#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৩৬
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“তোর কি মনে হয়না তুই অবিবেচক এর মতো কথা বলছিস?”
“কবিতা, সে আমার মা।” উদাস হয়ে জবাব দেয় মায়া।
“সে তোর মা। কিন্তু তোর বাবার কেউই না। সে শুধুমাত্র তার সন্তানের মা।”
“আমার জন্য হলেও কি তার মনে রাখা উচিত ছিল না?”
“মায়া, বোঝার চেষ্টা কর।”
“কি বুঝবো আমি? আমি মানছি যে আমার মা ভুল করেছে। পাপ করেছে। অন্যায় করেছে। কিন্তু সে তো তার স্ত্রী ছিল। ”
“তাদের কি সংসার হয়েছিল মায়া?”
মায়া মাথা নিচু করে জবাব দেয়,”নাহ।”
“শোন মায়া, মানুষ নিজের পোষা কুকুরটার মৃত্যুতেও কান্না করে। কারণ সে তাকে ভালোবাসে। তার সাথে দীর্ঘদিন ধরে তার একটা সম্পর্ক থাকে। তার মৃত্যুর শোক বহুদিন ধরে তার মনে গেঁথে থাকে। কিন্তু তোর মায়ের সাথে তো তোর বাবার কোনোরকম সম্পর্কই ছিল না। তাদের মাঝে মাঝে দেখা হতো শুধুমাত্র তোর জন্য। যদি তোর জন্ম না হতো, তোর বাবা কি তোর মা কে বিয়ে করতো? করতো না। কোনোক্রমে যদি জন্মের সময় তোর মৃত্যু হতো, তবুও তোর বাবা তোর মাকে বিয়ে করতো না। আর তুই যেন কি বলছিলি, তোর বাবা নাকি তার পরিবারের সাথে আনন্দেই ছিল। আসলেই কি তোর মনে হয় সে আনন্দে ছিল?”
“আমার মা তো তাদের মাঝে আসেনি কখনোই।”
“আরিয়ানের মাও কিন্তু আমার বাবার সাথে আদর্শ দম্পতির মতোই আছে। আমার বাবাও তাকে নিয়ে ভালো থাকার অভিনয় করছে। সেও ভালোই আছে। কিন্তু তাদের মনের মাঝে তো কোনো মিল নেই। তাদের মনে শান্তি নেই। তোর বাবা এইখানে সংসার করলেও তার মনে কোনো শান্তি ছিল না কিন্তু। সে ভয়ে ভয়ে থেকেছে সবসময়ই। তুই এমন ভাবিস না। তোদের দায়িত্ব তো সে পালন করেছে। আর একটা কথা কি জানিস?”
“কি?”
কবিতা একটু ইতস্তত করে বলে,”অন্যায় বা পাপ কিন্তু সবার জন্যই এক। সে তোর মা বলে যে তুই তার অন্যায়কে সমর্থন করবি, তাহলে কিন্তু তুই ভুল। এইটা মোটেও ঠিক না। আজ যদি শুনিস যে আমার আম্মুর সংসার অন্য একটা মহিলা ভেঙেছে, তাকে কি তুই পছন্দ করতি? তোর পার্সোনালিটি অনুযায়ী কিন্তু তুই জীবনে তার মুখটাও দেখতে চাইতি না। তাহলে? অন্যের ব্যাপারে ভিন্ন কেন ভাববি?”
“কবিতা, সে আমার মা।” বলেই হুহু করে কেঁদে উঠে মায়া।
“আমি জানি সে তোর মা। সেই জন্যই তোর খারাপ লাগছে। তোর বাবা, আম্মা সবাই পরিস্থিতির শিকার মাত্র। কেউ সহজে তোর মাকে মেনে নিবে না। তোর আম্মার কিন্তু কোনো দায় ছিল না তোকে তার সংসারে রাখা। আমি তার জায়গায় থাকলে আমি কখনোই মেনে নিতাম না এতো সহজে। তোর তো নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবা উচিত। আমি জানি তুই জীবনে অনেক সাফার করেছিস। কিন্তু তাই বলে এটা ভাবিস না যে তোর বাবাও ভালো ছিল।সে তোর থেকে আরো বেশি সাফার করেছে। তোর থেকে কম বয়সেই মাকে হারিয়ে সৎ মায়ের অত্যাচারে বাড়িছাড়া হয়েছে। এতো বড় শহরে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে । স্বার্থপর এই শহরে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত একজন মানুষকে খুঁজে বের করেছিল।তার মাঝে শান্তি খুঁজতে চেয়েছিল। কিন্তু তোর মায়ের জন্য তার মানসিক শান্তি বলতে কিছুই ছিল না। সে এতো বছর সংসার করেছে কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা ছাড়া। যার জন্য এতোকিছু হারিয়েছে সে, তার কথা তুই তাকে মনে রাখতে বলিস কিভাবে?”
“আমি জানি সবই ঠিক। কিন্তু নিজের মনকে যে মানাতে পারিনা আমি।”
“শোন, তোর মাকে নিয়ে কি তোর বাবা খারাপ কিছু বলে? কিংবা তোর আম্মা?”
“নাহ।”
“একজন মৃত মানুষকে এইটুকু সম্মান দেয়, এটাই তো যথেষ্ট। এর বেশি কিছু চাওয়া তো ঠিক না মায়া।”
মায়া কোনো জবাব দেয় না। ঠিকই তো বলেছে কবিতা। নানা-নানি মনে রেখেছে। ছোট খালা মনে রেখেছে। সেটাই বা কম কিসে?
“তুই পথশিশুদের খাওয়াবি আজকে তাহলে?”
“হুমম। আমার জমানো টাকা দিয়েই করবো।”
“ওকে। যথেষ্ট। আংকেল কিছু বলেছে?”
“নাহ। তবে তুইই ঠিক।”
“কোনটা?”
“আমাদের জীবনে আমার মায়ের মতো মানুষ আসুক, সেটা আমি মানতে পারবো না। তুই ঠিকই বলেছিস। কিন্তু আমি আমার মাকে খারাপও বলতে পারবো না।”
“কেউ তো তাকে খারাপ বলছে না মায়া।”
“আমি এর আগে একবার আমার সব দুঃখ-কষ্টকে সাইডে রেখে পড়াশুনোয় মন দিয়েছিলাম তোর ভাইয়ের কথায়। আবারও দিব। এইবার তোর কথায় দিব। আমার মা আমাকে একটা পরিবার দেওয়ার জন্য নিজেকে আমার বাবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। আমি যদি সেই পরিবারে মানিয়েই নিতে না পারি, তাহলে যে আমার মায়ের সব চেষ্টাই বৃথা হবে।”
“মানিয়ে নিবি মানে? মানিয়ে নেওয়া না বল যে মেনে নিবি। সেটা তোর ও পরিবার। তুই সেটাকে আগলে রাখবি। তোরও দায়িত্ব পালন করতে হবে এখন থেকে। কারণ তুই সেই পরিবারের বড় মেয়ে।”
“হুমম।অনেক বড় দায়িত্ব। অনেক বড়।”
★★★
“জীবনটা এতো সহজ না সোহাগ ভাই। আমার পক্ষে এইটা সম্ভব না।” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে মায়া।
“কেন সম্ভব না মায়া? আমি তোমাকে পছন্দ করি। বলতে পারো ভালোবাসি। তাহলে তোমার কি সমস্যা হচ্ছে?” অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে সোহাগ।
“আপনি আমাকে পছন্দ করলেও আমি আপনাকে একজন বড় ভাইয়ের মতোই দেখেছি এতোদিন। আমার পক্ষে আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া অসম্ভব। ”
“বাসার কথা ভাবছো তুমি? বাসার সবাইকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। তুমি শুধু বলো যে তুমি রাজি। তাহলেই হবে।”
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না ভাইয়া।”
“তুমি সময় নাও মায়া। আমরা একে অন্যকে বুঝি।”
“আমি তো আপনাকে সেভাবে দেখিনা ভাইয়া। আর তাছাড়া..”
“তাছাড়া কি?”
মায়া খুব মৃদু স্বরে জবাব দেয়, “তাছাড়া আমিও আপনার মতোই অন্য কাউকে ভালোবাসি। তাকে ছেড়ে অন্য কারো কথা ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
সোহাগের বুকের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। কি বললো মায়া? কি বললো এটা? সে ভালোবাসে অন্য কাউকে? সত্যিই কি তাই? নাকি তাকে সরানোর জন্য তাকে মিথ্যে বলছে মায়া?
“মজা করছো মায়া? তুমি আবার কাকে ভালোবাসো?”
“সেটা আপনার জানার কথা না।”
সোহাগ প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বললো,”আমরা কি একবার চেষ্টা করতে পারিনা মায়া? সে কি তোমাকে ভালোবাসে? তোমাদের মাঝে সম্পর্ক আছে?”
মায়া বিরক্ত হয়ে বলে,” আপনি কি চাইলেই রিজাকে ভালোবাসতে পারবেন? পারবেন না। মেয়েটা আপনাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে। কিন্তু আপনি ভালোবাসেন আমাকে। বিষয়টা কেমন না? আপনি যেরকম সেই সহজ সরল মেয়েটার ভালোবাসার মূল্য বুঝেন না, কখনো বুঝবেনও না, তাকে ভালোও বাসতে পারবেন না তেমনি আমিও পারবো না তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে।”
“তুমি কি সত্যি বলছো নাকি রিজার কথা ভেবে আমাকে রিজেক্ট করছো?”
“রিজা কোনো বিষয় না। আর তাছাড়া আমি চাইও না যে রিজার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক হোক। কারণ না আপনি আর না রিজা, কেউই কারো যোগ্য না। আপনি ঐ নিষ্পাপ মেয়েটার ভালোবাসা বুঝবেন না, তেমনি ভাবে ঐ মেয়েটাও আপনার সাথে চলতে পারবে না। বুঝলেন?”
“আমি কি তোমার বাসায় বলবো মায়া? আমার কি বলা উচিত হবে?”
“আমি আমার বাবা আর আম্মার কথা জানিনা ভাইয়া। কিন্তু আমি জানি আমি কখনোই রাজি হবো না। আমি রাজি না হলে তারাও হবে না। আপনি শুধুশুধু বাবা আর আপনার বাবার মধ্যকার বন্ধুত্ব নষ্ট করবেন না।”
“হুমম।”
এরপর আর কোনো কথা হয়না। মায়া চায়ের কাঁপটায় অর্ধেক চা রেখেই উঠে যায় রেস্টুরেন্ট থেকে। সোহাগ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকে। হঠাৎ করেই মায়ার ফেলে যাওয়া কাপের চা এক চুমুক দিয়ে শেষ করে। বিড়বিড় করে বলে,”তুমি কি আসলেই সত্যি কথা বলছো মায়া? নাকি রিজার কারণে আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো? যদি এমন হয়, তবে তোমাকে আমি এতো সহজে হারাবো না।”
মায়া বাসায় যাওয়ার পথে অনুভব করলো, কেউ তাকে ফলো করছে। কিন্তু পাত্তা দিলো না। সে। হঠাৎ কোথা থেকে কাব্য এসে দাঁড়ায় তার সামনে। রাগি রাগি গলায় জিজ্ঞেস করে,” আমি তোমাকে মানা করা সত্ত্বেও কেন গিয়েছিলে ওর সাথে দেখা করতে? ও কি বলেছে তোমাকে? তোমাকে প্রোপোজ করেছে? কি বলেছো তুমি? কেন গেলে তুমি?তুমি জানো না, আমি তোমাকে ওর সাথে সহ্য করতে পারি না?”
মায়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাহা করে হাসতে। কিন্তু মায়া নিজের মুখটা বেশ গম্ভীর করে বলে,” আমাদের এইখানে একসাথে দেখে দূরে থেকে যে কেউ বুঝবে, আমরা এইখানে প্রেম করছি। কিন্তু আসলেই কি আমরা প্রেম করছি? নাকি আপনি আর আমি ঝগড়া করছি?”
চলবে……