আমি_মায়াবতী #পর্ব_২৮ #লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

0
360

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২৮
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“বাবা, তুমি কিভাবে নৌকা চালাতে পারো? আমি তো পারিনা।”
“আমাকে কে নাও চালাইতে শিখাইছে জানো সাব্বির বাবা?”
সাব্বির বেশ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কে শিখিয়েছে মেজো কাকা?”
“তোমার বাবা।”
“কিহ? বাবা? বাবা, তোমাকে কে শিখিয়েছে?”
রিজভী হাসে। হাসতে হাসতে জবাবা দেয়,”তোমার দাদা।”
“তখন তুমি কার মতো ছিলে বাবা? আমার মতো?”
“নাহ। তোমার চাইতেও ছোট। আমরা নৌকা চালাতে চালাতে গান গাইতাম। আব্বা গঞ্জের হাটে যাইতো। আমরাও যেতাম। গঞ্জ থেকে সন্দেশ আনতো। কি যে স্বাদ ছিল সেগুলোর। এখনকার গুলোতে সেই স্বাদ পাওয়া যায় না। ”
মায়া প্রশ্ন করে,”তোমরা অনেক আনন্দ করতে ছোট বেলায় বাবা? আর এতোদিন পরেও কিভাবে মনে আছে নৌকা চালানো?”
রিজভী হাসে।হাসতে হাসতে বলে,” মানুষ যতোই আপডেট হোক না কেন মা, মানুষ কখনোই তার অতীত ভুলতে পারে না। এই সবকিছুই আমার বাম হাতের খেলা। বুঝলে?”
সাবিহা জিজ্ঞেস করে,” বাবা, তুমি কি গাছে উঠতে পারো? বাড়ির পাশে যে আম গাছটা আছে, ঐটাতে চড়তে পারবে? ঐটাতে চড়েছো কখনো?”
রিজভী শুধু হাসে আর আনমনে ভাবে পুরোনো কথা। বাড়ির পাশের আমগাছটা তার নিজের মায়ের হাতের লাগানো। বাড়িটায় তেমন গাছপালা ছিল না তখন। তার মা কত যত্ন করেই না তার সংসারটাকে গুছিয়ে নিয়েছিল। বাড়িটা রাস্তার চাইতে নিচু ছিল। তার মা আর দাদী মিলে মাটি কেটে কেটে এনে বাড়ি উঁচু করেছে। কত ধরনের গাছপালা লাগিয়েছে তার মা। অথচ এই সংসারে তার এখন কোনো অস্তিত্বই নেই। তার কথা মনে করার লোক নেই। তার সন্তানের জায়গা নেই। আহ দুনিয়া। কি আজব এই দুনিয়া।
সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশ লাল বর্ণ ধারণ করছে। রিজভী পাড়ের দিকে নৌকা নিয়ে যায়। হঠাৎ করেই মরিয়মের ভাই পানিতে ঝাঁপ দেয়। সাবিহা,সাব্বির আর মায়া চিৎকার করে উঠে। কিন্তু ছেলেটি কয়েকটি শাপলা ফুল তুলে এনে সাব্বির এর হাতে দেয়। ছেলেটি সাঁতরে পাড়ে উঠে গিয়ে দৌড় লাগায়। রিজভী হাসতে থাকে। তার ছেলেমেয়েরা যে ননীর পুতুল। সামান্য একটা ব্যাপারে চিৎকার দিয়ে উঠেছে। অথচ গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে এইটা কোনো ব্যাপারই না।
★★★
“হ্যাঁ, বলো।”
মায়া মিনমিন করে বলে,” স্যার, আমি মায়া বলছিলাম।”
“জানি, মায়া। তোমার নাম্বার সেইভ আছে ফোনে। কি হয়েছে আজ আবার?কোনো সমস্যা? ”
“ঠিক সমস্যা না। আসলে কবিতাকে কল দিয়েছিলাম। ও ফোন ধরে শুধু কান্না করে কেটে দিল। কিছু কি হয়েছে ওর? ও তো কাল বলেছিল ওদের বাড়িতে যাবে। সেখানে কি গিয়েছে? কিছু হয়েছে?”
“মায়া, ও একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তুমি সময় পেলে ওকে জিজ্ঞেস করো। সবচেয়ে ভালো হবে যদি ওর সাথে দেখা করে কথা বলো। বুঝলে? ফোনে আসলে সবকিছু বলা যায় না।”
“আমি বুঝেছি।আমি ওকেই জিজ্ঞেস করবো। ধন্যবাদ স্যার।”
“আর কিছু জিজ্ঞেস করবেনা?”
মায়া হকচকিয়ে উঠে বলে,”হ্যাঁ, অবশ্যই। স্যার ভালো আছেন?”
কাব্য মুচকি হেসে উত্তর দেয়, সে ভালো আছে।
★★★
বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে আনোয়ার। নিজেকে তার আজ একটা ব্যর্থ পিতা মনে হচ্ছে। সে কবিতার মাকে এতোটাই ভালোবেসেছিল যে তার কারণে তার আশেপাশে থাকা সবাইকে সে অবহেলা করেছে।।কবিতার মাকে ভালোবেসে বিয়ে না করলেও বিয়ের পর কেমন একটা মায়া জন্ম নিয়েছিল। অভাবের সংসারে শত কষ্টের মাঝেও সে সবসময়ই হাসিমুখে থাকতো। সামান্য একটা দর্জির দোকান ছিল তার। কবিতার মাও কাজ জানতো। নিজের বিয়ের সব গহনা বিক্রি করে দিয়ে একটা বড় দোকান কিনেছিল নিজের স্বামীর জন্য । সেই দোকানটাই আজ শো-রুমে রুপ নিয়েছে। এই বাড়িটা কত কষ্ট করে বানিয়েছিল তারা। সব লোন যখন শোধ হলো, তখন গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল তাকে। কবিতা তখন পেটে। তখন সে পড়তো না। বলতো ছেলের বউয়ের জন্য রাখেন। নয়তো মেয়ের জন্য। সে হাসতো। বলতো বাচ্চা না হতেই কত দূরের চিন্তাভাবনা। বাচ্চাটাকে নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল তার। কিন্তু বেচারি চোখের দেখাও দেখে যেতো পারলো না মেয়েটিকে। মেয়েটিকে দুনিয়ায় আনার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দিল। তখন আনোয়ারের মনে হয়েছিল সব দোষ বাচ্চাটার। মুখও দেখেনি তার। কোলেও নেয়নি। বৈরাগ্য জীবন নিয়েছিল। বড় আপাই তখন তার দেখাশোনা করছিল। হুট করেই একদিন সে শুনলো তার জন্য মেয়ে ঠিক করেছে। সে দেখতেও যায়নি পাত্রীকে। সে তো বিয়ে করতে চায়নি। বিয়ের রাতে দেখলো মেয়েটার শরীরে কবিতার মায়ের জন্য আনা গয়না। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল তার। বাসর রাতে সব গয়না খুলে তাকে দিয়ে দিতে বলেছিল। মেয়েটি ভয়ভয় চোখে তাকে দিয়েও দিয়েছিল। পরবর্তীতে হয়তো তাকে আরো অনেক গয়না কিনে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেই রাতে কি সে কাজটা ঠিক করেছিল? তার কি উচিত ছিল না, তাকে বুঝিয়ে বলা?হয়তো তাহলে সে বুঝতো। মেয়েটিকে সময় দিতো না সে মোটেও। নিজের মেয়েটিকেও যে সে ভালোবাসতো, তেমনটিও না। তার মা তার স্ত্রীর সাথে যে খারাপ ব্যবহার করতো, সেটা সে বুঝতো। কিন্তু কিছুই বলতো না। তখন তার কাজকে সে সঠিকই মনে করতো, কিন্তু আজ কেন এতো অনুতাপ হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে সবকিছুর জন্য সেই দায়ী? তার যে মা তার স্ত্রীর বাড়ির লোকদের সহ্যই করতে পারতো না গরীব বলে, হঠাৎ করেই তারা কিভাবে যেন তার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল। তারা বেশিরভাগ সময়ে এই বাড়িতে এসেই পড়ে থাকতো। মা কিছুই বলতো না। কিন্তু কবিতাকে বড় আপাকে দিয়ে দিয়েছিল। এমনকি মৃত্যুর আগে সে বলে গিয়েছিল তাদের বাড়িতে যেন তার শ্বশুরবাড়ির লোকের কোনো অসম্মান না হয়। তারা যেকোনো সময় এই বাড়িতে আসতো। সে কিংবা আনিকা দাওয়াত না দিলেও। এমনকি আনিকার বড় বোনের ছেলেটা এই বাড়িতেই থাকে বেশিরভাগ সময়ই। আর হয়তো পারবেনা তারা এই বাড়িতে বিনা দাওয়াতে আসতে। তাদের এই বাড়িতে আসার পথ যে তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মদোষে বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আজ নিজেকেই সবকিছুর জন্য দায়ী মনে হচ্ছে। সে যদি কবিতা আর আনিকাকে কিছুটা হলেও ভালোবাসতো, তবে হয়তো আজ এইরকম একটা দিন আসতো না। তার মেয়েটা এতো কষ্ট নিয়ে এই বাড়ি থেকে চলে যেতো না। এতো অনুতাপ নিয়ে সে বাঁচবে কিভাবে?
কায়রা আজ একটুও দুষ্টুমি করছেনা। হয়তো মায়ের কষ্ট হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছে। মায়ের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আয়রাও চুপ করে আছে। আনিকা বুঝতে পেরে বলে,” তোমরা না ঘুমিয়ে কেন ঘুমের ভাণ করে আছো বলোতো?”
আয়রা আর কায়রা দুজনেই চোখ মেলে তাকিয়ে হেসে বলে,”আম্মু। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কি মা?”
কায়রা বলে,”কবিতা আপু কি আর আসবে না আম্মু? আমাদের সাথে কি রাগ করেছে আম্মু? আর আসবে না? আমাদের কে আদর করবে না? আপু তো বলেছিল এইবার আমাদের সাথে থাকবে। অনেকদিন থাকবে। চলে গেল কেন আম্মু?” বলতে বলতে কেঁদে দেয় দুজনেই। কান্না ব্যাপারটা যেন সংক্রামক। সেটা ছুঁয়ে যায় আনিকাকেও। সেও কান্না করতে করতে বলে,”কেন আসবে না মা? অবশ্যই আসবে। এইটা তো তারও বাড়ি। তার মায়ের বাড়ি। সে অবশ্যই আসবে।”
“সত্যি আসবে? কবে আসবে?”
“এখন আসবেনা মা। পরে আসবে। ”
“পরে কবে মা?”
“সেটা জানিনা। তোমরা কি কালকে কবিতা আপুর কাছে যাবে? ”
দুজনেই একসাথে বলে,”হ্যাঁ, কালকেই যাবো। তুমি কি নিয়ে যাবে আম্মু?”
“অবশ্যই নিয়ে যাবো মা আমার। কিন্তু এখন যে ঘুমুতে হবে। না ঘুমুলে সকালে দেরি করে উঠবে আর দেরি করে উঠলে কবিতা আপুর কাছে যেতেও দেরি হবে।”
“ওকে, মা। আমরা ঘুমুবো এখনই। এই কায়রা চোখ বন্ধ কর।”
মেয়েদের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আনিকা। ইশ, কি সুন্দর তারা। আরিয়ানও কত সুন্দর। তার প্রথম বাচ্চাটাও কি এতোটাই সুন্দর হতো? আচ্ছা, তার কি মেয়ে হতো নাকি ছেলে? আনিকা জানে বাচ্চা নষ্ট করা উচিত না। তাহলে আল্লাহ জীবনেও ক্ষমা করে না। মানুষ তো চাইলেও একটা প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না। তবে তার কোন অধিকার আছে যে একটা প্রাণকে হত্যা করার? আচ্ছা, আল্লাহ কি তাকে ক্ষমা করেনি? কিন্তু সে তো কিছু করেনি। সে তো কিছু জানতোই না। তার শাশুড়ীকে সে জীবনেও ক্ষমা করবে না। মরে গেলেও না। তবে, আজ তার বেশ হালকা লাগছে। তার স্বার্থপর মা বোনেরা আর আসবে না। আর আসারই কি বা দরকার? তারা যা চেয়েছিল তা তো তারা পেয়েছেই। বড় বোনটার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যৌতুক চেয়েছিল, ছোট বোনটার বিয়ে হওয়ার দরকার ছিল। ভাইদের পড়াশোনার দরকার ছিল। কবিতার দাদী তাকে পছন্দ করায় তাকেই বলির পাঠা হতে হয়েছিল। আর কবিতার দাদীকে ব্ল্যাকমেইল করে এই বাড়িতে অবাধ যাতায়াতের সু্যোগ পেয়েছিল তারা। আজ সব সুযোগের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তার প্রয়োজন নেই এমন পরিবারের৷ যে পরিবারের মানুষ তাকে ব্যবহার করে উপরে উঠেছে। আনিকা রুমে এসে চোখ বন্ধ করতেই ফোনটা বেজে উঠলো। সে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মা ফোন দিয়েছে। সে মনেমনে ভাবে, এমন মা থাকার দরকার কি? এমন মা থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here