মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৩ #পুষ্পিতা_প্রিমা

0
428

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা

সকাল সকাল ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল আদির। সে বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ইশা হেসে আরেকটু দুষ্টুমি শুরু করল। আদির দিকে ঝুঁকে তার চুল দিয়ে আদির কানে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল,ডক্টর ফ্রেশ হয়ে, না খেয়ে আবার ঘুমোচ্ছেন? উঠুন।
আদি মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনে চোখদুটো পিটপিট করে তাকাল ইশার দিকে। আলুথালু হয়ে বলল,আরেকটু ঘুমোবো। তুমি ভালো না মিষ্টি।
ইশা আবার হাসল। বলল, আপনি পায়েস খাবেন বলেছিলেন। আমি আজকে কত কষ্ট করে বানিয়েছি। আগে চট করে এসব খেয়ে নিন। তারপর পায়েস খাবেন। নাহলে দেব না।
আদি চট করে উঠে পড়ল। চোখ কচলে বলল, মিষ্টি আমার পায়েস!
ইশা আওয়াজ করে হেসে দিল। আদির দিকে ঝুঁকে জানতে চাইল,জানতে চাইবেন না পায়েস কাকে বলে?
আদি মাথা চুলকাল। আবার ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ইশা অবাক হয়ে বলল,কি হয়েছে ডক্টর। আবার শুয়ে পড়লেন কেন? আমরা আজকে এক জায়গায় যাব না?
আদি বালিশে মুখ গুজে বলল, আমি কোথাও যাব না। কোথাও না।
ইশার রাগ লাগল। তারপর ও শান্ত কন্ঠে বলল, আচ্ছা যাইয়েন না। কিন্তু পায়েস খাবেন না?
আদি একচোখে ইশাকে দেখার চেষ্টা করে বলে, প্রমিজ করো, কোথাও নিয়ে যাবে না। তাহলে খাব।
ইশা হতাশ হলো। বলল, প্রমিজ কি ডক্টর?
উঠবেন নাকি আমি চলে যাব?
আদি চোখমুখ কুঁচকে উঠে পড়ল। ডিম, পাউরুটি, কলা দেখিয়ে বলল, আমি এটা,এটা,এটা খাব না।
ইশা রাগীচোখে তাকাল। আদি আবার ও বলল, আমি শুধু পায়েস খাব।
মিনি উড়ে এল, আদির কাঁধে বসে পড়ল। বলল,আমি খাব, আমি খাব।
ইশা মিনমিন করে বলল,হয়েছে ভাগ বসানোর জন্য চলে এসেছে। তুমি শুধু পাউরুটি পাবে মিনি।
মিনি উড়ে ইশার কাঁধে বসল। বলল, মিষ্টি ব্যাড গার্ল। ব্যাড গার্ল।
ইশা আবার হাসল। বলল, ডক্টরকে বলো ব্যাড বয়। ডক্টর খেতে চাইছে না তাই।
মিনি ডানা ঝাপটাল। বলল, আদি মিষ্টি ব্যাড ফ্রেন্ড।
আদি কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। ইশা মিনির কথা শুনে আওয়াজ করে হাসল। আদি পায়েস খেতে খেতে বলল,মিষ্টি আমি আজ থেকে শুধু পায়েস খাব। ঝাল খাব না। মিষ্টি ছাড়া কিছু খাব না।
ইশা শুনে ও না শোনার মত ভান করল। বলল, ডক্টর আপনার শরীর সুস্থ রাখার জন্য এসব খেতে হবে। আপনাকে ডক্টর ডিম,দুধ খেতে বলেছে। অথচ আপনি এসব কিছুই খাচ্ছেন না। শরীর সুস্থ থাকলেই তো মন ভালো থাকবে তাই না?
আদি অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকল মিষ্টির দিকে। ইশা নিজের মাথায় চাপড় মেরে বলল, আমি এসব কাকে শোনাচ্ছি, ধুরর।

আদির রুমের দিকে এগোতেই রাইনাকে থামিয়ে দিল আলিয়া। বলল, আদির রুমের দিকে কোথায় যাচ্ছ রাইনা?
রাইনা কাঁচুমাচু করে দাঁড়াল। বলল, মা আসলে ইশার সাথে একটু গল্প-গুজব করতে যাচ্ছিলাম। একা একা বোর হচ্ছি।
আলিয়া আবার ও ধমক দিলেন। তোমাকে দেখলে আদি রেগে যাবেনা? তুমি তারপর ও যাচ্ছ?
রাইনা আমতাআমতা করল। বলল, আচ্ছা যাব না মা।
রাইনা মাথা নামিয়ে চলে গেল। ইশা পেছনে দাঁড়ানো অবস্থায় সবটা শুনল। আলিয়া পিছু ফিরতেই ইশাকে বলল, আদিকে রাজী করিয়েছ? যাবে বলেছে?
ইশা অভয় দিয়ে বলল, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি ওনাকে ঠিকই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব।
হাঁফ ছাড়ল আলিয়া। ইশার দিকে তাকাল। মেয়েটার প্রতি মনে মনে বেশ কৃতজ্ঞ সে।

____________

ইশা আদিকে ছাদে নিয়ে যায়। চেয়ারে বসিয়ে দেয় । বড় সাইজের কালো কাপড় এনে গায়ে জড়িয়ে কাঁধের দিকে গিট বেঁধে দেয়। আদি ভ্রুকুঞ্চন করে বলে,মিষ্টি কি করছ?
ইশা হাসল। হেসে বলল, এভাবে ভালো ছেলের মত বসে থাকুন। নাপিত মামা আসবে আর চুল কেটে দেবে। আদি উঠে পড়ল। বলল,না,না মিষ্টি আমি কারো সাথে কথা বলব না।
ইশা রাগ দেখাল। আবার হেসে দিল। বলল, কথা বলতে হবে না চুপচাপ শুধু বসে থাকবেন। নাহলে আমি খুব রেগে যাব। কথা বলব না।
আদি বসে পড়ল। মাথা নিচু করে রাগ করার মতো করে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে।
ইশা অন্যদিকে মুখ করে হাসল। নাপিত আসলে আদি চুপচাপ বসে রইল। অন্যবারের চিৎকার চেঁচামেচি করল না। ছাদের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী দেখতে লাগল আদির কান্ড।
আদি চুল কাটা অবস্থায় ডাকল,মিষ্টি তুমি কাটবে না?
ইশা মাথা নাড়িয়ে বলল,কাটব,এখন না। আগে আপনি কেটে নিন।
আদি আবার বলল,মিষ্টি আমার গলায় চুলকাচ্ছে।
নাপিত মশাই বলল, কাটা চুল পড়ছে তাই। এক্ষুণি হয়ে যাবে আরেকটু। নড়াচড়া করলে কাটব কিভাবে বাবু?
ইশা চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল,চুপ থাকতে। আদি আবার রাগ করল। আজ সে মিষ্টির সাথে কম কথা বলবে। আরেকবার ধমক দিলে একদম বলবে না।
চুল কাটা শেষ হলো। আদি ছুটে আসল ইশার কাছে। বলল, মিষ্টি এখানে আর থাকব না। বাজে লোকগুলো ওই দেখো লুকিয়ে দেখছে। ইশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বলল, উনারা আপনার মা,বাবা। আপনাকে খুব ভালোবাসে।
আদি রাগ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। ইশা বলল, আপনি উঠে এলেন কেন? আর ও কাজ বাকি। শেভিং করতে হবেনা?
আদি মাথা চুলকাল। বলল, না আর করব না। কিচ্ছু করব না। তুমি ভালো না মিষ্টি।
ইশা অন্যদিকে মুখ করে বলল, ঠিক আছে। আপনি ও আমার সাথে আর কথা বলবেন না।
আদি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ইশার উপর। বলল,একটুখানি করব শুধু, হ্যা?
ইশা তাকাল। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। নাপিত মশাইকে বলল, মামা ক্লিন শেভ করিয়েন না।
নাপিত হেসে মাথা নাড়াল। আদি আড়চোখে ইশার দিকে তাকিয়ে বলল,মিষ্টি তুমি করবে না?
ইশার প্রচন্ড হাসি পেল। সে হেসে উঠার আগেই নাপিত আগে হেসে উঠল। ইশা ও তাল মিলাল। আদির প্রচুর রাগ উঠল। সে তারপর ও কিচ্ছু করল না। মিষ্টি যদি আবার কথা না বলে?
ইশা আড়চোখে রেগে লাল হওয়া মুখটা দেখে লুকিয়ে হাসল।
ওয়াশরুমে শাওয়ার নেওয়ার জন্য ডুকিয়ে দিতেই আদি চেঁচিয়ে উঠল। মিষ্টি ওখানে ও ছিলে, এখানে ও থাকবে। আমি তোমার সব কথা শুনেছি,তুমি ও শুনবে।
ইশা অবাক হলো। বলল,এটা কোনো লজিক হলো ডক্টর। আপনি কি বাচ্চা?
আদি সাবান গায়ে বেরিয়ে আসল। ইশা চোখ বন্ধ করল। চেঁচিয়ে বলল, ডক্টর এভাবে কেউ সামনে আসে?
আদি মজা পেল। সাবানের ফেনা ইশার দিকে ছুড়ে মেরে বলল,কিভাবে এসেছি মিষ্টি? তুমি ভয় পেয়েছ?
ইশা আদিকে ঠেলে ডুকিয়ে দিল ওয়াশরুমে। বাথটাবে বসিয়ে দিয়ে বলল,ডক্টর চুপচাপ গোসল সেড়ে আসুন। আমি ওইখানে আছি।
আদি হাত ধরে রাখল। পানির ছিটকে দিল ইশার মুখে। তারপর আওয়াজ করে হেসে দিল। বলল, পানিশ দিচ্ছি তোমাকে মিষ্টি। ভালো না ?
ইশা ক্লান্ত হলো। হাত ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, চটজলদি আসুন। আমি আছি।
আদি বামে ডানে মাথা নাড়াল। ইশা হেসে বেরিয়ে এল।
গোসল সেড়ে বেরিয়ে এল আদি। চুল বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে। ইশার দিকে এগিয়ে এসে বলল, মিষ্টি আমার শেষ। তুমি করবে না? তুমি ভিজে গিয়েছ?
ইশা পান্জাবী হাতে নিয়ে বলল,আপনি পান্জাবী পড়েছেন?
আদি মাথা নেড়ে বলল,না। ইশা ঘাড় ঘুরাল, উদম গায়ে আদিকে দেখে মাথায় হাত দিল। আপনি পান্জাবী পড়ুন। না পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
আদি হাসল। বলল,মিষ্টি এটা ও পানিশ। পান্জাবী পড়ে ইশার সামনে এসে বলল, মিষ্টি চুল মুছে দাও।
ইশা তোয়ালে নিয়ে চুল মুছে দিতে দিতে বলল,আমি তো আপনার কাজের বেটি। মিষ্টি এটা করে দাও। ওটা করে দাও।
আদি মিষ্টি করে হাসল। বলল,তুমি কাজের বেটি?
ইশার রাগ উঠল। তারপর ও চুপ থাকল। তোয়ালে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য সে পা বাড়াল। আদি তার দু হাত দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল ইশাকে। আকস্মিক ঘটনায় ইশা হকচকিয়ে গেল। বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হলো। ঠান্ডা স্পর্শ লাগতেই সে শিউরে উঠল। আদি দুষ্টু হেসে আধভেজা চুলগুলো এদিক ওদিক নাড়াল যাতে ইশার মুখে পানি পড়ে। ইশা চোখবন্ধ করে রইল। বিড়বিড় করে বলল,ডক্টর ছাড়ুন।
আদি চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,আর রাগ করবে? বলো?
ইশা মাথা নাড়িয়ে বলল,না আর করব না।
আদি বলল,আমার দিকে তাকিয়ে বলো। নাহলে মানব না।
ইশা নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল। আদিকে পিছু করে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি পথ ছাড়ুন ডক্টর, আমি যাব। জেদ করবেন না।
শীতল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল তার মন এক অন্যরকম স্পর্শে। যে স্পর্শে সাথে সে নতুন করে পরিচিত হলো। সে ডক্টরকে পিছু করে দাঁড়িয়ে রইল। কিঞ্চিৎ হাসল।
আদি মাথা চুলকাল। মিষ্টি কি আবার রাগ করেছে। সে মিথ্যে বলল। বলল, সরেছি মিষ্টি, যাও।
ইশা সাথে সাথে পিছু ফিরতেই আবার দেখা সেই মায়াবী মুখটার সাথে । বাচ্চামো চোখদুটোতে খেলা করছে দুষ্টুমি। চোখের প্রগাঢ় চাহনিতে রয়েছে মিষ্টির প্রতি তার অফুরন্ত ভরসা। ইশা পিছু চাপল। বলল, ডক্টর এভাবে তাকাবেন না। আপনি ভালো না।
আদির কষ্ট লাগল। মাথা নিচু করে বলল,ঠিক আছে, তাকাবোনা। তুমি রাগ করোনা।
ইশা নিচু করে রাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসল। একটু আওয়াজ করে বলল, রাগ?
আদি মাথা তুলল। সাথে সাথে খুব সুন্দর হাসি দিল। মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বলল,না মিষ্টি আমি রেগে নেই।
ইশা অবাক হলো। বাধঁন একটুখানি আলগা হলে সে আদির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আপনার কি হয়েছে ডক্টর?
আদি কিছু বলল না। শুধু বলল, মিষ্টি তোমাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করব।
ইশা কৌতূহল নিয়ে বলল, কি?
আদি কিছু একটা ভাবতে লাগল। ইশা তার মুখপানে চেয়ে রইল। আজ অন্যরকম লাগছে ডক্টরকে। চুলছাঁটার ফলে পরিপাটি লাগছে। একদম বর বর লাগছে। মিষ্টির বর। ইশা তাড়া দিয়ে বলল, ডক্টর এখন ও ভাবা শেষ হয়নি?
আদি ইশার কথা শুনে চোখ নিবদ্ধ করল ইশার দিকে। অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইল মিষ্টির দিকে। ইশা শুকনো ঢোক গিলল। আদির মন কেমন করা চাহনি থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগেই আদির প্রশ্নে সে মারাত্মকভাবে আহত হলো। অবাক করা চাহনি নিয়ে সে প্রশ্ন ছুড়ল কি বললেন ডক্টর?
আদি তার দিকে তাকিয়ে আবার ও বলল, কাজের বেটি কাকে বলে মিষ্টি?
ইশা আদিকে ছেড়ে গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এটা কোনো প্রশ্ন হলো? আর কোনো প্রশ্ন পায়নি ডক্টর? আদি হাসতে হাসতে বিছানায় ঢলে পড়ল। আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী আদির হাসির আওয়াজ শুনে হাসলেন। কতগুলো দিনপর ছেলে এভাবে হাসছে। মিনি উড়ে উড়ে বলতে বলতে লাগল, আদি নাটি বয়,নাটি বয়।
আদি মিনির কথা শুনে আবার ও হাসল। হাসতে হাসতে তার মাথার যন্ত্রণা আবার শুরু হলো।

___________

সূর্য ডুবতেই সন্ধ্যা তার ঝাপি নামিয়ে দিল। কালো কার এসে থামল ইশার সামনে। আদি ইশার দিকে তাকাল। বলল মিষ্টি আমরা ঘুরব?
ইশা হাসল। বলল, হ্যা ঘুরব,ফিরব। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসুন। আমি ওদিকে বসছি। আদি চট করে তার হাত ধরল। বলল,মিষ্টি তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় যাচ্ছ?
ইশা চোখ বন্ধ করে হতাশ সুরে বলল, আমি আপনার পাশেই বসব,আপনি এদিকে বসুন,আমি ওইদিকে বসছি।
আদি জেদ ধরল। আগে তুমি বসো তারপর আমি বসব। ইশা হাত নেড়ে বলল,আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।
ইশা বসে পড়ল। আদি বসল না। ইশা বলল,কি হয়েছে ডক্টর ?
আদি মাথা নিচু করে রাগ করে বলল, তুমি আমাকে বাবা বলেছ?
ইশা হাসতে হাসতে গাড়ির সিটে হেলে পড়ল। আদিকে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিল। বলল,আপনি আমার বাবা না। বর। বুঝলেন ডক্টর? আদি ভাবনায় মশগুল হলো। কিছু একটা বুঝে হাসল। ড্রাইভার হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। আজিজ চৌধুরী ও তাদের পিছু নিল।

গাড়ির জ্যামে আটকা পড়ল গাড়ি। আদি গাড়ির কাচ ভেদ করে মুখ বের করে এদিকওদিক তাকাল। বলল,মিষ্টি ওই দেখ কতগুলো গাড়ি। ইশা হাসল নীরবে। তাদের সামনে এসে দাঁড়াল একটি গাড়ি। গাড়িতে অসুস্থ মেয়েটি মাথা রাখল ছেলেটি কাঁধে। ছেলেটির চোখেমুখে একরাশ দুশ্চিন্তা। আদি, ইশা দুজনই দেখল। গাড়ির জ্যাম ছাড়লে গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। আদি ইশার মুখের দিকে তাকাল। এভাবে তাকাতে দেখে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল ইশা। আদি রাগ করল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,আমার কাধেঁ কি ময়লা পড়েছে?
ইশা চট করে আদির মুখের দিকে তাকাল। কিছু না বুঝে বলল, ময়লা কেন পড়বে ডক্টর, ঠিকই তো আছে।
আদি অভিমানী চোখে তাকায় ইশার দিকে। ইশা তারপর ও কিছুই বুঝল না। যখন আদি দূরে সরে বসল তখন ইশা হেসে উঠল। সে জোরে আওয়াজ করে হেসে দিল। নিজের হাসির জন্য নিজেই লজ্জা পেল। আদির পাশে গিয়ে আদির কাধেঁ মাথা রাখল। বলল, এই তাহলে রাগের কারণ?
আদি মিষ্টি করে হাসল। ওই ছেলেটার মতো করে মিষ্টিকে ও জড়িয়ে ধরতে চাইল। হাত আটকে গেল। ইশা মুখ তুলে বলল,কি? আদি হেসে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বলল, কিছুনা।
ইশা বাহুতে স্পর্শ পেয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল। লজ্জায় নাকের পাটা লাল হলো তার। আদির বাহু ছেড়ে এবার বুকে মাথা রাখল। সময়টাকে এখানেই স্থির করিয়ে দিতে মন চাইল তার। এত প্রশান্তির জায়গা বোধহয় আর কোথাও নেই। কিছুক্ষণ পর আদি নড়েচড়ে উঠল। গলা খাকড়ি দিয়ে বলল,মিষ্টি আমার সুড়সুড়ি লাগছে। ইশা সাথে সাথে দূরে সরে পড়ল। গাড়ির কাচ দিয়ে মুখ বের করে দিল। আনমনে নিজে নিজে হাসতে লাগল। ভুলে গেল কিছুক্ষণের জন্য। সে একজন রক্ষিতা।
আদি সোজা হয়ে বসে বলল,মিষ্টি ভালো না। সুড়সুড়ি দিয়েছ কেন?
ড্রাইভারের পাশে খাঁচার ভেতর থাকা মিনি তা শুনল। সে ডেকে উঠল, মিষ্টি নাটি গার্ল। নাটি গার্ল।

_____________

আইমির কথা অনুযায়ী আজিজ চৌধুরী আইমির চাচ্চু নিউরোলজিস্ট মিঃ ইমদাদের চেম্বারে নিয়ে গেল আদিকে। আদির চোখের আড়ালে থাকলেন পুরোটা সময় আজিজ চৌধুরী । ফোনে কথা বললেন ইশার সাথে। চেম্বারে ডুকে পড়ার সাথে আদি রেগে গেল। ইশার হাত ছুড়ে ফেলে বলল,মিষ্টি আমি থাকব না এখানে। চলে যাব।
ইশা সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আমি ও চলে যাব। আপনি কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসুন।
আদি মাথা নিচু করে ইশার শাড়ির আচল টেনে ধরল। বলল, না, এখন যাব।
ইশার পাশে থাকা মিনি ডেকে উঠল। আদি ব্যাড বয়,ব্যাড বয়।
আদি চেঁচিয়ে উঠল। বলল, আমি ব্যাড বয় নই মিনি।
ইশা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল, ঠিক আছে আপনি আর কখনো কথা বলবেন না আমার সাথে। আমি ও বলব না।
বেশ রাগ নিয়ে বলে বসে পড়ল ইশা চেয়ারে। ডক্টর ইমদাদ হাসলেন। আদি চুপচাপ মুখ কালো করে ইশার দিকে তাকাল। ইশার মুখের কাছাকাছি গিয়ে তাকাল। ইশা মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখল। আদি চুপচাপ ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। বলল, ঠিক আছে। আমি কোথাও যাব না মিষ্টি।
ইশা আড়ালে হাসল। ডক্টর ইমদাদ ও হাসল। ইশাকে বলল, আপনি পেশেন্টের ওয়াইফ হন?
ইশা মাথা নাড়িয়ে বলল, জি?
ইমদাদ অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু মিঃ আজিজ তো অন্যরকম বলেছেন।
ইশা তাড়া দিয়ে বলল, আমরা কাজের কথায় আসি ডক্টর।
ডক্টর ইমদাদ ও তাড়া দিয়ে বললেন, হ্যা, হ্যা। আমি ওনার আগের রিপোর্ট গুলো দেখেছি। ভয়ানক রকম অ্যাক্সিডেন্টে ওনার অতীতের সব স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। মানে ট্রান্সিয়েন্ট গ্লোবাল এমনেসিয়াতে আক্রান্ত উনি।
ট্রান্সিয়েন্ট গ্লোবাল এমনেসিয়া বোঝা একটু কষ্টসাধ্য।এক্ষেত্রে রোগী কিছুক্ষণের জন্য খুব বিচলিত,উত্তেজিত হয়ে যায়।সেই সময় তার আচরনে অনেক পরিবর্তন আসে এবং সে অস্বাভাবিক ব্যবহার করতে থাকে। কয়েক ঘন্টা পর সে একদম আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং এই এটাকের দরুন সে কি করেছে সব কিছু ভুলে যায়। তার মস্তিষ্কে এই সময়টুকুর কোন স্মৃতিই থাকেনা।
ইশা মাথা নেড়ে বলল, হ্যা ঠিক বলেছেন। উনি মাঝেমাঝে এমনটাই করেন।
ডক্টর ইমদাদ আবার ও বলেন, মিঃ আদির হিমোক্যাম্পাসে ও প্রচন্ড আঘাত লেগেছে। যা রিকোভার করতে খানিকটা সময় তো লাগবেই। হিপোক্যাম্পাস স্মৃতি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিমোক্যাম্পাস যতদিন না ঠিকঠিক হবে ততদিন আদি নতুন স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারবেন না। মানে এই যে এখনকার কোনোকিছু তার মনে থাকবে না। হিমোক্যাম্পাসে আঘাত লাগার আগে যা ছিল তা মনে আসবে। কিন্তু তারপরের সবকিছু মনে থাকবে না।
ইশা অবাক হলো। এসব কি বলছেন ডক্টর? ওনি আমাকে ভুলে যাবেন সুস্থ হলে?
ডক্টর ইমদাদ অবাক হলেন। বললেন, আপনাকে ওনি অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার আগে থেকে চিনত না?
ইশা টলমলে চোখ নিয়ে বলল, না।
ডক্টর ইমদাদ চিন্তিত হয়ে তাকালেন। বললেন,মিঃ আজিজের কথার মিল পাচ্ছি। তারমানে আপনাকে আদিকে সুস্থ করে তোলার জন্য কেনা হয়েছে। কেনা হয়েছে কথাটা বিষাক্ত তীর হয়ে বিধঁল ইশার কানে। সে সাথে সাথে চোখের জল ছেড়ে দিল। ডক্টর ইমদাদের মায়া হলো। কতটুকু বয়সই বা হবে মেয়েটার? তার ও তো এটুকু বয়সের একটি মেয়ে আছে। যে কিনা বাবাকে আইসক্রিম আনার জন্য আবদার করে। ইশার কান্না দেখে আদি ভড়কে গেল। টেবিলের সব ফাইল ছুড়ে মারল। টেবিল ক্লক ছুড়ে ফেলল। ডক্টর ইমদাদ কোনো উপায় দেখলেন না। ইশা হকচকিয়ে গেল। আদিকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে ফেলল। আদি ঘেমে একাকার। চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ছে। তারমতে, ডক্টর ইমদাদ ইশাকে বকা দিয়েছে। কেন বকা দেবে?
মিনি ভয়ে চুপসে গেল। আস্তে করে বলল, আদি কাম ডাউন, কাম ডাউন।
ইশা আদিকে শান্ত হতে বলল। বলল, আপনি এরকম করলে আমি আর ও কাঁদব।
আদি চুপ হয়ে গেল। বলল, আমি চলে যাব।
ডক্টর ইমদাদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, ওনাকে কনট্রোল করার জন্য কি ইউজ করেন?
ইশা ব্যাগ থেকে লাইটটি অন করল। ডক্টরকে দেখাল বলল, এটি।
ডক্টর ইমদাদ অবাক হয়ে বললেন, এই লাইটটি চোখের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কে ইউজ করতে বলেছে এটি।
ইশা বলল, আমি তো জানি না। আমাকে দিল। আমি একবার ইউজ করেছি মাত্র।
ডক্টর ইমদাদ বারণ করলেন। বললেন, এটি যাতে দ্বিতীয়বার ইউজ না করে।
ইশা মাথা নাড়াল। ডক্টর ইমদাদ একটি ডায়াগনস্টিক চেকআপ দিলেন। বললেন, এমআরআই চেকআপ করিয়ে আমাকে রিপোর্ট দেখাবেন। পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন। উত্তেজিতত করবেন না। সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবেন। রিপোর্ট দেখে বাকি সিদ্ধান্তটা আমি মিঃ আজিজকে জানিয়ে দেব।
ইশা চুপচাপ মাথা নাড়াল। আদি চট করে উঠে পড়ল। বেরিয়ে পড়ল চেম্বার থেকে। বেশ নির্জন একটি জায়গায় এসে আদি বলল,মিষ্টি বাসায় যাব।
ইশা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদির দিকে। আদি ও চেয়ে রইল। বলল, কি?
ইশা চোখ মুছে নিল। বেশ খানিকক্ষণ পর বেশ রয়ে সয়ে বলল, আপনি আমায় ভুলে যাবেন ডক্টর?
তার কন্ঠে স্পষ্ট কান্না। আদি বোধহয় টের পেল। সে বুঝে পেল না। মিষ্টি হ্যা বললে খুশি হবে নাকি না বললে খুশি হবে? খাঁচার ভেতর মিনি ডানা ঝাপটালো। ডেকে উঠল, আদি মিষ্টি। আদি মিষ্টি।
ইশা আদির মুখের দিকে আবার ও তাকাল। বলল, বলবেন না ডক্টর? ভুলে যাবেন আমায়?
আদি এখন ও বুঝল না কি বলবে। আচমকা মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বলল, মিষ্টি তুমি আমায় ছেড়ে কোথাও যাবেনা। যদি যাও? আমি ও চলে যাব।
ইশা অবাক হল। সে ভুলে গেল কথা বলতে। তার চোখের তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ল আদির পিঠে। পান্জাবী ভিজে গেল। কয়েক ফোঁটা পড়ল কে জানে? ইশার হিচঁকি উঠল। বলল, আপনি আমায় ভুলে যাবেন না ডক্টর। যদি যান,তাহলে আমি ও আপনাকে ভুলে যাব।
আদি মুখ তুলে তাকাল ইশার দিকে। একরাশ অভিমান নিয়ে বলল, না মিষ্টি এভাবে নয়। বলবে, আদি যদি ভুলে যায় মিষ্টি কখনো ভুলবে না। বলো, বলো।
ইশা অবাক হয়ে তাকাল আদির দিকে। সাথে সাথে আবার ও তার চোখের জল দৃশ্যমান হয়ে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। বলল, এ কেমন জেদ ডক্টর? আপনি এ কেমন শর্ত দিয়ে দিচ্ছেন?
মিনি ডানা ঝাপটাল। বলতে লাগল, ভুলবে না। আদিকে ভুলবে না। মিষ্টি ভুলবে না।
ইশার কান্নার আওয়াজ এবার দ্বিগুণ হলো। সে আশপাশ দেখল না। শুধু কেঁদেই গেল। আদি চোখের জলগুলো মুছে দিল। বলল, মিষ্টি আমার রাগ উঠছে কিন্তু।
ইশা কান্নাচোখে দেখল আদির চোখ লাল। সে কান্না থামাল।
মিনি বলে উঠল। মিষ্টি ডোন্ট ক্রাই। ডোন্ট ক্রাই।
গানের সুরের মতো করে আবার ডাকল, আদি মিষ্টি। মিষ্টি আদি।

চলবে,
( আপনার মতামত জানাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here