#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ১২
#বর্ষা
আমার জীবনে আবারো দূর্বিষহ নেমে এলো।ছেলেটা বড় চারেকের হতেই যখন আবার বাচ্চা নিলাম,সে মৃত জন্মালো। অসুস্থ হয়ে পড়লাম।তখন ফ্লাটে থাকি আমরা।তিন তালায় আমরা আর দুইতলায় গার্মেন্টসের কাজ হয়। প্রচন্ড পেট ব্যথা হতো তারপর থেকে।ডাক্তাররা বলে দিল,আমি আর কখনো মা হতে পারবো না।এই শব্দটা আমাকে শেষ করে দিয়েছিল।জয় আমার অনেক খেয়াল রাখতেন তবুও আমার অসুস্থতা যেন বেড়েই চলেছিল।জয় বড় এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে।কড়া ডোজের ঔষধ দিয়েছিলেন ডাক্তার।ডাক্তার আপা যে পেট ব্যথা বন্ধ হলে ঔষধ খেতে নিষেধ করেছিলেন তা আমাদের মনে ছিল।পেট ব্যথা বন্ধের পরও ঔষধ সেবনে গলা দিয়ে রক্ত উঠেছিল!সে কি কান্ড।ছেলে মেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিল!সেদিন রাতেই জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয় আমাকে।ডাক্তার আপা সেই কি বকাই না বকে ছিলেন জয়কে।
—আপনার তো দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল জয় আহমেদ!
—দুঃখিত ডাক্তার আপা!
—আমাকে দুঃখিত বলে কি হবে এখন। আল্লাহকে ডাকেন!
ডাক্তার আপার সহানুভূতি এবং চিকিৎসায় আমি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাই। কিন্তু কিছু ঔষধ আমাকে সারাজীবনের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়।বছর পেরতোই চলে আসি গাজীপুর।আমার বাপের বাড়ি থেকে আরো অনেক দূর।জয় বিশাল ফাঁকা জায়গার মাঝে জমি ক্রয় করেন। অবশ্য বাড়ি করার পূর্বে কয়েকমাস ভাড়া থেকেছি আমরা।জ্যোতি আর জিহাদকে মৌচাক স্কাউটে ভর্তি করানো হয়েছিল।ছেলে মেয়ে দুটোতেই অনেক খুশি ছিল নতুন বন্ধু বান্ধব পেয়ে।এভাবেই আমার তৃতীয় সন্তান গত হবার আট বছর পেরিয়ে যায়।
—আম্মু ,আম্মু দেখো আমি এ প্লাস পেয়েছি!
—সাধারণ বিষয়।গোল্ডেন তো আসেনি।
—দেখিস আপু আমিও তোর মতো পাবো!
আজ এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছে।জ্যোতি এ প্লাস পেয়েছে।এই সময় সব শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিভাগ দেওয়া হয় না।তবে জ্যোতি নিয়েও ছিল এবং পেরেও ছিল।
জ্যোতির আব্বু পুরো চল্লিশ কেজি মিষ্টি পুরো গ্রামে বেলোয়।মেয়েকে আদর করে খাওয়ায়।ছেলেকে ডেকে বলে,
—তুমি যদি এ প্লাস পাও তোমার জন্যও এমন আয়োজন হবে।
আমি জ্যোতিকে প্রচন্ড শাসন করি।মেয়ে মানুষের শাসনে বড় হতে হয় নয়তো পরের বাড়ি গেলে বাবা-মায়ের কথা শুনতে হয়। তাছাড়া তখন মেয়েটাও হয়তো কষ্ট পাবে কিন্তু মুখ ফুটে পরিবারের কাছে কিছু বলবে না,তার থেকে এখন মায়ের অতিরিক্ত শাসানিতে বড় হলে আর মেয়ের চোখের অশ্রু তখন গড়াবে না।আর ছেলে তো ঘরের তাই একটু কম শাসালেও চলে।তাই তো জয় মেয়েটাকে একটু বেশি আদর দেয়। তাছাড়া প্রথম সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার টান আলাদাই থাকে।
—আম্মু কি হয়েছে তোমার?তুমি বমি করছো কেন?
—জ্যোতি ঘরে গিয়ে তোমার আব্বুকে ফোন দেও! তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলো।
—আম্মু কি হইছে সেটা বলো!
—জ্যোতি যাও।
জয় বাসায় আসতেই জয়ের নিকট গিয়ে বললাম,
—জয় আমার পেটে মনে হয় টিউমার হইছে?দেখো কেমনে নড়ে!
—আরে কিছু হয় নাই গ্যাসে সমস্যা।ঔষধ খাওয়া তো বাদ দিছো।
—জয়..
—আচ্ছা ঠিক আছে চিন্তা করো না
কালকে সকালে ডাক্তারের কাছে যাবো!
সকাল যেন অন্যরকম ছিল আমাদের নিকট।পুরো আটঘন্টা এক হাসপাতাল হতে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটির পর জানতে পারলাম আমার মাঝেকার নতুন প্রাণের অস্তিত্বের কথা।ডাক্তাররা সেই কি হাসি।আমার বাচ্চাটা নাকি খেলছে।কোনো এক টেস্টে ফুটে উঠেছে সেই দৃশ্য।
বাকি চার মাসও দেখতে দেখতেই চলে যায়।আমার জুরফার জন্ম হয় অক্টোবরের এক তারিখে(বিঃদ্রঃ পাঠকগণ আমারও কিন্তু একই দিনে জন্মদিন)।ব্যবসাও যেন বড় হতে থাকে।আমি যেন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঔষধের সংখ্যা যেন আরো বাড়ে।আমার থেকে অধিকাংশ সময় জুরফা ওর বাবার কাছেই থাকতে লাগলো।বাপ পাগলা হয়ে উঠলো। কিন্তু মেয়েটার ভাগ্যে বেশিদিন বাপের ভালোবাসা লেখা ছিল না।জ্যোতি বরিশাল মেডিকেল কলেজে চান্স পাওয়ার পর জয় আমাদের উপার্জিত সকল ধনসম্পদ এক ব্যক্তিকে বিশ্বাস করে দেয় যাতে ওই ব্যক্তি জ্যোতিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পাইয়ে দেয়! কিন্তু না জয় প্রতারিত হয়।সেই দুঃখ সে বরদাস্ত করতে পারে না! দুই মাসের মাথায় হার্ট স্টোকে সে পরপারে পাড়ি জমায়।
জয়ের কবর শেষে শশুর বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয় যদি গ্রামে গিয়ে বড় মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে ছেলেকে দিয়ে কৃষি কাজ না করাই তবে তারা আমাদের দায়িত্ব নিতে পারবে না।আমার শাশুড়ি আম্মা বেঁচে নেই নয়তো সহযোগিতা পাওয়ার কোনো ভরসা পাওয়া যেতো।প্রচন্ড ভেঙে পড়ি। আব্দুর রহিম আমায় শশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি নিয়ে আসে।জুরফা তখন সারাদিন আব্বু যাবো,আব্বু যাবো বলে জ্বালাতে থাকে।একদিকে স্বামী হারিয়ে সত্ত্বাহীন হওয়া অন্যদিকে মেয়ের এমন ভেঙে পড়া যেন আমাকে আরো অসুস্থ করে ফেলছিল।আমার পাশে তখন ছায়া হয়ে দাঁড়ায় আমার ছেলে মেয়ে দুটো।ওরা বলে আম্মু আমরা তো আছি,কিছু না কিছু করে ঠিক খেতে পারবো আমরা! গাজীপুরে আবার চলে আসি।তারপর থেকে একপ্রকার যুদ্ধ শুরু হলো যেন জ্যোতিটা সকাল পাঁচটায় উঠে প্রাইভেট পড়াতে চলে যেতো তারপর ভার্সিটি করে এসে আবার রাত দশটা পর্যন্ত টিউশনি করতো।পরিচিত সবাই টিউশনি দিয়েছে বিধায় অনেকগুলো পাওয়া সম্ভব হয়েছে।আর ছেলেটা এসএসসি দিবে।তাই বাবার রেখে যাওয়া ভাড়ার দোকান চালানো আর পড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকতো সে।আর আমি টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করতে লাগলাম।
বাজ পড়া যেন শেষ হচ্ছিলই না। আমাদের বাড়ির জমির সামনের কতটুকু অংশও নাকি বিক্রি করা। লোকেরা বলে গেল।আমি মাঝবয়সে এসে আর পাগল হতে চাইলাম না।কি বোকামিটাই না করে গেল জয়!আজ যদি সব স্বয়সম্পত্তি থাকতো তবে ছেলেমেয়েগুলোর এতো কষ্ট করতে হতো না।
★
রহিমা ওর সংসার টেকাতে পারেনি।কয়েকবছর একসাথে থাকার পর ছোঁয়ার জন্মের পরপরই জুবায়ের আরেকটা বিয়ে করে।বিয়ের কারণ অবশ্য রহিমার শাশুড়ি ছিল।তিনি রহিমাকে কাজ নিয়ে এটা সেটা বলে খোটা দিতেন আর রহিমা তাতেই তেতে উঠতো। তারপর একসময় সব যখন জুবায়েরের হাতের বাইরে চলে যায় তখন সে রহিমাকে তালাক দিয়ে আরেকটা বিয়ে করে।রহিমা মেয়েকে নিয়ে আসতে চাইলেও তা করতে দেইনি ওর শাশুড়ি।দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন,
—আমার নাতনি এই বাড়ির তোন কোনো হানে যাইবো না মনু বুঝলানি!
রহিমা শশুর বাড়ি ত্যাগ করে আসার কয়েকমাস বাদেই সব কাগজপত্র জোগাড় করে বিদেশের মাটিতে পা দেয়। রহিমা সংসার না করতে পারলেও রোকেয়া ঠিকই আলমের সাথে সংসার টিকিয়ে রেখেছে বহুবছর।আব্বা সেদিন কিঞ্চিত ভাবুক হলেও পরে ঠিকই ওই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। রোকেয়া এখন দুই সন্তানের জননী।স্বামী এবং ছেলেদের নিয়ে সুখের সংসার ওর। শশুর শাশুড়ির আজ্ঞাকারী বউও বটে।
★
উপমা বেগম এখন চাল সন্তানের জননী। রহমতের আচরণে এখন প্রকৃত অর্থেই ওর সমস্যাগুলো ফুটে উঠেছে। অনেকটা মানসিক প্রতিবন্ধকতা আছে রহমতের।রুপসা আর রুপন্তি দুজন ভারী মিষ্টি হয়েছে বটে।তবে প্রচন্ড কুবুদ্ধি অন্তরে।আর রুপা সে তো ঝর্ণার মেয়ে জুরফার মাত্র সাত দিনের বড়।
রাজিব মিয়া ইন্তেকাল করেছেন জয়ের মৃত্যুর ছয় মাস পূর্বে। স্ট্রোকের পর ওনার গাল ব্যাকা হয়ে গিয়েছিল।ফলে কথা সে ভালো মতো বলতে পারতো না।আর তাছাড়া রিটায়ার্ডমেন্টের সুখটা যেন সে মানতেই পারেনি।তাইতো স্ট্রোকের নয়মাস অতিক্রমের পরপরই তার দিহান্ত হলো।
আব্দুর রহিম উপমা বেগমদের দেখে এখন।আহ,কি দরদই না এখন উপমা বেগম ওদের জন্য দেখান। আব্দুর রহিম শুধু অবাক হয়। আব্দুর রহিমের পড়াশোনা শেষ প্রায় বছর খানেক। রকিবুলের পড়াশোনা চলছে।আর রাহেলা এবং রেহানার বিয়ে হয়েছে ভালো ঘরে।দু বোনই ইন্টারপাশ। আব্দুর রহিম নিজের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা বরাবরই করে আসছে।বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার প্রতিশোধ পরায়ণ মনটাও শান্ত হয়েছে।বিয়েও করেছে বছর চারেক আগে তার বড় দুলাভাই বেঁচে থাকতেই।একটা দুই বছরের মেয়েও আছে তার।
আব্দুর রহিম কয়েকদিন বড় আপার পাশে ছিল তাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করতে।বাসায় ফিরে দেখে তাদের আম্মা তার বউকে দিয়ে গাধার খাটুনি খাটাচ্ছে। আব্দুর রহিমের রক্তিম চেহারায় ভীত হয়ে সেদিন উপমা বেগম পালিয়ে ছিলেন।পরে লুকিয়ে বাসায় আসতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলেন তিনি। আব্দুর রহিম ওনাকে দিয়ে মাফ চাইয়েছিল।উপমা বেগম অপমানিত হয়েও যেন শান্তি পাননি আরো অপমানিত হতে চেয়েছিলেন!তাইতো নুসাইবার খাবার কেড়ে নিয়ে নিজের ছোট মেয়ে রুপাকে দিয়েছিলেন।
আব্দুর রহিম তেমন কিছু না বললেও রকিবুল বলেছিল অনেক কিছু। প্রতিবেশী শুধু বিনোদন নিয়েছিল।ফেরাতে আসেনি কেহ।
★
জয়ের বাপের বাড়িতে সব বেশ চলছে।তার ঘরটা ভেঙে ফেলা হয়েছে।ঘর ভেঙে এক কোণে সব ফেলে রাখা হয়েছে।জয় তো মরেই গেছে আর ওর বউ তো ঢাকায় গেছে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। নিশ্চিত বিয়ে করে আরেক ব্যাটার সাথে সংসার পাতবে !এমন ধারণায় জয়ের পরিবারের।
তৃশা মাঝে মাঝে ওর চাচির সাথে যোগাযোগ করলেও এই বাড়ির মানুষগুলোর সাথে সে কখনোই যোগাযোগ করবে না।এই বাড়ির মানুষগুলো এক একটা হারামী যা ও ভালো করেই জানে।সামনে থাকে ভালোবাসা দিয়ে মুড়ে দেয় আর দূরে গেলে একটা ফোন দিতেও তাদের মন চায় না।২০১৩ সালে এসে ফোনের জন্য এতো হাঁসফাঁস কাউকে করতে হয়না।মধ্যবিত্তদের সকলেরই আছে।জয়ের প্রত্যেক ভাইয়ের হাতে ফোন আছে।
তৃশা ওর বাপ চাচাদের বড্ড ঘৃণা করে।তারা অমানুষ একেকটা।ওরা মেয়েদের কোনো সুবিধা দিতেই চায়না। শুধু ছেলেদের সুযোগ সুবিধা দেয়। কিন্তু এখন ওর বাবা হারে হারে বুঝতে পারছে!কারণ ওর ভাইয়েরা ওর বাবার দায়িত্ব নিতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে এবং নিজেদের জায়গা জমির ভাগ চাইছে।
তৃশার আব্বাও ত্যাড়ামি করে ছেলেদের সম্পত্তি দেবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। ছেলেরা রাগে জেদে বাড়ি ছেড়েছে।তৃশার আব্বার জেদ যেন মাথা চাড়া দেয়।ফলে ওদের মা’কে ইচ্ছে মতো পেটায় আর ছেলেদের এমন বেয়াদব হওয়ার মূল কারণ ওনাকেই বানায়।তৃশার আম্মা প্রচন্ড অসুস্থতায় জীর্ণশীর্ণ শরীরের মানুষটা শয্যাশায়ী হয়।
তৃশা বহুবছর পর জামাই নিয়ে বাপের বাড়ি আসে মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে।এতো বছরে একবারও বাপের বাড়িতে পা সে রাখেনি।ওর কোলে ছোট মেয়ে আর ওর স্বামীর হাত ধরে আছে একটা দশ এগারো বছরের ছেলে।ওর স্বামী ওকে এমনভাবে আগলে রেখেছে যেন একটু বেখেয়ালি হলেই বহুমূল্যবান কিছু হারিয়ে যাবে!
ইনশাআল্লাহ চলবে
(বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল! কালকে সকালের পর্বটা আজকে রাতেই দিয়ে দিলাম।হ্যাপি রিডিং)