#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা
“আমি ঝড়ো হাওয়ায় ঝড়ে পড়া একটি বকুল ফুল।
আমি হঠাৎ করে কুড়িয়ে পাওয়া একটি কানের দুল
মন কেমনের দিনে আমি একফোঁটা বৃষ্টি
আমি সেই মেয়ে, যে ডক্টরের মিষ্টি।
ছোট্ট একটুখানি কাগজের টুকরোতে এবড়োথেবড়ো লেখাগুলো খুব করে টানল আদিকে। ভ্রু কুঁচকে সে তাকিয়ে থাকল কাগজটির দিকে। কলমের কালির ছাপ বলে দিচ্ছে লেখাগুলো বেশ পুরোনো। দুই তিন বছর হবে বোধহয়। এভাবে লেখাগুলো কে লিখবে? মিনি কেনই বা মিষ্টি ডাকে? কাকে ডাকে? কেনই বা ডাকে? কে এই মিষ্টি? তার আলব্যামের পাতায় কি করে এই কাগজের টুকরোটি এল? কাগজের টুকরোটি সে নাক দিয়ে শুঁকল। কি অদ্ভুত এই কাগজে কি করে ওই শাড়িতে লেগে থাকা সুগন্ধটি এল? কাগজটি সে রেখে দিল। বারান্দায় গিয়ে বসল। আনমনা হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। আচ্ছা মিষ্টি কি আইমি হতে পারেনা? সে তো এতক্ষণ তা ভেবেই দেখেনি।
আদি দৌড়ে গেল খাঁচার কাছে। বেঁধে রাখায় মিনি রাগ করল। ঠোঁট দিয়ে পা কুটতে লাগল। আদির দিকে তাকাল না। আদি খাঁচার দরজা খুলে দিল। বলল, মিনি বেরিয়ে এসো।
মিনি বেরোলো না। অন্যদিকে ফিরে পা কুটতে লাগল। আদি আবার ডাকল,
‘ মিনি বেরিয়ে এসো বলছি। মিনি,,,,
মিনি যখনি বেরোলো না আদি নিজেই তাকে বের করল। মিনি সাথে সাথে হাতে ঠোকর দিয়ে বসল। আদি আওয়াজ করে বলল,
‘ কি হয়েছে মিনি? রাগ করে থেকোনো। সরি মিনি।
মিনি ডেকে উঠল। আদি ব্যাড বয়। ব্যাড বয়।
আদি হাসল। মিনিকে হাতের তালুতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মিনিকে বলল,
‘ মিনি বলো মিষ্টি কে? তুমি কাকে মিষ্টি বলে ডাকো?
রাইনা আদিকে ডাকতে চাইল। কিন্তু যখন আদির মুখ থেকে অমন প্রশ্ন শুনল। সে ভড়কে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল। আদির কি তাহলে মিষ্টিকে মনে পড়েছে। না কি করে মনে পড়বে? রাইনার মাথায় চিন্তার ঢেউ খেলে গেল। সে আদিকে ডেকে উঠার আগেই পেছন থেকে আলিয়া ডেকে উঠল। রাইনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। শান্তচোখে আলিয়া ধমক দিল। বলল
‘ আদিকে কিছু জানানোর চেষ্টা করবে না। আদির বর্তমানই আদির ভবিষ্যৎ। আইমিই আদির ভবিষ্যৎ। আদি আইমিকে ভালোবাসে। অন্যকাউকে নয়।
আদি বেরিয়ে পড়ল মিনিকে নিয়ে। মিনি আদির হাতে ক্রমাগত ঠোকর দিল। আদি জানতে চাইল,
‘ মিনি বলো কে মিষ্টি। মিষ্টি আমার কে হয়? তুমি আমাকে তার কথা বলবে।
মিনি ডেকে উঠল।
‘ মিষ্টি বউ। মিষ্টি বউ।
আদি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিনির কথা বোধগম্য হতেই সে চমকে উঠল। বলল,
‘ কার বউ মিনি?
মিনি আদির হাতে ঠোকর দেয়। বলে,
‘ আদি মিষ্টি। মিষ্টি আদি। মাই ফ্রেন্ড। মাই ফ্রেন্ড।
আদি বলল,
‘ আইমি? আইমিই কি মিষ্টি ? আইমি কি বউ? কে মিনি?
মিনি ডাকল,
‘ আইমি বউ। আইমি বউ।
আদি তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। বলল, থ্যাংকস মিনি। মেনি মেনি থ্যাংকস।
মিনি আদির কাঁধে উঠে গেল। আদির গালে গাল ঘষে নিল। ডেকে উঠল,
‘ মিষ্টি বউ। মিষ্টি বউ।
আদি আবার ও হাসল। বলল, মিনি তুমি খুব সুন্দর নাম দিয়েছ আইমির। নামটা ঠিক আইমির মতো মিষ্টি।
মিনি উড়ে চলে গেল। আদি মিনির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, আইমি তো আদির ইমিই হয়ে থাকবে। কিন্তু ওই কাগজটাতে তো ডক্টরের মিষ্টি বলা হয়েছে।
____________________________
জহির মিয়া হেসে কুটিকুটি হলো পরীর আর রিপের কান্ডে। রিপ তার পিঠের উপর পরীকে নিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে। পরীর হাসিতে ঝলমল করছে ড্রয়িংরুম। পরীর হাসির আওয়াজে জহির মিয়া ও হেসে উঠল। জহির মিয়া নামিয়ে দিতে বললে পরী ঠোঁট বাকাল। রিপের চুল টানতে টানতে রাগ করে মাথা নিচে নামিয়ে রাখল। হাসির আওয়াজ বন্ধ হয়ে আসলে রিপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পরীর দিকে। বলল,
পরী তুমি রাগ করেছ দাদাইয়ের কথায়।
জহির মিয়া হেসে কোলে তুলে নিলেন পরীকে। পরী জহির মিয়ার দাড়ি টেনে ধরল। তারপর ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল।
মুনা দৌড়ে আসল। হাত বাড়িয়ে বলল,
‘ আমার মাকে কে মেরেছে? দাদাই নাকি কাকাই?
রিপ হেসে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলল,
‘ এখনই কাকাইয়ের দোষ না?
ইশা বিরক্তি নিয়ে ড্রয়িংরুমে পা রাখল। বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ তোমাদের জন্য পড়ায় মন বসাতে পারছিনা। পরীকে এভাবে কাঁদাচ্ছ কেন? চিৎকার চেঁচামেচিতে আমার পড়ায় মন বসেনা।
রিপ সোফায় আয়েশ করে বসল। বলল,
‘ কে কাঁদিয়েছে? তোর ভাইঝি এমনি এমনি ভ্যা ভ্যা করছে।
ইশা তেড়ে এল। বলল, রিপুদা ভাইঝি ভাইঝি করবে না একদম। ওর নাম আছে নাম ধরে বলবে।
রিপ হো হো করে হাসতে লাগল ইশার রাগ দেখে।
মুনা এগিয়ে আসল। বলল,
‘ আহা তোরা ও ঝগড়া শুরু করলি?
রিপ হাসতে হাসতে বলল,
‘ তোমার মেয়েকে ভাইঝি বলেছি এতেই মহারাণীর রাগ?
ইশা এবার চিল্লিয়ে বলল,
‘ তোমার মেয়ে মানে কি আবার? ওর নাম পরী। পরী। পরী।
রিপ অবাক হলো। বলল,
‘ তুই এত রাগ করছিস কেন?
মুনা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তালহা বেগম চেঁচিয়ে ইশাকে ডাকলেন। ইশা গটগট পায়ে হেঁটে চলে যায়। রিপ অবাক হয়ে ইশার যাওয়া দেখে। তার ইশুর রাগ ও আছে?
তালহা বেগমের কথায় ইশার বুকে চিরে হতাশা বের হলো। কান্না পেল। তালহা বেগম তারপর ও তাকে বকে গেলেন,
‘ পরীর ব্যাপারে তুই কোনো নাক গলাবি না। কোন অধিকারে তুই আমার নাতনীর ব্যাপারে নাক গলাস? কিছু বলছি না বলে এই নয় যে কিছু বলব না। সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করবি না। নইলে এ বাড়িতে ও ঠাই হবেনা।
ইশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। স্বার্থের জন্য সবাই তাকে ব্যবহার করে তার প্রমাণ আজ সে হাতেনাতে পেল। সে কি শুধুই ব্যবহারের জিনিস? ব্যবহার করা শেষ হলো,তারপর ছুড়ে ফেলে দিল। এ কেমন অবিচার তার সাথে? কে তার সাথে অন্যায় করেনি। যাকে সে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে সে তার প্রয়োজনে লেগেছিল। প্রয়োজন শেষ তাই তাকে ও দরকার নেই। অবশ্য তার দোষ ও কি করে দেওয়া যায় না । ডক্টর তো সেই আগের ডক্টর নেই। সেই আগের ডক্টর নেই, কথায় কথায় মিষ্টি নামটি যার উচ্চারণ না করলে চলত না। সে আজ সারাক্ষণ ইমি ইমি বলে জপে। যে ডক্টর মিষ্টি একটু রাগ করলে রাগ ভাঙানোর জন্য নিশপিশ করত। আজ সেই ডক্টরের কাছে মিষ্টির রাগের কোনো পাত্তা নেই। থাকার কথা ও নয়। কারণ মিষ্টি সম্পূর্ণ রূপে অপিরিচিতা ডক্টরের কাছে। ডক্টরের মনে থাকা তো দূরে থাক। ডক্টরের ভাবনাতে ও সে নেই। থাকার কথা নয়। কারণ ডক্টর কোনোদিন মিষ্টির ছিলনা। ছিল আইমির। থাকবে। থাকুক।
রিপ দরজা ধাক্কাল। ইশা দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়ে চোখমুখ মুছে নিল। কন্ঠ পরিষ্কার করে বলল,
‘ রিপুদা আমি পড়ছি। ডিস্টার্ব করোনা প্লিজ।
রিপ থামল না। বলল,
‘ তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? দরজা খোল।
ইশা আবার কাঁদে। বলে,
‘ এত দরদ দেখাবে না রিপুদা। তুমি তোমার লাইফ নিয়ে ভাবো। তোমার বউ বাচ্চার কথা ভাবো।
রিপ অবাক হয়।
‘ এই মেয়ে কি পাগল হলো? কিসব বলছে? সে আবার বলল,
‘ তুই দরজা না খুললে আমি দরজা ভাঙতে পারি। সিনক্রিয়েট করতে না চাইলে তাড়াতাড়ি দরজা খোল।
ইশা বেশ বিরক্ত হয়ে দরজা খোলে দে। অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
রিপ তার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ায়। ছলছলে চোখ দেখার সাথে সাথে সে নীরব কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘ কে কি বলেছে তোকে? বল আমাকে।
ইশা ভড়কে যায়। বলে,
‘ কিছু হয়নি রিপুদা। জেরা করোনা তো, ভালো লাগছেনা।
রিপের রাগ উঠে। চেঁচিয়ে বলে,
‘ সমস্যা কি তোর? কিছু জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাস। হসপিটালে একা একা গিয়ে ট্রিটমেন্ট করছিস। কি ব্যামো নিয়ে ঘুরছিস বল তো তুই?
ইশা চোখ মুছে নিয়ে বলল,
‘ একটু হাতটা মচকে গিয়েছে। আর বেশি কিছুনা। তুমি এখন যাও। মামি শুনলে চেঁচামেচি করবে।
রিপ নড়ল না। বলল,
‘ কেন কাঁদছিস তুই?
ইশা মাথার একপাশ ধরে চিৎকার বলল,
‘ কিচ্ছু হয়নি বললাম না। তুমি বারবার এক কথা কেন জিজ্ঞেস করো? কিসের এত দরদ তোমার আমার প্রতি?
রিপ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে ইশার দিকে। এতদিনের বিশ্বাসে আজ মনে হলো আঘাত লাগল। এ মেয়েটা তাকে এভাবে বলছে? যার জন্য তার এত লড়াই। সে তাকে এভাবে বলছে? তার সহ্য হলোনা। তার কষ্ট লাগল। বুকটা হাহাকার করে উঠল। কিসের এত দরদ মেয়েটি কেন বুঝে না? কেন বুঝতে চাই না?
কোনোরূপ আওয়াজ না করে রিপ বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে। ইশা পিছু পিছু দৌড়ে যায়। রিপদা, রিপদা বলে ডেকে দৌড়াই । রিপ দাঁড়ায় না। ইশা তার পিছু যেতে না যেতেই থমকে দাঁড়ায় পরীর কান্নার আওয়াজে। মুনার কাছে গিয়ে পরীকে ছোঁয়ার আগেই মুনা পরীকে নিয়ে চলে যায়। পরী কান্নার মাঝে আওয়াজ করে ডাকে, ফিপফি,,,,,,,
ইশা আর পিছু ফিরে তাকাতে পারেনা। রিপের পিছু নেয়। রিপ তার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ইশা গেইটের কাছাকাছি গিয়ে চিৎকার করে ডাকে,
‘ রিপদা তুমি ও আজ আমায় ভুল বুঝলে। সবাই বুঝে না, আমি কেন এমন করি? কেউ বুঝেনা। ডক্টর ও বুঝেনা। আমার কল্পনায় এসে ও আমাকে শান্তি দেয়না। আমাকে ঘুমোতে দেয়না। আমি ইচ্ছে করে কিছুই করিনি রিপদা। পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। আমি বাধ্য হয়েছি।
___________________________
ঘড়ির কাটা দেখে ইশা আন্দাজ করে নিল মধ্যরাত। রিপের ঘরে রিপকে পেল না। হাতে খাবার প্লেট নিয়ে সে এগোলো ছাদের দিকে। ছাদের এককোণায় রেলিং ঘেষে বসা ছেলেটিকে দেখে সে অবাক হলো। পাশে গিয়ে বসল। বলল,
‘ রিপদা খাবেনা?
কিন্তু রিপের তাতে কোনো হোলদোল নেই। অদ্ভুত ভাবে সে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। চোয়াল শক্ত। ইশা আবার ও বলল,
‘ আমি খাইয়ে দিচ্ছি। হা করো।
রিপ তার দিকে তাকাল। ইশা তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিল। বলল,
‘আমি খাব না।
ইশা ভাতের লোকমা মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ খেয়ে নাও। আমি ও খাইনি।
রিপ বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ কি প্রমাণ করতে চাইছিস? আমি খাচ্ছি না বলে তুই ও খাচ্ছিস না?
ইশা ভ্রুকুঁচকে বলল, না। আমার খিদে নেই তাই খাইনি।
রিপ নড়েচড়ে বসল। বলল,
‘ কালকে ও বলতে শুনেছিলাম তুই রাতে ভাত খাবিনা। আমি জোর করিনি। কারণ তুই আমাকে অনুরোধ করেছিস বলে। তাই বলে আজ ও।
ইশা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ভাত মাখাতে মাখাতে বলল,
‘ আজ খিদে পেয়েছে। কেউ একজন খাচ্ছে না বলে আমি ও খাচ্ছি না।
রিপ অন্যদিকে ফিরে ব্যঙ্গ করে হাসে। তাচ্ছিল্যর সুরে বলে,
‘ শোন আমাকে একদম দরদ দেখাতে আসবিনা। কিসের এত দরদ আমার প্রতি তোর?
ইশা চমকে তাকায় রিপের দিকে। বলে, আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ। তুমি কি খাবে নাকি চলে যাব।
রিপ অন্যদিকে মুখ করে বলে। ‘ চলে যাহ। খাব না আমি।
ইশা চট করে অন্যদিকে মুখ করে তাকায়। ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ আমার খিদে পেয়েছে খুব। তুমি না খেলে আমি কি করে খাই? তুমি ও সবার মতো আমাকে ভুল বুঝে বসে থাকো। সবাই রাগ দেখায় আমার সাথে। আমি কি দেখাতে পারিনা একটু। কি না কি বলেছি তারজন্য তুমি সারাদিন বাসায় আসোনি। কিচ্ছু খাওনি। কথা ও বলোনি। আমি কেউ না তোমার। সবার মতো তুমি ও আমায় পর মনে করো।
রিপ অবাক হয়ে শোনে ইশার কথা। তার গাল বেয়ে পড়া জল দেখে তার কষ্ট হয়। বুকে জ্বালাপোড়া হয়। সে সহ্য করতে পারেনা মেয়েটার চোখের জল। অনেকক্ষণ পর বলে,
‘ খাব।
ইশার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে। খাইয়ে দিতে দিতে বলে,
‘ অন্যদের মতো তুমি কেন হলেনা রিপদা? নাহলে আমার আর কোনো কষ্ট থাকত না। তুমি কেন আমায় ভালোবাসো সেটা ও আমি জানি। তোমার কোনো বোন নেই তাই। বোন থাকলে অতটা ও ভালোবাসতে না। বউ বাচ্চা থাকলে ও ভালোবাসতে না। আচ্ছা তুমি যখন বিয়ে করে ফেলবে তখন আমাকে আর এতটা ভালোবাসবে না?
রিপ শুধু শোনে যায় মেয়েটির কথা। আনমনা হয়ে বলে, ‘ আমি অন্যকাউকে কেন বিয়ে করতে যাব? বোন নেই তোকে ভালোবাসি। কেমন লজিক তোর?
ইশা খাইয়ে দিতে দিতে বলে,
‘ ঠিক বলেছি। তুমি বিয়ে করবে না, তো? তোমার বউ বাচ্চা হয়ে গেলে দেখবে এই ইশুর কথা তোমার তখন গুণে গুণে মনে পড়বে। কথা বলার সময়টা ও হয়ত পাবেনা। রিকদার মতো। রিকদা ও আমায় ভালোবাসে জানো?
দেখায় না আর কি। আমি তোমাদের দুজনেরই খুব প্রিয় আমি জানি। আমি সত্যিই লাকি যে তোমাদের মতো দুইটা ভাই পেয়েছি। যারা আমার মাথার উপর ডাল হয়ে আছে।
রিপ বরাবরের মতো চুপ হয়ে শোনে ইশার কথা। বলে, তুই তো দেখছি অনেক জ্ঞানী ইশু। কতকিছু জানিস তুই। অথচ আমিই একমাত্র বোকা যে কতকিছু ভেবে বসে থাকি। আমি কেন তোর মত হলাম না বলতো?
ইশা ভাতের লোকমা মাখতে মাখতে আনমনা হয়ে ভাবে,
‘ আমার মত হতে যেওনা রিপদা। কষ্ট ছাড়া তুমি কিছুই পাবেনা। যে কষ্ট আমি প্রতিনিয়ত সহ্য করছি,সেই কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে না। কখনো পারবে না।
_________________________
শহরতলিতে মেলা বসেছে। নানানরকম মানুষের ভীড়। কেনাকাটা, নাগরদোলা,বাঁশি,লোকজনের সমাগমে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। খানিকটা সমতল, নির্জন জায়গায় এসেই দাঁড়িয়েছে আইমি। সাথে তার বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। অপেক্ষায় তারা আদির। অনেকদিন পর বন্ধুবান্ধবদের পেয়ে আইমি যেন কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। তার কথার মাঝেমাঝে একেকটি হাসির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। হাতে সবার বাদাম। কুটকুট করে খাচ্ছে সবাই। আদির কথা বলতে বলতে যেন হাঁপিয়ে উঠল আইমি। শেষমেশ বলল,
‘ শোন দোস্ত। আদির কথা বলতে গেলে আমি সত্যিই শেষ করতে পারব না। আদি হুট করে খুব বাচাল টাইপের হয়ে গিয়েছে। ওর যখন মাইন্ড ফ্রেশ থাকে, সবসময় হাসিখুশিতে থাকে। বেশি বেশি কথা বলে। যখন মন খারাপ থাকে, আমি নিজেই ওকে ভয় পায়। চারবছর আগের আদিকে আমি এখনো পুরোপুরি ফিরে পায়নি। সেই আগের আদি প্রচন্ড গম্ভীর, স্বল্পভাষী আর চাপা স্বভাবের। তাকে চেনা যেত না। বুঝা যেত না। এখন ও যায় না। ডক্টর আদি কি আদৌ পড়ার মতো?
বন্ধুমহলের একেকজনের একেক পরামর্শ, দুষ্টুমি, খুনসুটিতে কেটে যায় অনেক সময়। আদি আসেনা। আইমি ফোন দেয়। আদি ফোন ধরার সাথে সাথে বলে, তোমরা যাও। আমি আসছি।
আইমি তাই করল।
মিনি ডানা ঝাপটাল। আদি গাড়ি চালাতে চালাতে মনোযোগী হয়ে বলল,
‘ এনি প্রবলেম মিনি?
মিনি ডানা ঝাপটে বলল, মেলা,মেলা।
আদি হাসল। বলল, হ্যা আমরা মেলায় যাচ্ছি। তোমার জন্য কি কিনব বলোতো মিনি!
মিনি ডানা ঝাপটাল। বলল,
‘ মিষ্টি। মিষ্টি।
আদি চমকে উঠল। কানে বাজল,
মন কেমনের দিনে আমি একফোঁটা বৃষ্টি
আমি সেই মেয়ে, যে ডক্টরের মিষ্টি।
আদি চেহারা অন্যরকম করে বলে, মিষ্টি?
মিনি ডানা ঝাপটাল। বলল, খাব। খাব।
আদি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ বাঁচালে মিনি। আমি কি ভেবেছিলাম। আজ সামনাসামনি আইমির সামনে ওই শাড়ি আর চিরকুটের কথা বলতে হবে। যদি ও সরাসরি বলবে না। তার মনে হচ্ছেনা সে আইমি হতে পারে? আইমি না হলেই বা কে হবে? যদিই বা আইমি হয় এত লুকোচুরি কেন?
আদি নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। ভীড়ের মাঝে গাড়ি থেকে নেমে আইমিকে খুঁজল অনেক। পেলনা। ফোন দিল। কিন্তু এত চেঁচামেচির জন্য কথা শোনা গেলনা। সে ফোন রেখে দিল । মিনিকে নিয়ে অনেক হাঁটল। যখনি সে কিছুটাদূরে আইমি আর তার বন্ধুবান্ধবদের দেখল ডাক দিতে চাইল। কিন্তু তার আগেই মিনি ডাক দিল,
‘ মিষ্টি। মিষ্টি।
আদি চমকে গেল। মিনিকে শান্ত হতে বলে বলল,
‘ মিনি কে মিষ্টি? আইমির কথা বলছ?
মিনি খাঁচার ভেতর ডানা ঝাপটে যায়। আবার ডাকে,
‘ মিষ্টি। মিষ্টি।
আদি খাঁচা থেকে বের করে দেয় মিনিকে। বলে,
মিনি আমাকে নিয়ে যাও মিষ্টির কাছে। মিনি ছাড়া পেয়ে উড়ে চলে যায় মিষ্টির কাছে।
আদি খুঁজতে থাকে মিনিকে। মিনি বলে ডেকে উঠে।
ছোট্টছোট্ট কয়েকডজন চুড়ি নিল ইশা পরীর জন্য। নিজের জন্য একজোড়া নূপুর নিল। মুনার জন্য কেনাকাটা করল। রিপের বাইকে চেপে বসল। রিপ মজা করে বলে,
‘ এইগুলো কেনার জন্য তুই এখানে এলি।
ইশা তার পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে বলে,
‘ শুধু শুধু টাকা খরচা করে কোনো লাভ আছে। রিপ তার হাতে থাকা ব্যাগটা ইশার সামনে ধরে। বলে, খরচা তো হলোই। এখন কি হবে?
ইশার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
‘ তোমাকে এসব কে কিনতে বলেছে রিপদা। কি কিনেছ তুমি?
ইশার রাগ দেখে হো হো করে হাসে। বাইক স্টার্ট দেয়। তারমধ্যেই ইশার কাধেঁর উপর ভারী কিছু অনুভব হতেই সে চমকে ফিরে তাকায়। ভয়ে,আশঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে যায়। গাড়ির সাথে তার হৃৎপিন্ড ও দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। মিনি তার গালের সাথে গাল ঘষে শান্তভাবে ডাকল, মিষ্টি বউ।
ইশার চোখজোড়া টলমল করে উঠল। মাথার কাপড় টেনেটুনে কিছু বলার আগেই রিপ প্রশ্ন করল। এটা কি ইশা ?
রিপ হঠাৎ বাইক থামানোয় ইশা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। নিজেকে সামলে নেয় পরক্ষণে। রিপ জিজ্ঞেস করে,
‘ তুই ঠিক আছিস?
ইশা মিনিকে শক্ত করে ধরে চেঁচিয়ে উঠে।
‘ তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দাও রিপদা। তাড়াতাড়ি। দেরী করোনা।
রিপ জানতে চাইল।
‘ এই পাখিটি কোথা থেকে এল। কার?
মিনি অনবরত ডেকে যায়।
‘ মিষ্টি। মিষ্টি।
ইশার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে রিপের পিঠে হাত ছুড়ে বলে,
‘ গাড়ি স্টার্ট দাও। নয়ত আমি নেমে যাচ্ছি।
রিপ তার কথামত স্টার্ট দেয়। বলে,
‘ কার না কার টিয়ে পাখি? নিয়ে যাচ্ছিস। ভালো হচ্ছে?
ইশা চুপ থাকল। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ায় স্বস্তি পেল। মিনি তারপর ও ডেকে গেল,
‘ মিষ্টি। মিষ্টি। মিস ইউ। মিস ইউ।
আদি দৌড়ে এল। ততক্ষণে বাইকটি বহুদূর চলে গেল। ওহ শিট। নাম্বার প্লেটটা ও খেয়াল করেনি সে। বাইকে বসা ছেলেটি কে? মেয়েটিই বা কে ? মিনি তার সাথে কেন চলে গেল।
সেসব ভাবতে না ভাবতেই তার চোখ যায় কিছুটা দূরে। কুড়িয়ে নেয় মাটিতে পড়ে থাকা একটি ছোট্ট সাইজের চুড়ি। মনে হয় কোনো বাচ্চার। অন্যটি একটি নূপুর। এসব ফেলে চলে গেল কেন?
মিনিকে কোথায় খুঁজবে সে। আদির মাথায় চিন্তা চেপে বসল। এই ছোট্ট চুড়ি আর নূপুরটি কার?
চলবে,
( আপনাদের মতামত জানাবেন)