ করি”
“সরি”
অতঃপর চৈত্রই আবার শুরু করে,
“তারপর আমাদের দেখা হলো,কথা হলো,প্রেম হলো,ভালোবাসাও হলো।পরিশেষে আমায় নিয়ে বেশ ইন্সিকিওর্ড ছিলো।যার দরুন বিয়েটাও আমি তাকে করি।আড়ালে,গোপনে।সাক্ষীস্বরূপ তার নিজের ভাইবোনেরা তো ছিলোই চাঁদও ছিলো”
“চাঁদ জানতো সবটা?”
“হ্যা আমার ব্যাপারে সবকিছুই আমার বোনের জানা।আমরা বেশ কম জিনিসই একে অপরের থেকে লুকাই।ভাইবোন কম বন্ধু বেশি।তবে প্রণয়ের বিষয়টা কখনো চাঁদ আমায় বলেনি।হয়তো বড় ভাই এবং কিছু সীমাবদ্ধতা আছে বলেই!আড়ষ্টতা ছিলো বলেই হয়তো জানাতে পারেনি”
“তারপর কী হলো চৈত্র?ডিভো!র্স….”
“বলছি”
বলেই লম্বা শ্বাস টানে চৈত্র।অতঃপর ফের শুরু করে,
“বিয়ের পরপরও সব ঠিক ছিলো।তখনকার সময় পারিবারিক নানান সমস্যার জন্যই রূপকে ঘরোয়াভাবে বিয়েটা করতে পারছিলাম না।অতটা সচ্ছল পরিবারে তো আর বিলোং করিনা যে বউয়ের যেকোনো শখ-আহ্লাদ যখন তখন পূরণ করতে পারবো।তাই সময় নিয়েছিলাম।অপেক্ষা করছিলাম।আড়ালে আমাদের সংসারও ছিলো।আমাদের বিয়ের বছর খানেক গড়াবার আগেই তার মনে হলো সে বেশ ভুল করে ফেলেছে!বিয়েটা করা উচিত হয়নি।তার দোষ দিতে চাচ্ছিনা তবে দোষী তো আমিও তাকে মানি।সবচাইতে অবাক করা বিষয় ছিলো যেই রূপা আমায় তার সর্বস্ব উজাড় করে ভালোবেসেছে,সে কী করে ধোকা দেয়?এতটা সহজ সরলা মেয়ের মনে ধোকা জিনিসের উদ্ভবও হয় কী করে?আপনি জানলে অবাক হবেন কিনা জানিনা তবে সেই মেয়েটা নিজের কথা চিন্তা করার আগে বারবার কেবল আমার কথাই ভাবতো।এমনকি চাঁদের কথাও সে চিন্তা করতো।হুট করে তার কী হলো জানিনা।এক প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছিলো।তার ডি!ভোর্স লাগবে মানে লাগবেই!কারণ হিসেবে দাড় করিয়েছিলো কয়েকটা লেইম এক্সকিউজ।বিয়ে করেও ঘরে তুলছিনা,সংসার করছি পরিবারেও জানাচ্ছিনা,আমার মতো ছেলের সাথে নাকি তার যায়না।বড়লোক ঘর থেকে তার জন্য সম্বন্ধ এসেছে আর সে সেখানেই বিয়ে করতে চায়।আমার সাথে আর নাকি থাকতে পারছেনা।যদিও বলেছিলাম তাকে ঘরে তুলবো।তবে সে জানিয়েছিলো সে সত্যিই আর আমায় চায়না।আমায় নাকি আর ভালোবাসেনা।আমার উপর নাকি শুধু ক্রাশ খেয়েছিলো।সেই দরুনই প্রেমে পড়ে আবিষ্ট হয়েছিলো কেবল।ছেলেদের সাথেও এমন হয় বলুন?ভালো লেগেছিলো শুধু।আর এই ভালোলাগা কেই বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে সে নাকি বিরাট ভুল করেছে।বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা।তবে আমি তার পা পর্যন্ত ধরেছিলাম রিহা।জীবনে কেবল দুই নারীর জন্য কেঁদেছি আমি।এক আমার বোন, দ্বিতীয়ত রূপন্তিকা।মেয়েটা আমায় ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিলো।আজও আমার জানা হয়নি ভুলটা কী করেছিলাম আমি?সাথে অবাকও হই এই ভেবে যে এতটা ভালোবাসার পরেও কেউ কাউকে কী করেই বা ছেড়ে যায়?কোনোদিক দিয়েই তাকে আমি কম ভালোবাসিনি অথচ সত্যিই সে আমায় ছেড়েছে।আর এমনভাবেই ছেড়েছে যে নারীদের প্রতি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করেই ছেড়েছে।শেষ পর্যন্ত কী বলেছিলো জানেন?আমি নাকি তাকে ভো*গ করছি!কী বি!শ্রী অপবাদ তাইনা?নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে কেউ ভো*গ করে বলুন?বিষয়টা মানতে পারিনি।আমার ব্যক্তিত্বের সাথে যায়নি।এরকম ব্যক্তিত্বের সাথে না যাওয়া বহুকাজ আমি তার জন্য করেছি।যা আজ অব্দি কারো জন্যই করা হয়নি।সর্বপ্রথম ছিলো তার পায়ে ধরে আকুতি করা।কতভাবে যে তাকে আটকানোর চেষ্টা আমি করেছিলাম!তবে সফল হইনি।শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি সে অন্যকাউকে বিয়ে করেছিলো।আমায় কার্ড পর্যন্ত পাঠিয়েছিলো।গিয়েছিলাম তার বিয়েতে।তার বিয়ের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি,হয়তোবা মন গললো!কিন্তু পাষাণীর মন আর গলেনি রিহা!আর না সে আমার থেকেছে।আমার সামনেই অন্যকারো হয়েছে।আমি কখনোই চাইনি কেউ তাকে কোনো প্রকার অপবাদ দিক।সেদিনই আমাদের ডিভো!র্সটা হয়।আমি তাকে ডি!ভোর্স দেই।সেও সাইন করে,আমিও করি।অতঃপর আমাদের প্রেম বিচ্ছেদ,বিবাহবিচ্ছেদ,সর্ব বিচ্ছেদ ঘটে রিহা।আমার রূপন্তিকাকে আমি চিরতরে হারাই।আর কখনো তার সাথে আমার দেখা হয়নি।আমিই চেষ্টা করিনি।তবে এখনো আমি তাকে ভালোবাসি।অসম্ভবরকম ভালোবাসি।তার জায়গা টা অন্যকাউকে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।আমায় নিয়ে আপনি আর ভাববেন না প্লিজ!আসি”
অতঃপর রিহাকে আর কোনোকিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত না দিয়ে কফির বিল মিটিয়ে চলে আসে সেখান থেকে চৈত্র।আর রিহার সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজনবোধ করেনি।দেখা সাক্ষাৎ করার সুযোগটুকু পর্যন্ত তাকে দেয়নি।এড়িয়ে চলেছে সে রিহাকে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
সপ্তাহখানেক পরের কথা,
বেশিরভাগ সময়ই বাসায় থাকা পড়ে চাঁদের।বাইরে তেমন আসা যাওয়া করেনা।প্রণয়ই নিষেধ করেছে।তার সাথেও যেনো ঘনঘন দেখা করতে না যায় বলেও জানিয়ে রেখেছে।মন বেশ উদাস চাঁদের।বিছানার উপর পা তুলে বারান্দার দিকে চেয়ে আছে সে।পুরো রুম জুড়েই তার আর প্রণয়ের কতশত স্মৃতি!ঐ বারান্দায়ও তাদের প্রেমময় অহরহ স্মৃতি রয়েছে।যার কথা স্মরণে আসলেই চিত্ত জুড়ায় চাঁদের।প্রশান্তি ছায় হৃদয়ে।আজও প্রণয়ের সাথে দেখা করতে যাবেনা ভেবেই মন খারাপের মাত্রা বাড়ে তার।বেশ গোমড়াটে মুখশ্রী করে মুঠোফোন হাতে নিতেই মনে পড়ে দুপুরের ঔষধ এখনো খাওয়া হয়নি।ঝটপট বিছানা থেকে নেমে ভারী পেটে হাত রেখেই এগিয়ে যায় আলমারির দিকে।আলমারিতেই বেশ সাবধানে ঔষধের শিশিটা রাখা আছে।আলমারির কাছে পৌঁছাতেই তা খুলে সেখান হতে বোতলটা হাতে নিয়ে পাশে রাখা স্টিলের চামমের এক চামচ সিরাপ সে পান করে।অতঃপর মুখে চামচ রেখেই বোতলের মুখ আটকাতে গেলে শুনতে পায় মেয়েলি শীতল কন্ঠস্বর,
“চাঁদ?কী খাচ্ছো তুমি?দেখি”
পিছু ঘুরে রিহাকে দেখে মৃদু হাসে চাঁদ।অতঃপর চামচ মুখ থেকে বের করে ফের ঔষধের বোতল আলমারিতে রাখতে রাখতেই বলে,
“ঔষধ খাচ্ছিলাম আপু।দুপুরে ভুলে গিয়েছিলাম”
কপাল কুচকে সামনে এগুতে এগুতে রিহা প্রশ্ন করে,
“ঔষধ?প্রেগ্ন্যাসির শেষ সময়ে কীসের ঔষধ?”
“শুরু থেকেই খাচ্ছি আপু”
চাঁদের সামনে এসে গম্ভীরভাবে রিহা বলে,
“দেখি ঔষধটা?”
রিহার কথা মোতাবেক ঔষধের শিশিটা তার হাতে ধরিয়ে চামচ নিয়েই বেসিনের দিকে এগোয় চাঁদ।অতঃপর চামচ ধুতে ধুতে শুনতে পায় রিহার গম্ভীর কন্ঠস্বর,
“এটা কে দিয়েছে তোমায়?আর কবে থেকে খাচ্ছো?”
“পূর্ণপু দিয়েছে।যখন থেকে প্রেগ্ন্যাসির খবর পেয়েছি তখনই দিয়েছে।একটা শেষ হয়েছে আরেকটা খাচ্ছি।এটাও শেষের পথে”
কপাল কুচকে রিহা বলে,
“কিন্তু ও তো আমায় কিছু বলেনি”
“বাবুর হেল্থে নাকি কিছু প্রবলেম ছিলো সেজন্যই আমায় এটা খেতে বললো।হয়তো ভুলে গেছে বলতে”
“দেখি আলাপ করবো ওর সাথে।ততদিন তুমি এটা খেয়ো না।প্রেগন্যান্সির শেষ সময়ে কোনোপ্রকার ঔষধ খাওয়া ঠিক হবেনা”
“ঠিক আছে আপু।কিন্তু তুমি এখানে?”
মৃদু হেসে রিহা বলে,
“তোমার চেকাপ করতে এসেছি।প্রণয় বিশেষ তলব দিয়েছে ক’দিন পরপরই যেনো তোমায় দেখে আসি”
“বাচ্চা নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে তোমার বন্ধু”
“ভাববে না কেন?বাচ্চার বাবা ও”
অতঃপর চাঁদকে বিছানায় শুইয়ে কয়েকটা টেস্টের জন্য চাঁদের রক্ত নেয় আর চাঁদকে একটা শিশি দিয়ে কিছু একটা বলে চাঁদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।অতঃপর দরজার কাছে যেতেই চাঁদের রুমে চৈত্রকে প্রবেশ করতে দেখে হকচকায় রিহা।চৈত্রেরও বেশ অস্বস্তি হলেও সূক্ষ্মভাবে রিহাকে এড়িয়ে চাঁদের নিকটে যায়।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
হাজত হতে বেরিয়ে থানার ভেতরকারই এক মাঠের পাশে বসে আকাশপানে চেয়ে আছে প্রণয়।একধ্যানে সে পানে চেয়ে থেকে কিছু একটা ভাবছে সে।হঠাৎ পাশে কারো আগমণের অনুভূতি টের পেলেও নড়েনা।সেভাবেই বসে থাকে।আর পাশে বসা লোকটা খানিক কেশে প্রশ্ন করে,
“এত মগ্ন হয়ে কী ভাবছো প্রণয়?”
লম্বা শ্বাস টেনে দৃষ্টি মাটির দিকে করে প্রণয় বলে,
“গুনছি”
“কী?”
“দিন গুনছি মামা”
কপাল কুচকে লোকটা বলে,
“কীসের দিন?”
“আমার পুতুলের কান্না শোনার”
“মানে?”
লোকটার পানে চেয়ে কিঞ্চিৎ ওষ্ঠ প্রসারিত করে প্রণয় শুধায়,
“আরে মামা!আমার মেয়ের পৃথিবীতে আগমণের দিন গুনছি।আর মাত্র আড়াই মাস!তারপর আমি আমার ছোট্ট মেয়ের ছোট্ট,নরম তুলতুলে হাত-পা ধরার সুযোগ পাবো”
“ছয় মাস শেষ?”
“হ্যা।তখন হবে”
“মেয়ে খুব পছন্দের?”
“তেমন না কিন্তু আমার মেয়ে হলে ভিন্ন বিষয়।আর আমি জানি আমার মেয়ে ই হবে”
“আল্লাহ তোমার আশা পূরণ করুক বাবা”
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
দিন পাঁচেক পর,
চৈত্রের অফিসে এসে হাজির হয়েছে রিহা।চৈত্রের সাথে দেখা করতে চাওয়ায় অনেকেই বিভিন্ন প্রশ্ন করেছে,কেউবা সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়েছে।তবে রিহা ঠিকই চৈত্রের ডেস্ক খুঁজে তার পাশে এসে দাড়িয়েছে।কম্পিউটারে কিছু কাজ করতে করতেই আকস্মিক রিহার পানে নজর গিয়েছিলো চৈত্রের।তবে সে তাতে তোয়াক্কা করেনি।কিন্তু বর্তমানে তার পাশ ঘেষে দাঁড়ানোয় খানিক মেজাজ খারাপ হয় চৈত্রের।গম্ভীরস্বরে সে বলে,
“স্টে আওয়ে” [দূরে থাকুন]
চৈত্রের কথায় খানিক সরে দাঁড়ায় রিহা।অতঃপর বলে,
“আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো”
“এখন আমার কাজের সময়।আর আমি সময় অপচয় পছন্দ করিনা কতবার বলতে হবে আপনাকে?”
চৈত্রের রুক্ষ ব্যবহারে মনঃক্ষুণ্ন হয় রিহার।তবুও নিজেকে সামলে সে বলে,
“বেশ জরুরী কথা।চাঁদকে নিয়ে”
এবারে ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয় চৈত্রের।কম্পিউটারের মাউস আর কি-বোর্ডে হাত চালানো বন্ধ হয় তার।অতঃপর কপাল কুচকে রেখেই প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে চাঁদের?”
“এখানে কীভাবে?”
ফের কাজের দিকে মনোযোগী হয়ে রিহার পানে না চেয়েই তাকে উদ্দেশ্য করে চৈত্র বলে,
“আরও ঘন্টা তিনেক অপেক্ষা করতে হবে।আপনি এখন আসুন।আমি আপনাকে মেসেজ করবো”
“ঠিক আছে”
কোনো দ্বিরুক্তি না করেই চলে আসে রিহা।
রিহার চেম্বারের সামনে হাজির হয়েছে রিদি আর রুবা।মূলত রুবাই জোর করে রিদিকে নিয়ে এসেছে।ক’দিন যাবৎ ই রিদির শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা।আর আজতো অজ্ঞানই হয়েছিলো ক্যাম্পাসে।মিরার থেকে এরূপ তথ্য শুনেই তৎক্ষনাৎ রিদির শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে দ্রুতই হাজির হয়েছে রিহার চেম্বারে।আপাতত রিহার সাথে আলাপ করলেই হবে।রুবা বেশ চিন্তিত রিদিকে নিয়ে।সাথে কিছু শংকাও আছে।অতঃপর ভেতরে এসে নিজেদের পরিচয় দিতেই তাদের ভেতরে যেতে অনুমতি দেয়া হয়।দু’জনে এসে দরজায় নক করতেই রিহাও হাসিমুখেই তাদের ভেতরে আসার অনুমতি দেয়।অতঃপর দু’জনই চেয়ারে বসলে রিহা প্রশ্ন করে,
“হঠাৎ তোমরা?”
রিদি কোনোকিছু না বলে অস্থির হয়ে ঘামছে বলে রুবাই জবাব দেয়,
“আসলে আপু রিদুর শরীরটা ক’দিন ধরে ভালো যাচ্ছেনা”
“কী হয়েছে রিদি?সেদিনও এসেছিলে।শরীর কি বেশিই খারাপ?”
রিদি আমতা আমতা করে,
“না মানে…..”
অতঃপর রুবাই তার কথা সম্পূর্ণ করে,
“হ্যা আপু।অনেকটাই খারাপ আজ সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলো।আর এমনিতেও ইন্টার্নাল কিছু সমস্যা আছে”
অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে রিদির পানে চেয়ে কপাল খানিক কুচকে রুবা বলে,
“তুই কি বলবি?নাকি আমারই বলতে হবে?সমস্যা আমার না তোর?”
রিদি ফের ইতস্তত করে বলে,
“না মানে আসলে আপু কীভাবে বলি মানে…..”
আকস্মিক রিহার শান্তস্বরের প্রশ্ন,
“মিস গেছে?”
দ্রুত পলক ঝাপটে দৃষ্টি নত করে মাথা ঝুকায় রিদি।অতঃপর ফের শুনতে পায় রিহার চিন্তিত কন্ঠস্বর,
“কয় মাস?”
এবারে রিদি অতিরিক্ত লজ্জিত হতেই কপাল কুচকে রুবা বলে,
“দুই মাস আপু।আর তুই নতুন বউদের মতো এমন করছিস কেন?এটাতো সমস্যা নাকি?থা!পড়াবো।সোজা তাকা”
মৃদু হেসে রিহা বলে,
“টেস্ট করিয়েছিলে?এতে এত ভয় পাওয়ার কী হলো রিদু?এটাতো খুশির ব্যাপার।মির জানে?”
রিদিকে ফের চুপ দেখে মেজাজ খারাপ হয় রুবার।অতঃপর রিদির মাথায় ঢুশ মে*রেই বলে,
“আপু ও আসলে লজ্জা পাচ্ছে।কিন্তু আমিও বিষয়টা বলতে পারছিনা”
অতঃপর রিদির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসায় রুবা,
“আমার কাছে বলতে পেরেছিস আপুর কাছে বলতে কী সমস্যা তোর?”
রিদিও ফিসফিসায়,
“আপু কী না কী ভাবে!”
“যেটার ভাবার ছিলো অলরেডি সেটা ভেবে ফেলেছেই।তুই আপুকে ক্লিয়ারলি প্রবলেমগুলো বল।নাহলে কিন্তু আমার হাতে মা*র খাবি তুই”
“ব….বলছি”
ঢোক গিলে রিদি।অতঃপর ফের শুনতে পায় রিহার সন্দিহান কন্ঠস্বর,
“বেশি সিরিয়াস কিছু?”
মনে মনে সাহস সঞ্চার করে রিদি তার নজর কামিজ পানে রেখে তা চেপে ধরেই রিহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আসলে আপু!মানে….তুমি যা ভাবছো তেমন না।মানে আমার আর মিরের মানে অন্য হাজবেন্ড ওয়াইফের মতো আমাদের সম্পর্কে তেমন!বুঝতে পারছোনা তুমি”
কপাল কুচকে রিহা বলে,
“বুঝতে পারছিনা মানে?তোমাদের বিয়ের ক’দিন বাদে এক বছর হবে আর তুমি ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছো রিদি?তোমাদের মাঝে কোনো সমস্যা চলছে?”
দ্রুত মাথা তুলে রিহার পানে চেয়ে ডানে বায়ে ইশারা করে রিদি বলে,
“না না আপু।কোনো সমস্যা নেই”
“তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
অতঃপর নিজেকে শান্ত করে রিদির সাথে সহজ হতে রিহা বলে,
“দেখো রিদি।আমি প্রথমত কী?একজন ডাক্তার তাইতো?আর তুমি আমার পেশেন্ট।তো আমাদের সম্পর্ক কী অথবা তুমি আমার কে,আমি তোমার কী এসব কিছুক্ষণের জন্য বাদ দাও।তুমি আমার বন্ধুর ওয়াইফ এটাও মাথায় রাখতে হবেনা।জাস্ট ভাবো আমি শুধুই ডাক্তার যে তোমার ট্রিটমেন্ট করবে।আর তুমি নিজেও কিন্তু মেডিকেল স্টুডেন্ট।আর আমাদের প্রথম শর্তই হচ্ছে পেশেন্টকে নার্ভাস ফিল না করানো।আর পেশেন্টেরও উচিত ডাক্তারকে সব প্রবলেম খুলে বলা,কোনোকিছু না লুকানো।তাই হেজিটেট হয়ো না”
লম্বা শ্বাস নিয়ে রিহার দিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে ডেস্কের পানে চেয়ে রিদি বলে,
“আপু সেদিন তো তোমায় সমস্যার কথা বলেছিলামই।কিন্তু দুই মাস যে মিস গেছে এটা লজ্জার জন্য বলতে পারিনি কী না কী ভাবো!সরি”
রিহা প্রতিত্তোর করেনা,কেবলই শোনে।খানিক থেমে ফের রিদি বলে,
“আর মির বা আমার মাঝে তেমন সম্পর্কও মানে…..এখনো মানে তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন না।তো তারপরেও প্রবলেম গুলা কেনো হচ্ছে?সেজন্যই চিন্তিত।আজ সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম।সবাই অন্যকিছুই মিন করছে,রুবাও।কিন্তু সেরকম কিছুই না আপু।তুমি প্লিজ একটু মানে….. একটু দেখো না আমার কী হলো?”
বলেই রিহার পানে চায় রিদি।নিজের পানে রিদিকে চাইতে দেখে মিষ্টি এক হাসি উপহার দেয় তাকে রিহা।অতঃপর বলে,
“এজন্য এত লজ্জা?এরকম সমস্যা তো অহরহ মেয়েদের হয়।আমার বেশিরভাগ রোগীই এই সমস্যার জন্য আসে।চিন্তা করোও না”
অতঃপর রুবার দিকে চেয়ে রুবাকে বলে,
“রিদিকে নিয়ে ভেতর দিকটায় যাও।আমি আসছি,কিছু চেকাপ করবো”
রুবা শান্তস্বরে বলে,
“ঠিক আছে আপু”
বলেই রিদিকে নিয়ে ভেতরে কাপড়ে আড়াল করা রুমের মতো দেখতে জায়গাটায় নিয়ে এগুতেই দেখে একটা হাসপাতালের বেড।অতঃপর ইশারায় রিদিকে বলে সেখানে বসতে।আর নিজে তার পাশেই দাঁড়িয়ে কথা বলে তার সাথে।
ঘন্টা খানেকের মতো রিদির কিছু চেকাপ করে বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে হাতের মোবাইলটায় সময় দেখে তা রিদির বেডের বালিশের পাশেই রেখে বাইরে আসে রিহা কিছু কাজের জন্য।রিহা সেখান থেকে যেতেই লক হওয়া স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠে।লক করা ফোনে হঠাৎ কোনোকিছুর আওয়াজ পেতেই রুবার কপাল কুঞ্চিত হয়।সে ভাবে হয়তো কেউ কল দিয়েছে।অগ্যতা ফোন হাতে নিয়ে রিহার কাছে যেতে নিলেই চোখে পড়ে ‘চৈত্র’ লেখা নাম্বারটার দিকে।কুচকানো ভ্রু মাত্রাতিরিক্ত কুঞ্চিত হয় রুবার।সে মোবাইলের পানে ভালো করে মনোযোগ দিতেই দেখে মেসেজ এসেছে চৈত্রের নাম্বার হতে।অতঃপর রুবার মন খচখচাতেই সংকোচবোধ সহিতই সে মোবাইলের শাটার নামিয়ে চৈত্রের মেসেজ খানা পড়ে।যাতে স্পষ্ট লেখা ছিলো তারা কোথায় এবং কখন দেখা করবে।সাথে আরও ছিলো ‘বেশি দেরি করবেন না!’
হঠাৎ করেই রুবার মনে আশংকার দানা বাঁধে।সে হতাশার শ্বাস ফেলে মোবাইলটা আগের জায়গায়ই রেখে দেয়।অতঃপর কাউকে কিছু না বলে রিদিকে রিদির বাসায় পৌঁছিয়ে ফোন করে শিফার নিকট।শিফা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই রুবা প্রশ্ন করে,
“কোথায় তুই?”
উত্তর আসে শিফার বিরক্তিকর কন্ঠে,
“জানিস না কোথায় থাকি?”
রুবাও তিরিক্ষি মেজাজে বলে,
“সোজা সোজা জবাব দিতে পারিস না?”
নিজেকে দমিয়ে ধীরকন্ঠে শিফা বলে,
“টিউশনে।কী হয়েছে তোর?রিদুর ব্যাপ……”
শিফাকে থামিয়ে রুবা প্রশ্ন করে,
“টিউশনের আর কতক্ষণ?”
“শেষই প্রায়।কী হয়েছে তোর?”
“তোকে আমি এড্রেস মেসেজ করছি ঐখানে জলদি আসবি,এক্ষুনি।বেরুবো আমরা”
“হঠাৎ কোথায়?”
“যেতে যেতে বলবো”
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
সবে রেস্টুরেন্টের ভেতরে শিফার হাত ধরে ঢুকতে নিয়েছিলো রুবা।তখনই চৈত্র আর রিহাকে মুখোমুখি বসা দেখে খানিক ঢোক গিলে শিফার সহিতই তার পাশের টেবিলে বসতে গেলে শুনতে পায় চৈত্রের গম্ভীর কন্ঠস্বর,
“আপনাকে আমি এক মাসের সময় দিচ্ছি।যদি একমাসে আপনার জন্য আমার বিন্দু পরিমাণ সহানুভূতিও জাগ্রত হয়।আপনাকে নিয়ে আমি ভেবে দেখবো”
চৈত্রের চোখের দিকে একধ্যানে চেয়ে থেকে তৎক্ষনাৎ শিফার হাত ধরেই ছুটে আসে রুবা।ভুলবশত দৌড়াতে গিয়ে পাশের টেবিলে রাখা পানির এক বোতলে রুবার হাত লেগে তা ফ্লোরে পড়ে গেলে রুবা তা নিচ হতে টেবিলে তুলে যেতে যেতেই বলে,
“সা….সরি সরি!”
চৈত্রের নজরে শিফা আর রুবা পড়েছিলো ঠিকই।তবে তার ভাবনা মোতাবেক হয়তো কাজে এসেছিলো তারা!কিন্তু রুবাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে কপাল সামান্য কুঞ্চিত হয় চৈত্রের।একধ্যানে সে চেয়ে থাকে রুবার যাওয়ার পানে।এখানে রিহা যে তাকে কিছু বলছে সেদিকে খেয়াল নেই।অতঃপর ধ্যান ভাঙতেই রিহার পানে খানিকের জন্য চেয়ে বাইরে দরজার দিকে তাকিয়ে সে বলে,
“কিছুনা”
To be continued……
[বিঃদ্রঃগল্পটা কাল্পনিক।ভুলসমূহ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ]