#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ১১
#বর্ষা
হায়, আফসোস ১৯৯৭ এ মানুষ চলে আসলেও এদের চিন্তা চেতনা আটকে আছে সেই ১৮০০ সালের কোঠায়।নাতনির জন্মানোতে যতটা দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন আমার শশুর বাড়ির লোকজন,ঠিক ততোটাই জিহাদের জন্মের সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করেছেন।অক্টোবর মাসের সমাপ্তির আরো দশদিন বাকি।আজ আমার ছেলে জিহাদের জন্ম হলো। চল্লিশদিন পর্যন্ত নবজাতক নিয়ে গাড়িতে যাত্রা করতে হয়না,তাইতো আমার শশুর ছেলেসহ আমাকে নিতে এসেও ফিরে গেলেন।আমি অবাক না হয়ে পারলাম।কেমন মানুষ এরা!জ্যোতি আর জিহাদ উভয়ই তো তাদের রক্তই।তবে নাতনির জন্য কোনো ভালোবাসা না থাকলেও নাতির জন্য যেন ভালোবাসা উতলে পড়ছে।
জয় ওনার পরিবারের ওপর প্রচণ্ড রেগে ছিলেন।তাইতো চল্লিশদিন পূর্তি হতেই আমাকে সহ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শহরে চলে আসলেন। মেয়ে আমায় অনেক সহযোগিতা করে। নরমালে জিহাদকে জন্ম দিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল তাকে।এখনো দুর্বলতা তার মাঝে আছে।জ্যোতি জিহাদের ময়লা কাপড় চোপড় ধুতেও আমাকে সাহায্য করে।ভাত রান্নার জন্য চাল ধুয়ে দেয়। তরকারি রান্নার জন্য তয়তরকারি ধুয়ে দেয়।
—আম্মু জিহাদ কাঁদে!
—আচ্ছা তুই ওর পাশে বস আমি দেখছি।
চুলায় তরকারি রেখে ঘরে গিয়ে দেখি মেয়ে আমার ভাইকে টিভি দেখাচ্ছে।রঙিন টিভি।এইতো কয়দিন আগেই ওদের আব্বু এনেছে। বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে জ্যোতি টিভি দেখতো। বাড়িওয়ালা জ্যোতিকে টিভি দেখার অনুমতি দিলেও অন্য ভাড়াটিয়ার সন্তানদের দেয়নি।ফলে টিভি দেখা নিয়ে আমাদের মাঝে ক্যাচালের সৃষ্টি হয়।একেই ছেলের যন্ত্রণা।তারওপর মেয়ের নামের এই বিচার আমার সহ্যের বাইরে ছিল।মেয়ের পিঠে থারুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলাম।মেয়েটা সেই যে কান্না শুরু করেছিল,কানতে কানতেই ঘুমিয়েছিল এবং কানতে কানতেই জেগেছিল।রাতে যখন জয় এসেছিলেন কান্না যেন আরো বেড়েছিল।আমার নামে বিচার তো ছিলই।আমার কাছে মেয়ের টিভি দেখা নিয়ে নালিশ শুনেই সে মেয়েকে জোর করে আমার কাছে রেখে বেড়িয়ে গেছিল। এসেছিল এখনকার সবচেয়ে বড় টিভিটা!জ্যোতির সে কি আনন্দ।স্কুল, পড়াশোনা করে ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্রবার বিকালে আলিফ-লায়লা, সিনবাদের কাহিনীই হতো বিটিভির পর্দায়।
—আম্মু,আমি যেমন লায়লা চরিত্রের অভিনয় করেছিলাম এ যেন ঠিক তেমন তাই না?
—হুম।
আমি জ্যোতির থেকে জিহাদকে নিয়ে পরিষ্কার করে দিলাম।মেয়ে যখন বুঝলো জিহাদ কাঁদছিল কেন!সে ছিঃ করে দূরে সরে গেল।একটু পর এসে ভাইকে অর্থাৎ জিহাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—এই পুঁচকে তুমি আগে বলনি কেন যে তুমি কিছু করেছো?
—মা,দেখো জিহাদ কতো বেয়াদব বড়রা কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়না। তুমি না বলতে বড়দের প্রশ্নের উত্তর না দিলে সে বেয়াদব হয়!
মেয়ের কথায় আমি হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাই না।মাত্র পঞ্চাশ দিনের বাচ্চাটা কিভাবে কথা বলবে!মেয়ে আমার মাঝে মাঝে এমন এমন প্রশ্ন করে যে আমি বুঝতেই পারি না, সেই প্রশ্নে আমি কি উত্তর দিবো।মেয়ের বর্তমান কথায় কিছু না বলেই আমি বেড়িয়ে গেলাম রান্না করার উদ্দেশ্যে। রান্না ঘরে গিয়ে দেখি নাসিমা আপা আমার তরকারির কড়াই নামিয়ে নিজে রান্না বসাবেন এমন হাবভাব।
—কি নাসিমা আপা আমার চুলার এখানে কি করছেন?
—আ..আরে দেখছিলাম তোমার রান্না পুড়ে যাচ্ছে কিনা তাই!
—তা দেখতে কি আপনার না হওয়া তরকারিও এনেছেন এখানে! আপা আগে নিজেরটা করবেন পরে অন্যের উপকার করার অনেক সময় পাবেন!
—তুমি রান্না করো জ্যোতির মা আমি যাই!
এই বাড়িতে আমরা নতুন।গ্রাম থেকেই সোজা এ বাড়িতে এসেছি।নাসিমা আপা সেদিন থেকেই আমাদের কেমন একটা দৃষ্টিতে দেখতেন!পরে অন্য আরেকজন ভাড়াটিয়ার সাথে সখ্যতা হওয়ার পর বুঝলাম নাসিমা আপার এমন ব্যবহার কেন! তারপর থেকে আমিও তার মতোই ঠেস মেরে কথা বলতে শুরু করি। আমি ঠেস মেরে কথা বলতে শুরু করার পর থেকে সে আর আমার পথ মারায় না।
নাসিমা আপা প্রকৃত পক্ষে জয়কে পছন্দ করেন।জয়ের হাসি-ঠাট্টা, সকলের সাথে নিমেষেই মিশে যাওয়ার ক্ষমতা অনেক।তাইতো যেদিন প্রথম জয় এ বাড়ি ভাড়া নিয়ে মাল-পত্র গোছায় তখন অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের সাথেও সমালতালে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে।আর নাসিমা আপার হৃদয়ে তখন অন্য কিছুই জয়ের জন্য চলে।জয় কিছুদিন হলো সব জানতে পেরে সামনের মাসে এই বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা বাড়িওয়ালাকে জানিয়েছে। বাড়িওয়ালা আমাদের ছাড়তে প্রথমে নারাজ হলেও পরে ঠিকই রাজি হোন।
—জ্যোতির মা দেখে যাও তোমার জ্যোতি কি করছে?
হঠাৎ জয়ের ডাকে অবাক না হয়ে পারলাম না।উনি কখন আসলেন!ঘরে গিয়ে দেখি মেয়ে তো আমার চুপচাপ বসেই আছে।আর জয় মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে।মেয়ে আমার এদিকে তাকাচ্ছেই না।আমি বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই জয় বলে,
—তোমার মেয়ে আজ বড় বোনের দায়িত্ব পালন করেছে।
—মানে?
—আরে জিহাদকে পরিষ্কার করে দিছে।
আমি অবাক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়ের আমার এদিকে তাকাচ্ছেই না।তখনই এন্টেনায় কোনো সমস্যা দেখা দেয়।মেয়ে আমার তবুও আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না।ও নিশ্চিত অনেক লজ্জা পাচ্ছে।তাই জয়কে বললাম মেয়েকে না ঘাটিয়ে বিশ্রাম নিয়ে এন্টেনা ঠিক করে গোসল করতে যেতে।মেয়ের মুখের লাল আভা আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই আব্দুর রহিমের সময়কার কথা।আম্মা তখন রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত।ভাই আমার কেঁদেই চলেছিল।আমি ওকে কোলে নিতে গিয়ে বুঝলাম ওকে পরিষ্কার না করা অব্দি ও এভাবেই কাঁদবে। কিন্তু আমি তখনো কোনো বাচ্চাকে পরিষ্কার করাইনি।কেমন জানি লাগছিলো!তবুও পরিষ্কার করে ভাইকে কোলে নেওয়া মাত্রই আম্মা কোথা থেকে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়।আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল।যে লজ্জাটাই না আমি পেয়েছিলাম। আম্মা সেদিন আমাকে লজ্জা পেতে দেখে বলেছিল,
—বড় বোন হলো মায়ের মতো।বড় বোন তার ছোট ভাই-বোনদের বুকে আগলে রাখে! তাদের সব কাজই করতে পারে!
সেদিন আম্মার বলা কথাগুলো স্মরণে এতেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে বিন্দু বিন্দু পানির ঝর্ণা।এই আর বিন্দু পানির ঝর্ণা এক হয়ে কাঁদছে।ইশ আজ যদি মা থাকতো তবে কতোই না আনন্দদায়ক মুহূর্ত গড়ে উঠতো।আমরা যেমন নানা বাড়ি গিয়ে নানার থেকে গল্প শুনেছি,আম্মা বেঁচে থাকলে আমার সন্তানেরাও পারতো।এখনো আব্বা জ্যোতি জিহাদকে ভালোবাসেন।তবুও আফসোস থেকেই যায়।আম্মা থাকলে হয়তো আরো বেশি ভালোবাসতো!
★
রহিমা আজ বাপের বাড়ি এসেছে গাট্টি বোঁচকা বেঁধে। বরিশালের মানুষদের বিখ্যাত নাম খ্যাতার গাট্টি!এই নাম বরিশালের মানুষদের কাছে খারাপ লাগলেও সবস্থানে তাদের এ নামেই ডাকা হয়।লঞ্চে করে যাতায়াত করতে।রহিমা আর জুবায়ের এসেই দোতলার একটা ঘরে ঢুকে পড়েছে। বিশ্রাম নিচ্ছে। আব্দুর রহিম কিংবা বাড়ির কেউই জানে না যে ওরা এসেছে!বেলা যখন বারোটা তখন ওরা ঘর থেকে বের হয়।লঞ্চ যাত্রা করে সুন্দর ঘুম অবশ্য হয়নি তাদের।তাই বাড়ি এসে আজ কারো সাথে কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
—কিরে আপা কহন আইলি?
রেহানার কথায় কলপাড়ের দিকে তাকায় রহিমা। রাহেলা কল চাপছে আর রেহানা কাপড় কাচছে।রহিমা অনেক অবাক হয় তাদের বোনদের অবস্থা দেখে। অবশ্য আজ রহিমার গ্রামে আসার বিশেষ এক কারণ আছে। বিশেষ কারণ বলতে অত্যাধিক বিশেষ।তাইতো বড় বোন আর তার জামাই শহরে ফিরতেই এখানে চলে এসেছে।কারণ রহিমা খুব ভালো করেই জানে জয় থাকলে তাদের আরেক বোনের ব্যাপারে কোনো কথাই রহিমাকে বলতে দিতো না।তাইতো জয় চলে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। প্রচন্ড ভয় পায় যে জয়কে এ বাড়ির সবাই।যতটা ভালোবাসে ঝর্ণার ভাই-বোনদের নিজের ভাইবোনের মতো ঠিক ততোটাই শাসনও করে নিজের ভাই-বোনদের মতো!
রহিমা ভাই-বোনদের সাথে কোন কথা না বলে সোজা বাপের ঘরে যায়। রাজিব মিয়া শুয়ে আছেন দেখে তাকে ডাকে।আজ শুক্রবার দিন। অর্থাৎ ছুটির দিন।আর ছুটির দিনে রাজিব মিয়া সহজে কারো ডাকাডাকি সহ্য করে না।উত্তপ্ত মেজাজে রাজিব মিয়া উঠে বসেন।
—নূন্যতম ভদ্রতা বোধ নাই তোমাগো?দেখছো ঘুমাইতাছি তাও ডাকতে লাগছো?
—আব্বা আপনার সাথে জরুরী কথা ছিলো!
—তা বইলো।কহন আইছো তোমরা?
—সকাল বেলা।
—দেখলাম না তো!
—আব্বা ঘুমাইছিলাম আইয়া তাই দেহেন নাই।আব্বা ছাড়েন এগুলা আগে আমার জরুরী কথা শুনেন!
—আইচ্ছা কও! কি জরুরী কথা কইবার লিগা তোমরা আদ-পাগল হইতাছো তা আমিও শুনি!
—আব্বা আপনে আমার দেবর আলমরে দেখছেন না?
—হুম।
—আব্বা কেমন লাগছে?
—দিমু এক থাপ্পর গাল পাছাইয়া।এতো কথা না ঘুরাইয়া আসল কারণে আয়।নয়তো ঘর থাইকা যা আমি ঘুমামু!
রাজিব মিয়া ঘুমের ঘরে থাকলে কয়েক ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলে। মুক্তিযোদ্ধা থাকাকালীন দেশের অনেক অনেক এলাকায় তাকে অভিযানে যেতে হয়েছে কমান্ডদের সাথে।খেয়ে না খেয়ে, পশুদের মতো আওয়াজ করে, পশুদের মতো জীবনযাপন করে পাকিস্তানী হারাতে হয়েছে।ঘাস পাতাও খেয়েছে এমনও রেকর্ড আছে।তবে আজ তিনি পদ্মার এপারের ভাষাটার অবস্থা একেবারে দফারফা করে ছেড়েছে।তার ছেলে-মেয়েরাও তার মতো এই ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত হলেও ঝর্ণার অভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে।এখন ঝর্ণা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে জানে।যাইহোক,রহিমা আর তার আব্বাকে না ঘাটিয়ে আসল কথা বলেই দেয়।
—আব্বা আমি ভাবতাছিলাম আলমের লগে আমগো রোকেয়ার বিয়া দিমু!আপনে কি কন?
রোকেয়ার বিয়া দিমু কথাটা বলতেই যেন রাজিব মিয়ার ঘুম ভাব ছুটে যায়।লাফিয়ে উঠে বলে,
—থাপ্পর খাইতে মন না চাইলে আমার বাড়ির থিকা বাইরা। তুই বরিশালে বিয়া করছোস মাইনা নিছি। তুই কেমনে ভাবলি আমি আমার এতটুকু রোকেয়ারে ওনে বিয়া দিমু!
রহিমা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের রহিমাকে কথা বলতে বলে বাইরে গেছে তাও অনেকক্ষণ।উপমা বেগম তখন গটগট করতে করতে ঘরে ঢুকে বলেন,
—আপনের রোকেয়া কোন দিয়া এতটুকু?এহন বিয়া দিলে কাইল চাইর বাচ্চার মাও হইবো।
—উপমা তুমি বাইরে যাও।মাথা গরম আছে। থাপ্পর খাইতে না চাইলে আমগো ভিতরে কথা না কইয়া রান্না বান্না কইরা ওগো খাওয়াইয়া বিদায় করো। রোকেয়া ঠিকই কয় সৎ মা কহনো আপন হয়না।পরই থাকে।ওর যদি আপন মা হইতা এতো তাড়াতাড়ি বিয়া দেওয়ার কথা তুলতে পারতা!আমি ভুল করছি তোমার কথা শুইনা পুলাপানডিরে সত্ত্বাহীন কইরা দিছি।আমার তো নিজের প্রতি ঘৃণা হয় এহন।
ইনশাআল্লাহ চলবে
(বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)