সত্ত্বাহীন_আমরা #পর্বঃ৯ #বর্ষা

0
148

#সত্ত্বাহীন_আমরা
#পর্বঃ৯
#বর্ষা

জ্যোতি দুমাস ধরে স্কুলে যাচ্ছে।মেয়েটাকে স্কুল ড্রেসে যে সুন্দরই না লাগে মাশাআল্লাহ। বাসায় এসে রোকেয়াকে ধরে বেঁধে একসাথে পড়তে বসায় জ্যোতি। রোকেয়া পাশের একটা স্কুলে ওদের দুলাভাই ভর্তি করেছে।তবে সে স্কুলে যায় না।জয় প্রথম প্রথম বকলেও এখন স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে এনেছে। পরশু জয় আমাদের গ্রামে রেখে আসতে যাবে।আমার শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না।রান্না বান্না করতে পারিনা,চাকরিও ছেড়ে দিয়েছি!জয়কেই বাসায় এসে রান্না-বান্নার ঝামেলা পোহাতে হয়।জ্যোতি আর রোকেয়াকেও সারাদিন হাবিজাবি খাবারই নাড়াচাড়া করতে হয়।তাইতো ওদের আর আমার স্বাথ্যের কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত।

দুপুর দুইটা। রোকেয়া আর জ্যোতি ঘুমিয়েছে।একা একাই বসেছিলাম আমি।জ্যোতির বইগুলো নাড়াচাড়া করছিলাম। হঠাৎ মনে হয় কে যেন আমাদের দরজায় টোকা দিচ্ছে।বাইরে গিয়ে কাউকেই দেখলাম না। দরজা লাগানোর সাথে সাথেই আবারও মনে হলো কেউ টোকা দিচ্ছে।এভাবে চার-পাচবার দেখলাম।কেউ ছিল না। বিকেল বেলা একথা বাড়িওয়ালা খালাকে জানাতেই মনে হলো তিনি চিন্তিত।আমাকে বললেন,

“শোন ঝর্ণা কেউ তিনবার ডাক না দিলে দরজা খুলবি না।”

“কেন খালা?”

“তোরে না করছি তাই!আর ভর দুপুরবেলা বা সন্ধ্যায় মেয়েটাকে ঘর থেকে বের হতে দিবি না!”

“খালা কারণ বলেন নয়তো আমি কিছুই করবো না!”

“ঝর্ণা শোন তাহলে। আমাদের বাড়ি নির্মাণ করার পর তোদের ওইপাশে একটা বন্ধ রুম আছে না, ওইখানে জুলেখারা ভাড়া আসছিল।একদিন ওর জামাই ওকে এত মারে,এত মারে যে ও মরেই যায়।পুলিশ কেস হইছিল।আর ওর জামাইয়েরও শাস্তি হইছিল।জুলেখা তখন আটমাসের গর্ভবতী ছিল।তাই ও ওর বাচ্চার জন্য আসে বারবার।”

গ্রামেও এমন ভুতপ্রেতের কথা শুনেছি। কিন্তু কখনও ভাবিনি একটা ভুতের সাথেই আছি। হঠাৎ করে মনের মাঝে ভয়ের সৃষ্টি হলো।ওই জুলেখার ভুত তো ওর বাচ্চার জন্য আসে।আর আমার পেটেও তো আরেকটা জান আছে।সে যদি কোনো ক্ষতি করে দেয়!আমি ভয়ে ভয়ে ঘরে চলে এলাম। পাঁচটার দিকে ওই দুজনের ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙার পর মেয়েটা কতক্ষণ আমায় জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। বিছানাতেই বসেছে তবে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া মেয়ে আমার বুঝদার হয়েছে। হঠাৎ দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে আমার ভয় যেন দশগুণ বেড়ে গেল। রোকেয়া দরজা খুলবে মাত্র আমি বলে,

“রোকেয়া দরজা খুলিস না।”

“কেন আপা?”

“আগে জিজ্ঞেস কর কে এসেছে।তারপর দরজা খোল!”

“আচ্ছা আপা!”

রোকেয়া জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে জবাব এলো না।আমি ভয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে গুটিয়ে গেলাম।ভয় যেন তরতর করে বাড়তে লাগলো। হঠাৎ আমাকে এত ভয় পেতে দেখে জ্যোতি আর রোকেয়ার মুখেও ভীতি নেমে এলো।আমার জয়ের ওপর রাগ লাগছে কেন সে এবাড়ি নিতে গেল!আজ দু’বছর ধরে এবাড়িতে আমরা আছি।তবে এতোদিন এমন ঘটনা একবারও ঘটেনি।আমারও এখন আটমাস চলছে। তাই হয়তো ওই প্রেতাত্মা আমার সন্তানকে কেড়ে নিতে এসেছে।আমি রোকেয়া আর জ্যোতিকে আগলে ধরে বসে রইলাম। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ওমনেই বসে ছিলাম।জ্যোতি আর রোকেয়া ভয়ে ভয়ে এই সময়টা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল।জয় বাসায় আসলো।জয়ও টোকা দিয়েছিল।আমি সে কি বকা!সে কিছুক্ষণ স্থম্ভিত হয়ে খাটে বসেছিল। পরে আমি খালার বলা সব কথা ওনাকে বললাম।জয় আমার কথাগুলো মজা হিসেবেই উড়িয়ে দিল।আমি জেদ ধরে রইলাম আমি কালই আমার বাপের বাড়ি যাব।ও একবারেই রাজি হয়ে গেল।আমি অবাক হলেও পরে জানতে পারলাম কাল কি একটা দিবস তারই ছুটি। সেপ্টেম্বর মাস শেষ হতে আর মাত্র দুইদিন। মেয়েটাকে বছরের মাঝেই ভর্তি করিয়েছেন জয়।শিশু শ্রেণীতে।আজ মেয়ের স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে এনেছে। প্রধানশিক্ষক বলেছিলেন জয়কে,

“ভাই আরেকবার ভেবে দেখুন! আমাদের স্কুলে ছেলে-মেয়ে ভর্তি করানোর জন্য সবাই পাগল এবং আমাদের বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল।আর আপনার মেয়েকে আপনি এই স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছেন!”

“স্যার আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম আমার মেয়েটা এই স্কুলে ভর্তি হতে পারে কিনা!আমি ওকে যেখানেই পড়াই ও যদি ওর সর্বোচ্চ দেয়,তবে সেখানেই ও সফল হবে!”

জয়ের কথায় প্রধানশিক্ষক শেষে শুধু বলেছিলেন,

“আপনার আপনিই ভালো বুঝবেন ভাই!”

“ধন্যবাদ ”

জয় বেরিয়ে আসে ওই বিদ্যালয় থেকে।এখানে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হতে আগে থেকেই শিশু শ্রেণীর সব পড়া জানতে হয়। তবুও সুযোগ পায়না।জয় পেছনে ফিরে একবার বিদ্যালয়টা দেখে নেয়। তারপর সেখান থেকে অফিসে চলে যায়।আর তারপর বাসায় আসে।বাসায় এসে আমার ভীত মুখশ্রী আর কথা শুনে সে হাসতে হাসতে শেষ!

“তো তুমি বলতাছো জুলেখা ওর বাচ্চা নিতে আসছে?”

“খালায় বলছে!”

“তা আমি কি জুলেখার জামাই ছিলাম যে জুলেখা আমাদের বাচ্চা নিতে আসবে!”

“আমি জানি না।আমি এই বাসায় থাকতে চাই না!”

“কালকে তো গ্রামে রেখেই আসছি!”

“যদি বাসা পরিবর্তন না করেন তাহলে আমি আর শহরে আসমু না!”

“বউ দেখি আমার ভয়ে নীল হয়ে যাচ্ছে!”

জয় হাসতে হাসতে বাইরে চলে যায়।এটা প্রতিদিনকার কাজকর্ম তার।এখন রান্না বান্না করে বেরিয়েছে।রাত দশটা পর্যন্ত সে বাইরেই থাকবে। দিনকয়েক ধরে আধাঘণ্টার জন্যই বাইরে যায়।আগে দু’তিন ঘন্টা অনায়াসে বাইরে থাকতো।

আব্দুর রহিম প্রচন্ড চিন্তিত। রাহেলার জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।শীতে কাঁপছে। জলপট্টি মাথায় দিয়েই চলেছে আব্দুর রহিম। রেহানা আর রকিবুল ঘুমিয়ে পড়েছে। আব্দুর রহিম জলপট্টি দেওয়ার সময় শুনতে পায় রাহেলার কথা।

“আম্মা,আম্মা আমারে তোমার সাথে নিয়া চলো..”

“আম্মা আব্বা এহন আর আমগো নাই।আম্মা আমারে তোমার কাছে নিয়া যাও!”

“আম্মা আমার অনেক মাথা ব্যথা করে।আম্মা মাথাটা টিপ্পা দেও!”

“আম্মা বড় ভাইয়ে আমগো অনেক খেয়াল রাহে!”

“আম্মা মামারা আর আমগো আগের মতো দেহে না!”

রাহেলা একাই বিড়বিড় করছিল।আর আব্দুর রহিম ওর বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো শুনে কাঁদছিল। সত্যিই তো ওদের আম্মা যখন বেঁচে ছিল ওদের মামারা ওদের কতোটা খেয়াল রাখতো।পিঠা থেকে শুরু করে কোনো ভালো-মন্দ রান্না হলেও তা পাঠাতো।প্রতি ঈদে কাপড় কিনে দিতো।আর এখন..!বছরে একবার খবরও নিতে আসে না।বড় মামা শহরে চলে গেছে আর মেজ মামা বিদেশ গেছে একবছর হলো।আম্মা মারা গেছে আজ পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে অনেক আপন মানুষের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে।এখন আর তেমন কারো সাথেই যোগাযোগ নেই।

আব্দুর রহিম জলপট্টি দেওয়ার ঘন্টাখানেক পর জ্বর কিছুটা নামে। রাহেলা ঘুমিয়ে পড়ে। আব্দুর রহিম রোয়াকে গিয়ে বসে। আব্দুর রহিম এখন প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছে।যে ওর সাথে যেরকম করে ওউ তার সাথে সেরকমই করে।ওইতো সেদিনকার ঘটনা।

রহিমা ওর জামাই নিয়ে এসেছিল।ওর জামাই জুবায়ের সবার জন্যই অনেক কিছু এনেছিল। আব্দুর রহিমকে একটা বই দিয়েছিল।বইটা উল্টে পাল্টে দেখে ভালোই লাগে তার।ঘরে নিয়ে রেখে দেয়।উপমা বেগমের বোন দু’দিন হলো বেড়াতে এসেছে।উপমা বেগমের বোনের মেয়ে তমাকে একটু পুতুল দেয় জুবায়ের। অবশ্য জুবায়ের রোকেয়ার জন্য আনা পুতুলই দিয়েছিল তমাকে।তমা সেটা দেখে আনন্দিত হলেও রাহেলার পুতুল দেখে সেটা নেওয়ার জন্য কান্না শুরু করে দেয়। রাহেলার সমবয়সীই তমা।উপমা বেগম রাহেলা হাত থেকে খেলনাটা নিতে গেলেই আব্দুর রহিম তমার হাত থেকে খেলনা নিয়ে নেয়।দুইটা খেলনাই সুন্দর।তমা গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে।উপমা বেগম ঝাঁঝালো গলায় বলে,

“আব্দুর রহিম তুই তমার পুতুল কেন নিছোস?”

“পুতুলটা আমার ভালো লেগেছে। রাহেলা তুই তোরটা দিয়ে দে।এটা নে সুন্দর আছে!”

রাহেলা ভাইয়ের কথা মতো উপমা বেগমের হাতে পুতুল দিয়ে ভাইয়ের হাত থেকে নেয়।তমার মা তমালিকা বেগম মুখে ভেংচি কেটে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

“আপা দেখলি এই ছেমড়ায় আমার মাইয়ার খেলনা নিয়া গেছে!”

“এই যে খালা শুনেন এটা আপনার মাইয়ার খেলনা না।এইডা আমার রোকেয়ার খেলনা।ও বাড়ি নাই দেইখা আপনার মাইয়ারে ভদ্রতার খাতিরে দুলাভাই দিছে।তাই কন্ঠ নামাইয়া কথা কন!”

“আব্দুর রহিম!”

পেছন থেকে ধমকে ওঠেন রাজিব মিয়া। আব্দুর রহিম পাত্তা না দিয়ে রাহেলার হাত ধরে সেখান থেকে চলে আসে। ওদের আরো আগে রকিবুল আর রেহানা চলে এসেছিল। আব্দুর রহিম জানে সে বেয়াদবি করছে কিন্তু কিভাবে সে ভালো থাকবে! অন্তত পক্ষে একজন খুনির পরিবারের সাথে সে কখনোই ভালো ব্যবহার করতে পারবে না।ভালো ব্যবহার করতো যদি নিজের বোনের কর্মে তমালিকা বেগম লজ্জিত থাকতেন।

আজ থেকে একসপ্তাহ আগে আব্দুর রহিম যখন দুপুরে ভাত খেতে বাসায় আসে।তখন দেখে উপমা বেগম ভাত বেড়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছে।সে খুশি হয় এটা ভেবে যে উপমা বেগম তাদের মানতে চাইছেন। কিন্তু না তিনি তো আব্দুর রহিমকে হত্যা করতে চাইছিলেন।রেহানা যদি সঠিক এসে না বলতো যে,আম্মা খাবারে কিছু মিশাইছে।

আব্দুর রহিম খাবারের ঘ্রাণ নেয়।খেতে পোকামাকড় মাড়তে সাধারণ যে ঔষধ দেওয়া হয় তারই ঘ্রাণ পায়।খাবার ওমনে রেখেই ছুট লাগায় সে রাজিব মিয়ার কাছে।ছেলেকে এই সময় নিজের কাছে দেখে চমকালেও প্রশ্ন করেন না তিনি। আব্দুর রহিম নিজ থেকেই বলে,

“আব্বা আমগো যদি পালতে না পারেন তাইলে তো বলতেই পারতেন চইলা যাইতে!প্রতারণা কইরা আমারে মারা চেষ্টা করতাছেন কেন?”

“আব্দুর রহিম কি কইতাছোস তা নিজে জানোস তো!”

“হ আব্বা আমি জানি আমি কি কইতাছি!আপনের বউ আমার খাবারে খেতে পোকামাকড় মারার ঔষধ দিয়া রাখছে। বিশ্বাস না হইলে বাইত্তে লন নিজে ঘ্রাণ নিয়া দেখবেন!”

“যদি তোর কথা মিথ্যা হইছে তাইলে তোর খবর আছে আব্দুর রহিম!”

সেদিন আব্বা প্রমাণ পেয়েছিল খাবারে বিষ দেওয়ার।উপমা বেগম প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে ঠিকই স্বীকার করেন নিজের অপরাধ। কিঞ্চিত সময়ের ব্যবধানেই হাজির হয় ওনার বাবা-মা।ওনার মা ওনার গালে কষে এক চড় লাগিয়ে বলেছিলেন,

“পুলাডারে কেমনে মারবার চেষ্টা করছোস মা*! নিজে এহন এই বিষের ভাত খাইয়া মর!”

উপমা বেগম ওনার মায়ের কথায় গরম মাথায় ঠিকই বিষ খেয়েছিলেন!তারপর আব্বা তাকে ক্ষমা করে ঠিকই হাসপাতালে ছুটেছিলেন।এইতো একসপ্তাহ হলো সেই ঘটনার।ওনার মাঝে একটুও লজ্জাবোধ নাই। ছিঃ।

“ভাই..”

রকিবুলের শব্দে রোয়াক থেকে উঠে আসে আব্দুর রহিম।ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায়, রকিবুল চৌকির উপর দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে।ছেলেটা হয়েছেও এক। আব্দুর রহিম বিহীন অন্যকারো কাছে ঘুমালেও সেই মাঝরাতে তার ঘুম ভাঙবেই এবং ভাই ভাই করে ডাকবে। আব্দুর রহিমের ভয় হয় মাঝে মাঝে এই ছেলেকে নিয়ে।যদি তার কিছু হয়েছে যায় তখন রকিবুলের কি হবে!

ইনশাআল্লাহ চলবে..

(বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here