মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_২৪ #পুষ্পিতা_প্রিমা

0
347

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা

দুরুদুরু বুক নিয়ে ইশা চেয়ে থাকে রিপের দিকে। কিচ্ছুটি বলার সাহস করে উঠতে পারেনা। কি কারণে রিপ এই কথা বলল তা আর বুঝতে বাকি রইল না । সে হাত বাড়িয়ে রিপকে ছুঁতে চাইল। কিন্তু রিপ তার জায়গা থেকে দুই পা এগিয়ে গেল তালহার দিকে। অসুস্থ শরীর এখনো টলমল। দাঁড়াতে পারছেনা ঠিকমতো। মুনা রিক জহির মিয়া সবার চেহারা আতংকে চুপসে গিয়েছে। রিপ কারো কাছে গেলনা। শুধু তালহা বেগমের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়াল। এক আকাশ প্রশ্ন, অভিযোগ নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে ইশার মুখে বলা কথা গুলো কি তাহলে সত্যি? নাহলে মা এভাবে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? বাবা ও তো। সেই ছোট্ট ইশুকে মা বাবার হাতে তুলে দিয়ে ও তো নিশ্চিন্তে বিদেশে গিয়েছিল সে। মা বাবা তো তাকে কথা দিয়েছিল। মা বাবা তো জানে তাদের ছোট ছেলে ঠিক কতটা ভালোবাসে ওই মেয়েটাকে। তারপরে ও কি করে এত অবহেলা। এত অবজ্ঞা। কাকে জিজ্ঞেস করবে সে? কি করে পরী ইশুর সন্তান হয়? কে বাবা? কখন হলো বিয়ে? আর ইশু। সে কি একটিবার ও বুঝতে পারেনি রিপদা শুধু তাকে আগলে রাখত না। ভালো ও বাসত। বাসে।
তালহা বেগম মাথা নামিয়ে রাখে। রিপ যেভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে সে তাকাতে পারছেনা। দোষ তো তার নয়। সে তো জোর করে বিয়ে দিতে চাইনি। ইশা তো নিজেই রাজী হয়েছে সেই বিয়েতে। তাহলে এখন দোষ তার হবে কেন?
রিপ রক্তবর্ণ চোখে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। উপর থেকে দেখা যাচ্ছে তার চোখ ভারী শান্ত।
ইশা সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ায় রিপের। রিপ ঘুরে দাঁড়ায়। ইশা তার পেছনে দাঁড়ায়। বলে,
‘ রিপদা আমি তোমাকে সব বলব। এখন আমার মেয়েকে এনে দাও প্লিজ। তুমি আমায় ভুল বুঝোনা। আমি তোমাকে সব বলব।
রিপ চোখ উপরে তুলে তাকায়। তার কানে কি সুন্দর করে আওয়াজ তুলল একটি শব্দ,
‘ আমার মেয়ে, আমার মেয়ে, আমার মেয়ে। তার গাল বেয়ে টপটপ টপটপ জল গড়াল। স্ফটিকমণির মতো দেখাল সেই জল। কি সুন্দর?
রিক দেখল ভাইয়ের চোখে জল। মুনা ও দেখল। তালহা বেগম দেখল। জহির মিয়া দেখল। ছোট ছেলের চোখে জল। তালহা বেগম শাড়ির আঁচল মুখে গুজল। ডুকরে ডুকরে কাঁদল। ছেলের চোখে এমন জল অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত। সহনীয় নয়। ইশা সবার মুখের দিকে তাকাল। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলল,
‘ রিপদা তুমি কিছু বলছ না কেন? তুমি অন্তত আমাকে ভুল বুঝোনা। ডক্টর আদি চৌধুরীর কাছে আমি ফিরতে চাইনি। কখনোই না। সে নিজেই এসেছিল। আসে। আমি নই রিপদা। তুমি আমায় ভুল বুঝোনা।
রিপ ফেরেনা। নড়তে ও পারেনা। তার ভেতরকার রূপ খোলাসা হলো মা ভাইয়ের সামনে। কিন্তু যার জন্য তার চোখের জল গড়াল সে দেখল না। কতটা স্বার্থপর! কতটা। রিপ জবাব দিতে পারল না ইশার কথার। দুচোখ বেয়ে নিঃশব্দে গড়ানো জল থামল না। আদি? আদিই তাহলে সেই ভাগ্যবান পুরুষ? আদি?
কি আশ্চর্য সে থামাতে চেয়ে ও পারল না চোখের জল আটকাতে।
ইশা তার পেছনে এসে হাত ধরে ডাকল।
‘ রিপদা কেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ? আমার মেয়ে পরী ……

পুরো কথা শেষ করার আগেই সপাটে চড় পড়ল তার গালে। আর সেই আঘাত পেল ইশু তার রিপদার হাতে। অবিশ্বাস্য না ব্যাপারটা? যে রিপুদা তাকে লাল চোখ করে কোনোদিন ধমক দেইনি সেই রিপুদা কি করে? এ ও সম্ভব?
ইশা পড়ে যায়। কিন্তু উঠে দাঁড়ায় না। তাকায় ও না। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক। রিপদা তাকে মারেনি। রিপদা কি করে তার গায়ে হাত তুলবে? রিপ তার ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাত উপরে তুলে একটান দিয়ে খুলে ফেলে ব্যান্ডেজ। ছুড়ে মারে দূরে।
ইশা তার পা জড়িয়ে ধরে আচমকা। রিপ তারপর ও তাকায়না তার দিকে। পা নাড়িয়ে বলে, ছাড়। ছুঁবিনা।
ইশা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে যায়। বলে,
‘ এত বড় শাস্তি আমায় দিওনা রিপদা। মুখ ফিরিয়ে রেখোনা। আমার মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে নিওনা। আমাকে দূরে ঠেলে দিওনা রিপদা। আমি অসহায়।
রিপ পা সরিয়ে দূরে দাঁড়ায়। বলে, তুই অসহায় কোথায়? অসহায় আমি। খবরদার আমায় রিপদা ডাকবি না। আমায় আর ডাকবি না। আমার নাম মুখে নিবিনা। কখনো না।
ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর চলতে চায়না। তারপরে ও সেই শরীর নিয়ে রিপ সিড়ি ধরে। রিক এগিয়ে তাকে ধরতে যায়। রিপ নেয়না কারো সাহায্য। এবার থেকে পথ চলাটা,স্বপ্নগুলো না হয় তার একার হোক।
ইশা তার পিছু পিছু দৌড়ে যায়। রিপ রুমে ডুকে পড়ে। ইশার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে পিঠ করে দাঁড়ায়। নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দেয় দরজার উপর। যন্ত্রণা হয় তার মাথায়। ব্যান্ডেজের উপর চেপে ধরে হাত দিয়ে। দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসে কান্নামাখা কন্ঠস্বর।
‘ আমি জানতাম না কাউকে ভালোবাসা অন্যায় অপরাধ রিপদা। যদি জানতাম, ভালোবাসতাম না। কখনো না। কখনোই ভালোবাসার মতো এত বড় অন্যায় আমি করতাম না।
রিপ পিঠ ঠেকায় দরজায়। মাথা এলিয়ে দেয় দরজায়।
‘ আমি ও বাসতাম না। যদি জানতাম ভালোবাসলে এতটা কষ্ট পেতে হয়। ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়। মরতে মরতে ও বেঁচে থাকতে হয়। মন ভাঙার মতো কষ্ট কি আর দুটো আছে?
ছেলেটির মুখ ফুটে বের হয়না সেই কথা। মেয়েটি ও শুনল না। মেয়েটি বুঝলই না। মেয়েটির জানা হলোনা তাকে তার রিপদা ঠিক কতটা ভালেবাসে। তার ও ভালোবাসা পাওয়ার ছিল। কিন্তু পাওয়া হলোনা। তার কপালে অত ভালোবাসা পাওয়ার ছিলনা। সে ডিজার্ভ করেনা।

___________________

মেঝেতে পড়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটির ঘুম ভাঙে খিদের চোটে। খিদে লাগলে সে কেঁদে কেঁদে ডাকে, মামমমমমা……..
আজ ও ঠিক সেভাবেই ডাকল, মামমমমমমা…..
কিন্তু আজ ভিন্ন কিছু ঘটল। মামমমমা দৌড়ে এল না। পাপপপপপা ও এল না। রিইইই ও এলনা। ফিপি ও এল না। কোথায় সবাই?
খিদের চোটে সে পড়নের ফ্রক আঙুলে পেঁচিয়ে গালে ডুকিয়ে চুষে চুষে খেতে লাগল। কান্না করে করে ডাকল,
‘ মামমমমমমমা……. মিননননননননি…………
তারপর ও কেউ দৌড়ে এল না। অন্ধকার রুমটির ভেতরে মিটিমিটি কোথা থেকে আলোর রেখা পড়ল। পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। তার মনে হলো মামমমমমা আসছে।
সে ডাকল, মামমমমা……….
কিন্তু মাম্মা ছুটে এলনা। তার হাসি আবার কান্নায় পরিণত হলো। কাঁদতে কাঁদতে তাকল, পাপপপপপা…….
চাবি দিয়ে তালা খুলে চুপিসারে রুমটাতে ডুকে পড়ল মিনুমা। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে এদিকওদিক মারতেই ছোট্ট হলুদ ফ্রক পড়া আদুরে মেয়েটির চেহারা দেখে আপনাআপনি জলে টলমল করল চোখ।
দৌড়ে গেল। পরীকে কোলে তুলে নিল। পরী কোলে উঠতে পেরে হাসল। কিন্তু সেই হাসিতে প্রাণ নেই । মিনুর হাতের দিকে তাকাল। ফিডার তো নেই। খাবার তো নেই। পরী ঠোঁট বাঁকাল। ঠোঁট টেনে কেঁদে কেঁদে বলল, দাদদদদা আম।
মিনু কিছু বুঝলা না। শুধু ফিসফিস করে বলল, কেঁদোনা দাদু। আমরা এখনি বেরিয়ে যাব।
পরী কিছু বলল না। মিনুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, দাদদদদদা আম।
মিনু তাকে শাড়ির আঁচলের নিচে ঢেকে নিয়ে বের হয়ে গেল। দৌড়ে দৌড়ে ডুকে পড়ল রাইনার রুমে। রাইনা এতক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। রেহান ছোট্ট গুলুমুলু একটি কিউটিকে শাড়ির আঁচলের নিচ থেকে পিটপিট করে তাকাতে দেখে লাফ দিয়ে উঠল। বলল,
‘ মা এটা আমার।
রাইনা কোলে নিয়ে নিল পরীকে। বলল,
‘ এই মা টা তোমার বোন বাবা।
রেহান পরীকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। বলল, বোন এসো কোলে।
পরী গেলনা। ঠাসসস করে চড় মারল রেহানের নাকে। ডাকল, পাপপপপপপপপা…….
রাইনা আর মিনুমা হেসে দিল। পরী রেহানকে মারার জন্য রাইনার কোল থেকে ঝাপ দিতে চাইল। কিন্তু রাইনা আটকাল। পরী হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল রাইনার ড্রেসিং টেবিলে রাখা একটি বাক্স। বলল, আমমমমমম।
রাইনা আর মিনু বুঝে গেল পরী কি বলতে চাইছে। রেহান দৌড়ে গিয়ে দুইটা কেকের প্যাকেট এনে ধরল পরীর সামনে। পরী হাত বাড়িয়ে নিতে চাইল। রেহান দুষ্টুমি করল। দিল না। পরী কেড়ে নিতে না পেরে রাইনার চুল টেনে ধরল। জোরে গর্জে ডাকল, মামমমমমা…………
মিনু বাটিতে করে গরম ভাত নিয়ে আসল। ডিম আর আলু দিয়ে ছোট ছোট করে মেখে পরীর মুখে দিল। ঝাল খেতে না পারা পরী আজ ঝাল খেল। যখন পেট ভরল ডানে বামে মাথা নেড়ে খাবেনা বলল। ছোট্টছোট্ট দাতগুলো একটার সাথে একটা চেপে ই ই ই শব্দ করে বলতে চাইল, তার ঝাল লাগছে।
মিনু পানি খাইয়ে দিল সযত্নে। রাইনা কোলে নিল। বলল,
‘ মিনুমা মা বাবা আসার আগে কি ওকে রেখে আসতে হবে?
মিনু পরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল, না । ও কি করে সেখানে থাকবে?
যখনি পেটের ক্ষুধা মিটল পরীর। তারপর থেকেই সে কান্না শুরু করল। রেহানের কথায় কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে হেসে ডাকে পাপপপপপা…..
আবার কেঁদে কেঁদে ডাকে মামমমমমমা………
মিনু আর রাইনা কেউ কান্না থামাতে পারেনা।
ধুমধাম পা ফেলে রুমের ভেতর ডুকে পড়ে আজিজ চৌধুরী। এক ঝটকায় কেড়ে নেয় পরীকে। পরী আচমকা কান্না বন্ধ করে দেয়। আজিজ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর জোরে টেনে ধরে দাড়ি। আজিজ চৌধুরী এক ঝটকায় ছুড়ে দেয় আলিয়ার কোলে। বলে,
‘ তোমাদের এত বড় সাহস কি করে হয় এই মেয়েটাকে এখানে নিয়ে আসার?
আলিয়া বেগম নিজের অজান্তেই কোলে দোলায় পরীকে কান্না থামানোর জন্য। পরী কান্না থামায় না। মিনুর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ডাকে,
‘ দাদদদদদা…….
মিনু ছলছল চোখ নিয়ে এই প্রথম আজিজ চৌধুরীর চোখে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠে,
‘ কতটা নির্দয় হলে মানুষ একটা ছোট বাচ্চার সাথে এমনটা করতে পারে? কতটা নির্দয় হলে?
আজিজ ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। রেহান আজিজের কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ দাদাই প্রিন্সেসকে আমাকে দিয়ে দাও। কি কিউট! আমি ওকে খুব আদর করব। ও আমার বোন হবে। ভালো হবেনা?
আজিজ চৌধুরীর মনে পড়ল দুইবছর আগের কথা। এবরশন পেপারে গুটিগুটি অক্ষরে স্বাক্ষর। আজিজ চৌধুরী চাপা গর্জন করে বলে,
‘ আমায় ছাড়ো রেহান। ও তোমার বোন নই।
রেহান ছেড়ে দেয়। এই প্রথম দাদাই তাকে বকল। সে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। রাইনা ছেলের যাওয়া দেখে। ফট করে বলে ফেলে,
‘ এতটা পাষাণ মানুষ জীবনে দেখিনি আমি।
আজিজ চৌধুরী পরীকে নিয়ে যায়। আলিয়া পিছু পিছু যায়। আজিজ চৌধুরী সেই অন্ধকার রুমটাতে পরীকে আবার রাখে, পরী খামচে ধরে তার শার্ট। বলে,নান নান না, পাপপপপপপা……..
আজিজ চৌধুরী কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকে। আবার পরীকে ছুড়ে মেরে গটগট পায়ে হেঁটে চলে আসে। পরী তার পেছন পেছন দৌড়ে আসে। দরজায় ছোট্টছোট্ট হাতদুটো দিয়ে দুমদুম মৃদুমন্দ আওয়াজ করতে করতে কাঁদে। ডাকে, দাদদদদদদা।
আলিয়া চৌধুরী আজিজ চৌধুরীর পিছু পিছু যায়। বন্ধ দরজাটার দিকে আবার ফিরে তাকায়। কান্নার আওয়াজ থামেনা। ক্রমশ বাড়তে থাকে। আজিজ আর আলিয়া একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে। আলিয়া কিছু বলতে চাইলে আজিজ চৌধুরী হাত দেখিয়ে বারণ করে বলে,
‘ লিয়া এখন বলোনা চেহারা এর সাথে ওর সাথে মিল। মনে রেখো এই মেয়েটি আমাদের কেউ হয়না। আদির সন্তান দুইবছর আগেই মারা গেছে। এবরশন করিয়ে ফেলেছে সেই সন্তান। প্রমাণ তুমি নিজ চোখে দেখেছ।
আলিয়া চিন্তিত হয়।
‘ এতটা ও মিল কি করে? চোখদুটো তো পুরোটাই আদির। আর নাকটা তো আমার। এতটা ও মিল কি করে হয়? আমাদের কি কোথাও ভুল হচ্ছে?

_________________________

সন্ধ্যা নামবে কিছুক্ষণ পর। ইশার গায়ে পড়নের আকাশি রঙের সেলোয়ার কামিজ। ওড়নাটা অবিন্যস্ত। ফোন হাতে নিয়ে সে অনেকবার ট্রাই করল আদি চৌধুরীর সেই নাম্বারে। কিন্তু সুইচড অফ বলছে। কোথায় ডক্টর? এমনসময় ডক্টর তাকে হেল্প করতে পারত। ডক্টর যদি জানত পরী তার সন্তান। এত বড় অন্যায় কখনো হতে দিতনা। ইশা মিনুকে ফোন দিল। তা ও সুইচড অফ। মিনুমার আবার কি হলো?
ইশা দিশেহারা হয়ে পড়ল। আজিজ চৌধুরীর ফোনে কল দিলে রিসিভ হয়না। সেদিক থেকে কল আসে। ইশার হাতে খাঁচা। খাঁচার ভেতর মিনি। সে শান্ত, নীরব। ইশার পুরো মুখ টকটকে। নাক মুখ জ্বলজ্বলে। ডুকরে ডুকরে থেকে থেকে সে উঠছে কেঁদে কেঁদে। খাঁচার ভেতর থেকে মিনিকে সে বের করল। হাতের তালুতে নিল। মিনি ডানা ঝাপটে ইশার গালের সাথে গাল লাগাল। অবুঝ পাখিটি ও বোধহয় বুঝল ইশার কান্নার কারণ। মিনমিন করে ডাকল, প্রিন্সেস।
ইশা চোখের জল মুছল। বলল,
‘ মিনি ডক্টর কোথায় হারিয়ে গেছে? যে সময় তাকে আমার খুব প্রয়োজন হয় সে তখনই হারিয়ে যায়। দূরে চলে যায়। আমি জানিনা আমার ছোট্ট মেয়েটা কেমন আছে। কোথায় আছে? কিছু খেয়েছে কিনা? আমি এখন কোথায় যাব মিনি? কার কাছে। কেউ নেই আজ আমার পাশে। কেউ না। রিপদা ও নেই। মিনি আজ আমি খুব অসহায়। আমার এই অসহায়ত্বেরর সময় তুমি পাশে আছ। তুমি যাও মিনি। আমার মেয়ের কাছে যাও। তাকে দেখে রেখ। ইশা হাঁটতে হাঁটতে আর ও এগিয়ে যায়। চৌধুরী বাড়ির গেইট দেখা যাচ্ছে। পরী কি চৌধুরী বাড়িতেই আছে? আজিজ চৌধুরী কি অত কাঁচা কাজ করবে?
ডক্টর আদি চৌধুরী তো থাকে সেই বাড়িতে। না,না আজিজ চৌধুরী অত কাঁচা খেলোয়াড় না। ডক্টর আদি চৌধুরীই বা কোথায়। সে তো এমনিতেই সামনাসামনি হুটহাট এসে পড়ে। আজ কেন আসছেনা। মিনিকে উড়িয়ে দেয় ইশা। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ মিনি যেখানেই থাকো প্রিন্সেসকে ভুলে যেওনা। প্রিন্সেসের সাথে থেকো।ডক্টর আদি চৌধুরীকে প্রিন্সেসের কথা বলো। মিষ্টির কথা বলো। প্রিন্সেসকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিতে বলো। আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব তার প্রতি। জন্মদাতা হিসেবে শুধু এটুকু দায়িত্ব তার। শুধু এটুকুই।
মিনি উড়ে যায়। লক্ষ্য চৌধুরী বাড়ি। নিমেষেই মিনি অদৃশ্য হয়। ইশা হু হু করে কেঁদে দেয়। পিছু ফিরে চোখ মুছতে মুছতে হাঁটে। দূরে দাঁড়ানো বাইকের ছেলেটি সাথে সাথে বাইক ছেড়ে দেয়। উল্কার গতিতে ছুটে যায়। রেখে যায় একজোড়া ছলছল চোখ।

বালিশের কোণা ভিজে জবজবে। মুনা আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। বিছানার নিচে পা ফেলে রেখে হাতের ভর দিয়ে বসে আছে রিক। মুনা দেখল রিপকে। উঠে বসল। বলল,
‘ আপনি খেয়েছেন। রিক উত্তর দিলনা।
মুনা আবার ও প্রশ্ন করল,
‘ পুলিশকে বলেছেন? রিপ কিছু করেছে?
রিক এবার মুনার দিকে তাকাল। বলল
‘ রিপ কথা দিয়েছে আমায় মুনা। পরীকে ফিরিয়ে আনবে। ভাই কথা রাখবে মুনা।
মুনা চুপ মেরে বসে থাকে। ছোট্ট কোলবালিশটা দেখে কাঁদে। দেওয়ালে টানানো পরীর হাসিখুশি আদুরে চেহারাটা দেখে জোরে কাঁদে। বলে,
‘ পরী কি খেয়েছে?
রিক সাথে সাথে ফিরে মুনার দিকে। টেবিলে তাকায়। বলে, তুমি খাওনি?
মুনা উল্টো প্রশ্ন করে।
‘ আপনি খেয়েছেন?
‘ আমার রাতে খেতে ইচ্ছে করেনা মুনা।
মুনা আর কোনো প্রশ্ন করেনা। রিক খাবারের প্লেট নিয়ে আসে মুনার সামনে। মুনা মুখ ফিরিয়ে রাখে। রিক চামচে করে বাড়িয়ে দেয় মুনার দিকে। বলে,
‘ খেয়ে নাও মুনা। অসুস্থ হয়ে পড়বে।
মুনা খাবার মুখে তুলতে যায়, চোখে ভাসে পরীর আদুরে চেহারা। কানে বাজে সেই আদুরে কন্ঠস্বর।
‘ মামমমমমমা আম।
মুনা খাবার মুখে তুলতে পারেনা। সাথে সাথে কেঁদে দেয় আওয়াজ করে। রিক চামচ নামিয়ে নেয়। অন্যদিকে মুখ করে রাখে কিছুক্ষণ। কিছু লুকোতে লুকোতে একহাতে আগলে নেয় মুনাকে। মুনার মাথার উপর চিবুক রেখে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলে,কষ্ট আমার ও হচ্ছে মুনা। তবে আমি উপরওয়ালার ভরসায় আমার মাকে ছেড়ে দিয়েছি।
মুনা আবেগে আপ্লুত হয়ে মাথা রাখে রিকের বুকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে এনে দিন। আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে। আমার চারপাশটা অন্ধকার দেখাচ্ছে। আমি আঁধার দেখছি। আমার কোলে তাকে ফিরিয়ে দিন। আমার পরীকে এনে দিন। আমি কখন আবার মামমমমা ডাকটি শুনতে পাব? কখন সে আমায় তার নরম ঠো্ট দিয়ে আদর দেবে। কখন মামমা ডেকে গলা জড়িয়ে ধরবে। কখন ক্ষিদের চোটে কামর দিয়ে বলবে মামমমমমা আম। আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। আমার সময় কাটছেনা। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু আমার সত্যিই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার মা টা কোথায় আছে এখন? কেমন আছে? সে কতবার মামমা পাপপা ডাকছে একবার ও যেতে পারছিনা। কখন দেখব আমার মা টাকে।
রিকের জ্বলজ্বল করা চোখ দুটো থেকে দুফোটা জল টপ করে পড়ে মুনার চুলে। ব্যস
। শুধু দুই ফোটা।

কেউ যদি খুব কাছ থেকে খুব গভীরভাবে অনুভব করার চেষ্টা করত তাহলে বুঝতে পারত রিকের কষ্টের গভীরতা ঠিক কতটুকু। একটা ছোট্ট মেয়ে কি সবার প্রাণপাখি হতে পারে। মেয়েটি ছাড়া পুরো বাড়িটা যে নিষ্প্রাণ। কেন এমন? কেন?

কাঁদতে কাঁদতে ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির কান্না একসময় থেমে যায়। গলার স্বর বয়ে গেছে। মিনু দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি শুয়ে আছে মেঝেতে। হয়ত ঘুম এসে গেছে। চারপাশে মশা আআঁকড়ে ধরেছে। মেয়েটি নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর ফাঁকে ফাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় ঠোঁট টেনে টেনে কাঁদছে। ভড়কে যায় মিনু। নিজেকে আটকে রাখতে পারেনা। ছুটে যায় আলিয়া চৌধুরীর কাছে। পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। বলে,
‘ ম্যাডাম প্লিজ একবার, শুধু একবার মেয়েটিকে আমার কোলে দিন। বাচ্চা মেয়েটার উপর এত অত্যাচার খোদা সইবে না।
আলিয়া চৌধুরী চুপ থাকল মিনুর কথায়। পরক্ষণে ভেবে বলে,
‘ হবে না। রিস্ক আছে। তোমাদের বিশ্বাস নেই। থাকুক সেখানে।
মিনু কেঁদে দেয়। নিজের অজান্তেই বলে ফেলে,
‘ অন্যের সন্তান এনে লালন পালন করছেন। আর নিজের বংশের প্রদীপকে ফেলে রেখেছেন,বন্দী করে রেখেছেন,মশার ঘাটিতে ফেলে রেখেছেন। একবার ও কি মায়া হয়না। এতটা নির্দয়, পাষাণ মানুষ ও হয়? ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা মেঝেতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজের রক্তের সাথে কেউ কি করে এমন করতে পারে?
আলিয়া তাকিয়ে থাকে মিনুর দিকে।
‘ মাথা খারাপ তোমার? ওই মেয়েটা……….

‘ আদির মেয়ে ম্যাডাম। আপনাদের ছোট ছেলের একমাত্র মেয়ে আদিশা। এ বাড়ির উত্তরসূরি। আদির রক্ত বইছে তার শরীরে। চিনতে পারেননি? গোলাটে চোখ দেখে? আদির চেহারা তো একটুখানি ঠাহর করে দেখলেই বোঝা যায়। এতটা মিল বাবা মেয়ের মধ্যে। সে বেচারা তো জানেইনা। তার আদরের একমাত্র সন্তানকে আপনারা অন্ধকার রুমে ফেলে রেখেছেন। যদি জানত?

আলিয়া চৌধুরীর হাত কাঁপে। পানির গ্লাস সে টেবিলে রাখে। গলা কাঁপে। ফোন দিলে আজিজ চৌধুরীর সাথে ভালোকরে কথা ও বলতে পারেনা। শুধু বলে, আমাকে ওই মেয়েটার ফোন নাম্বার দাও। তাড়াতাড়ি।

টিকটিক টিকটিক ঘড়ির কাটার আওয়াজ। মেঝেতে বসে দেয়ালে হেলান দেয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে ইশা। হঠাৎ আচমকা তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় অগোছালো ভাবে পড়ে থাকা রিপদার দেওয়া সেই পড়ে থাকা টেডিবিয়ার আর লাল শাড়ি। ইশা কোলে তুলে নিল সেই টেডিবিয়ার। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, আদিশা……..
ফোটা ফোটা গড়াল সাদা স্বচ্ছ জলের নহর। আনমনে হেঁটে সে পাড়ি জমাল ছাদে। চাঁদের আলোয় আলোকিত পুরো ছাদ। ভেসে আসছে ফুলের গন্ধ। নির্জন, নিস্তব্ধ রাতে ঝি ঝি পোকার স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে। ইশা টেডিবিয়ারটি বুকে জড়িয়ে দাঁড়াল। আকাশের দিকে মুখ করে তাকাল। আজ এই কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সে? কেউ কেন নেই তার পাশে। তার মা কোথায় আছে? কি খেয়েছে? কে ঘুম পাড়াচ্ছে?
ইশা কাঁদল নিঃশব্দে, নীরবে। রিপদা ও তাকে কেন বোঝার চেষ্টা করছেনা? আবেগের বশে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাকে কি ক্ষমা করা যায় না?
আর ডক্টর? সেই বা কোথায়? ফোন সুইচডঅফ কেন? তার এই দুঃসময়ে কেউ কেন পাশে নেই। আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? কখন বিয়ে হচ্ছে ডক্টর আর ইমির। বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে গেলেই ভালো। তার বাচ্চা তার কাছে ফিরবে। খিলখিল করে হাসবে। গালে গাল লাগিয়ে আমমমমমা ডাকবে। লুকোচুরি খেলবে। পুরো বাড়ি দৌড়ে দৌড়ে খেলবে।
টেডিবিয়ারটির গায়ে চুমু বসাল ইশা। বলল, আর কত শাস্তি পাওয়া বাকি আছে ডক্টর। আপনার দেওয়া শাপ আমি আর বয়ে বেড়াতে পারছিনা। আমি তুলে নিন এই শাপ। আমাকে মুক্ত করুন ডক্টর। মিষ্টি এবার রেহাই চায়। মিষ্টি এবার একটু শান্তি চায়। আপনি ফিরে আসুন ডক্টর। সবকিছু ঠিক করে দিয়ে যান। আমি আর পারছিনা। পারছিনা। আমার কষ্ট হচ্ছে। আপনি যতটা না কষ্ট পেয়েছেন তার চাইতে হাজারগুণ আমি পাচ্ছি ডক্টর। আমায় এবার একটু শান্তি দিন।

মেয়েটি যদি দেখত ছাদঘরের দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ানো ছেলেটির নীরব আর্তনাদ শুধু বিশ্বাস ভেঙ্গে ঘুরিয়ে যাওয়ার জন্য নয়। এতগুলো বছর যাকে ভালোবেসে এসেছে সে, সেই মেয়েটির চোখেমুখে অন্য কারো প্রতি ভালোবাসা দেখে। তাকে ভালোবাসেনি এটাই তার দুঃখ নই। তাকে ভালো না বেসে ও সে কেন সুখী হতে পারল না এটাই তার দুঃখ। রিপ দাঁড়িয়ে রইল ঠাই দেয়ালে হেলান দিয়ে। হাতের সেই ছবিটা এক মায়াবিনীর ছবি। সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম হাসল। প্রশ্ন ছুড়ল আজ বহুদিন পর চুপিচাপি,

‘ কতটা ভালোবাসলে তুই আমায় ভালোবাসতি? কিভাবে ভালোবাসলে তুই আমার অব্যক্ত ভালোবাসা বুঝতে পারতি, যেভাবে বুঝেছিস ডক্টর আদি চৌধুরীর না বলা ভালোবাসা।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে সে দেশলাই জ্বালায়। লাগিয়ে দেয় সেই ছবিটাতে। ছবিটা কড়কড় করে পুড়তে থাকে। আগুনের ঝলকে আলোকিত হয় রিপের মুখ। সে আগুন দেখে হাসে। কষ্টগুলো যদি পোড়ানো যেত? রিপ ছবি থেকে চোখ তুলে তাকায় ওই দূরে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। ইশা চমকে তাকাল রিপের দিকে। এসব কি জ্বালাচ্ছে রিপদা?
চোখাচোখি চারটা চোখ। জ্বলন্তআগুন শুধু পুড়ছে কাগজের ছবি নয়। এতগুলো বছর যার নাম লেখা ছিল হৃদয়সিন্ধুকে তার নাম ও। সেই নাম আজ মুছে যাক। পুড়ে যাক।ছারখার হয়ে যাক। পোড়া গন্ধ উঠুক। আলো আধারিতে চোখাচোখি সেই চারচোখে বিস্ময়যুক্ত, আর হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার হাসি,অবজ্ঞা। যার পুরোটার আড়ালে লুকোনো কষ্ট, কষ্ট, আর কষ্ট। যন্ত্রণা। চোখে চোখ রাখা অবস্থায় ছেলেটি চোখে চোখে প্রশ্ন ছুড়ে মেয়েটিকে,
‘ ডক্টর আদি চৌধুরী কি রিপের চাইতে ও বেশি ভালোবাসতে জানে? কতটা ভালোবেসেছিল আদি ইশাকে? ভালোবাসার মাপকাঠিতে কার ভালোবাসার পরিমাণ বেশি হবে? কার পাল্লা বেশি ভারী ? রিপের চাইতে বেশি ভালো কি কেউ বাসতে পেরেছে আদৌ?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here