সত্ত্বাহীন_আমরা #পর্বঃ৩ #বর্ষা

0
173

#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ৩
#বর্ষা

নতুন আম্মা আব্বার সামনে আমাদের সাথে আলগা পিড়িত দেখায় বললেই চলে।ঐতো কাল যখন জয় আসলেন তখন তো আব্বার সাথেই এসেছিলেন।আহা নতুন আম্মার কি যত্ন আত্মী আর আজ সকাল থেকে একবার তার খাবারের খোঁজ নিতে আসেন নাই। অবশ্য সকাল বেলাই আব্বার আর জয় বাইরে গেছেন।আমি যখন ভাবনায় অতি ব্যস্থ তখন হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করে রহিমা।

“আপা,আপা নতুন আম্মায় শুক্লার মায়েরে কি কইতাছে শুনবা?”

রহিমা এমন একটু সচেতন হয়ে বসলাম।রহিমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার পাশে বসিয়ে বললাম।

“আগে একটু আরামে বয়।নয়তো শ্বাস-প্রশ্বাসের নাইলে তালুতে উঠবো!দৌড়াইয়া আসার প্রয়োজন কি ছিল?”

“বড় আপা নতুন আম্মায় শুক্লার মায়েরে কইতা ছিল,আমরা নাকি হেরে সহ্য করবার পারি না।হের লগে খারাপ ব্যবহার করি। আচ্ছা আপা সহ্য কি?”

নয় বছরের রহিমার মুখে এরূপ কথা শুনে ধপ করে রাগ উঠে যায় আমার।ওই মহিলা একেই তো আব্বার কাছে আমাদের খারাপ বানাচ্ছে, এখন আবার বাইরের মানুষের কাছেও বানাচ্ছে।এসব তো আর মানা যায় না। কিন্তু এই মহিলার কাছে না থাকলে ওদের তো দেখার কেউ থাকবে না। সাতদিন যাবৎ রকিবুল তার কাছেই আছে। রকিবুল দুধমাতা ছাড়া আমাদের যেন চেনেই না। অবশ্য আমাদের সাথে নতুন আম্মায় খারাপ আচরণ অল্প করলেও রকিবুলকে বেশ আদরই করে।হয়তো রকিবুলের মাঝে নিজের মৃত সন্তানকেই খোঁজার চেষ্টা করেন।

“আপা…”

“সহ্য মানে যাকে…যাকে… পঁচা মনে হয়,খারাপ মনে হয়,মিশতে মন চায় না তাই!”

“আপা আমরা তো এমন করি না। তাইলে নতুন আম্মায় এমন কইলো কেন?”

মুহূর্তেই মুখটা চুপসে ফেলে রহিমা।অতি কাতর স্বরে বলে,

“আপা আমগো আম্মা কি আর কখনোই ফিরবো না?”

রহিমার অতি কাতর কন্ঠ যেন আমার হৃৎপিণ্ডে ব্যথার আবির্ভাব ঘটায়।চোখ বাঁধা ভাঙতে চায়। তবুও বাঁধ ভেঙে ঝড়তে পারে না।আমি কিছু বলার পূর্বেই জয়ের আওয়াজ পেলাম।কালই এসেছে সে।আব্বা নতুন আম্মাকে বিয়ে করার তেরো দিন চলছে।আজই আমাকে শশুর বাড়ি চলে যেতে হবে।কাপড় গোছাচ্ছিলাম আমি।রহিমার প্রশ্নের জবাব আর দিলাম না। বললাম,

“দেখতো গিয়ে তোর দুলাভাই বাজার থেকে কি আনছে!আর শোন বারান্দায় বসিয়ে পানি খেতে দিস।বুঝলি?”

রহিমা মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরে চলে গেল অর্থাৎ সে বুঝতে পেরেছে।রহিমা যদি মায়ের দ্বিতীয় সন্তান হতো তবে ওর বয়স এগারো হতো। কিন্তু না ও মায়ের তৃতীয় সন্তান। বর্তমানে ও আমার মেজ বোন হলেও আমাদের ঝুমকা বেঁচে থাকলে রহিমা হতো সেজ বোন।মায়ের কাছে শুনেছিলাম ঝুমকা দু’বছর বয়সে ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।মা তারপর থেকে আমাকে নিয়ে আরো বেশি সচেতন হলেন।তারপর একে একে জন্ম নিল রহিমা,রহিম, রোকেয়া আর রেহানা এবং রাহেলা। আমাদের মা যেভাবে নিজ হাতে বয়স বছর তিনেক বড় করেছিলেন তা আর রকিবুলের কপালে জোটেনি।

আমি ভাবনাগুলো পাশে রেখে কাপড়ের ব্যাগটা গোছানো শেষ করলাম।ঘর থেকে বেরিয়ে জয়কে হালকা খাবার খেতে দেখলাম।পাশে বসে আমার ভাই-বোনেরাও খাচ্ছে আর তাদের দুলাভাইয়ের সাথে গল্প করছে।আমি রান্না ঘরের দিকে গেলাম। নতুন আম্মা রাধছেন। রকিবুল রোকেয়ার কাছেই ছিল যা আসার সময় দেখে এসেছি।নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

“আম্মা রান্ধা কি হইছে?”

“রানবার বইলেই রান্ধা হইয়া যায়নি!ধৈয্য নামক কিছু তুমগো মায় তুমগো শিখায় নাই?একটার পর একটা লাগেই তুমগো।”

ঝাড়ি মেরে মুখ বিকৃত করে জবাব দিলেন উপমা বেগম।এই মহিলা আমাদের সাথে এমন করেই কথা বলে। শুধু আব্বার সামনে আগলা পিড়িত দেখাইতে আসে।

“আম্মা আমগো আম্মায় তো আমগো কিছু শিগায় নাই।আপনি আমার ভাই-বোনগো শিখাইয়া লইয়েন তাইলেই হইবো!”

আমি মুচকি হেসে ক্রোধান্বিত চোখে সেখান থেকে ফিরে আসলাম।আমি থেকেও ওদের এখনো সকালের খাবার খাওয়াতে পারিনি,আমি না থাকলে ওদের খেতে কয়টা বাজবে তা ভেবেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলাম। গর্ভবতী অবস্থায় নাকি এতো চিন্তা করতো নেই,সুষম খাদ্য খেতে হয় তার কোনটাই আমার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না।বেলা বারোটা বাজতে চললো।আজ শুক্রবার দিন। বিকেলের দিকেই শশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। মনে ভয় হচ্ছে ওদের যদি কিছু হয়ে যায়।আবার আরেক চিন্তাও রয়েছে।আজ একমাস চাকরি বাদ দিয়ে আমি গ্রামে জয় সবকিছু কিভাবেইবা সামলাচ্ছেন আল্লাহ মালুম।১৯৯২ সালের বাংলায় জৈষ্ঠ্য মাসের শেষদিকে চলে এসেছে। ঘাঁটায় পানি উঠেছিল। চারদিনের কড়কড়া রৌদ্রে উজানে পানি নেমে গেছে।

“কি এতো ভাবছো ঝর্ণা?এসো এখানে বসে খেয়ে নেও।বেলা তো হয়ে আসছে!”

জয়ের কথায় মুচকি হাসলাম। কিন্তু খাবার…!খাবার খেলেই যে বমি হয়ে বেরিয়ে আসে সব। ইশ্ তখন যে মাথা ঘোরে.. মরে যেতে মন চায়। নিজের ভাবনায় নিজেই ক্রোধান্বিত হলাম।যদি মরে যাই তবে ইনি তো ঠিকই আরেক বিয়ে করে বাবা হতে পারবেন কিন্তু আমার ভাই-বোনেরা!

রাজিব মিয়া দোকানে বসেছেন।শিক্ষকতা তো করছেনই করছেন।সরকারি ভাতাও সরকার থেকে অবশ্য পাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা বলে কথা।নিজের কোনো ইচ্ছেই ছিলো তার না,ঝর্ণার মামাদের জোরাজুরিতে নিচ্ছেন শুধু সরকারি ভাতা।আরো অনেক কাগজ পত্রের ব্যাপারও নাকি আছে সব ঝর্ণার মামারাই করতে বাধ্য করছেন। এগুলো নাকি ঝর্ণা আর বাকি পোলাপাইনের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে তাই নয়তো কখনোই করতেন না।

“কিগো চাচা কি এতো চিন্তা করো দোকানে বইয়া?”

প্রতিবেশী ফকরুলের পোলা জসিমে তেড়াবেকা দাঁতে হেসে বললো। রাজিব মিয়া বরাবরের মতো বিরক্ত হলেন।এই ছোকড়ার তাকে জ্বালানো ছাড়া আর কাজ নেই।হ্যা আরেক কাজ আছে তার মেজ মেয়ের সাথে গল্প করার বাহানা খোঁজা।

“তেমন কিছুই না। তুমি এইবেলায় এইহানে যে?”

“চাচা বাটার বন রুটি দেন পাসটা (পাঁচটা)।বাইত্তে মেজবান আইছে শহর থিকা।হেরা নাকি আমগো মতো সকালে ভাত খাইতে পারেনা।তাই নিতে আইলাম আরকি!”

রাজিব মিয়ার নিজের মাথায় নিজেই ইট মারার ইচ্ছে করছে।কেন যে প্রশ্ন করতে গেছিলেন।একটা জিজ্ঞাসা করলে দশটা উত্তর।এবার আর জবাবে কিছু না বলে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটলেন।বড় মেয়ে ঝর্নার সাথে আজ এগারো দিন যাবৎ কথা বন্ধ।মেয়েটা নাকি ওর নতুন আম্মাকে হুকুমে হুকুমে কাজ করায়!বাসায় ফিরলেই বউয়ের নালিশ শুনতে কার ভালো লাগে!তাই তিনিও আর কারো কাছে কিছু না শুনে মেয়েকে গর্ভবতী অবস্থায় কষে এক চড় লাগান। এমনিতেই নাওয়া-খাওয়া ঠিক মতো না করায় দূর্বল তার ওপর ভারী এক চড় খেয়ে যেন পড়ে যেতে যেতেও সামলে যায় ঝর্ণা।

“ঝর্ণা তোরে কি আমি এই শিক্ষাই দিছি?তোর আম্মা অসুস্থ থাকাকালীন না তুই বাইত্তে আইলে আমগো রাইন্ধা খাওয়াইছোস!তাইলে এহন তোর নতুন আম্মারে এতো হুকুম দেস কেন।নিজেও তো কইরা লইতারোস…!”

“আব্বা আমার তো নতুন আম্মার লগে কথাই হয় নাই এহনো!”

“ঝর্ণা মিথ্যা কইলে কিন্তু আরেকটা খাবি…!”

এক ধমক দেয় রাজিব মিয়া।ঘরে থাকা রেহানা বেরিয়ে এসে সুধায়,

“আব্বা বড় আপারে আপনে কি দিবেন? আমারেও দেন!”

অবুঝ রেহানার গালেও পড়ে এক চড়। মেঝেতেই পড়ে যায়।নিমেষেই লাল বর্ণ ধারণ করে।গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে ওর। মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে থাকে। ঝর্ণা আর চুপ করে থাকে না তখন।বজ্রধ্বনিতে বলে,

“লোকজন ঠিকই কয়, মা মরলে বাপ হয় তাওই!আপনে আমারে মারলেন তো মারলেন তিন বছরের রেহানারে কেন মারলেন?আপনি তো আমারেও জিগাইতে পারতেন আমি এগুলো করছি কিনা!না,এহন তো আপনি নতুন আম্মার কথায় আর চোখে দুনিয়া দেহেন!”

ঝর্ণা কথাগুলো বলেই মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়া রেহানাকে একটানে দাড় করিয়ে ওর উদ্দেশ্যে বলে,

“তোর আম্মা মইরা গেছে এই কথা মাথায় ঢোকা।আম্মা ছাড়া দুনিয়ায় কেউ আপন না!”

ঝর্ণা শেষের কথাটা রাজিব মিয়ার দিকে তাকিয়েই বলেছিলো।হয়তো সেই কথার মানেটা রেহানা বোঝেনি। তাইতো এখন তার আব্বার কাছে আদর থেকে আদর নিতে যায়।রাজিব মিয়া নিজ চিন্তায় হাঁটতে হাঁটতে উষ্টা খেলেন।মাটিতে পড়লেন না।ঝর্ণার মতোই সেও নিজেকে সামলে নিলেন।

বিকেল সাড়ে চারটার আমি শশুর বাড়ি আসলাম।সবাইকে দেখে মনে হলো,আমি আসায় যেন তারা খুবই অসন্তুষ্ট। শাশুড়ি আম্মা এগিয়ে এসে আমাকে আগলে নিলেন।আমার মেজ জা ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বললেন,

“এহহহ যত্তসব ঢং!আমরা যেন কোনদিন পোয়াতি হই নাই।”

আমি অবাক হলাম।আম্মা তো সবাইকেই খুব স্নেহ করেন,তবে তারা কেন আমাকে শুধু হিংসা করে? নিজের কাছে প্রশ্ন করে উত্তর আর পেলাম না।বড় জা আমার নিকট এগিয়ে এসে আগলে নিয়ে বললেন,

“এই যে সেজ বউ এহন তো তুমি মা হইবা!তহন তো নিজের মাইয়ার কাম নিজেরই করন লাগবো!হা হা”

“বড় বউ এগুলো কোন ধরনের কথাবার্তা কও তুমি!মাইয়া হইবো কেন!কও পোলা হইবো!”

আমার শশুরের ধমকে মুহুর্তেই বড় জায়ের মুখটা চুপসে গেল। আমার মনে হঠাৎ ভয় জাগলো।বড় আপা তো শুধু বলছিল,মেয়ে হলে মেয়ের কাজ আমারই করা লাগবো। তাতেই শশুর আব্বা যে ধমক দিছে!যদি ছেলে না হয়ে আমার মেয়ে হয় তবে কি হবে!আমার মনের ভয়ের কথাটা কেমন করে যেন জয় বুঝতে পারলেন।জয় বললেন,

“আব্বা মাইয়া পোলা যাই হোক!আমারই তো রক্ত হইবো!”

জয়ের কথায় ভয়টা কাটলো।জয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।এই মানুষটাকে আমি যখনই দেখি হাসতেই থাকেন। কিন্তু খুব অল্প বিষয়ে অনেক বেশিই রেগে যান।গায়েও হাত তোলেন।তাইতো ভয় লাগে।ওনার মতো খুব কম মানুষই আছেন হয়তো।ওনার হাত ধরেই তো ঢাকার মতো বিশাল অজানা শহরে পা রাখা।আবার ওনার হাত ধরেই তো রান্না-বান্নার হাতে খড়ি দেওয়া।

“বংশধর না থাকলে তোর সম্পত্তি তুই মরলে কেডা খাইবো?আমি মরলে তো আমার সম্পত্তি তোরা খাইতে পারবি।তোরডা কেডা খাইবো ভাবছোস!তোর বড় ভাইয়ের সম্পত্তি খাইবো খোকন আর দুলালে।আর তোর মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি সুমনে আর শিমুলে খাইবো!আর তোরডা?”

“আব্বা বড় ভাইয়ের মাইয়া তমা আর তৃশা নাম তো আপনে কইলেন না!”

জয় প্রশ্ন করতেই শশুর আব্বা ছ্যাত করে উঠে বললেন,

“মাতবর শোন মাইয়া মাইনষে সম্পদ দিয়া কি করবো?বিয়া দেওয়ার সময় ভারী যৌতুক দিলেই হইবো!আর তো সব ওর ভাইগোই থাকবো!”

আমার শশুর জয়কে মাতবর বলেই ডাকেন।গ্রামে আসলেই বিচার শালিসি সেই করে বিধায় গ্রামের মানুষ তাকে মাতবর বলেই ডাকে। এছাড়াও জয়ের দাদা ছিলেন এই গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন এবং মাতবর আর তাই এই বাড়ির নাম পড়েছে মাতবর ভিটা। অবশ্য শশুর আব্বার মাত্র বলা কথায় যে জয় সন্তুষ্ট হয়নি তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শাশুড়ি আম্মা তাড়া দেখিয়ে বললেন,

“ওগো বড় বউ আর কতক্ষণ তোমার শশুরের কথা শুনতে এনে দাঁড়াই থাকবা!সেজ বউরে নিয়া ঘরে যাও!”

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here