#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা
সেদিন ইশা চলে এসেছিল আদির কাছ থেকে। আদিকে শুনিয়ে এসেছিল তিক্ত কথা। আদি তার জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল ইশার চলে যাওয়া। সে আর আটকায় নি। যে চলে যেতে চায় তাকে যেতে দেওয়া উচিত। ইশা খান বাড়িতে ডোরবেল বাজানোর সাথে সাথে দরজা খুলে দেয় একটি ছেলে। তার পড়নে শাড়ি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
‘ এটা তোর বাড়ি নয়। এখানে কি চাই। কেন এসেছিস? তোর এখন স্বামীর ঘরে থাকা উচিত। মিথ্যেবাদী।
ইশাকে কিছু বলতে না দিয়ে রিপ তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। ভেবে রাখে যে, কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দেবে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পার হলে ও দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসেনা। রিপ তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দেখে কেউ নেই। লাল শাড়ি পড়া মেয়েটি কোথাও নেই। রিপ চেঁচিয়ে ডাকে, ইশা…….
সেদিন হাজার ডেকে ও ইশা আসেনি। হুট করে একটা মেয়ে কোথায় যাবে। রিপ সেদিন বাইক নিয়ে এদিকওদিক ঘুরেছিল সারারাত। চৌধুরী বাড়ি গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে আদির ফ্ল্যাটে ও গিয়েছিল। কিন্তু দেখা মিলল না। বরঞ্চ আদি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছে। কোথায় যেতে পারে মিষ্টি?
সারা শহরময় খুঁজল ইশাকে আদি আর রিপ মিলে। কোথাও পেল না। এমন কোনো আত্মীয় ও নেই যেখানে ইশা গিয়ে থাকতে পারে। প্রায় তিন চারদিন হয়ে গেলে ও ইশার খোঁজ যখন পাওয়া গেলনা তখন থানায় মিসিং ফাইল করা হলো। ইশার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে রিপ নিজেকেই দোষারোপ করল। সে যদি দরজা বন্ধ করে না দিত,তাহলে কিছুই হতোনা। ইশা হারাত না। পরী সারাঘরময় একা একা হাঁটল। নীরাকে ছুঁতে দিল না। কোলে নিতে দিল না। গুনগুন করে কেঁদে কেঁদে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগল,
‘ নাই ইশআআা নাই। আমমমমা নাই।
আদি নিয়ে গেল পরীকে। সারাটা দিন সারাটা রাত মেয়েকে তার কাছে রাখল। রিক কোনোকিছু বলল না। সে বুঝতে পারে আদির কষ্ট। আদি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুমায়। পরী মাঝরাতে ঘুম থেকে লাপিয়ে উঠে কাঁদে। ইশআআ নাই,আমমমা নাই। নাই নাই।
আদি চেয়ে থাকে দেয়ালে টাঙানো ইশার ছবিটার দিকে। তার দেখাদেখি পরী ও তাকায়। আদির গালে গাল লাগিয়ে ইশার ছবিটার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকে, ইশআআ আয় আয়,আমমমা আয় আয়।
আদি কাঁদে হাসে। মেয়ের গালে স্নেহের স্পর্শ দিয়ে বুকে চেপে ধরে বলে,তুমি যেওনা আমমি আমাকে ছেড়ে। আমি খুব একা।
পরী মুখ তুলে তাকায় আদির দিকে। মাথা দুলিয়ে আদির গালে লালা লাগিয়ে দিয়ে বলে, নান না দাবো না দাবো না।
পরে ঠোঁট টেনে কেঁদে কেঁদে বলে, আমমমমা নাই, নাই নাই।
রিপ ইশার রুমের প্রত্যেকটা জিনিস তন্নতন্ন করে কোনো ক্লু পাওয়া চেষ্টা করে। পুরো ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস ছুড়ে মারে এদিকওদিক। বেহাল দশা বানিয়ে ফেলে। নীরা এসে আটকালে রিপ তাকে ধমক দেয়
‘ খবরদার নীরা। তুমি এখানে নাক গলাবে না।
নীরা ভয়ে চুপসে যায়। সরে পড়ে। রিপ ইশার আলমারি থেকে কাপড়চোপড় বের করে সবকিছু দেখে। তার কষ্ট সফল হয় অবশেষে। দুইটি মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে পায় সে। একটি পরীর ডেলিভারি অপারেশনের। অন্যটি?
রিপের দুচোখ চকচক করে উঠে। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফুসফুসের ক্যান্সার? ইশু বেশিদিন বাঁচবে না? তার ইশু মরে যাবে?
রিপ বসে পড়ল খাটে। অনেকক্ষণ পায়ের উপর ভর দিয়ে সে দাঁড়াতে পারল না। তার হাত পা কাঁপাকাঁপি বন্ধ হলো না। এখন উপায় একমাত্র আদি।
পাগলের মতো হন্য হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া রিপকে দেখে কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারেনা। যখন সে দৌড়ে যায় আদির বাসায়,তখন আদির বুকের উপর শুয়ে থাকা পরী। বাবা মেয়ে বাইরের লনে শুয়ে আছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে কবে ফিরবে মিষ্টি। কবে ফিরবে পরীর আমমা। পরী মাথা ফেলে রাখে আদির বুকের উপর। ডাকে, আবব্বে আববব্বে আববব্বে।
রিপ ছুটে যায়। পরীকে কোলে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বলে,মা কোথায় তোমার মা????
আদি বিস্ময় নিয়ে বলে,
‘ কি হয়েছে রিপ?
রিপ পরীকে বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁপাকাঁপা হাতে উপরে তুলে দেখায় সেই রিপোর্ট। আদি একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখে সেই রিপোর্ট। তার গাল বেয়ে কখন যে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল কেউ বুঝতে পারল না। কেউ দেখল না। পরী মাথা তুলে একবার রিপের মুখ দেখে, একবার আদির মুখ দেখে। দুজনকেই প্রশ্ন করে,,, রিইইই দিইইই আমমমমা নাইই???
রিপ তার দুচোখ চেপে ধরে পরীর বুকের কাছে। বলে, আছে আমমা আছে। পরী রিপের চুল নিয়ে খেলা করে, বলে
‘ নাই নাই আমমা নাই। আমমা নাই।
আদি তন্নতন্ন করল পুরোটা শহর। পুরোটা কলোনি। পাগলপারা হলো রিপ আর সে। ইশার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। আদি ক্লান্ত হলো। রিপ মাথার দুপাশে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল অতীতের সেই ইশুর সাথে তার কাটানো মুহূর্ত গুলো। যেদিন সে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে চলে যাচ্ছিল,সেদিন ইশু চিৎকার করে কেঁদেছে। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। কেউ তাকে ছাড়াতে পারেনি । কয়েক মিনিট পর সে নিজে নিজে ছেড়ে দিতে দিতে বলেছিল,
‘ রিপদা আমাকে এভাবে একা করে চলে যাওয়ার শাস্তি তুমি পাবে। এখন যাচ্ছ। যাও।
রিপ এত কষ্টের মাঝে ও হাসল একটুখানি। বলল, তুই আমাকে সেই শাস্তি ঠিকই দিয়েছিস ইশু। এত বড় শাস্তি দিলি আমায়!
রিপ হাতের কব্জিতে চেপে ধরল নিজের দুচোখ। তুলল না মাথা। তাকাল না কারো দিকে। আদির দিকে সে তাকাতে পারল না। আজ বেশি কষ্ট তার আদির জন্য হচ্ছে। হিসাব করতে গেলে তার প্রাপ্তির খাতা শূন্য।
__________
যখন চারদিকে রিমঝিম বৃষ্টি, নির্জন,নির্মল বাতাস বইছে তখন আদি বেরিয়ে পড়ল তার মিষ্টির খোঁজে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সে হাঁটল। তার কোলে যে পরী আছে তা তার মাথায় থাকল না। পরী দুহাত মেলে নেচে নেচে বলল, ওহ ওহহহ দিইইই বৃতততি। ওয়াহ না।
আদি হাঁটল। পরী তার ঠান্ডা হওয়া গাল লাগিয়ে রাখল আদির গালে। বলল, আবববব্বে দুক্কু।
আদি তারপর ও জবাব দিল না। আদি পৌঁছে গেল আহমেদ বাড়ির কাছাকাছি। ঠিক যেটাই ভাবল সেটাই হলো। দাঁড়িয়ে আছে দুজন মেয়ে পাশাপাশি। আইমি আর একজন?
পরী আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তার মাকে, ওতততো আমমমা।
আদিকে দেখেই মেয়ে দুজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আদি যেতে যেতে বলল,
‘ অসাধারণ। যাকে পুরো শহর আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি সে তো আমার আশেপাশেই আছে। আমি কি অন্ধ?
আদি পরীকে নিচে নামিয়ে দেই। পরী দৌড়ে যায় ইশার কাছে। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ইশাকে। ডাকে, আমমমা।
ইশা পরীর ছোঁয়া পেয়ে কেঁদে দেয়। আবার হাসে। পরীর দুগালে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলে, মা তুমি ভালো থেকো। খুব ভালো থেকো। তোমার আব্বাকে দেখে রেখো।
পরী ইশার দুগাল আগলে ধরে আদুরে স্বরে ডাকে, আমমমা আয়। আয়।
ইশা জড়িয়ে ধরে তাকে। বলে, এভাবে ডেকো না মা। আমি আসতে পারব না।
পরী ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, আয়, আমমা আয়।
ইশা আদর দেয় তার ঠোঁটে,মুখে,কপালে। বলে, আসব মা। এইরকম বৃষ্টি হয়ে। আমার মাকে ছুঁয়ে দিতে। আদর করে দিতে। সত্যি আসব।
ইশা কোলে নিল পরীকে। আবার ও আদর করে দিয়ে আইমির কোলে তুলে দিল। বলল, ওঁকে কাপড় চেন্জ করে দিতে হবে। ঠান্ডা লেগে যাবে। আইমি তাকিয়ে থাকে ইশার মুখের দিকে। বলে,
‘ আদিকে আমি ডেকে এনেছি।
ইশা তাকায় ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে। বলে, ডক্টর,,,,
আদি ধীর পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। বলে, সব অন্যায় অবিচার আমার সাথেই কেন হয়?
ইশা পিছু হাঁটে। বলে, ডক্টর সত্যিটা মেনে নেওয়ায় ভালো। আপনি ভালো থাকুন আইমিকে নিয়ে। নতুন করে সংসার সাজান। মনে করুন মিষ্টি খানিকক্ষণের জন্য আপনার জীবনে এসেছিল। প্লিজ ডক্টর পাগলামি করবেননা। আইমিকে আপনাকে ভালোবাসে, ও ভালো রাখবে আপনাকে।
আদি তার অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকে মিষ্টির মুখপানে।
ইশা একবার চোখ মুছে আবার কাঁদে। বলে, ডক্টর আমাকে যেতে হবে। আপনি প্লিজ পরীর খেয়াল রাখবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আইমিকে সুখী করবেন। আমার শেষ ইচ্ছেটুকু রাখবেন ডক্টর। মিষ্টির চাওয়া এটুকুই। প্লিজ ডক্টর।
আদি কিছু বলতে যায়। ইশা হাত দেখিয়ে বাঁধা দেয়। ইশা হেঁটে দৌড়ে অনেকদূর চলে যায়। পরী হাত বাড়িয়ে ডাকে, আমমমা আয় আয় আয়। আমমা আয়।
আদি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আইমির দিকে। পরী দৌড়ে আসে। দুজনের পাশে দাঁড়িয়ে ওই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলে, তা তা আমমা তা তা।
______________
ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ের আবোলতাবোল বকবকানি শুনে আদির ঘুম ভেঙে যায়। বাচ্চা মেয়েটি কোথায় খেয়াল করতেই সে বুঝতে পারে মেয়েটি বারান্দায় দাঁড়ানো। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে বাচ্চা মেয়েটি আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকছে, বৃততততততি আয় আয় আয়।
আদি ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় মেয়েটির পিছু। কোনো শব্দ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। পরী বকবক করতেই থাকে, আয় আয় বৃতততি আয়। আয় আয়। বৃতততি আয়।
আদির রুম থেকে ভেসে আসে একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর।
‘ পরী খেতে এসো। আজকে তোমার পাপপার কাছে যাওয়ার পালা। এসো।
পরী শুনে ও শোনেনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে অবিরত ডাকতে থাকে,
‘ বৃতততি আয় আয়।
চলবে,,