সত্ত্বাহীন_আমরা #পর্বঃ১৩ #বর্ষা

0
338

#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ১৩
#বর্ষা

জ্যোতি আর জাহিদ নিজেদের বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলে।গড়ে তুলতে থাকতে তাদের ছোট্ট জুরফাকে।চার বছর বয়সী জুরফা ছিল বাবার ভক্ত।বাবাকে হারিয়ে হয়ে ওঠে বোনের ভক্ত। কিন্তু বছর ছয়েক পেরোতেই বোনের বিয়ে হয়ে যায়।বোনকে শশুর বাড়ি রেখে আসার সময় সে কি কান্নাটাই না করে সে।ছোট থেকেই জুরফা ছিল নিজের মাঝেই এক অনন্য দৃষ্টান্ত।সে তার ভাই-বোনদের কষ্টটা বুঝতো।সে কখনোই এমন কিছু চাইতো না তবে চেয়ে নিলেও পরিবা থেকে না পেলে কষ্টটা সে জমিয়ে রাখতো না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ তার খুব কান্না পেতো। কেন কান্না পেতো তা জুরফা কখনোই জানতো না।আমি মা হয়েও জুরফার মনের অবস্থা তখন জানতাম না। আমাদের জুরফা ছোটবেলায় প্রচন্ড বোকা থাকলেও বয়ঃসন্ধির পর থেকে যেন আলাদা চরিত্রেই প্রবেশ করে।তবুও বন্ধুদের মতো এতো মিশুক জুরফা হতে পারেনা।কিছু প্রতিবন্ধকতা তার মাঝে রয়েই যায়।আমি জুরফাকে সবসময়ই একজন অতিব সাধারণ শিক্ষার্ হিসেবেই জানি।তবে জুরফার মধ্যকার আকর্ষণ নামক কিছু আছে।যা অন্যদের ওর প্রতি প্রভাবিত করেই ফেলে।ওকে কেউই সাধারণের মতো ভাবতে পারেনা।ওর দিকে প্রভাবিত হওয়ার প্রধান কারণ ওর হাসিটা! মাশাআল্লাহ এমন হাসি মন ছুঁয়ে যায়।

আজ আমার মেয়ের পনেরো তম জন্মদিবস।মেয়েটার মন অনেক খারাপ!ওর বন্ধু-বান্ধব কেউই নাকি ওর জন্মদিবসের কথা মনে রাখে নাই।(বিঃদ্রঃ আপনাদের লেখিকার সাথেও আজ এমন ঘটেছে)মেয়েটাকে হাসাতে জিহাদ সেই কখন থেকে ওর পেছনে পড়েছিল। কিন্তু হাসাতে পারেনি।মন মরা হয়েই বসেছিল স্কুল থেকে বাসায় এসে।আমি জানি আমার জুরফা সবই বোঝে। তবুও তো সে কিশোরী বয়সে পা দেয়া রমনী!

—আম্মু আপু কল দিছিলো?

—না।তোমার ভাগ্নে,ভাগ্নির জ্বর তো তাই হয়তো সারাদিন ব্যস্ত ওদের নিয়ে!

—হুম!

জুরফা নিজ কক্ষে গিয়ে মোবাইল টিপতে শুরু করে।আমি বিরিয়ানি রান্না বসিয়ে দেই।মুরগির বিরিয়ানি।মধ্যবিত্ত মানুষদের কাছে গরুর বিরিয়ানি এখন আর সম্ভব না।যেই হারে সবকিছুর দাম বাড়ছে এর মধ্যে মুরগি বিরিয়ানিই বিলাসিতা।জিহাদ আমায় হাতে হাতে সাহায্য করছে।ছেলেটার বয়স হয়েছে।এখনকার যুগে ওর কাজকে ফ্রিল্যান্সিং বলা হয়। পাশাপাশি দুটো টিউশনি তো করছেই।আমার জুরফাও টিউশনি করে।

জ্যোতির বিয়ে হয়েছে পাঁচবছর।দু বছরের একটা বাচ্চা ছেলে আর মাস একের বাচ্চা মেয়ে তার।ভালোই আছে জ্যোতি।স্বামীও হয়েছে তার ভালোই। সহযোগিতা করে তাকে। শাশুড়ি,ননদ,দেবর,জা নিয়ে বিরাট সংসার। সংসার দায়িত্ব থেকে এখন ছুটি নিয়ে নিয়েছে জ্যোতি!মেয়েটা আর ছেলেটার জ্বর হয়েছে। ওদের নিয়েই থাকছে।

—হ্যাপি বার্থডে সোনামনি!

—কেমন আছো?

কথা বলতে বলতে জুরফা আমার কাছে আসে।মেয়ে তার বড় বোনের সাথে কথা বলছে।জুরফা বোনের সাথে আল্লাদী আচরণ করে।জ্যোতিও বোনকে প্রচন্ড ভালোবাসে।জ্যোতির সাথে কত যে ঘুরতে গিয়েছে জুরফা!

আমার খুব খুশি লাগে আমার বাচ্চাগুলোর জন্য।কত সুন্দর এদের সম্পর্ক! কিন্তু আমার ভাই-বোনদের সম্পর্ক!বর্তমানে সুইহীন সুতা!আজ কয়েকমাস যাবৎ যোগাযোগ বলতে প্রয়োজন।আর সম্পর্ক আছে স্বার্থের খাতিরে!

আমি বেশ আছি। কিন্তু মাঝে মাঝে অনেক কষ্ট পাই।আমার সন্তানেরা তাদের অধিকার পায়নি।আমার মেয়েটা তো ওর দাদাবাড়ির নামও মুখে নিতে চায় না। কিন্তু আমার ছেলেটা চায় ওর চাচাদের সাথে সম্পর্ক সুসৃঙ্খল করে বিন্যস্ত করতে।তবে কি তা আর করা সম্ভব!

জিহাদ ফোন দিলে ওদের দাদাবাড়ির লোকেরা কথা বললেও নিজ থেকে তারা কখনোই খোঁজ খবর নেয় না।জুরফা তার পনেরো বছরের জীবনে কখনোই তাদের চাচা কিংবা অন্য কোনো নামে সম্বোধন করেনি।আর না তার করার কোনো আকাঙ্ক্ষা আছে।জ্যোতি এতো অভিমান করে রাখলেও সে চাচাদের চাচা বলে এখনো ডাকে এবং মানে। কিন্তু জুরফা!সে ঘুনাক্ষরেও মানতে নারাজ!

আব্দুর রহিম ঢাকায় আছে বর্তমানে।ব্যাংকের ম্যানেঞ্জার পদে। দুই মেয়ে আর এক ছেলেসহ বউ নিয়ে থাকে সে ভাড়া বাড়িতে!ভালোই জীবন যাপন করছে সে। রকিবুলও ভালোই আছে।কয়েকদিন আগে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে এসেছে।ভাই তাকে পড়িয়েছে কলেজ পর্যন্ত। তারপরের ব্যবস্থা সে নিজেই করে নিয়েছে।বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল একটা কোম্পানিতে কর্মরত সে। ভালোই চলছে ওদের জীবন।এখন আর আমাদের সাথে যোগাযোগ নেই কিংবা একে অপরের সাথে যোগাযোগ নেই বললেই চলে।

উপমা বেগমের অবস্থা মোটামুটি।রহমত আর ছোট মেয়ে রুপাকে নিয়ে গ্রামেই আছেন।রহমতের মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে কি হয়নি তা বোঝা দায়। পড়াশোনা করেনি।রিকশা চালিয়ে খায় এখন।যে যা দেয় তাই নেয়।দরাদরি করে না।কিছুদিন আগে দোকান দিয়ে ১০০০ টাকার দোকানে বাকি পড়েছিল ৯১০ টাকা।সেই টাকা আর সে তুলতে পারেনি।

—আম্মা বড় ভাইয়ে নাকি আমার লিগা কি পাঠাইছে?

—আব্দুর রহিমের কথা কস?

—হ,আর কেউ কিছু পাঠাইছে?

—রকিবুলেও পাঠাইছে।গা,গোতর ধুইয়া ঘরে যা আমি রাইন্দা আইতাছি।

—আম্মা এখন দেহাও!

—দিমু চারখান।একদম কানের নিচ বরাবর।যাইতে কইসি!

উপমা বেগমের ধমকানোতে চলে যায় রুপা। শ্যামা বর্ণ হয়েছে মেয়েটার। কিন্তু ওর বড় দুবোন অনেক ফর্সা। কিন্তু আগে ওরাও কালো ছিল।উপমা বেগম ওদের কারোই যে তেমন যত্ন করেন নাই তাই এমন হয়েছে।যত্ন মানুষকে পরিবর্তন করে। অসুস্থকে যেমন সুস্থ করে ঠিক তেমনি যত্নহীনতা মানুষকে অসুস্থও করে।

রুপসা আর রুপন্তি উভয়েরই একমেয়ে।রুপসার মেয়ে নয়না প্রচন্ড ফর্সা।বয়স আর কত হবে!বছর আটেক।এই বয়সেই সে বর্ণের ভেদাভেদ করে।শ্যামা কারো সাথে মিশতে চায় না। অন্যদিকে রুপন্তির মেয়ে আনিশা।বয়স বছর ছয়।শ্যামা গায়ের রং।নয়না প্রায়ই দ্বিধাদ্বন্দ্ব করে আনিশার সাথে খেলতে শুধু তার গায়ের রং শ্যাম দেখে। ওদের মায়েদের মাঝেও এ নিয়ে খারাপ লাগা আছে।নয়নার মাঝে লজ্জাবোধ হয়ে ওঠেনি।তবে ছোট আনিশার মাঝে লজ্জাবোধ এখনই বেড়ে উঠেছে।

ওইবার যখন আব্দুর রহিমের বড় মেয়ে তন্নির বিয়েতে গ্রামে আসলো সবাই তখন ঝর্ণার মেয়ে হাতে করে সব বাচ্চাদের জন্য কিছু না কিছু এনেছিল।জ্যোতি সব বাচ্চাদের কাপড় দেয়।কেউ কিছু না বললেও নয়না বলে ওঠে,

—একটার সাথে প্যান্ট দিছো আরেকটার প্যান্ট কোথায়?

জ্যোতি লজ্জায় পড়ে যায়। কিন্তু জুরফা সে তো বোনকে সেফ করতে ছিল।জুরফার কোলে তখন ইজহান অর্থাৎ ওর ভাগ্নে। জুরফা ফট করে নয়না না চিনেই বলে দেয়,

—কেন তুমি বেড়াতে আসার সময় এক্সট্রা প্যান্ট আনোনি?

ওর উক্ত কথায় জুরফার এরূপ প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হয়েছিল নয়না।তাতে কি ,জুরফা তো জুরফা!

—এনেছি।

—তাহলে যখন এনেইছো সেখান থেকেই এই জামার সাথে ম্যাচিং করে পড়েনিও।

জুরফা পুরো বিয়ে বাড়ি ঘুরেছিল।ইজহান মাটিতে হাঁটতে পেরে সে কি খুশি। অবশ্য তখন ওর একবছর পূর্ণ হলেও সে একা হাঁটতো না ভয় পেতো।কেউ হাত ধরে রাখলে হাঁটতে পারতো।সবাই বিয়ে খেয়ে ফিরে আসে। অবশ্য সুযোগ করে একবার গিয়েছিল ওদের দাদাবাড়ি।তবে জুরফা তাদের কোনো কিছু বলে সম্বোধন করেনি।

রহিমা এসেছিল।জুবায়েরের সাথে ডিভোর্সের পর বিদেশ যাত্রা করেছিল সে যার ইতি টেনেছে সে বছর চারেক আগে।আরেক বিয়ে করেছে।।সুখেই আছে।তার আর জুবায়েরের মেয়ে নুসাইবাও ওর পরিবার নিয়ে এসেছে বোনের বিয়ে খেতে। রোকেয়া, রাহেলা এবং রেহানার পরিবারও এসেছে।সবার পরিস্থিতি একেকরকম। রোকেয়া যে তার সর্বস্ব সংসার জীবনেই ঢেলে দিচ্ছে!আর রাহেলা স্বামীর সাথে দুবাইতে আছে। তাদের দুই মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস, জান্নাতুন মাওয়া।আর রেহানা তার স্বামীর দিহান্ত হয়েছে। রেহানার শশুর বাড়ির লোকজন অমায়বিক ভালো বিধায় তাকে নিজেদের মেয়ের মতো আগলে রেখেছে।রেহানার চারবছরের ছেলে সোহান আর সে এখন সুখেই আছে বলতে গেলে!

বিয়ে শেষে সবাই ফিরে গিয়েছিলেন নিজ নিজ লক্ষ্যে। যাইহোক জুরফার গোপনীয় এক কথায় আসি, জুরফা মনে মনে এখনো একটা বিশাল যৌথ পরিবার চায় যা আদৌ সম্ভব না।যৌথ পরিবারের গল্প তাকে ভাবুক করে তোলে।

ঝর্ণার প্রচন্ড কোমড় ব্যথা।বছর কয়েক আগে পিত্তথলিতে পাথর ধরা পরার সময়ই মেরুদন্ডে যে হাড় বাঁকা হয়ে অন্য হাড়ে ঢুকে গেছে তা ধরা পড়েছে।পিত্তথলি অপারেশন করে ফেলে দিলেও মেরুদন্ডের হাড়ের আর কিছুই করা হয়ে ওঠেনি।জয় থাকতে যেই পরিমান ঔষধ সে দিনে সেবন করতো তা এখন মাসেও হয়তো হয়না।

ঝর্ণার মাঝে বার্ধক্য এসেছে।কথায় কথায় কাঁদার বিষয়টা সেই ছোট থেকেই তার মাঝে বিদ্যমান ছিল এবং এখনো আছে।কিছু একটা যদি তাকে কষ্ট দেয় এখনও সে কাঁদে।যদি সে সদ্য কিশোর বয়সী পা দেওয়া কিশোরী হতো তবে তাকে বলা হতো ছিঁচকাদুনী!তবে সেই বয়সেই কিন্তু ঝর্ণার কাঁধে ছিল বিশাল দায়িত্ব।বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের দায়িত্ব। ঝর্ণা নামাজ,কালাম, কোরআন শরীফ সব থেকেই জ্ঞান অর্জন করছে।সে যে তার আখিরাত সুন্দর চায়।এখন যে সে আবারো তার নানাজানকে দেখতে পায়।শেষ যে বার দেখেছিল সে বার তার নানাজান তাকে বলেছিল,

—বেগম, তুই চিন্তা করিস না সময় হইলে আমিই তোরে নিতে আসমু!

ঝর্ণার মনে ভয় জেঁকেছে জুরফাকে রেখে মৃত্যুর কোলে যদি সে ঢলে পড়ে কি হবে তার জুরফার।জিহাদ জ্যোতি বেশ বড় হয়েছে। জিহাদের বিয়ে দিতে হবে।আর জুরফা সে তো মাত্র ক্লাস নাইনে।তার সামনে পরে আছে পুরো একটা জীবন।ঝর্ণা জানে জ্যোতি আর জিহাদ তার মেয়ে জুরফাকে দেখে রাখবে। কিন্তু সে যে তার জুরফাকে দিয়ে ভরসা পায় না।এ মেয়ে এখনই বলে দিয়েছে,

—আম্মু আমি সত্যিই বলছি তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তবে আমি আর এখানে থাকবো না।ঢাকায় চলে যাব।স্কুল শেষে রাত আটটার মধ্যে করা যাবে এমন কাজ খুঁজে নিবো অনলাইনে এবং আমি বাঁচবো!

ঝর্ণার এই কারণেই মেয়েকে নিয়ে ভয় হয়।সত্যিই যদি তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে ঢাকায় চলে যায় এবং খারাপ লোকের পাঙ্গায় পড়ে তখন..!ভাবতেই রুহ কেঁপে কেঁপে ওঠে ঝর্ণার।বড্ড আদরের যে মেয়ে তার।জয়ের আম্মাজান।জয়ের মৃত্যুর দু’ঘন্টা আগেও জয় তার আম্মাজানকে বুকে নিয়ে বলেছিল,

—আম্মাজান,তুমি এতো বড় হবা।আমি তোমারে পুতুল সাজামু।একটা রাজপুত্রের হাতে তুলে দিমু।

জয়ের সেসব কথা যে ঝর্ণাকেই এখন পূরণ করতে হবে।জয়ের আম্মার বিয়ে তো সে সুপুরুষের সাথেই দিয়েছে।বাকি আছে আরো দুজন।জিহাদ সে ফ্রিল্যান্সিং এর পাশাপাশি যে ইন্টার্নে করছে তা শেষ হলেই চাকরি নিবে এবং তার পরপরই মিষ্টি এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে!আর জুরফা তার এখনো ঢের সময়।আরো আট-নয় বছর! কিন্তু ঝর্ণা তার স্বপ্নের মানে খুঁজে পায়না।সে যদি তার আগেই..!

সমাপ্তি

(বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।আশা করছি পাঠকগণ আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য জানাবেন।হ্যাপি রিডিং পাঠকগণ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here