#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ৫
#বর্ষা
“ওই হারাম** তোরা না করছিলাম না পঁচা পানিতে নামবি না।তাইলে নামছোস কেন?”
জয়ের রাগ মাথায় চাড়া দিয়েছে।সে কি বলছে সে নিজেও জানে না।এক বাসার ময়লার টাংকি ব্লাস হয়েছে।ওই টাংকি ব্লাস্ট হওয়ায় পাশের বিশুদ্ধ পানির লাইনও ব্লাস্ট করে।আর ওই পানিই এখন গুলশানের এক এরিয়ায় ধেয়ে বেড়াচ্ছে।ঝর্ণার আট মাস পেরিয়ে নয় মাসে পড়েছে।শীতকাল চলছে।ঝর্ণা এমনিতেই নাওয়া-খাওয়া ঠিক মতো না করায় প্রচন্ড দূর্বল।তাই জয় প্রচন্ড খেপেছে যখন বাসায় এসে ঝর্ণাকে নোংরা পানি পাড়িয়ে রান্না ঘরে যেতে দেখেছে। নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরও আমার এই খামখেয়ালিপনায় উনি প্রচন্ড ক্রোধান্বিত হয়েছেন।ক্রোধে কাঁপছেন।
“মাফ করবেন…”
জয় আমাকে আর কিছু না বলেই চলে যান কোথাও।আমি আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠি।উনি যতই আমার যত্ন নেন,তবুও তার খারাপ ব্যবহারে আমার কষ্ট লাগে।
ঘন্টাখানেক পর জয় বাসায় আসলেন।আসার সময় হাতে করে শাড়ি নিয়ে এসেছেন।প্রতিবার ঝগড়া হলেই তিনি ক্ষমা প্রার্থনা না করে আমার জন্য কিছু না কিছু উপহার নিয়ে আসেন। আগেরবার বেলিফুলের মালা এনেছিলেন। চৌকিতে বসে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে দিলেন।তারপর আমার কিছুটা কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,
“বউ কি আমার এহনো অভিমান কইরা আছে! আচ্ছা আমি তো তোমারে নোংরা পানিতে নামতে নিষেধ কইরা গেছিলাম।নামলা কেন?”
“ঘরে বাসি নোংরা থালাবাটি ছিল…তাই ধুইতে…”
“আমি আইসাই তো ধুইতে পারতাম।”
“সারাদিন এতো কষ্ট করছেন অফিসে,এহন আবার বাইত্তে আইয়া বাসি থালাবাটি ধুইতে তো আপনার কষ্ট হইতো…”
“তোমার আর আমাদের ভবিষ্যত সন্তানের কিছু হলেও যে আমার কষ্ট হইতো।শোনো বউ আর কখনো আমার কথার বাইরে যাইও না।আর এইনেও এই একক্ষান শাড়ি।যখন আমি গেলে তুমি আমার সন্তান নিয়া আমার কাছে আইবা তহন এইডা পড়বা।বুঝছো?”
“আমি আবার কই যামু?”
“আরে তোমারে তো বলতেই ভুইলা গেছি।আইজ রাইতে তোমারে নিয়া লঞ্চে উঠমু।তোমার বাপের বাড়ি রাইখা আইমু।খুশি?”
“হুম। আচ্ছা আপনারে একক্ষান প্রশ্ন করি?”
লুঙ্গির গাট বানতে বানতে বলে,”বলো!”
“আচ্ছা আমগো যদি মাইয়া হয় তাইলে কি আপনে আমগো মানতে পারবেন?নাকি ফুলির আব্বার মতো ফুলিগো রাইখা আরেকখান বিয়া করবেন?”
আমার প্রশ্নে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে উনি হাসতে হাসতে বললেন যে আমাদের মেয়ে হলে তিনি আরেকটা বিয়ে করবেন। ওনার কথা শুনেই আমি কাঁদতে শুরু করে দেই।আমি তো জানি সৎ মায়ের সংসার কত কষ্টের হয়।উনি আমার কান্না দেখে দ্রুত আমাকে ধরলেন।আরেকটু দেরি করলেই হয়তো আমি পরে যেতাম।উনি আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
“হায়রে আমার অবুঝ বউ শোনো আমি তোমারে ছাড়া আর কাউরে বিয়া করমু না।আর আমার যদি মাইয়া হয়,তাইলে তো ভালাই। বাপের কষ্ট বুঝবো আমার ছোট মায়।”
জয়ের কথা আমার হৃৎপিণ্ডে দাগ কাটে। আল্লাহর রহমতে আমি একজন ভালো মানুষ পেয়েছি।হয়তো উনি এতো শিক্ষিত নন।মাত্র ইন্টার পাশ ছিলেন তিনি।তবে গুলশানের একটা অফিসে ম্যানেঞ্জার পদে আছেন তিনি।সাধ্য মতো দান করেন। আল্লাহ আমাকে উচ্চ হৃদয়ের একজনকে দিয়েছেন।আমার উনি একদম আমার শাশুড়ি মায়ের মতো। এককথায় মাটির মানুষ।
আমাদের প্রতিবেশী রুকসার আপা বাইরে থেকে ডাকলেন।তার সাথে জরিনা আপা, মাইমুনা আপাও আছেন।আমি বাইরে যেতেই আমার হাতে কয়েকটা ছোট ছোট কাপড় ধরিয়ে বললেন,
“এই নেও আপা তোমার সন্তানদের জন্য এগুলো। আমাদের ভাগিনা বা ভাগ্নি হওয়ার কয়দিনের মাঝেই আইসা পইড়ো।চিন্তা কইরো না আমরা তো আছি সাহায্য করতে!”
মাইমুনা আপা ভরসার হাত আমায় মাথায় বুলিয়ে দিলেন।জরিনা আপা ইয়ার্কি করে বললেন,
“তুমি চিন্তা কইরো না আপা তোমার এই দস্যি বোন দুলাভাইরে চুরি হইতে দিবো না!হা হা ”
জরিনা আপার কথায় ওনার স্বামী তমিজ উদ্দিন বললেন,
“এই যে ভাবি ভুলেও এই দস্যির কথা শুইনেন না।এক নাম্বারের দস্যি।এর জন্য আমি সিগারেট খাইতে পারি না কতদিন!”
শেষের কথাটা আফসোসের সুরে এবং প্রায় বিড়বিড় করেই বললেন। কিরে শেষ রক্ষা হলো না জরিনা আপা ঠিকই শুনলেন।তেতে উঠে বললেন,
“আজ ঘরে আসো তোমায় আমি সিগারেট খাওয়াচ্ছি।”
আমি,রুকসার আপা আর মাইমুনা আপা ওনাদের কান্ডে শুধু হাসছিই। দুজন একসাথে বাসায় থাকলে এমন খুনসুটি করবেই। তাদের নাকি প্রণয়ের বিয়ে।প্রণয় মানে আগে আমি একদম জানতাম না। কিছুদিন হলো আমিও একজনের প্রণয়ে পড়েছি।হ্যাঁ আমি জয়েরই প্রণয়ে জড়িয়েছি।খুব গভীরভাবে।তাইতো এর অর্থও আমি জানি।আমি জানি প্রণয় ছাড়া সংসার করা যায়।এইতো আমার সন্তান পেটে আসার পূর্বেও আমি জয়কে ভালোবাসতাম না।তাই বলে কি দায়িত্ব পালন থেমে ছিল।না, একদম না।আমি ঠিকই আমার সব দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি।আমি ওনাকে ধীরে ধীরে ভালোবেসেছি।এখন আমার মরার ভয় যেন আরো বেড়ে গেছে।আমি জীবনের জন্য লোভ করছি।আমি লোভী হয়ে উঠেছি মিথ্যা এই দুনিয়ার জীবনের লোভে।
“আচ্ছা শোনো আপা, বাড়িওয়ালা চাচি তোমাকে দেখা করতে বলছে যাওয়ার আগে।কি জানি বলবো শুইনা আইসো!”
রুকসার আপা আমাকে বলেই মাইমুনা আপাকে নিয়ে নিজ নিজ বাসায় চলে গেলেন।আমি ভাবতে লাগলাম কি কারণে খালা আমায় ডাকছেন।স্বভাবগতই প্রচন্ড চিন্তা করা আমার অভ্যাস।খালার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই জয় আমাকে ডেকে উঠলো।খালার কাছে আর তখন যাওয়া হলো না।বের হওয়ার মিনিট দুয়েক আগে খালার ঘরে গেলাম। দেখলাম খালা শুয়ে আছেন।আমাকে কিছু উপদেশ দিলেন।সব উপদেশ দেওয়ার পর বললেন,
“তোর ছেলে-মেয়েগুলোও তোর মতো ভালো হোক দোয়া করি।শোন বিপদে ধৈর্য ধারণ করবি। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকবি।তবুও কান্নাকাটি করে সময় নষ্ট করবি না। জীবনে চলার পথে অনেককেই হারাবি তাই বলে তুই থেমে থাকবি না।আমি জামাইকে বলছি তোরে ক্লাস নাইনের বই এনে দিতে।এতদিন যেমনে পুরান বই দেখে পড়ছোস,ওমনিই পড়বি।শুভা তোকে এখনও পড়াবে।তাই না শুভা!”
খালা আমাকে বোঝানোর পাশাপাশি তার মেয়েকে প্রশ্ন করলেন।শুভা আপা পুলকিত নয়নে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
“আম্মা আপনি চিন্তা করবেন না ও একবার ফিরে আসুক।ওর মেয়েকেও পড়াবো,ওকেও পড়াবো!”
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ক্লাস করার ক্ষমতা সেই ক্লাস সিক্সে শেষ হলেও শুভা আপার শেখানো পড়াগুলো আমায় ক্লাস এইট পড়ুয়া বানিয়ে দিল।হয়তো সার্টিফিকেট একটাও নেই।তাই বলে কি জ্ঞান অর্জন থেমে আছে।নেই তো।শুভা আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ে।শুভা আপা অত্যন্ত মেধাবী।ঘর ভর্তি তার প্রাপ্য সম্মানী।খালা শুভা আপারে পড়াইছে।শুভা আপার বাপ নাই।শুভা আপা যখন বছর চারের তখন নাকি ওনার আব্বা মারা যান।খালা একা হাতে বড় করছে ওনারে।আমার মনে কেন জানি প্রশ্ন জাগে মাঝে মাঝে,খালা যদি একা থেকে মেয়ে মানুষ করতে পারে,তাইলে আমাদের আব্বার কেন আরেকজনের প্রয়োজন পড়লো।
★
ভোর ছয়টা নাগাদ বাজে।গ্রামে এই সময়ই সকাল।একে তো শীত পড়াও শুরু হয়েছে।রহিম রোয়াকে বসে পড়ছে।তাকে যে বড় কেউ হতেই হবে। রকিবুল তাদের কাছে আসে না। ওদের ছাড়া বাকি সবার কাছে যায়। রকিবুল বেজায় ভালোই আছে। নতুন আম্মাও রকিবুলের মাঝে নিজের মরা সন্তানকে খুঁজে পেয়েছে।এই হয়তো দুধমাতার টান।উপমা বেগম আবারও তার সন্তান হারিয়েছেন। দুইদিন তিনি অসুস্থতায় ভুগে তৃতীয় দিন ঘর থেকে ঝাটা নিয়ে বের হন। রোকেয়া নিজের বানানো মাটির হাঁড়িগুলো দেখছিল তখন। শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ পেছন থেকে ওর গায়ে ঝাড়ুর বারি লাগতেই মাটির একটা খেলনা ছুঁড়ে মারে ও।উপমা বেগম পিছিয়ে যান।গলা বরাবর লেগেছে। আজ ঝাড়ুর বারি মারতে অবশ্য প্রতিবেশীরা দেখেছে। কিন্তু রোকেয়ার মাটির হাঁড়ি ছুঁড়ে মারা দেখেনি।উপমা বেগম গলায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। রোকেয়া ভয়ে ছুট লাগায়।
“কুত্তা*** তুই বাইত্তে আহিস!তোরে খুন করমু আমি!”
“যেইডা আমারে কইলা হেইডাই তুমি। তাইতো আমগো লগে এতো ঘেউ ঘেউ করো!হি হি”
রোকেয়া পেছনে ফিরে কথাটা বলে সেই যে ছুট দিলো বিকেল বেলা আব্বার সাথে বাড়ি ফিরলো।উপমা বেগম রোকেয়ার দিকে তেড়ে আসতে নিলেই রাজিব মিয়া ধমক দিয়ে ওনাকে সরে যেতে বলেন।আসার সময় প্রতিবেশীদের থেকে তিনি শুনেছেন রোকেয়াকে নাকি ওর নতুন আম্মায় ঝাড়ু পিটা করছে।তাই হালকা ক্রোধান্বিত।হায়রে বাপ!
ওই দিনের পর পেরিয়ে কয়েকটা মাস।রহিম শুনেছে আপা আসবে।কালরাতে লঞ্চে উঠলে আর কিছুক্ষণ পর ঘাঁটায় চলে আসার কথা।রহিম বাইরে একটু আকটু উঁকি দিচ্ছে।রহিমা বাইরে ঝাড়ু দিচ্ছিলো।রহিমকে এমনে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে রহিম্মা এতো বাইরে তাকাস কেন?”
“আপা আমার নাম রহিম্মা না।তোমার নাম রহিমা।আমার নাম রহিম”
রহিম মুখটা চুপসে বলে।আম্মা বেঁচে থাকতে এ দুজনের খুনসুটি দেখার মতো ছিল।আম্মা মরার পর থেকে রহিম চুপচাপ স্বভাবের হয়ে গেল। আগের মতো আর চঞ্চলতা দেখায় না।সে তো তখন আম্মার জোরে চঞ্চলতা করে বেড়াতো এখন তো আর কেউ নেই। মামারা কয়েকমাস হালকা পাতলা খোঁজ খবর রাখলেও এখন আর এমুখী সহজে হয় না। ওদের থেকে পালিয়ে থাকলেই যেন বাঁচে।
“আপা জানো ঝর্ণা আপায় আইবো আইজ!”
রহিমের কথায় রহিমা ঝাড়ু দেওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তোরে কেডা কইলোরে রহিম্মা?”
“শহর তওন চিঠি আইছিল।আব্বা যহন পড়তাছিল আমি উঁকি মাইরা দেখছি।”
“ওহ।তাইলে তো মেলা কাম।আপার লিগা ঘরও তো গুছান লাগবো। তুই রোকেয়া আর দুইডারে ওঠা।যা”
রহিম ঘরে বোনদের জাগাতে যায়।আর রহিমা বাড়ির সামনের অংশ পুরাটা ঝাড়ু দিয়ে দেয়।একপাশে চুলা বানানোর কাঁদা এনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিল উপমা বেগম।রহিমা সাধ্য মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কাঁদা গুলো একত্রে রাখে।তারপর হাত ধুতে বাড়ির পেছনের পুকুরে যায়।বিশাল এ পুকুরের একপাশে বিশাল বাঁশঝাড় আর আরেকপাশে কুন্তি,শিমলা ওদের বাড়ি। তবে পুকুর ঘেরাও করা কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে।মাছ চাষ আগে করলেও এখন আর করা হয়না।তবুও কোথা থেকে যেন মাছ প্রতিবছরই আসে।রহিমা বিশাল পুকুরের পাশে স্থাপিত গোসল ঘর থেকে হাত ধুয়ে নেয়। বলে করে পানি রাখা আছে এখানে।গোসল শেষে ওখানে গিয়েই পোশাক পরিবর্তন করে আসে ওরা। টিউবওয়েল নাকি সামনের বছর ওদের আব্বায় গাড়বে।তখন আব্বার খাবার পানি নিয়ে ওদের সমস্যা হবে না।
ইনশাআল্লাহ চলবে