মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_২৩ #পুষ্পিতা_প্রিমা

0
405

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ইশশ মেয়েটি যদি একবার,,
শুধু একবার ছেলেটির চোখের দিকে স্থির হয়ে দেখত তবে দেখতে পেত তার চোখ থেকে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়েছে। অশান্তিতে মাথার রগ দপদপ করছে। গরম গরম দুফোঁটা চোখের জল কানের কাছে গড়িয়ে পড়েছে। মেয়েটি দেখল না। ছেলেটি আজ আবার ও হেরে গেল। আজ আবার তার একবুক অব্যক্ত ভালোবাসারা প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেলনা। বলা হলোনা আর। জানানো হলোনা। মেয়েটি ও বুঝল না।
ফোনকলের আওয়াজে দুজনের হুশ ফিরল। ইশা ফোন রিসিভ করল। সাথে সাথে ভেসে এল পুরুষালী কন্ঠে একটি ভয়ানক বার্তা। মেয়েটি বড়দা বলে ডাকার আগেই। শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের বড়দার কন্ঠে কান্নার আভাস পাওয়া গেল।
ইশা দুরুদুরু বুক নিয়ে আবার জানতে চাইল।
‘ কি হয়েছে বড়দা? আমার পরী মা……..
রিক অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ ইশুরে পরীকে নিয়ে গেল দুজন বোরকা পড়া ডাকাত। গুলি দেখিয়ে বলল তারা নাকি মেরে ফেলবে আমার মাকে। পুলিশকে না জানাতে বলেছে। কোথায় নিয়ে গেল পরীকে। কোথায়?
ইশার হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। সে আবার কুড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগাল। রিপ কিছু বুঝতে পারল না। ঘুমের ঔষধ দেওয়ায় তার ঘুম ভর করল দুচোখের পাতায়। চোখ বন্ধ করার সাথে একফোঁটা জল গড়াল কানের কাছে। সাদা স্বচ্ছ শুভ্র ভালোবাসারা প্রকাশিত না হওয়ার খুশির জল। কি সুন্দর!

ইশা ছুটে গেল কাঁপাকাঁপা পায়ে। ফোন বাজল তার। ওপাশ থেকে আওয়াজ এল হাসির। ইশা বুঝে গেল সব। চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, মারবেন না। মারবেন না। আমার পরীকে মারবেন না। সব দোষ আমার।
আমার কলিজাটাকে মারবেন না।
আজিজ চৌধুরী হো হো করে হাসলেন। বলল,যতদিন না আদি আর আইমির বিয়েটা কমপ্লিট হচ্ছে ততদিন এই মেয়েটা আমার কাছে থাকবে। তোমাকে নাচানোর সুতো এই মেয়েটা। পরীর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে । সে আওয়াজে ভয় মেশানো। মনে হয় তাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।
ইশা গর্জে উঠে।
‘ আমার পরীকে আলোতে রাখুন। আঁধার ভয় পায় ও। ওকে খেলতে দিন। আমার মা টা ব্যাথা পেয়েছে কপালে। ওর আদর,যত্ন দরকার। একটা বাচ্চাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছেন। কেন? আমি তো সরে গিয়েছি। তাহলে কেন এত অবিচার? কেন?
ইশা অন্ধকারে ছুটে চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্য। সে ভুলে গিয়েছে চৌধুরী বাড়ি বহুদূর। দৌড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে তারপর ও দৌড়াতে থাকল। ঝড়বৃষ্টির মাঝে একটা মেয়ে নির্জন রাস্তায়।
পায়ে কাঁটা বিধল। সারা শরীর ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠল। কিন্তু তারপর ও সে দৌড় থামাল না। কারো গলার আওয়াজ ও ভেসে এল পেছন থেকে। কিন্তু সে তোয়াক্কা করল না। এগিয়ে চলল।
আচমকা কারো হাতের টানে সে আর এগোতে পারল না। থেমে গেল। একরাশ ঘৃণা বিরক্তি ক্রোধ ক্ষোভ নিয়ে তাকাল পুরুষটির দিকে।
আদি তার দুইবাহু ধরে ঝাকিয়ে বলল, এভাবে কেউ দৌড়াই? কোথায় যাচ্ছেন এমন সময়? কি হয়েছে?
আদির গায়ের ধূসর রঙের শার্ট গায়ে লেপ্টানো। চুলগুলো চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে। উদভ্রান্তের মতো আচরণ করল ইশা। আদির শার্ট সর্বশক্তি দিয়ে টান দিল। দূরে ছুড়ে মারল আদিকে। আদি অবাক হলো। নিজের বুকের কাছে তাকাতেই দেখল খসে পড়েছে কয়েকটা বোতাম। সে তারপর ও ইশার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি? কি করছেন এসব? কেন করছেন?এই ঝড়বৃষ্টির মাঝে এতরাতে কেউ এভাবে বের হয়? আর ইউ মেনটালি সিক?
ইশা আর চুপ থাকতে পারল না। সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসাল আদির গালে। কিন্তু তার পরপরই সে ঢলে পড়ল আদির দিকে । আদি অবাক হওয়ার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেখতে পেল মেয়েটি এবার গুনগুন করে কাঁদছে। বসে পড়েছে রাস্তায়।
ইশা যে হাতে চড় মেরেছে আদিকে সে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে কাঁদল। কোনোকথা বেরোলো না। আদির দিকে আর তাকাল না। শুধু ডাকল, আমার মা। পরী।
আদি বসে পড়ল ইশার সামনে। অনেকক্ষণ বসে বসে কাঁদল ইশা। আদি ও ততক্ষণ বসে রইল। ইশা অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে দেখল আদিকে। আদি তার দিকে ততক্ষণে চেয়ে আছে। মুখটা ক্লান্ত, অবসন্ন, আঘাতপ্রাপ্ত। ইশা দাঁড়িয়ে পড়ল। দৌড়ে দৌড়ে এগোতে লাগল। পায়ের ব্যাথাকে পাত্তা দিল না। আদি বুঝে উঠতে পারল না কি হয়েছে মেয়েটার?
আদি এবার দৌড়ে গেল মেয়েটির পিছু পিছু। শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। তার হাতে পেঁচিয়ে নিল। মাথায় তার যন্ত্রণা লাগল। হাতে শাড়ি পেঁচাতে পেঁচাতে ইশাকে নিয়ে আসল তার কাছে। তার বুকের কাছে। ইশা আটকে গেল তার কাছে এসে। ঘৃণাসূচক শব্দ বের করল মুখ দিয়ে, নির্লজ্জ।
আদি ইশার কথায় কান দিলনা। শাড়ি হাতে পেঁচিয়ে দেখাল ইশাকে। বলল, আপনি মিষ্টি হতেই পারেন না। মিষ্টি আমি হাতে শাড়ি পেঁচালে লজ্জা পেত। আমি কি করে আবার একই ভুল করলাম ?
মাথায় হাত দিয়ে আহঃ শব্দ বের করে বলল, আপনি মিষ্টি নন। কখনো না।
ইশা আর পারল না। নিজের ভার ছেড়ে দিল আদির গায়ের উপর। মিনমিন করে বলল, ডক্টর ফিরিয়ে দিন। আমার মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।

আদি কিছুই বুঝলনা। বৃষ্টিজল ভেসে নিয়ে গেল সেই মিনমিন করে বলা কথা। আদির বুকের কাছে এসে মুখ ঠেকল ইশার মুখ। সে চেতন হারাল। চেতন হারানোর আগেই বিড়বিড় করে বলল, মা আমার। পরী?
চোখে ভাসল ছোট্ট মেয়েটার আদুরে মুখ। কানে বাজল একটি ডাক, ‘ আমমমমমমা।
আদি তার বুক থেকে একহাত দিয়ে ইশার মুখ তুলল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ঝড়বৃষ্টি বাদলের এক মন কেমনের রাতে আবার দেখা,সাক্ষাত, আঘাত,তার জীবনের প্রথম বৃষ্টির সাথে। চেয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে অন্যায় বাসনা মনে জাগল আকস্মিক। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি জল জমা মেয়েটার কপালটা দেখে।
ঠোঁট কাঁপল তরতর করে। কিন্তু ছুঁয়ে দেওয়া হলোনা। এই অন্যায় বাসনা নিমেষেই নিভু নিভু হয়ে এল একটি ভাবনায়, মেয়েটি বিবাহিত। অন্যের স্ত্রী।
আদি চৌধুরী ভালোবাসতে জানে। সে চরিত্রহীন নয়। তার বৃষ্টিকে চায়না আর। বৃষ্টি নেই আর তার। তার মিষ্টিকেই চায়। যেমন সত্যি সে বৃষ্টিকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসেছে একসময়। বলা হয়ে উঠেনি। বলার সুযোগ আসেনি।
ঠিক তেমন সে এখন মিষ্টিকে ভালোবাসে। মিষ্টিকেই চায়। তার বর্তমান মিষ্টি। ভবিষ্যৎটা ও তাকে ঘিরেই হবে। সে থাকুক বা না থাকুক। সে থেকে যাবে ডক্টরের মনে মিষ্টি হয়ে ।
আর এই মেয়েটি থাকবে হঠাৎ করে,আচমকা,আকস্মিক এক মন কেমনের সকাল,সন্ধ্যা,দুপুর,রাত হয়ে। এক মন কেমনের রোদ হয়ে। এক মন কেমনের ব্যাথা হয়ে। এক মন কেমনের হাসি হয়ে। এক মন কেমনের স্মৃতি হয়ে। এক মন কেমনের বৃষ্টি হয়ে। থেকে যাবে। চিরকাল।
আদি মন থেকে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে। আমাকে ছাড়া দুজনই ভালো থাকুক। তারা ভালো থাকত না আমার সাথে। থাকত না।
বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজের তালে তালে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দূরে কোথাও আওয়াজ করে বজ্রপাত হলো। আদির সেদিকে খেয়াল নেই।
সে বিড়বিড় করে বলল,
‘ কিন্তু আমি ভালো থাকতাম বৃষ্টির সাথে। না বৃষ্টি নয় মিষ্টির সাথে। হ্যা হ্যা মিষ্টির সাথে। কারণ মিষ্টি আমার অর্ধাঙ্গিনী। জীবনসঙ্গী।

__________________________

ঝিরঝির বাতাস ডুকে পড়ছে কেবিনের জানালা দিয়ে। সকালটা সুন্দর ঝকঝকে। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ শীতল,নির্মল। আদি কেবিনের জানালার পাশ থেকে সরে এসে দাঁড়াল মেয়েটির কাছে। মেয়েটি নড়াচড়া করছে অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু চোখ খুলল না। আদি চেয়ার টেনে বসল মেয়েটির পাশে। তার গায়ের ভেজা শার্টটি এখনো গায়ে। পাল্টানো হয়নি। সময় পায়নি। সুযোগ হয়নি।
আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে ইশা খেয়াল করল শরীরের প্রত্যেকটা শিরায় উপশিরায় ব্যাথা। নড়তে চড়তে তার কষ্ট হচ্ছে। চোখ খুলে একদম সামনে তাকাতেই দৃষ্টি আদানপ্রদান হয় সামনে বসে থাকা পুরুষটির সাথে। মাথা এলিয়ে সে শুয়ে থাকে। দুজনের চোখের পলক স্থির। বেশকিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পর ইশার মনে হলো এই লোকটার সাথে তার কি? কিসের কথা?
ইশা নামার চেষ্টা করল । ব্যাথায় চোখমুখ আপনাআপনি কুঁচকে এল। আদি বলল, কোথায় যাবেন?
ইশা জবাব দিল না। আদি আবার ও বলল,
‘ রাতে কোথায় ছুটছিলেন এভাবে?
ইশা সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আদির দিকে। তার মনে পড়ল সবটা। পরী?
কোথায় পরী? আজিজ চৌধুরী পরীকে কোথায় নিয়ে গেছে?
ইশা নামতে চাইলেই আদি আটকাল। বলল, নামবেন না। আপনি অসুস্থ।
ইশা থামল না। বলল, আমার এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী। আমার সামনে থেকে সরুন আপনি। কতবার বলেছি আমার সামনে আসবেন না।
আদি তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে,
‘ আসব না। আদি চৌধুরী অতটা ও নির্লজ্জ নয় যে একটা বিবাহিত মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করবে। তার হাতের চড় খাবে।
আদি উঠে দাঁড়াল সাথে সাথে। বলল, আমি আপনার সমস্যাটা জানতে চেয়েছিলাম। সলভ করতে পারতাম কিনা জানিনা। তবে চেষ্টার ত্রুটি রাখতাম না। কিন্তু না,,আপনি সেই সুযোগটা দেননি।
ইশা চুপ করে বসে থাকে। ডক্টরকে সে চড় মেরেছে কথাটা অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্য। সত্যি সে চড় মেরেছে। আদি কিছুদূর হেঁটে যায়। আবার ফিরে আসে। ইশার দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলে,
‘ শুরু থেকে আপনি আমাকে আঘাত দিয়েই এসেছেন বৃষ্টি। একদম শুরু থেকেই। সেই আঘাত কষ্টগুলো এখন আপনি পুনরায় পাচ্ছেন। কেন পাচ্ছেন আমি জানিনা। সেই কথা জানার জন্য সেই অধিকারটুকু ও আমার নেই। হয়ত এটা আপনার আর আপনার স্বামী সংসারের কোনো ইস্যু। তাই আমার নাক গলানোর কোনো স্কোপ নেই। শেষমেশ শুধু এটুকুই বলব। আপনি ভালো থাকুন। খুব ভালো থাকুন। আদিকে ছাড়া সবাই ভালো থাকতে পারে।
ইশা শুধু থম মেরে বসে রইল। নড়ল না চড়ল না। নিঃশ্বাস ও ফেলল না বোধহয়। আদি চলে গেল। নিমেষেই উদাও হলো। আর দেখা পেল না ইশা। নিজেকে একা অনুভব হলো। খুব একা। ভীষণ একা। কেউ নেই। রিপদা ও অসুস্থ।

_________________________

আলিয়া চৌধুরী আদির খোঁজ না পেয়ে আদির ফ্ল্যাটে চলে গেলেন। সেখানে দেখা গেল তালা ঝুলানো। দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করায় দাড়োয়ান জানাল,
‘ স্যার স্যুটকেস নিয়ে কোথাও গিয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করলে ও কিছুই বলেনি।
আলিয়া চিন্তিত হয়ে পড়েন। কল দেন আজিজ চৌধুরীকে। আজিজ চৌধুরী কল ধরার সাথে সাথে বলেন,
‘ লিয়া এবার সব ঠিকঠাক। বিয়েটা হয়ে গেলেই হলো। দুজনকে এব্রোড পাঠিয়ে দেব।
আলিয়া ডুকরে কেঁদে উঠে। বলে, তুমি এসব কি বলছ? আদি চলে গেছে।
আজিজ চৌধুরী গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে
‘ কি বলছ এসব? কখন? কোথায়? কেন?
আলিয়া কেঁদে কেঁদে বলে,
‘ কোথায় যেতে পারে আদি?
আজিজ কল রেখে দিলেন। আইমিকে কল দিলেন। আইমি বেশি কিছু বলল না। শুধু বলল, আমি জানিনা আন্কেল। শুধু এটুকু জানি। আদি ফিরবে আমাদের বিয়ের আগে। ফিরবেই।
আজিজ চৌধুরী বিক্ষিপ্ত মেজাজে চিৎকার দিয়ে উঠে। যদি না ফেরে তখন?

_____________________

লম্বা হয়ে সোফায় শুয়ে আছে রিক। চোখের উপর হাতের কব্জি দিয়ে রেখেছে। মুনার গলা ধরে আছে। সে হাঁটুভেঙ্গে বসল রিকের মুখের কাছে। ঝিম ধরে বসে রইল। গুনগুন কান্নার আওয়াজ শুনে রিপের হাত নড়েচড়ে উঠে। কিন্তু সে তাকায়না মেয়েটার দিকে। চোখের উপর থেকে ও হাত সরায় না। কাঁদুক মেয়েটি। মুনা যখনি দেখল রিক তার দিকে তাকাচ্ছেনা সে হু হু করে কেঁদে দিল এবার। একটু সান্ত্বনার বাণী তো শোনাতে পারে। কষ্ট কি শুধু তার একার হচ্ছে?
মুনার কান্নার আওয়াজ ভারী হওয়ায় রিক উঠে বসল। থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে চেয়ে রইল সিড়িটার দিকে। মনে হলো হামাগুড়ি দিয়ে কেউ নামতে নামতে ডাকছে,পাপপপপপা…..
যদি পড়ে যায়? সে ডাক দিল,পরী পড়ে যাবে। কি আশ্চর্য সে কথার আওয়াজ হলোনা। কেউ শুনল না। কেউ সিড়ি বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নামছে না তো?
রিক চোখ বুলাল পুরো ড্রয়িংরুমে। না,, খিলখিল হাসির সুর ভেসে আসছে না তো? কেউ সোফার পেছনে লুকিয়ে পড়ে বলছে না তো? পাপপপা নাই নাই…….
কেউ আর লুকোচুরি খেলছে না তো?
মুনার কান্নার আওয়াজ আর ও ভারী হয়। রিক তাকায় মুনার দিকে। ধমক দেয়,
‘ কেন কাঁদছ মুনা? আমি কি কাঁদছি? তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না? দেখতে পাচ্ছ না তুমি? আমি কাঁদছিনা তুমি কেন কাঁদছ? আমার তো কষ্ট হচ্ছেনা। তোমার কেন কষ্ট হবে।
মুনা ডুকরে কেঁদে উঠে।
‘ আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি ওকে পেটে ধরিনি বলে আমার কাঁদা বারণ? আমি ওকে জন্ম দিইনি ঠিক কিন্তু আমি ওর মা হতে পেরেছি। আমি ওর মা। সে আমাকে মা ডাকে। ডাকত। রাতে সে আমার বুকে ঘুমোতো। আমি তাকে আমার নিজ হাতে খাওয়াতাম। সারাক্ষণ হেসেখেলে আমাকে মাম্মা মাম্মা ডেকে বেড়াত। জন্ম না দিলে কি মা হওয়া যায়না? আর সেই সন্তানকে যখন চোখের সামনে থেকে কিডন্যাপার নিয়ে যায় তখন কষ্ট হবেনা। তার কান্না পাবেনা? আপনি আমাকে কাঁদতে বারণ করছেন?

‘ কান্না কোনো সমাধান না মুনা। তোমাকে বুঝতে হবে সেটা। কেন পরীকে নিয়ে গেছে, কারা নিয়ে গেছে সেটা জানতে হবে।

মুনা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।

‘ দয়া করে পুলিশকে বলবেন না। ওরা পরীর ক্ষতি করবে।

‘ পুলিশকে সরাসরি বলব না। তবে আমি চুপ থাকব না। পরীকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসবই। ও আমার মেয়ে।

তালহা বেগম ছুটে আসেন। মাথা চাপড়ে বলেন,

‘ এ কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি রিক। আমার নাতনীটাকে কে নিয়ে গেল? আমার পরী এখন কোথায় আছে? তুই চুপ করে কেন আছিস আব্বা? পরীকে নিয়ে আয়না। আমার রিপটা ও তো অসুস্থ। এ কোন ধস নামল আমার সুখের সংসারে।

রিক শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ তোমাদের তো খুব কষ্ট হচ্ছে মা। কিন্তু আমার হচ্ছেনা। আমি কে হয় পরীর? পাপপা ডাকলেই কি আমি ওর পাপপা হয়ে গেলাম?

তালহা বেগম কথা বলতে পারেনা। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। তার আহাজারিতে ভারী হয় ড্রয়িংরুম। কেউ গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আর ছলছল চোখে তাকিয়ে ডাকেনা, দাদ্দা!
গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলেনা, দাদ্দা…
মুখের উপর দুহাত দিয়ে লুকোচুরি খেলতে খেলতে কেউ বলেনা,
‘ দাদ্দা নাই নাই……
তালহার আহাজারি কিছুটা কমতে না কমতেই ছুটে আসে ইশা। ঝাপিয়ে পড়ে রিকের উপর। রিক আচমকা এমন আক্রমণে হতভম্ব হয়ে যায়। পিছু টলে। ইশা কান্নার আওয়াজ শুনে তালহা মাথা তুলে তাকায়। ইশা কাঁদে, বলে,
‘ বড়দা আমি তো তাকে দিয়ে ফেলেছি তোমাদের বড়দা। তোমরা কি করে হারিয়ে ফেললে বড়দা? ভালো রাখার জন্য আমি মা হয়ে তার কাছ থেকে দূরে দূরে থেকেছি বড়দা। আমার ছোট্ট মেয়েটা কেন আমার করা একটা ভুলের শাস্তি বড়দা।
ইশা মাথা তুলে তাকাল রিকের দিকে। রিক ইশার দিকে তাকাল। ইশা কপালের একপাশে হাত দিয়ে দেখাল। বলল,
‘ এখানে ঠিক এই জায়গায় পরী ব্যাথা পেয়েছে বড়দা। আমাকে অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে আঙুল দিয়ে বারবার সেই জায়গাটা দেখিয়ে আমমমা আমমমমা বলে ডাকছিল। আমি কি পাষাণ বড়দা। ফিরে তাকায়নি আমার মেয়ের দিকে। তার তো বোধহয় এখনো কষ্ট হচ্ছে বড়দা। আমি কি করব বড়দা? আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। আমাকেই কেন সবসময় হেরে যেতে হয় বড়দা। কেন আমি এত অসহায়? কেন?
ইশার কান্নার আওয়াজ শুনে মুনা ও কাঁদে। তালহা ও কাঁদে। জহির মিয়া চোখ থেকে চশমা খুলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। রিক দাঁড়িয়ে থাকে। সে কেন কাঁদতে জানেনা। কাঁদলে নাকি বুক হালকা হয়। এই ব্যাঘাতক বুকটা হালকা করার জন্য কি তাহলে কাঁদতে হবে?
ইশা পিছু হেঁটে হেঁটে বসে পড়ে তালহা বেগমের সামনে। বলে,
‘ তুমি কোথায় ছিলে মামি? তোমার হাতেই তো আমি তুলে দিয়েছিলাম আমার মেয়েকে। তাহলে তুমি শেষ রক্ষা কেন করতে পারোনি? কেন মামি? আজ ও কি দোষটা আমার?
নিশ্চুপ সময় কাটে সবার। শুধু নীরব আর্তনাদ ঢেউ খেলে। হাহাকার করে পুরো বাড়িটা।
ফোন আসে রিকের ফোনে। রিক অপরিচিত নাম্বারে ফোন আসায় কল রিসিভ করে। লাউড করে দেয়। ওপাশ থেকে স্পষ্ট পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

‘ প্রাণে যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও তাহলে পুলিশকে ইনফর্ম করার চেষ্টা করবেনা কোনোমতেই। যদি করো তাহলে লাশ পাবে।

ইশা চিৎকার কেঁদে উঠে। পাষাণ। হৃদয়হীন। নিজের রক্তকে মারার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ফোনটি কেটে যায়।
বাড়ির প্রত্যেকে হতভম্ব হয়ে তাকায় ইশার দিকে।

‘ নিজের রক্ত মানে?

রিক গর্জে উঠে।

‘ এই ইশু রক্ত মানে কি? আজিজ চৌধুরী? না এ কি করে হয়? ইশু,,,,,,,,,

ইশা নিজের চুল হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে। বলে,
‘ ওই শয়তান নিয়ে গেছে আমার মা কে।

এতক্ষণে চুপচাপ থাকা তালহা এবার সামনে এগিয়ে আসে ইশার দিকে। বলে,

‘ সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড তাহলে তুই? তোর জন্য পরী আজ আমাদের মাঝে নেই। তুই আবার ফিরতে চাইছিস ওই ডাক্তারের কাছে। দরদ উতলে উঠছে? বেরিয়ে যাহ ঘর থেকে। নিয়ে আয় আমার পরীকে। যাহ বেরিয়ে যাহ।
ইশা ছুটে যায় রিকের কাছে। রিক অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। মুনা অবিশ্বাস্য চোখে তাকায়।
ইশাকে তালহা বেগম হাত ধরে টেনে দরজার কাছাকাছি নিয়ে। ঠেলে বের করে দিয়ে বলে,
‘ যাহ নিয়ে পরীকে। ঘরে ডুকবিনা তুই পরীকে ছাড়া। যাহ।
জহির মিয়া ছুটে আসে। বলে, কষ্ট কি তোমাদের একা হচ্ছে? ও মা। মা মানে বুঝোতো। ওর আর ও বেশি কষ্ট হচ্ছে।
ইশা টাল সামলাতে পারেনা। পড়ে যায়। কেউ একজনের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে সাদা শার্ট পরিহিত ছেলেটিকে। ব্যান্ডেজ মোড়ানো তার মাথায়। হাতে। মুখে। ইশা দাঁড়ানো মাত্রই জাপটে ধরে রিপকে। ক্লান্ত, অবসন্ন, অসুস্থ রিপ কয়েক পা পিছু চলে যায়। কিন্তু কিচ্ছু বলেনা। ইশা বুক ফাটিয়ে কাঁদে।
‘ রিপদা আমার কাছে আমার মেয়েকে এনে দাও না। পরীকে আমার কাছে এনে দাওনা। আমি কতসময় ধরে দেখিনা আমার মেয়েটাকে। সে ব্যাথা পেয়েছে রিপদা। কপালে ব্যাথা পেয়েছে। ওর বোধহয় এতক্ষণে খিদে ও পেয়েছে। ও কাঁদছে রিপদা। তুমি তো আইনের লোক রিপদা। তুমি পারবে তাকে ফিরিয়ে আনতে। আমার বাচ্চাটাকে, আমার কাছে ফিরিয়ে দাও রিপদা। একবার আমার কাছে নিয়ে এসো। ও আমাকে একবার ও মা বলে ডাকেনি। আমি শুনতে চায় একবার। ওর যদি কিছু হয়ে যায়? তুমি ওকে নিয়ে এসো রিপদা। আমি আর পারছিনা। আমার কষ্ট হচ্ছে। আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে রিপদা। আমার নিঃশ্বাস নিতে ও কষ্ট হচ্ছে।
দূরে দাঁড়িয়ে একটি পাখি ও নীরব আর্তনাদ করছে। ছোট ছোট আওয়াজ করে করে ডাকছে, প্রিন্সেস। প্রিন্সেস। মিস ইউ। মিস ইউ।
রিক,মুনা,তালহা বেগম চেয়ে থাকে সাদা শার্ট পড়া ছেলেটির মুখের। ভয়ানক কিছুর অপেক্ষায় তারা।
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ইশা নিজে নিজেই মুখ তুলে তাকায় রিপের দিকে। রিপ চোখে হাসে। অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি। অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসির আড়ালে কি কিছু লুকোনো আছে? রিপ গলার এক পাশ কাত করে ইশার দিকে তাকায়। ডাকে, ইশা। আমার ইশু কি তাহলে মরে গিয়েছে?

_________________

অন্ধকার ঘরটি থেকে শুধু ভেসে আসছে একটি ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি শুধু ডাকছে, পাপপা, রিইইইইই, মাম্মা, দাদদদদা, মিননননি, আমমমমমা।
থেকে থেকে কেঁদে উঠছে। খিদে পেয়েছে বোধহয়। অন্ধকার রুমটিতে মেয়েটি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। কাঁদতে কাঁদতে ডাকে, পাপপপপপা……..
তার মনে হয় তার পাপপপপপা। আদরে আদরে ভরিয়ে দিল গাল। বুকের সাথে চেপে ধরল। এত্তগুলো চকলেট দিল।
তার মনে হলো, এইতো মাম্মা ছুটে এল
হাতে ফিডার। হাতে বাটি। বাড়িয়ে দিয়ে বলল, খাও মা।
মাটিতে লুটিয়ে পড়া পরী আপনাআপনি হা করল। কিন্তু কেউ খাইয়ে দিতে এলোনা। ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে চোখ মুছে ডাকল, রিইইই।
মনে হলো রিইইই ছুটে এল। চট করে কোলে তুলে নিল তাকে। বলল, আমার মা মেঝেতে কেন ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু না কেউ তাকে কোলে তুলে নিল না।
তার মনে হলো দাদা দাদু চলে আসল। বলল, পরী দাদুমণি এসো। খেলতে এসো। খেতে এসো।
পরী উঠতে চাইল। অন্ধকার দেখে আর উঠল না। চোখ বন্ধ করে কাঁদল। ডাকল, পাপপপপা……
মনে হলো ফিপি ছুটে এল। ধমক দিল।
‘ পরী মেঝেতে কেউ ঘুমোয়? উঠো। আসো ফিপির কোলে আসো। খাবে চলো। চকলেট খাব। চিপস খাব। আর মজা মজা করে ভাত খাব। আর না খেলে কিন্তু খুব খুব মারব। খুব খুব।
পরী চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। সে ভয় পাচ্ছে, আর ফিপি তাকে মারবে বলছে?
পরী অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে খেতে কোথায় গিয়ে যেন আটকে গেল। আঙুলে ব্যাথা পেল। হয়ত রক্ত ও বেরিয়েছে। সে রক্তমাখা আঙুল গালে ডুকিয়ে দিল। চোখবন্ধ করে আঙুল চুষে চুষে খেতে লাগল। মাথা দুলিয়ে কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, উমমমমম।
যেভাবে মাম্মা তাকে ভাত খাইয়ে দিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে, মজা। মজা। ঠিক সেভাবে।
সে ও সেই আঙুল চুষতে চুষতে মাথা দুলাল। মেঝে ভিজল তার চোখের জলে। অন্ধকার তবু ও দূর হলোনা।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here