#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ১০
#বর্ষা
গ্রামে পৌঁছানো মাত্র শুনলাম রাহেলার অনেক জ্বর। রোকেয়া বোনের কাছে ছুটেছে।আমিও যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আব্দুর রহিম কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে তারপর যেতে বললো। রাহেলা জ্বর একটু কমেছে।আব্বা নাকি ঔষধি গাছের পাতা দিয়ে রসালো এবং অনেকটাই তিক্ত স্বাদের ঔষধি বানিয়ে রেখে গেছেন। আব্দুর রহিমকে বলে গেছেন রাহেলাকে খাইয়ে দিতে।আজ যেহেতু বন্ধের দিন তাই আব্দুর রহিম বাসাতেই থাকবে।আর আব্বা গিয়েছেন পদ্মার ওপার জমি মাপতে।জমি মাপার কাজও মাঝে মাঝে করেন তিনি।যাইহোক,ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিলাম। দুপুর হয়ে গেছে আমাদের আসতে আসতে।জ্যোতি এখনও ঘুমে।
—ঝর্ণা,তোমার বেশি খারাপ লাগছে?
—না।বোনটার জন্য চিন্তা হচ্ছে!
—আচ্ছা তুমি গিয়ে রাহেলাকে দেখো।আমি জ্যোতির কাছে আছি।
—আচ্ছা।মেয়ে উঠলে ওকে নিয়ে আপনিও চলে আসুন।
—হুম! সাবধানে নেমো।
জয়ের কথায় দেয়াল ঘেঁষে পাশে যে কক্ষ আছে ওইটায় গেলাম।এ বাড়িটা দোতলা।আমরা দোতলায় উঠেছিলাম।দোতলা আমার জন্য রিস্কের তাই আব্দুর রহিমকে বলে নিচের ফাঁকা কক্ষটা পরিষ্কার করে নিতে বলবো।নিচ তলায় তিনটা রুম আর বিরাট এক ফাঁকা জায়গা।আর ওপর তালায় পাঁচটা রুম।আব্বা এই বাসায় ওতো একটা আসেন না। ওরাই খাওয়ার সময় আব্বাদের ঘরে যায়।আগে খাওয়ার সময়ও যেতে চাইতো না ওরা। কিন্তু এখন যায়।
নিচ আসতেই শুনতে পেলাম ঝগড়া। রেহানা আর একটা মেয়ে ঝগড়া করছে।আমি ওদের থামাতে যাবো তার আগেই রোকেয়া গিয়ে দুইজনকেই থাটিয়ে চড় লাগিয়েছে। আব্দুর রহিম বাইরে ছিল রেহানার কান্নার শব্দে ছুটে আসে।কারণ জানতে চাইলে রোকেয়া বলে,
—ভাই রেহানা খেলতাছিল।এই মাইয়া ওর লগে খেলতে চাইলে খেলতে,ও খেলতে নেয়।মাইয়াডা এহন রেহানার খেলনা নিয়া যাইবো তাই টানাটানি করতাছিল আর রেহানা দিব না তাই ও টানাটানি করতাছিল। রেহানার খেলতে নেওয়া লাগবো কেন যারে তারে আর এই মাইয়ারই অন্যের খেলনা নেওয়ার এতো লোভ থাকবো কেন!
দুই দম ত্যাগে পুরো কথাটা শেষ করে রোকেয়া।ওর চোখ মুখ দিয়ে আগুন ঝড়ছে।যেন এখনই সবকিছু ভস্ম করে দেবে। আব্দুর রহিম ঠান্ডা মেজাজে রোকেয়াকে ঠান্ডা করে প্রথমে।তারপর নিজে গড়াগড়ি খেয়ে কান্নারত রেহানাকে কোলে তুলে নেয়।
—রেহানা আমি বলছিলাম না তমার সাথে খেলবি না তাইলে ওর সাথে খেলতে গেছোস কেন?
—ভাই,আমি খেলতে যাই নাই।ওই আইসিল!
রেহানা আর আব্দুর রহিমের কথার মাঝে আমি আব্দুর রহিমকে প্রশ্ন করলাম,
—তমা কে ভাই?
—আমগো সৎ মায়ের বইনের মাইয়া!
আমি কথা পরিবর্তনে আব্দুর রহিমকে বললাম,
—আচ্ছা,ভাই এগুলো বাদ দে।আমি রাহেলার কাছে যাচ্ছি।তোর দুলাভাই যে ব্যাগটা নিচে রেখে গেছে ওইটা নিয়ে ওই ঘরে আয়।
আমি রাহেলার কাছে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ওরা আসে। আব্দুর রহিমকে ব্যাগ খুলতে বললি।সবার হাতে কিছু না কিছু উপহার দেই। রাহেলা তখন সজাগ ছিল।জ্বর কমেছে এখন অনেকটাই।আমি আব্দুর রহিমকে বলে তিনটা ব্যাগ হাতে আব্বাগো ঘরের দিকে গেলাম। রেহানা আমার হাত ধরে আছে।বাইরে বের হতেই রকিবুলকে দেখলাম। রকিবুল আমায় দেখে দৌড়ে এসে বললো,
—বড় আপা,কহন আইছো তুমি?
—এইতো অনেকক্ষণ। কিন্তু তোর শরীরে এতো কাঁদা কেন?
—পুকুরে নামছিলাম।মামাগো পুকুরে লোক দিয়া মাছ ধরানো হইতাছিল।তাই আমিও নামছিলাম।এই দেহো এগুলা আমি ধরছি।তাই আমারে দিছে।
একটা মাঝারি সাইজের ঝুড়িতে কতগুলো সরপুটি,আরো কিছু ছোট-বড় মাছ।আমার অবাক লাগলো আমার পাঁচ-ছয় বছরের ভাই কেমনে মাছ ধরলো! অবশ্য,গ্রামে জন্মালে এগুলো জানতেই হয়।একাই জেনে যায় প্রয়োজন হলে।
—আচ্ছা মাছগুলো ঘরে রেখে কিছু দিয়ে ঢেকে তারপর গোসল করতে যা।
—আইচ্ছা বড় আপা আপা।
আম্মার ঘরে কাছে যেতেই দেখলাম রহমত মাটি খাচ্ছে।ছেলেটার জন্য আমার অনেক মায়া হয়।উপমা বেগম নিজের ছেলেরও জন্য তো নেন না খেতেও দেন না ঠিক মতো।আবার আমার ভাই-বোনদের কেউ নিতে আসলে তাদের কাছেও যেতে দেন না।রোগা হয়ে গেছে ছেলেটা। শেষবার যখন এলাম তখন কি মোটাসোটা ছিল রহমত মাশাআল্লাহ। কিন্তু এখন দেখলে অবাক লাগে!পেট যেন পিঠের সাথে মিশে গেছে।তবুও দুষ্টু বুদ্ধিতে ভরপুর মাথা। কিভাবে বড় ভাই-বোনদের মার খাওয়াতে হয় তা সে ভালোভাবেই জানে।আমাকে দেখে আমার কাছে ছুটে আসলো রহমত।
—আপা
—যা তোর মাকে ডেকে আনতো রহমত।
—আমি তোর কথা কেন শুনমু রেহানা?
—আমি তোরে কইছি তাই।
আরেকটু দেরি করলেই দুজনের মাঝে চুলাচুলি লেগে যাবে বুঝতে পেরে আমি রেহানাকে ইশারায় থামিয়ে দিলাম।আম্মাদের ঘরে গিয়ে দেখলাম তমা আর আরেকজন মহিলা মিলে উপমা বেগমকে যাচ্ছে তাই বলছে আমাদের নামে।আমি শুনেও না শোনার ভান করে ওনাদের হাতে আমার আনা উপহার সামগ্রী তুলে দিলাম।আম্মা আমাকে দেখেই কুমিরের কান্না শুরু করেন।মাফ চান।আমি একটুও গলিনি।আমি বসিওনি ওখানে।বাসায় চলে আসি।
★
রাজিব মিয়া বাসায় মিথ্যা বলে স্কুলের শিক্ষক কক্ষে বসে আছেন।স্কুল বন্ধ হলেও দাড়োয়ানকে বলে তালা খুলে নিয়েছে। রাজিব মিয়া আজ খুশি কারণ তার আদরের বড় মেয়ে এসেছে। তবে সে অত্যন্ত দু্ঃখী।কারণ আজ থেকে বছর চারেক আগে তাকে তার অত্যন্ত সোহাগের এই মেয়েই তালোই বলেছে।সত্যিই কি সে ওদের তালোই হয়ে গেছে!
রাজিব মিয়ার বুকে অনেক ব্যথা হচ্ছে।এই ব্যথা কোনো রোগের ব্যথা না,এই ব্যথা আপন মানুষদের কাছে না রাখতে পারার ব্যথা। রাজিব মিয়ার মাঝে মাঝে সকল বাঁধনচ্যুত করে বনবাসে চলে যেতে মন চায়। কিন্তু সে যে তা পারে না।তার দায়িত্বে যে অনেক কিছু।মেয়ের সংসারে যেমন নতুন অতিথি আসছে তেমনি নিজের সংসারেও তো নতুন অতিথি আসছে।
—স্যার,মাফ করবেন। সন্ধ্যা হইতে চললো।আপনে বাইত্তে যাইবেন কহন?আমারো বাইত্তে যাওন লাগবো!
—এইতো এখনই যামু। তুমি ভালো কইরা তালা মাইরা যাইও।
দাড়োয়ান সিকান্দার উদ্দিনের কথায় রাজিব মিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। সরকারি এই স্কুল বর্তমান সরকারের সহযোগিতায় মোটামুটি চলে আরকি।শিশু শ্রেণীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা যত বেশি মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী সংখ্যা অধিকাংশই হারিয়ে যায়।তিনি নিজেই তো শশুরের ইচ্ছে পূর্তিতে নিজের আদরের বড় মেয়ের বলিদান দিয়েছিলেন।তার মেয়েটা পড়তে কতোই না ভালোবাসতো। অবশ্য রাজিব মিয়ার পুরাতন বই কিনে দেওয়ার সামর্থ্য থাকলেও তিনি কখনোই বই খাতা কিনে দিতেন না নিজের কোনো সন্তানকে। আব্দুর রহিম ক্ষেতে কাজ করে যত টাকা পায় তাই দিয়েই নিজেদের বই খাতা কিনে।আর খাওয়া তো রাজিব মিয়ার সাথেই।
রাজিব মিয়া স্কুল থেকে বেরিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে চলে যান।আজ তার নাতনি এসেছে।কিছু না নিয়ে কি আর বাসায় যাওয়া যায়!রাজিব মিয়া যখন বাজারের উদ্দেশ্যে হাঁটছেন,তখন তার দেখা হয় জয়ের সাথে। দুজনের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতোও বটে।তালোই বলে সম্বোধন করার পর ঝর্ণা রাজিব মিয়ার সাথে প্রয়োজনহীন কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু জয়ের বোঝানোর পর ঝর্ণা আবার সাধারণ ভাবে কথা বলতে শুরু করে।একদম সাধারণভাবে না বললেও সাধারণভাবে সে কথা বলছে এমনটা দেখানোর চেষ্টা অন্তত করেছে।তবে রহিমার পালিয়ে বিয়ে আব্বা মেনে নেওয়ায় জয় প্রচন্ড রাগ করেছিলো। কিন্তু সেই রাগে ধুলো জমেছে এখন।
—আব্বা,কেমন আছেন?
—এইতো আল্লাহ ভালোই রাখছে।তা জামাই তুমি কেমন আছো?
—হুম ভালোই আছি।তা আব্বা সারাদিন কই আছিলেন?
—কাজে গেছিলাম!
—আপনি কি স্কুল মাঠ দিয়া আইসেন নাকি যে আবার বাজারে যাইতাছেন?
—আরে তেমন না।নাতনি আইছে নাতনির লিগা কিছু নিতে ভুইলা গেছিলাম।তাই নিয়া আইতে যাইতাছি।তা তুমি কই যাও!
—আপনার মাইয়ার বদল খুঁজতে বাজারে যাই!হা হা হা
জয় নিজে বলে নিজেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে। রাজিব মিয়াও জয়ের সাথে হাসে।হাসি-ঠাট্টা করতে করতেই দুজন বাজারের উদ্দেশ্যে যায়। সন্ধ্যা হতে চলায় মানুষেরা ফসলি জমিতে কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিল তখন শশুর-জামাইয়ের হাসি খুশি মুহুর্তে তারাও আবেগপ্রবণ হয়।তাদেরও ইচ্ছে জাগে জয়ের মতো মেয়ের জামাই পাবার।
★
জ্যোতিকে আম্মা আম্মা বলে ডেকেই চলেছে রেহানা।আজ নাকি ওর আম্মার কথা অনেক মনে পড়ছে। অনেক কান্না করছিল এতক্ষন।তাইতো আমি যখন বললাম জ্যোতিকে আম্মা বলে ডাকতে সেই থেকে জ্যোতিকে জড়িয়ে ধরে আম্মা আম্মা বলে সে ডেকেই চলেছে।আর আমার মেয়েটাও রেহানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
আমারও অনেক আম্মার কথা মনে পড়ে।মনে পড়লেই বা কি হবে!আম্মা যে ওপারে।যত কষ্টই হোক তার নিকট যাওয়া যে সম্ভব নয়।আম্মা যখন ছিল কতই না ঝগড়া করছি তার সাথে।সেই জন্য আব্বার কাছে কতই না মার খাইছি।ইশ,সেই সোনালী দিনগুলো কেটে ধূসর রঙের জীবনটা কেন এলো আমাদের জীবনে!আম্মার জন্য মামাদের ভালোবাসা পেয়েছি।আম্মার মৃত্যুর সপ্তাহ কয়েক পরে তারাও আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষ বড়ই নিষ্ঠুর।
আব্দুর রহিম রকিবুলকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢোকে।হাত পা ধুইয়ে পরিষ্কার করে এনেছে। দুপুরে মাছ এনে এই ঘরেই রেখে গিয়েছিল সে। কিন্তু ঢাকনা দিতে ভুলে গিয়েছিল।বিড়াল এসে সব মাছ খেয়ে ফেলেছে।গোসল করে এসে বিড়ালকে মাছ খেতে দেখে মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদছিল রকিবুল।দু’ঘন্টা যাবৎ করা সব কষ্টই বৃথা গেল।এটা ভেবেই গলা ছেড়ে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কাঁদছিল।জয় অনেক চেষ্টা করেছে থামানোর কিন্তু রকিবুল থামার নাম তো নেয়নি বরং আরো জোরে চিল্লাচিল্লি করে কাঁদছিল। আব্দুর রহিম এসে জোরে এক ধমক দেওয়ায় চিল্লিয়ে কান্না থামিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছিল সে। আব্দুর রহিম ছোট ভাইকে নিয়ে ক্ষেতে চলে গিয়েছিল তখন।মাত্রই দুজন একসাথে আবার গোসল করে ফিরলো।রোকেয়া এখন রাহেলার কাছে।আর রেহানা আর আমার দুষ্টু জ্যোতি ঘরে বসে খেলছে।এতক্ষণে বেরিয়ে যেতো আমি যদি ভুতের ভয় না দেখাতাম।
ইনশাআল্লাহ চলবে..
(বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।আমি দেরিতে গল্প দেওয়ার জন্য খুবই দুঃখিত।ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে গল্প লিখতে দেরি হয়েছে।আশা করছি আমার সিচুয়েশন আপনারা বুঝবেন!হ্যাপি রিডিং)