সত্ত্বাহীন_আমরা #পর্বঃ৪ #বর্ষা

0
211

#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ৪
#বর্ষা

শশুরবাড়ি আসার ক’দিনের মাথায় নদীর পাড়ে জায়েরা মিলে কাপড় ধুতে গিয়েছিলাম আমরা। হঠাৎ কোথা থেকে এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন আমাদের পেছনে। সজোরে পেছন থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন নদীতে। গ্রামের মেয়ে বিধায় সাঁতার কেটে কোনো মতে উঠলাম। বৃদ্ধ বলতে লাগলেন,

“অভাগীরে মইরা যা তুই,এই জীবনে তুই সুখের দেখা পাইবি না।তোর মায়ের মরণের লগেই তোর সুখ শেষ!”

বৃদ্ধ পাগলটা সিঁড়ি ওপরে উঠে প্রায় হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বললেই চলে।আমার হাড় কাঁপানো জ্বর আসে।সে কি জ্বর। পেটে তখন পাঁচ মাসের বাচ্চা। কবিরাজ,বৈদ্য সবাই আশার আলো দেখানো ছেড়ে দিল।প্রায়ই স্বপ্ন আম্মাকে দেখতাম।আম্মা অসুস্থতার শেষ দিন রাতে আমার স্বপ্ন এলেন।

“আমার ঝর্ণা মায় তো এতো দূর্বল না,তবে এক পাগলের কথায় নিজেকে শেষ কইরা দিতাছে কেন!তার তো তার পোলাপাইন আর ভাই-বোনের লিগা বাচন লাগবো।এইডা কি হেয় ভুইলা গেছে!”

আম্মার স্বপ্ন বলা কথাগুলো আমার মধ্যে কি করলো আমার জানা নেই। প্রচন্ড গরম লাগতে লাগলো।যেখানে ছয়দিন যাবৎ আমি তোশকের নিচে শীতে কাতরাচ্ছিলাম,সেখানে সেই রাতেই সব তোশক চৌকির আরেকপাশে রেখে ঘুমিয়ে গেলাম।

সেদিন আম্মা স্বপ্নে না এলে হয়তো আমি বাচতাম না।আম্মা আমার সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে ছিল সেদিন।আম্মা এর আগেও আমার সকাল বিপদের সময় আমার সত্ত্বা রক্ষা করতে স্বপ্নে আসতেন। আমার জানা নেই,আমার ভাই-বোনেরাও কি আম্মাকে এভাবে স্বপ্নে দেখে নাকি।আমার অসুস্থতার সময় আব্বা এসেছিলেন নতুন আম্মাকে নিয়ে। নতুন আম্মায় আলগা পিড়িত দেখিয়ে গেলেন।কোলে করে আমার রকিবুলকেও এনেছিলেন।ছেলেটা অনেক মায়াবী জন্মেছিল, কিন্তু যত্নের অভাবে তার সিংহভাগও নেই।তবে কি নতুন আম্মা আমাদের সাথে যেমন করতে তা কি রকিবুলের সাথেও করছেন…..হায় আল্লাহ!

সুস্থতার কয়দিন পরেই জয় আমাকে আবারও শহরে নিয়ে আসলেন।আমার শাশুড়ি আম্মা আমাকে ছাড়তে চাননি।বার বার বলেছিলেন,

“আব্বা তুই মাতবরের ঝিঁ রে নিয়া যাইছ না!ওনে একা একা কেমনে থাকবো!কেমনে কি করবো?”

“আম্মা তোমাগো এনে তো ভালো থাকার লিগাই রাইখা গেছিলাম। মরতে মরতে এহন জীবন পাইছে।আবারও যদি এমন হয়!আমি রিস্ক নিতে পারমু না।আমারে মাফ কইরেন।”

চলে আসলাম ঢাকাতে।পদ্মার ওপার আমার বাপের বাড়ি আর শশুরবাড়ি দুটোই।তাই লঞ্চে করেই চলে আসতে পারলাম নদীর এপার। কিন্তু সেই মরার বাসে উঠতে আমায় হলই।বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা এগারো।বমি করার কারণে শরীর দু’দন্ড শক্তিও আর বাকি নেই।উনি আমাকে একহাতে আগলে আরেকহাতে ব্যাগ নিয়েই বাসায় প্রবেশ করলেন।রুকসার আপা তখন রান্না করছিলেন।দৌড়ে এসে আমায় ধরলেন এবং বললেন,

“আপা তুমি সেই যে গেলা আর আজকে আসলা!জানো কত মনে পড়ছে তোমার কথা।আপা তুমি নাকি নদীতে…”

“আরে রুকসার ভাবি আপনার বোন কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না।তাই পড়ে যা বলার বইলেন। এমনিতেই বমি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে।আমি দরজা খুলে দিচ্ছি আপনি ওকে ঘরে বসান গিয়ে!আমি খাবার কিনে দিয়ে অফিসে যাবো।”

জয় দরজা খুলতে খুলতে বললেন।তার আজ নাইট শিফট শুরু।কাল রাত করে গ্রামে গিয়ে আজ নিয়ে আসলেন। রুকসার আপা আমাকে ঘরে বসালেন। গুলশানের এই এরিয়ায় আটচালা করেই একবাড়িতে কতগুলো করে ঘর বানানো হয়েছে। অবশ্য দেয়াল ঘর রয়েছে।তবে ভাড়া বেশি।বাড়িয়ালারা দেয়াল ঘরগুলোতেই থাকে।আমি এসেছি খবর পেয়ে নুরজাহান খালা,জরিনা আপা,মাইমুনা আপারা আমাকে দেখতে আসছেন।সবাই আমার খোঁজ খবর নিলেন। এখানকার প্রতিটা মানুষই আমায় প্রচন্ড স্নেহ করেন। ওনাদের উপস্থিতির মাঝেই খাবার নিয়ে ফিরে এলেন জয়। খাবারগুলো রেকের ওপর রেখে বেড়িয়ে যেতে নিয়ে বললেন,

“ঝর্ণা বাড়ি থেকে আসার সময় কিন্তু বেশি কিছু খাও নাই।আবার লঞ্চেও কিছু খাও নাই।আর যা খাইয়া আইসিলা সব বমি করে বের করেই দিছো।তাই নিজের লিগা না খাইলেও আমার ভবিষ্যৎ পোলাপাইনের লিগা খাইয়ো।আর সবাই গেলেগা দরজা ভালো কইরা বন্ধ কইরা ঘুমাইয়ো।”

“আপা দেখছো তোমার জামাইয়ের তোমার জন্য দরদ নাই।সব দরদ তার ভবিষ্যৎ পোলাপাইনের জন্য!হা হা”

জরিনা আপা কথাটা বলেই হেসে দেন। পাশাপাশি খালা আর বাকি আপারাও হাসেন। অবশ্য খালাকে এখন আর আমার লজ্জা লাগে না।কারণ খালার কাছ থেকেই নারীদের গোপন কষ্ট এবং তার থেকে প্রাপ্ত এক শক্তি সম্পর্কে জানতে পেরেছি।যাইহোক,আমাকে রেস্ট করার কথা বলে তারা চলে যান।আমি দরজা ভিরিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

মুরগি ডাকা ভোরে রোকেয়া মামা বাড়ি এসেছে।কালরাতে অনেক করে আব্বা তাকে মেরেছে।তারই বিচার সে মামাদের দিতে এসেছে। কিন্তু এতো করে ডাকার পরেও কেউ দরজা না খোলায় রোকেয়া ফ্যাকাসে মুখে ফিরে আসে।প্রতিমধ্যে শুনতে পায় তাদেরই এক প্রতিবেশী লোক আরেক প্রতিবেশী লোককে ডেকে বলছে,

“ভাই শুনছোনি রাজিব মাষ্টার কি কামডাই না করছে?মাইয়া পোয়াতি আর এহন হের এই বউও পোয়াতি! ঝর্ণার তো বিয়া হইয়া গেছে,বাইচ্চা গেছে মাইয়াডা।আর পোলাপাইনডির কপাল মনে হয় পুড়লো!”

রোকেয়ার ছোট মস্তিষ্ক এত বড় বড় কথা না বুঝতে পারলেও এটা বুঝতে পারলো যে তাদের জন্যই আফসোস করছে এনারা।হায়, দুদিনের এই আফসোস। রোকেয়া মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তে প্রফুল্ল হয়ে দৌড় লাগায় স্কুল মাঠের দিকে।আজ সালমান শাহ নামক এক অভিনেতা আসবে তাদের স্কুল মাঠে নাটকের শুটিং করতে।সে কখনো নায়ককে দেখেনি।তার অনেক আগ্রহ।সে জানতে চায় নায়ক দেখতে কেমন হয়!

“কিরে রোকেয়া,এই বেলায় কই ছুটস?”

ময়না কাকি বাজার থেকে ফেরার সময় রোকেয়াকে এভাবে ছুটতে দেখে প্রশ্ন করেন। রোকেয়া প্রফুল্ল চিত্তে বলে ওঠে,

“স্কুল মাঠে যাচ্ছি গো চাচি!আইজ নাকি নায়ক আইবো নায়ক।হেরে দেখমু আমি!”

ময়না চাচির মুখে বিরক্ত ভাব দেখা যায়।তিনি বলেন,

“এই বেক্কল মাইয়া তোর লাইগা কি নায়কে হের শান্তির ঘুম ভাইঙ্গা ভোর বেলা আইবো!”

“তাইলে চাচি কহন আইবো?”

“বারোডার সময় যাইস।এহন বাইত্তে যাইয়া ভাত খাইয়া কাম করগা!”

ময়না চাচির বলতে দেরি হলেও রোকেয়ার ছুটতে দেরি হয় না।সে এক ছুটে বাড়িতে চলে আসে।রাহেলা আর রেহানা খেলছিল তখন। কাঁদা এনে মাটির থালা বাসন বানাচ্ছিল। রোকেয়াকে দেখে রাহেলা আল্লাদের সহিত বলে,

“আপা দেহো আমরা মাটির থালা বাসন বানাই। তুমি আমগো লগে বানাইবা?”

রোকেয়া যেন এই প্রস্তাবের অপেক্ষাতেই ছিল।প্রস্তাব পাওয়া মাত্র ওদের দুজনের মাঝে ধুপ করে বসে পড়ে। ভারী শরীরের রোকেয়ার এমনভাবে শরীর ছেড়ে দেওয়ায় রাহেলা আর রেহানা কিছুটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। স্বাভাবিক হয়ে একত্রেই খেলতে থাকে তারা।

হঠাৎ কোথা থেকে উদয়িত হয় উপমা বেগম।এসেই ঝাড়ু দিয়ে কয়েকটা ঘা লাগান ওদের শরীরে। রোকেয়া, রেহানা, রাহেলা ছিটকে দূরে সরে যায়।রহিমা কাপড় কাচতে গেছে,আর রহিম গেছে ওদের আব্বার সাথে বাজারে।তাইতো এখন নির্দিধায় মারতে পারছেন উপমা বেগম।

“আম্মা আমরা কোনো দোষ করি নাই।ও আম্মা আম্মা আমগো আর মাইরেন না!”

রোকেয়া কাকুতিমিনতি করতে থাকে। রাহেলা আর রেহানা কাঁদতে কাঁদতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে।তবুও যেন মন গলে না এই নিষ্ঠুর মহিলার। রোকেয়া নিজেদের বাঁচাতে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মহিলাকে ধাক্কা মারে।উপমা বেগম রোয়াকের কিনারায় দাড়িয়ে মারছিলেন বিধায় ধাক্কা খেয়ে ঘাঁটায় গিয়ে পড়েন। রোকেয়া আর ওর বোনদের মারার সময় রাজিব মিয়া না আসলেও ধাক্কা দিতে তিনি দেখেন।দৌড়ে এসে রোকেয়াকে চোখ রাঙানি দিয়ে বউকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে যান।দাই মহিলাকে জরুরি তলবে আসতে বলে রাজিব মিয়া হাতে কঞ্চির লাঠি নিয়ে বাইরে আসেন। রোকেয়াদের শরীরের রক্তও তার মনে কোনো প্রশ্ন তোলেনি হয়তো সে নিজের মনেই প্রশ্ন তুলতেই চায়নি।কঞ্চির লাঠি দিয়ে ইচ্ছে মতো মারেন রোকেয়াকে। রোকেয়া এতক্ষণ চিৎকার করে কাঁদলেও রাজিব মিয়া মারার সময় নিরব অশ্রু বিসর্জন দিয়েছ।ওইদিন বড় আপা যখন রেহানাকে আব্বা মারার পর যে কথাগুলো বলেছিল তা রোকেয়াও শুনেছিল।তখন এর মানে না জানলে এখন সে ঠিকই বুঝেছে তার বড় আপা কি বোঝাতে চেয়েছিল।

রোকেয়াকে রক্তাক্ত করে চলে যেতে রহিম রোকেয়া ওখান থেকে ঘরে নিয়ে যায়। রোকেয়া নিশ্চুপ নির্বিকার বসে থাকে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় রাস্তায় শোনা কিছু কথা।বুঝতে আর বাকি নেই তাদের নতুন খেলার সাথি আসার কথাই বলছিল প্রতিবেশী চাচারা।বড় বড় আপা তো তার পেটে হাত দিয়ে বলেছিল,যখন খেলার সাথী আসে তখন নাকি পেটটা তরমুজের মত বড় হয়।আর যে খেলার সাথীকে আনে তাকে গর্ভবতী বা গ্রামের ভাষায় পোয়াতি বলে। রোকেয়া হঠাৎ হাসতে থাকে।কি বিদঘুটে সেই হাসি, রোকেয়ার মাথায় রক্ত চেপেছে বুঝতে পারে রহিম।রেহানা আর রাহেলা আরেক ঘরে রেখে রহিমা আপাকে ডাকতে ছুটে যায় সে। রোকেয়া কিছুক্ষণ হাসার পর বিড়বিড় করে বলে,

“আম্মা আপনি আমগো ভালা চাইলেন না আল্লাহও আপনার ভালা চাইবো না মিলাইয়া নিয়েন।আপায় কইছিল,তারে নাকি কোন খালায় কইছে পোয়াতি অবস্থায় সাবধানে চলাফেরা করতে হয়।হেনে আম্মা আপনে তো এক ফুট উঁচু থেকে গড়াইয়া পড়ছেন!”

রহিমা ছুটে এসে রোকেয়াকে ধরে। রোকেয়া তখনও কি জানি বিরবির করে থাকে।রহিম পানি আনতে গেছে। রোকেয়ার মাথায় পানি না ঢাললে এখন এই মেয়ে পাগলও হয়ে যেতে পারে।আগেও এমন পাগলামী রোকেয়া করেছে।তখন বড় আপা বলতো,

“রহিম যা তো পানি নিয়ে আয়।ওর মাথায় পানি দিতে হবে।রক্ত মাথায় উঠেছে এই মেয়ের!”

আর তখনই ছুটতো রহিম।তখন অবশ্য রহিমা পানি আনতে সাহায্য করতো। কিন্তু এখন তো বড় আপা নেই তাই রহিমকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে।যাওয়ার আগে বড় আপা পইপই করে বলে গেছেন,

“রহিম তুই আমাদের ভাই।রহিমা তোর বড় হলেও মনে রাখবি তুই আমাদের ভাই।তোর দায়িত্বেই এখন ওরা থাকবে।আর নিজেদের পড়াশোনা ঠিক রাখবি। পড়াশোনা না করলে জীবনে কিছু করে উঠতে পারবি না।আর ছোট বোনগুলোকে আগলে রাখবি। নিজের ভীতুপনা বাদ দে ভাই!”

কিন্তু না আজও রহিম নিজের ভীতুপনা বাদ দিয়ে উঠতে পারিনি।কারণ সেও তো মাত্র সাত-আট বছরের বাচ্চা।আর এই বয়সে কম দায়িত্ব তো সে পালন করছে না। পড়াশোনার পাশাপাশি মাঠে ধান বোনার কাজ নিয়েছে সে।আব্বা এখন তাদের দিকে নজর দেয়না যে।আম্মা থাকতে প্রতিদিন সবাইকে একটা ডিম বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে টুকরো করে দিতো। কিন্তু এখন তো সপ্তাহেও সেটা তাদের কপালে জোটে না।তাইতো রহিম কাজ নিয়েছে।ছোট বাচ্চা নিলে কম টাকা দিলেই চলবে বিধায় মালিক পক্ষ নিয়েছেন।

ইনশাআল্লাহ চলবে

(আসসালামুয়ালাইকুম পাঠকগণ ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।আশা করছি আশানুরূপ সাড়া পাবো।হ্যাপি রিডিং পাঠকগণ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here