সত্ত্বাহীন_আমরা #পর্বঃ১ #বর্ষা

0
401

আম্মা মরার পর যেন আমার ভাই-বোনের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল।আম্মার যখন ক্যান্সার ধরা পড়লো তখন আমার ছোট ভাই রকিবুল দিনকয়েকের।রহিমা নয়ে পা দিছে,রহিম সাতে পা দেবে,রোকেয়া তখন পাঁচ বছরের আর রেহানা, রাহেলা তখন বছর তিনেকের জমজ বোন।আর আমি নানার মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য মাত্র নয় বছর বয়সেই বলির পাঁঠা হই।বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় আমার।

পড়াশোনার প্রতি তীব্র ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও আমি শিক্ষিত নারী হতে পারবো না কেন!এ কথাটা আমার মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে পারেনি।

যেদিন আমার বিয়ে হলো রকিবুল তখনও জন্মায়নি।আম্মাও তখন বেশ সুস্থ।আমার অসুস্থ সরকার নানার হুকুমে বেশ বড়সড় করেই আমার বিয়েটা হলো উনার সাথে।আমি তখনও ওনাকে দেখিনি। শুধু শুনেছিলাম,উনি ঢাকায় চাকরি করেন।

শশুরবাড়িতে প্রবেশের পরপরই আমাকে যেই গহনা দিয়ে আনা হয়েছিল সেগুলো খুলে নেয় আমার শশুর।অতসব বোঝার জ্ঞান তখনও হয়নি যে আমার।এক কাপড়ে আনা হয়েছিল আমায়।নানা আমার বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন যিনি যৌতুকের ঘোর বিরোধীতা করতেন।ফলে আমার বিয়েতে যৌতুক চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারেননি আমার শশুর।

ভোরবেলা ঘুম শেষে উঠার পর জানতে পারলাম গহনাগুলো ছিল মেজ জায়ের।তাই কালই নিয়ে নিয়েছেন। অবশ্য গহনার মূল্যায়ন করার মতো প্রাপ্তবয়স্কা নারী আমি ছিলাম না।

আমার শাশুড়ি আম্মা ছিলেন অসম্ভব ভালো মনের একজন মানুষ।বড় জা,মেজ জা আমার অনেক বড়।তবুও কাজের সময় তারা আমাকেও কাজ দিতেন।আমার শাশুড়ি আম্মা ভাবিদের ধমকের সুরে বলতেন,

“বুয়ারাও তো তুমগো সাহায্য করবার লাগছে।তাইলে তুমগো কোন হেতু সেজ বউয়ের সাহায্য লাগবো?”

আম্মার কারণেই আমি ক্লাস সিক্স পর্যন্ত স্কুলে যাইতে পারছি।দশের কোঠায় পা দেওয়ার পরই আমার উনি আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।খুব ভয় পেতাম ওনাকে।স্বাস্থ্য ছিল মাশাআল্লাহ।তবে ভয়ঙ্কর রাগী মানুষ ছিলেন তিনি।আমার কোনো আত্মীয় আমাকে দেখতে এলেই তাদের সঙ্গ ধরে শুধু একটা চিঠি লিখেই চলে আসতাম।

এমনি ভাবে চলে এসেছিলাম যখন আমার তেরো বছর বয়স।আম্মা তখন গর্ভবতী। খুব অসুস্থ থাকতেন।আম্মার চিন্তায় শহরে একা থাকা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল।তাইতো ছোট মামা আমাকে দেখতে গেলেই তার সঙ্গ ধরে চলে আসি।প্রতিবার আমার উনি আমাকে সপ্তাহ দুয়েক পর নিতে আসলেও এবার আর তার কোনো বার্তা কিংবা সে আমার কোনো খোঁজ নিলেন না।আমার আব্বা,মামা-রা সবাই ভয় পেয়ে গেলেন।ওনাকে খুঁজতে বড় মামা আর মেজ মামা শহরে গেলেন।আর ছোট মামা আমার শশুরবাড়িতে গেলেন। মিনিট পঞ্চাশের পায়ে হাঁটা মেঠোপথ পেরলেই আমার শশুর বাড়ি।ছোট মামা সন্ধ্যা আমার ওনাকে নিয়ে ফিরলেন। পরিবারের বড় মেয়ে ছিলাম আমি সকলের খুব আদরের। কিন্তু সেদিন ছোট মামা আমায় বকলেন।আমার নানী আমাকে কটাক্ষ করে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে ঝর্ণা জামাইরে হালাইয়া বারবার আইয়া পড়ছ কেন?”

“আমি কি করমু কও নানী! তুমগো জামাই বাজার তওন সব পঁচা পঁচা তরকারি আনে।একদম মজা লাগে না। ছিঃ ”

আমার কথায় নানী আশ্চর্যচকিত হয়ে আমার উনি অর্থাৎ জয়কে জিজ্ঞেস করলেন,

“কিগো নাত জামাই তুমি কি কিপ্টামি করবার যাইয়া পঁচা তরকারি আইনা আমার নাতনিরে খাওয়াও?”

নানীর এমন প্রশ্নে কিঞ্চিত চুপ থেকে দম বন্ধকর হাসি হাসতে হাসতে বললেন,

“বুড়ি তোমার নাতনিরে বুঝাও শহরে তাজা জিনিস পাওয়া যায়না সহজে। বাসি তরকারিই কিনতে হয়।নয়তো যে তাজা তরকারি আনি তা সব ফরমালিন যুক্ত। তাই স্বাদবিহীন।”

ওনার কথায় দাদী হাসতে হাসতে কক্ষ ত্যাগ করলেন। আসার এতক্ষণ পর্যন্তও সে সরাসরি আমার সাথে কথা বলে নাই। এরপরও উনি কিছুক্ষণ নিরবতা পালন শেষে আমার দিকে কিঞ্চিত দৃষ্টি স্থাপন করে ক্ষমা করে দিলেন।আম্মার তখন আটমাস চলছে।তাই তিনি শহরে ফিরে গেলেও আমাকে রেখে গেলেন।

যেদিন আমি চৌদ্দতে পা দিলাম সেদিন আম্মার পানি ভাঙলো।ব্যথা না থাকায় আব্বা দ্রুত হাসপাতালে নিলেন। ভাইয়ের জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ পায়নি।আম্মার অবস্থা সাংঘাতিক।সদর হাসপাতাল থেকে ডাক্তার-রা ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন।অনেক কমপ্লিকেটেড ক্যাস ছিল আম্মার। রকিবুলকে বাসায় রেখেই আব্বা আম্মাকে নিয়ে ঢাকা শহরে ছুটলেন। তাদের প্রণয়ের বিবাহ না হলেও আব্বা আম্মাকে পছন্দ করেই ঘরে তুলে ছিলেন।বড় মামার অধীনে আর ছোট মামার সহযোগী হিসেবে আব্বা মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিজয়ের পরপরই নাকি আব্বা মামাদের সাথে নানা বাড়ি গিয়েছিলেন।তখন নাকি নানার হুংকারে বাড়ির পরিবেশ বেগতিক।

“আকবর যাতো তো আমার বন্দুকটা আন।আইজ ওই মানিক ডাকাত বাচবো নয় আমি বাচমু!”

নানার হুংকারে মামারা নাকি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। নানার মুখের কথায় তাদের মাথাও আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।দৌড়ে ঘর থেকে বন্দুক নিয়ে এসেছিল।আব্বা যখন তাদের কারণ জিজ্ঞাসা করেন তখন জানতে পারেন তখনো আমার না হওয়া আম্মাকে বিয়ে করতে চায় ডাকাত মানিক।আব্বাও যেন ক্ষেপলেন। কিঞ্চিত পূর্বে দেখা নারীর প্রতি তিনিও তীব্র এক আকর্ষণবোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি মামাদের দমালেন।বুঝে শুনে কাজ করার অনুরোধ করলেন।

“স্যার,আপনার বোনকে তো মানিক ডাকাত বিয়ে করতে চেয়েছে,এখন আপনি যদি তাকে গুলি করে হাজতে যান তবে আপনার বোনকে পরে দেখবে কে!স্যার ছোট মুখে বড় কথা বলবো।ক্ষমা করবেন।অনুমতি…”

বড় মামা কিছু বলার পূর্বেই মেজ মামা আব্বাকে তাড়াতাড়ি কথা সমাপ্তির কথা বলে বললেন,

“বন্ধু তুমি দাদাকে দাদা বলেই বল।”

“হ্যা হ্যা, রাজিব তুমি আমাকে দাদা বলেই বলো!”

আব্বা মামাদের সম্মতি পেয়েই মায়ের হাত চেয়ে বসেছিলেন।নানা তো আমার সেই ক্ষেপে ছিলেন। কিন্তু মায়ের সম্মান যেন ক্ষুণ্ন না হয় তাই আমার অনাথ বাপের কাছেই শেষমেশ আম্মার বিয়ে হয়।আম্মা কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো এখন ফিকে মনে হচ্ছে।কিভাবে আজ আব্বা আম্মা মরার উনচল্লিশ দিনের মাথায় বিয়ে করলো আমি ভেবে পাচ্ছি না।

“ঝর্ণা পোয়াতি অবস্থায় ছোট ভাইরে এতো কোলে রাইহো না।তোমার বাচ্চার ক্ষতি হইতারে!”

দশ মাসের রকিবুল মেঝেতে হাত-পা ঝোড়াঝুড়ি করছে।আব্বার দ্বিতীয় বউ নিয়ে কিছুক্ষণ পূর্বেই আব্বায় ঘরে ঢুকছে।আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আমি পরিস্থিতি মানতে অক্ষম।

“আপা আমি আম্মার কাছে যামু!”

কান্না করতে করতে রেহানা,রাহেলা আসে।মা ভক্ত মেয়ে ছিল এই জমজ দুজন।গালে হাত বুলিয়ে আদর করতে নিতেই রেহানা ছিটকে কয়েককদমা পিছিয়ে যায়।

“রেহানা এদিক আয় তো দেখি কি হইছে?”

রেহানা আগায়না। নিশ্চুপ থাকে সে। যেন বাকহীন সে।

“রাহেলা, বলতো আমায় রেহানার কি হয়েছে?”

“আপা খিদা লাগায় কাকির কাছে খাওন চাইছিলাম আমরা।কাকি খাওন তো দেই নাই।উল্টা রেহানারে চড় মারছে!”

রাহেলার কথায় আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।যেই চাচি কোনদিন আমাদের ধমকের সুরে কথা বলেন নাই। সেখানে আজ ওদের গায়ে হাত তুলছেন!আমার মাথায় রাগ যেন তড়তড় করে বাড়ছিল তখন।আজ পঁয়তাল্লিশ দিন আমি গ্রামে।চার মাসের অন্তঃসত্ত্বাও বটে। কিন্তু এতো সবের মাঝে একটা জিনিসই বারবার আমার মস্তিষ্কে ঘুরছে।

“আমিও যদি মরে যাই তবে উনিও হয়তো দ্বিতীয় বিয়ে করবেন।এখন আমার ভালো চাওয়া মানুষগুলোই তখন আমার সন্তানদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে!..”

ভাবতেই আমার কলিজা কেঁপে ওঠে।আমি রেহানা রাহেলাকে বুকে আগলে নেই।আমি যে ওদের বড় আপা, ওদের আরেক মা! কি করো ওদের অবহেলা মানতে পারি!

ইনশাআল্লাহ চলবে

#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ১
#বর্ষা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here