সত্ত্বাহীন_আমরা #পর্বঃ৬ #বর্ষা

0
139

#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ৬
#বর্ষা

মা ডাকটা হয়তো অনেক মধুর।তবে আমার সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হলো আমার চিত্তে বহু ভুল ধারণার উদয় ঘটলো।একেই তো নরমালে বাচ্চা জন্মাতে গিয়ে বিশটা হাড় ভাঙার কষ্ট সহ্য করেছি দূর্বল শরীরে।তারপর একটু সুস্থ হতেই আম্মার কটাক্ষ ধ্বনি শুনতে হলো।আম্মা আমায় কটাক্ষ করে বললেন,

“করছোস তো মাইয়া পয়দা।তোর শশুর বাইত্ত তোন কেউ আহে নাই দেখবার।আর জামাইরে তোর আব্বায় হেই ভোরে খবর পাঠাইছে এহনো আহে নাই।”

আমার চোখ বেয়ে বাঁধাহীন অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।মা হওয়ার স্বাদ ভুলে নিজের সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে অপবাদ দিতে লাগলাম।ভাবতে লাগলাম তবে কি সেদিনের বলা জয়ের সব কথাই কি ভিত্তিহীন ছিল!আমার অশ্রু বাঁধ মানছিল না।মেয়েটাও খাবারের জন্য কেঁদেই যাচ্ছিল।যতই হোক আমি তো ওর মা।দাই মা আমাকে ধরে বসিয়ে দিতেই মেয়েটাকে শোয়া থেকে কোলে তুলে খাওয়ালাম।মেয়েটা আমার হাতের আঙ্গুল শক্ত করে ধরে রাখলো যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাব।মেয়েটা আমার স্বাধীনতা দিবসে ভোরবেলা জন্মেছে।আব্বাই সবার আগে কানে আজান দিয়েছেন দাই মা বললেন।আমাকে ওই ঘরেই রাখা হলো। মেয়েকে রহিমার কাছে রেখে গোসল করে আসলাম রোকেয়ার সাহায্যে। গোসল ঘরে রহিম আর রোকেয়া মিলে পানি এনে রেখেছিল আমার জন্য।সেই পানিতেই গোসল করলাম। নরমালে প্রথমে প্রচন্ড যন্ত্রণা ভোগ করলেই বাচ্চা জন্মানোর পর সেই যন্ত্রণা অর্ধেয়াংশে নেমে এসেছিল অর্থাৎ সহ্যসীমায়।

“আপা দেখো আমার ছোট্ট আম্মায় আমার দিকে কেমনে তাকাইয়া আছে?”

রহিম প্রফুল্ল হয়ে ঝর্ণাকে বলে।রহিমা বাইরে গেছে বিধায় মেয়েটা আমার রহিমের কোলে।রহিম আমাকে আবার বলে,

“আপা,আমগো আম্মার নাম অনেক সুন্দর রাখমু।আমগো মতো এমন নাম রাখমুনা।”

“কি নাম রাখতে চাস ভাই?”

আমার আট-নয় বছরের ভাইটা অনেক বড় হয়ে গেছে।অনেক কিছু বোঝে।কে বলবে একবছর আগেও আমার এই ভাই অনেক বোকা ছিল! রোকেয়াকে দেখে আমি আশ্চর্য।মেয়েটা এখন প্রায়ই পাগলামী করে।মাথায় পানি না ঢালা অব্দি পাগলামী থামে না। পড়াশোনা করার কোনো ইচ্ছে আমি আমার রোকেয়ার মাঝে কখনোই খুঁজে পাইনি। রোকেয়া তার ছয়বছরের ছোট এই জীবনে মা মরার পূর্বেই তার থেকে মৃৎশিল্প শিখে রেখেছে।তার জীবনে যেন খাওয়া, ঘুম, পড়াশোনা বলতে কিছুই নেই শুধু আছে মৃৎশিল্প। তবুও তো সে মায়ের কিছু একটা আগলে ধরে বেঁচে আছে। কিন্তু আমরা!

“জ্যোতি”

রহিম খুবই বিরাট কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছে এমনভেবে আনন্দিত হয়।আসলেই নামটা সুন্দর।জয়ের নামের সাথে মিলে যায়।জয়…। জয় তো এখনও এলো না।আসতে কি অনেক সময় লাগে তবে!

“হ্যা রে ভাই অনেক সুন্দর হইছে!”

“আপা জানো আমি এই নাম কই পাইছি?”

“কই পাইছিস?”

“জ্যোতি মানে আলো আর আমাদের ছোট আম্মা তো আমাদের জীবনে আলো হয়েই এসেছে।তাই আমার নাম জ্যোতি!”

আমি রহিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।মেয়েটা রহিমের কোল থেকে উঠে যেতে চাইছে। বুঝলাম,কিছু একটা তো করেছে।আমি রহিমের থেকে মেয়েকে কোলে নিয়ে চৌকির কিনারায় শুয়িয়ে দিলাম।মেয়েকে পরিষ্কার করে বুকে নিলাম। এতোক্ষণের ভয়ডর সব যেন আমার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। রহিমের বলা কথাটাই ঠিক আমার মেয়েটা আমার জীবনে জ্যৌতি হয়ে এসেছে।

“আপা,আপা কি হইছে জানো?”

রেহানা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে আসে।মেয়েটা আমার নিকট বেশি ঘেঁষে না।হয়তো ভয় পায় নয়তো অন্য কিছু!মেয়েটার হাত টেনে চৌকিতে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলাম কি এমন হয়েছে যে তাকে এভাবে ছুটতে হলো!

“আপা জানো দুলাভাই কি করছে দুইটা খাসি, পঁচিশটা শাড়ি,বিশ প্যাকেট মিষ্টি নিয়া আইছে!”

“তোর দুলাভাই আইছে কই হেয়?”

“আমগো শয়তান নানীরা আটকাইয়া রাখছে।হাদিয়া না দিলে নাকি জ্যোতিরে দেখতে দিব না!”

“ওহ। আচ্ছা তোকে কে বললো ওর নাম জ্যোতি?”

“হি হি।রহিম ভাইয়ে পুরা গ্রামে দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া কইতাছে!”

আমি রেহানার কথায় হেসে দিলাম।পাগল ভাই আমার! আচ্ছা রহিমা কোথায় গেল!এখনও যে এলো না।রহিমার কথা ভাবছিলাম এবং তখনই সে এসে হাজির হলো।হাতে স্টিলের মাঝারি সাইজের একটা বাটি।ভেতরে সাদা যাউ।বাটিটা আমার পাশে রেখে জ্যোতিকে কোলে তুলে নিলো।আমার খালাতো মামাতো ভাই বোনেরাও এসেছে। তাদের কাছে নিয়ে যাবে বলেই যেতে নিলেই বললাম।

“রহিমা ওকে নিয়ে বাইরে যাস না।”

“আপা ভয় পাইয়ো না।আমি ওরে পাশের রুমেই নিয়া যামু!”

রেহানাও ওর সাথে চলে যায়।আমি খাবার শেষে বাটিটা আগের যায়গায় রেখে দেই।মেয়েটাকে নিয়ে গেল দশমিনিট হবে। প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে। তখনই বাচ্চা কোলে ঘরে প্রবেশ করলো জয়। বাচ্চা দেখে বুকটা ধুক করে উঠলেও পরক্ষণেই মনে পড়লো জ্যৌতির কথা।মেয়েটার গন্ধ আমি দূর থেকেও পাই।এই হয়তো মাতৃত্বের স্বাদ।

“ভয় পেয়েছিলে?”

“বিশ্বাস ছিল!”

“জানি তো।তাইতো তুমি আমার সেদিন কিনে দেওয়া শাড়িই পড়েছো!”

সত্যিই মনে গোলক ধাঁধা গাঁথা থাকলেও আমি বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়েছিলাম।তার সেদিন কিনে দেওয়া শাড়িটাই আজ পড়েছি।গাঢ় নীল শাড়িটা আমার মনে বেশ লেগেছে।তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,

“মন খারাপ লাগছে?”

“আব্বা তো বলেছিলেনই ছেলে সন্তানই সব। মেয়েদের পরের ঘরে যৌতুক দিয়ে তুলে দিলে আর দায়িত্ব থাকে না!”

“আমার জ্যৌতি কিন্তু আমার সব।মনে রেখো,আমার এটা আমার আরেক মা।নেও ওকে রাখো।আমি তোমার শশুর বাড়ির লোকদের নিয়ে আসি গিয়ে।”

“আজই তো শহর থেকে আসলেন বিশ্রাম করুন।কাল নাহয়…”

“জ্যৌতির আম্মু এই যে এই ব্যাগে মেয়ের জন্য কিছু কাপড় আছে ধুয়ে দিতে বলো কাউকে।তোমার শশুর বাড়ির লোক আসলে জামা পড়িয়ে তারপর দিবা!”

“একদিনের বাচ্চাকে জামা পড়াবো?”

“এতো শীতের মাঝে মেয়েটাকে শুধু কাথায় রাখবা!”

আমি আজ প্রচন্ড খুশি।আম্মা মরার আগে আমাকে একজন সু পুরুষের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন।যেখানে আমার মেয়ের প্রয়োজন সম্পর্কে আমি অবগত হয়নি,সেখানে তিনি ওতদূর থেকে এসেও অবগত।এটাই হয়তো বাবা-মেয়ের টান।তাহলে আমাদের সাথে আমাদের আব্বার টান কোথায়!ওহ আমি কিভাবে ভুলে যাই আম্মা মরার আগে আব্বাও তো এমন টান দেখাতো আমাদের প্রতি।আমি মরলে হয়তো আমার মেয়েটার সাথেও এমন হবে! একাকী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।ইশ,আজ যদি আম্মা থাকতো তবে আমার কতই না খেয়াল করতো!আর নতুন আম্মা সে তো দ্বিতীয়বার ফিরেও দেখলো না এই ঘরের দিকে…!

মাতবর ভিটায় তুলকালাম কাণ্ড।জয় তালুকদারের নামকরণ হয়েছিল জয় কারণ সে বিজয়ের সময় জন্মেছিল।তখন সাড়া দেশ চাচ্ছিল জয়।তাই তার দাদা তার নাম রেখেছিল জয়।কে জানতো এই জয় তার দাদার মতোই মাতবর হবে!কে জানতো মাত্র ইন্টার পাশ করেও সে বিশাল এক কোম্পানির ম্যানেঞ্জার হবে।হ্যা ১৯৯২ সালে ইন্টার পাশ মানে অনেক কিছু।আর যদি থাকে চাকরির দক্ষতা তবে আর কি!
ঘন্টাখানেক আগেই জয় মাতবর ভিটায় ঢুকেছে।সবাইকে হুমকি দিয়েছে ঘন্টাখানেকের মাঝে তার মেয়েকে দেখতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত না হলে খবর করে ছাড়বে সবার।

“আম্মা শুনেন?”

ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বার দুয়েক ডাকে জয়।তার আম্মা নাসিমন বিবি বাইরে যেতে পকেট হাতড়ে ছোট এক প্যাকেট বের করে।মায়ের হাতে তুলে দেয়।মা তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েই রয়েছে।

“আম্মা আব্বায় যদি আমার শশুর বাড়ি যাইয়া আমার মাইয়ার হাতে কিছু না দেয় খারাপ দেখাইবো!আমি আমার মাইয়ারে দেওয়ার লাইগা এইডা আনছিলাম।আপনে দিয়া দিয়েন!”

“মাতবর তোর বাপে যে গুষ্টি সুধ্ধা লোক নিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করতাছে!এতো মানুষ তোর শশুর খাওয়াইবো কেমনে?”

“আম্মা আমি আগেই জানতাম আমার মাইয়া হইছে খবর পাইলে আব্বা জীবনেও যাইবনা নিজ মর্জিতে।আর আমি যদি নিতে আসি তাইলে কিছু না কিছু অকাম করবোই।তাই সন্তান হইলে আকিকা দেওয়ার লিগা আর আরেকটা দিয়া আত্মীয় স্বজন খাওয়াইতে আমি দুইডা খাসি কিন্না আনছি!”

“ভালা করছোস বাজান!”

জয় ওখান থেকে চলে আসে।আজ তার অনেক খুশি লাগছে।সেও একটা পুতুল পেতেছে।যাকে সে নিজের ইচ্ছে স্বাধীন সাজাতে পারবে।যে তার দুঃখ বুঝবে।সে তার মেয়েকে অনেক পড়াবো।বড় মানুষ বানাবে।অনেক অনেক আশার আলো বাসা বাঁধছে তার হৃদয়ে।বাড়াবাড়ি রকমের জল্পনা-কল্পনা। হঠাৎ জয় কেঁদে দেয়।মনে পড়ে,মেয়েটা তো একদিন তার বড় হবে।অন্যের বাড়ি চলে যাবে তার ঘরটা ফাঁকা করে।জয় কাঁদতে থাকে।

“চাচা লও আমরা প্রস্তুত!”

সুমন কথাটা বললেও শিমুল, খোকন,দুলাল আর ওদের বোনেরাও ছিল।বাড়ির আর কারো মাঝে তার মেয়েকে দেখার আগ্রহ না থাকলেও এদের মাঝে প্রবল আগ্রহ।এরা সবাই পিঠাপিঠি জন্মেছে তাই একে অন্যের ছোটবেলা এদের মনে নেই।তাই এতোগুলো বছর পর তাদের সেজ চাচার বাচ্চা হওয়ায় তারা অনেক খুশি। এদের কাছে বাচ্চা মানে শুধুই বাচ্চা।মেয়ে বা ছেলে বলে কোনো ভেদাভেদ না।আসলেই বাচ্চাদের মনটা সত্যিই বিশুদ্ধ।নয়তো বড়রা মেয়ে হয়েছে বলে/ছেলে হয়নি বলে বাচ্চা দেখতে যাবে না, জেদ আঁকড়ে বসে আছে সেখানে এরা আগ্রহবোধ করছে।

ইনশাআল্লাহ চলবে

(বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here