#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা
মৃদুমৃদু নেশায় টলতে থাকা আদি পুতুলটির উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে বিছানায়। লাল বেনারসিটি এক হাতের মুঠোয়। ফোনের ওপাশের মেয়েটি পুরোটা সময় থাকে নীরব। শুধু শুনতে পায় ছেলেটির অস্ফুটভাবে বলা দু একটা শব্দ। কানে বাজে যা অবিরত।
‘মিষ্টি……..
ইশা ফোন কানে চেপে বসে থাকে আর ও একটিবার মিষ্টি ডাকটি শোনার অপেক্ষায়। একপাশে কাত করে শোয়। চোখের কোণা বেয়ে জল গড়ায় কানের কাছে। মিষ্টি করে হেসে সে উচ্চারণ করে,
‘ ডক্টর?
কি আশ্চর্য ওপাশ থেকে শুধু ভেসে আসে নিঃশ্বাসের শব্দ। ইশা হেসে উঠে। ডক্টর ঘুমিয়ে পড়েছে?
পরক্ষণে তার মনে হয় ডক্টর তো প্রত্যেকটা রাতে আইমির সাথে কথা বলে এভাবেই ঘুমোয়। এ আর নতুন কি? হয়ত আজ ও ঠিক সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত তো এমনিতেই ফুরিয়ে আসছে। এভাবেই না হয় কিছুক্ষণ ডক্টরের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে আলাপ করা যাক।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে সে যে কখন ঘুমিয়ে পড়ল নিজে ও জানেনা। যখনি তার ঘুম ছুটে গেল তখন ফজরের আযান ভেসে আসছে। পাশে পড়ে থাকা ফোন দেখে সে ধড়ফড় করে উঠে। ফোনের স্ক্রিন জলে উঠতেই দেখে এখনো কানেক্ট। অজ্ঞাত বশত সে ফোন কানে দেওয়া মাত্রই উচ্চারণ করে,
‘ ডক্টর?
সাথে সাথে ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষালি ঘুম ঘুম কন্ঠে ভেসে আসে একটি শব্দ আবার।
‘ মিষ্টি…..
চোখের জলের সাথে হাসিটা বিস্তৃত হয় ইশার। সে আর কোনোকিছুই বলতে পারেনা। তার আকাশকুসুম কল্পনায় জল ঢেলে দেয় পুরুষালী কন্ঠে ভেসে আসা আর ও একটি কথা।
‘ কে আপনি?
ইশা মুখের বিস্তৃত হাসি ধীরে ধীরে নিভুনিভু হয়ে যায়। হাত কেঁপে উঠে তার। গলা ধরে আসে তার। কি হচ্ছে তা ভেবে উঠতে, বুঝে উঠতে সময় লাগে। যখনি তার বোধগম্য হয় আপনাআপনি তার ফোন হাত থেকে খসে পড়ে।
আদি সেভাবেই বলে যায়,
‘ কে আপনি? কথা বলুন। কে হন আপনি আমার?
ইশা হাত দিয়ে ফোনটি চেপে ধরে। যাতে আওয়াজ না আসে। কিন্তু চাপ পড়ায় ফোনটি লাউড স্পিকার হয়ে যায়। ভেসে আসে আবার ও সেই কন্ঠের আওয়াজ।
‘ আনসার মি। কে আপনি? কার কাছে আপনি চিঠি পাঠিয়েছেন। চৌধুরী বাড়ির সাথে আপনার কি সম্পর্ক?
খাঁচায় থাকা মিনি পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ডেকে উঠে,
‘ আদি। আদি। মিস ইউ। মিস ইউ।
ইশা সাথে সাথে ফোন কেটে দেয়। এলোমেলো সুরে কেঁদে বলে, স্টপ মিনি। তুমি আমার এত বড় ক্ষতি কেন করছ?
ফোন কেটে যাওয়ায় আদির মেজাজ চটে যায়। সে স্পষ্ট মিনির ডাক শুনতে পেয়েছে। তার মানে এই মেয়েটির কাছে মিনি আছে। এই মেয়েটিই মিষ্টি। কিন্তু কে সে? কেন সে লুকিয়ে থাকে?
এতসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় সে আবার ফোন দেয় সেই নাম্বারে। শেষমেশ বিজি দেখায় সেই নাম্বার। আদি মাথা চেপে ধরে জোরে। কাল রাতের কথা মনে হতেই তার নিজের উপর রাগ লাগল। মাথা ভার ভার লাগল। তার সব রাগ, ক্রোধ গিয়ে পড়ল ওই মেয়েটার উপর। মেয়েটার নাম কি যেন? ও হ্যা ওই ইশা নামের মেয়েটির উপর। মেয়েটির সাহস কত? তাকে অত বড় বড় কথা শুনিয়ে দিল। নিজেকে কি মনে করে সে? আদিকে যে পড়তে আসে সে নিজেকে ও পড়তে ভুলে যায়। মেয়েটি কি তা জানেনা? না জেনে, না বুজে মেয়েটি কেন বারবার তাকে হেয় করছে। কেন আদিকে পড়ার চেষ্টা করছে? কেন এমন ভাব নিচ্ছে যেন সে আদিকে পড়ে ফেলেছে। যেখানে আইমিই আদিকে পড়তে জানেনা সেখানে ওই মেয়েটি কি করে পারবে? মেয়েটি ভুল। মেয়েটি আদিকে পড়তেই জানেনা, কিন্তু তারপর ও কেন আদির ভয় হচ্ছে?
ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আদি ঠিক যেভাবে মাথায় দু হাত চেপে বসেছিল ঠিক সেভাবেই আছে। কোনো নড়চড় নেই। যখনি পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রেহান,রাইনার গলার আওয়াজ ভেসে আসছে তখনি তার হুশ ফিরল। নিজের বিছানার এই অবস্থা দেখে সে ভড়কে গেল। পুতুলটিকে নিজের জায়গায় রেখে দিল। লাল শাড়িটিকে বালিশের নিচে চাপা দিল। ছোট্ট কাগজটি একবার দেখে নেয়। চাপা উত্তেজনা নিয়ে আলব্যামটি ঝাড়তে থাকে। যতই ঝাড়তে থাকে, একের পর এক পড়তে থাকে কাগজের টুকরো। পড়ে একটি শুকনো বকুল ফুলের মালা আর কয়েকটি শুকনো বকুল ফুল।
বিস্ময় চোখে আদি শুধু চেয়ে থাকে সেই টুকরো টুকরো কাগজগুলো, বকুল ফুল আর মালাটির দিকে। কাঁপাকাঁপা হাতে সে তুলে নেয় একেকটি কাগজের টুকরো। তুলে নেয় সেই বকুল ফুলের মালা। শাড়িতে লেগে থাকা সুবাস বকুল ফুলগুলো থেকে ভেসে আসছে। চোখ বন্ধ করে হতাশ ভঙ্গিতে সে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
পরক্ষণে চোখ আটকে যায় তার আলব্যামের পাতায় তার কাঁধে মাথা রাখা হাসিমুখের মেয়েটির দিকে। অস্ফুস্বরে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘ ইমি……..
___________________
রান্নার কাজে রাইনাকে সহযোগীতা করছে মিনু। এ বাড়িতে এই একটি মেয়েই মিনুর ভালোলাগার মানুষ। এই মেয়েটার সাথে মনপ্রাণ খুলে সব শেয়ার করা যায়। মিনু তাই করে। ইশার সাথে বলা কথা শুনে রাইনা প্রচন্ড খুশি হয়েছে। এমনকি এ ও বলেছে যে সে নিজেই ইশার সাথে কথা বলবে। কত বছর পর ইশার গলা শুনতে পারবে। মেয়েটা ভালো আছে তো?
মিনু কাজে ব্যস্ত হয়ে জবাব দেয়,
‘ আদি বাবার যদি সব মনে পড়ে যেত? ইশার ছোট্ট সুন্দর একটি সংসার হতো। মেয়েটা ছোট থেকেই নিঃস্ব।
রাইনা মনোযোগ দিয়ে শোনে মিনুর কথা। বলে,
‘ মিনুমা ইশাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে খুব। শুধু একটিবার যদি দেখতে পেতাম?
মিনু হাঁফ ছেড়ে বলে,
‘ দেখে কি করবি? সে কি আগের ইশা আছে? সে এখন আমাদের থেকে পালাতে চায়। জানিনা কি হবে?
দুজনের কথা শেষ হতে না হতেই আদির গলার আওয়াজ শোনা যায়। দুজনই বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে।
টেবিলের দিকে এগোতেই আদির গলার আওয়াজ এবার স্পষ্ট শুনতে পায় তারা। আদির হাতের লাল শাড়ি। হাতে শুকনো বকুল ফুলের মালা। সব চিরকুট।
সে ছুড়ে মারে সেসব আলিয়া চৌধুরীর দিকে। বলে,
‘ এসব কার? কে এই মিষ্টি? কি লুকোচুরি খেলা হচ্ছে আমার সাথে?
আজিজ আর আলিয়া চৌধুরী হতভম্ব হয়ে তাকায় আদির দিকে। কথা বলতে যেন ভুলে যায়। দ্বিতীয় বার আদির চিৎকারে তাদের হুশ ফিরে। আদি চেঁচিয়ে বলে,
‘ দাভাই। রাইনা আপু । তাড়াতাড়ি আসো।
রাইনা দৌড়ে যায়। বলে,
‘ কি হয়েছে আদি? ডাকছিস?
আদি চুপ করে দেখে রাইনার অবাক হওয়া মুখখানা। বলে,
‘ দাভাই কোথায়?
চেহারায় অসম্ভব রকম বিরক্তি ফুটিয়ে আফি তেড়ে এল। বলল,
‘ কি হয়েছে সকাল সকাল? এটা তো ভদ্রলোকের বাড়ি বলে জানতাম।
আদির রক্তিম চোখ চোখে পড়ায় থেমে যায় সে। বলে,
‘ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? কি বলেছি আমি?
আদি শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
‘ কিছুই বলোনি দাভাই। শুধু আমাকে এটা বলো আমার অজান্তে এ বাড়িতে কি হয়েছে। মিষ্টি মেয়েটা কে হয় আমার?
আফি ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায়। বলে,
‘ তোর মা বাবার কাছ থেকে জেনে নে। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছিস? আমি ওসবে নেই ভাই।
আফি গটগট পায়ে হেঁটে চলে যায়। আদি গর্জন করে উঠে। বলে,
‘ কেউ কি বলবে আমায়? রাইনা আপু, মিনুমা….. তাড়াতাড়ি বলো।
রাইনা আর মিনু আড়চোখে তাকায় আজিজ আর আলিয়ার দিকে। আলিয়া এগিয়ে এল। শাড়িটা কেড়ে নিয়ে বলল,
‘ আদি কে মিষ্টি? কোথাকার মিষ্টি? তুমি কার কথা বলছ?
আদির সোজা জবাব,
‘ এই শাড়িটার মালিক। কার শাড়ি এইটা? আমার ঘরে কেন পেলাম? এই বকুল ফুলের মালা কার? আলব্যামের ভাঁজে এত চিঠি কার? কে লিখেছে এত চিঠি? এ বাড়িতে তার দেওয়া চিঠি কি করে আসে? কার হাত দিয়ে আসে? কি করে আসে? এ বাড়ির সাথে নিশ্চয় তার কোনো সম্পর্ক ছিল। এখন ও হয়ত আছে। এতসব প্রশ্নের উত্তর আমি কোথায় পাব?
আলিয়া কুড়িয়ে নেয় সেসব চিরকুট। একেকটা ছিড়ে কুটিকুটি করে ফেলে। আদি হতভম্ব হয়ে বলে, এসব কি করছ মা? আলিয়া সব একে একে ছিড়ে ফেলে। বলে,
‘ মিষ্টি বলতে তোমার জীবনে কেউ ছিল না আদি। না আছে। না থাকবে। কেউ নেই এই নামের।
আদি বিরক্তি নিয়ে বলে,
‘ কিন্তু তার সাথে আমার কথা হয়েছে।
ফোন দেখিয়ে বলে,
‘ এই দেখো অনেকক্ষণ কথা বলেছি। এখন ও মিথ্যে বলবে?
আলিয়া চট করে ফোনটা কেড়ে নেয়। নাম্বারটা ডিলিট করে দিয়ে বলে,
‘ রাতটা ভুলে যাও আদি।
আদি রেগে মাথা চেপে ধরে একহাত দিয়ে। বলে,
‘ কিন্তু এই শাড়ি? এই শাড়ি কেন আমার কাছে? এই বকুল ফুল? মালা।
আলিয়া শাড়িটা কেড়ে নেয়। বলে,
‘ এটা ইমির শাড়ি। তুমি ইন্ডিয়াতে কিনেছিলে ইমিকে দেবে বলে। এখনো দাওনি কেন?
‘ কিন্তু এটাতো বিয়ের শাড়ি মনে হচ্ছে। এত ভারী শাড়ি ইমি এমনিএমনি কেন পড়বে?
‘ এমনিএমনি প্রশ্নটা কেন আসছে আদি? তুমি দেবে তাই পড়বে। আইমি তোমাকে কতকিছু দেয়,তুমি কি ফেরত দাও? ও তোমাকে ও দেবে না। ওঁকে দিয়ে দিও শাড়িটা।
আদি চিন্তিত হয়ে বলে,
‘ কিন্তু মিষ্টি? তুমি জানো আমি মিনির ডাক শুনেছি। মিষ্টি সত্যিই আছে। কেন বিশ্বাস করছ না?
আজিজ চৌধুরী এবার আর চুপ করে থাকলেন না। বললেন,
‘ হ্যা আছে। মিষ্টি সত্যিই আছে। কিন্তু সে বিবাহিত।
আদি চমকায়। বলে, বিবাহিত?
আজিজ হেঁটে আদির কাছে আসে। বলে,
‘ মিষ্টি বিবাহিত।
‘ কিন্তু তার সাথে আমার, এই বাড়ির কি সম্পর্ক?
আজিজ চৌধুরী মিথ্যে রটালেন। মিথ্যে বললেন,
‘ তোমার দেখাশোনা করার জন্য তাকে রেখেছিলাম। সে অন্যজনের স্ত্রী। টাকার বিনিময়ে রেখেছিলাম তাকে। শুধু তোমার দেখাশোনা করত অন্যকিছু নয়।
আদি অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে যায়। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ টাকার জন্য? বিবাহিত? এটা কেমন কথা বাবা? আমি বিশ্বাস করছিনা। আমার প্রমাণ চাই। তার ঠিকানা দাও। যতক্ষণ না তার মুখ থেকে শুনছি ততক্ষণ আমি এসব বিশ্বাস করছিনা।
আজিজ ত্যাড়া জবাব দিলেন। বললেন,
‘ ঠিকানা দিতে পারব না। তার স্বামী সংসার আছে। ঠিকানা দেওয়া বারণ।
আদি রেগে চিৎকার করে উঠে। বলে,
‘ বিবাহিত একজন মেয়েকে কেন আমার দেখাশোনার জন্য রাখবে তোমরা? মেয়ে কি কম পড়েছে? তার সাথে তো আমি দেখা করেই ছাড়ব।
আলিয়া দায়সারাভাবে বলে,
‘ তুমি তখন কাউকেই সহ্য করতে পারতেনা। না আমাদের না ইমিকে। নার্স ও রেখেছিলাম একজন। তা ও তোমার রাগের কারণে থাকেনি। কোনো উপায় না পেয়ে আমরা তাকে রেখেছিলাম। তখন আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না আদি।
আদি কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ে। চোয়াল শক্ত করে সে তাকায় মিনুর দিকে। এগিয়ে যায়। বলে,
‘ মিনুমা তুমি অন্তত চুপ থেকোনা প্লিজ। সত্যিটা আমায় বলো। ঠিকানা দাও তার। আমি দেখা করতে চাই।
মিনু চোখ তুলে তাকায় আদির দিকে। পেছনে চোখ যায় তার। আলিয়া চৌধুরীর চোখের ভাষা বুঝে চুপ হয়ে যায়। বলে,
‘ আমি একদমই জানিনা সে কোথায় থাকে। জানলে বলে দিতাম।
আদি যেন এবার ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাথার দুদিকে হাত দিয়ে চেপে ধরে। বলে, কে বলবে আমায়? মিনিকে কোথায় পাব আমি?
ইমি! হ্যা ইমি। ইমিই বলতে পারে তার ঠিকানা কোথায়? দৌড়ে বেরিয়ে যায় আদি বাড়ি থেকে। তার পিছু পিছু ধাওয়া করে আজিজ চৌধুরী কোনো লাভ হয়না। আদি গাড়ি নিয়ে চলে যায়। আলিয়া ফোন লাগায় আইমিকে। আদি এসব কি শুরু করেছে। আজিজ চৌধুরীর মাথায় রক্ত টগবগ করে ফুটে। কতবড় সাহস মেয়েটি এ বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছে। আবার যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছে? এর শেষ দেখে নিতে হবে? এত লোভী মেয়েটা?
__________________________
এভাবে হনহন করে আদিকে আসতে দেখে আইমি প্রথমে ভড়কে গেল। আদি যখনই তার সামনাসামনি এসে দাঁড়াল। আইমি দুষ্টুমি করে বলল,
‘ আজ সোজা বাড়িতে? এনি প্রবলেম?
আদি প্রথমেই একটু নিশপিশ করল। তারপর অনেকক্ষণ পর বলল,
‘ ইমি খুব জরুরী প্রয়োজনে এসেছি। আমাকে তুমি সত্যিটা বলবে।
আইমি কিছু বলার আগে দেখে তার ফোন বেজে উঠেছে। ধরতে গিয়ে দেখে অলরেডি অনেক বার লিয়া আন্টির ফোন থেকে কল এসেছে। আদি তো এখানে। কেন কল দিচ্ছে।
আদি তার ফোন কেড়ে নেয়। বলে,
‘ ইমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে তুমি। প্লিজ।
আইমি সামনাসামনি দাঁড়ায়। বলে,
‘ বলুন কি বলবেন।
আদি কোনোরূপ ভঙ্গিমা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে,
‘ মিষ্টির ঠিকানা চায় আমার। ইমি আমাকে প্লিজ তার ঠিকানা দাও।
আইমি যেন কানে ভুল শুনল। আদির মুখে মিষ্টি নামটি আবার? এই বৃষ্টি, মিষ্টি নামগুলো পঁচে গলে যায়না কেন? আইমির হাসিহাসি চোখ ছলছল করে উঠে। বলে,
‘ আদি কে মিষ্টি?
আদি অবাক হয় ইমির চোখ দেখে। বলে,
‘ ইমি কেন এমন করছ? দেখো, ঠিকানা জানাটা আমার খুব প্রয়োজন। তার সাথে আমার দেখা করতে হবে। সত্যিটা আমার জানতেই হবে ইমি।
আইমির চোখের জল দৃশ্যমান হয়। সে চট করে মুছে নেয়। বলে,
‘ তুমি আমায় অবিশ্বাস করছ আদি। আমি জানলে কি তোমায় বলতাম না?
আদি হতাশ হয়। ইমির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,
‘ ইমি তুমি কেন কাঁদছ? আমি কিন্তু এই ইমিকে সত্যিই চিনিনা। এত ছিঁচকাঁদুনে কখন হলে তুমি? আমি শুধু ঠিকানা জানতে চেয়েছি।
আইমি আদির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলে,
‘ আমি এসব কিছুই জানিনা আদি। শুধু জানি টাকা দিয়ে একটি মেয়েকে রেখেছিল তোমার দেখাশোনা করার জন্য। এর বেশি কিছুনা।
আদি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। বলে,
‘ মিনি তার কাছে ইমি। মিনির জন্য বলেছিলাম। মিনিকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য বলেছি। তুমি অযথা রাগ করছ।
আইমি ফুঁপিয়ে উঠে কান্না থামিয়ে দেয়। বলে, আমি রাগ করিনি আদি। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো সেটাই আমাকে কষ্ট দেয়।
আদি অনেকক্ষণ পর হাসে। আইমিকে টেনে তার সামনে নিয়ে আসে। গলা একপাশে কাত করে বলে, তুমি রাগলে আমার কষ্ট হয়।
আইমি চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। বলে,
‘ কষ্ট? ডং।
আদি হেসে উঠে। বলে,
‘ ডং না সত্যি। তিন সত্যি। ইমি রাগ করলে সত্যিই আদির কষ্ট হয়।
আইমি দুম করে কিল বসায় আদির বাহুতে। আদি লাফিয়ে উঠে। বলে,
‘ ব্যাথা পেয়েছি ইমি!
আইমি তাকে বিদ্রূপ করে বলে,
‘ ব্যাথা পেয়েছি ইমি।
দুজনই একসাথে হেসে উঠে। আফাজ আহমেদ দরজায় টোকা দিয়ে নক করলেন। দুজন দুজনের কাছ থেকে দূরে ছিটকে আসে। আদি মাথা চুলকিয়ে বলে,
‘ আন্কেল আপনি? আসুন।
আফাজ আহমেদ ঘরে ডুকে। বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে বলে,
‘ বিয়ের আগে আমার মেয়ের বেডরুমে আমি কাউকে এলাও করিনা কিন্তু।
সবাই কিছুক্ষণ চুপ থাকে। বিষয়টা বোধগম্য হতেই তিনজনই খিলখিল করে হেসে উঠে। আদি বলে,
‘ কাউকে এলাও না করলে ও আদিকে করতেই হবে কিন্তু।
আইমি হেসে উঠে। আফাজ আহমেদ বলে,
‘ আগামী মাসের দিকে এনগেজমেন্ট হবে। আইমির চাচ্চু আর কাকিরা ও আসবে। ছোট্টখাট্টো একটা ফাংশন হবে। তার কয়েকদিন পরপরই বিয়ে। দুজনেই রেডি তো?
আইমি চোখ তুলে তাকায় আদির দিকে। আদি তাকাতেই সে লজ্জায় পড়ে যায়। আদি সামান্য হেসে বলে,
‘ তারিখ ও ঠিক করা হয়েছে? আমাকে তো জানানো হয়নি।
আফাজ আহমেদ আর আইমি অবাক হয় আদির কথায়। বলে, তুমি রেডি নও।
আদি আইমির দিকে তাকায়।
বলে, অন্য কোনো ব্যাপার নেই। আমার বন্ধুমহলের কাউকে জানানো হয়নি তাই বলছিলাম।
আইমি বলে,
‘ এখনো তো অনেক সময় আছে আদি। জানাতে পারবে।
আদি বলে, হ্যা সময় আছে। জানি। সবাইকে বলে দিতে হবে।
আফাজ আহমেদ আর আইমিকে অবাক করে দিয়ে আদি চলে যায়। বলে যায়, আমাকে একটা কাজে বেরোতে হবে। অনেক কাজ। ইমি ফোন দেব তোমায়।
______________________
মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো প্লাস্টিকের ঘোড়া, বক, পুতুল। তুলোর টেডিবিয়ার। গাড়ি। নানারকম খেলনা। মাঝখানে বসা পরী। তারপাশ ঘেষে পাউরুটির টুকরো ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে মিনি। ঝগড়া করার পরে আবার ও দুইজন খুব ভালো বন্ধু। এ কয়দিনে দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমেছে। ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো কপালের সামনে এসে পড়ায় মেয়েটি হাতের মুঠো দিয়ে সরিয়ে দেয় চুলগুলো। আবার সামনে এসে পড়ে। পাশে থাকা টিয়ে পাখিটির দিকে তাকিয়ে ডাক দেয়,
‘ মিননি…….
মিনি আওয়াজ করে খেতে খেতে। কথা স্পষ্ট নয়। খাওয়া শেষে ডেকে উঠে,
‘ প্রিন্সেস……. প্রিন্সেস
পরী খিলখিল করে হেসে উঠে। গায়ের পড়নে লাল সাদা মিশেল ফ্রকটির কোণা মিনিকে দেখিয়ে দেয়। যার উদ্দেশ্য খেয়ে এখানে মুখ মুছে নাও। যেভাবে তার মাম্মা তাকে ওড়নার কোণা দিয়ে মুখ মুছে দেয়। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব খেয়াল করছে তালহা আর জহির মিয়া। দুজনই পরীর কান্ড দেখে হাসে। ডাকে,
‘ দাদুমণি….
পরী ডাগর ডাগর চোখদুটো পাকিয়ে তাকায়। আবার মাথা নিচু করে খেলায় মনোযোগী হয়ে বলে,
‘ দাদ্দা…..
তালহা এগিয়ে এলেন। পরীর পাশে বসে পড়লেন। বললেন,
‘ দাদুমণি খাবেনা?
পরী দুপাশে মাথা নাড়ায়। মিনি ডেকে উঠে,
‘ খাব, খাব।
তালহার ধমকে চুপ হয়ে যায়।
‘ জিজ্ঞেস করছি কাকে বলছে কে? রাক্ষসী পাখি একটা।
মিনি খেতে খেতে মিনমিন করে ডাকে,
‘ বুড়ড়ি ব্যাড গার্ল। ব্যাড গার্ল।
তালহা শোনে। রেগেমেগে মিনিকে ধমক দেওয়ার আগেই পরী ডাকে,
‘ মিননননি……
জহির মিয়া হেসে উঠে। বলে,
‘ পরীর জন্য কিছু বলতে পারবে না। পরী তো মিনির বেস্ট ফ্রেন্ড।
মিনি খেয়ে ডানা ঝাপটায়। ডাকে, বেস্ট ফ্রেন্ড। বেস্ট ফ্রেন্ড।
তালহা বেগম রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে মিনির দিকে। পরী হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঢলে ঢলে হাঁটতে হাঁটতে তালহার গা বেয়ে উঠে। দু গালে হাত দিয়ে আদর করে। নাকের সাথে নাক দুম দুম করে বাড়ি খেতে খেতে ডাকে,
‘ দাদ্দা,, দাদ্দা।
জহির মিয়া হো হো করে হেসে। তালহা বেগমের মুখে প্রশান্তির হাসি। জহির মিয়া দুচোখ ভরে দাদু নাতনীর কান্ড। তালহার একমাত্র দুর্বল জায়গা এই ছোট্ট মেয়েটি। এতটা ভালোবাসে তালহা মেয়েটিকে। পরী জহির মিয়ার কোলে চলে আসে। জহির মিয়ার দাড়ি টেনে দেয়। খিলখিল করে হাসে। জহির মিয়া যখন রাগ করার মতো চেহারা করে রাখে তখন পরী মুখ কালো করে ফেলে। গালে গাল লাগিয়ে ডাকে,
‘ দাদ্দা,,,
জহির মিয়া নিজেই হেসে উঠে হো হো করে। পরী ও হেসে উঠে।
মুনা হাতে ছোট্টখাট্টো একটা বাটিতে করে খাবার নিয়ে আসে। বলে,
‘ পরী খাবে। আসো।
‘ পরী দুপাশে মাথা নাড়ায়। ঠোঁট বাকায়। সিড়িতে দাঁড়িয়ে দুটো চোখ দেখে পরীর ঠোঁট বাকানো। পরীর রাগ। সেই রাগী চাহনী। কতটা মিল?
মুনা নরম কন্ঠে বলে,
‘ না খেলে মিনি কথা বলবে না তোমার সাথে। কেউ বলবে না। খেলবে ও না। এসো।
পরী জহির মিয়ার গলা ধরে পেছনে মুখ করে রাখে। বলে,
‘ নান নান না।
জহির মিয়া হাসে। বলে,
‘ রিককে পাঠাও। ও খাওয়াতে পারবে।
মুনা বলে, ও অফিসে বেরোবে। কি করে,,,,,,,
ইশার পাশ ঘেষে নিচে নেমে আসে রিক। অফিসের ড্রেস পড়া। মুনার হাতের বাটির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ এখনো খায়নি।
মুনা দুপাশে মাথা নাড়ায় অসহায় হয়ে। রিক শক্ত চাহনি নিয়ে তাকায় মুনার দিকে। মুনা মাথা নামিয়ে নেয়।
রিক পরীর কাছে এগিয়ে যায়। পরী বেজায় খুশি। বাবার কোলে জাপটে পড়ে। গলা ধরে ডাকে গালে আদর বসিয়ে বলে ,,,পাপপপপা।
রিক হেসে বলে,
‘ মাই প্রিন্সেস না খেলে পাপপপা রাগ করবে। আড়ি দেবে।
পরী কি বুঝল কে জানে। রিকের মুখে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে করতে মুখ দিয়ে বের করে কয়েকটা এলোমেলো শব্দ। কোনোকিছুুর কোনো অর্থ নেই।
রিক মুনার কাছে নিয়ে যায় পরীকে। ইশারায় বলে খাইয়ে দিতে। রিক মিনিকে দেখিয়ে বলে, ওই দেখো মা মিনি খাচ্ছে। তুমি ও খাও। কি মজা!
পরী হাসে। মুনা তার ফাঁকে খাইয়ে দেয়। পরী মিনির সাথে তাল মিলিয়ে খেতে খেতে ডাকে,
‘ মিনননি……..
রিক এদিকওদিক হাঁটে পরীকে নিয়ে আর হাতে পড়া কব্জির দিকে তাকিয়ে ঘড়ির টাইম দেখে। মুনাকে বলে, আর ও কয়টা খাইয়ে দাও। আমার আর ও সময় আছে।
পরী খেতে খেতে দূরে দাঁড়ানো ইশাকে দেখে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় রিককে। বলে,, ফিপপপফি,,,
ইশা দূরে দাঁড়িয়ে হাসে। মাথা দুলিয়ে বলে,, কি মজা! কি মজা!
পরী খেতে খেতে ইশার মত করে মাথা দুলায়।
মিনিকে দেখিয়ে দেয় ইশাকে। বলে,,, ফিপফি মিননি……..
ইশা হাসে।
পরী খাওয়া শেষে রিকের ঘাড়ে মুখ মুছে নেয়। মুনা হায় হায় করে বলে, এটা কি হলো? এখন কি হবে? আপনার ড্রেসে তো পরী,,,,,
রিক ঘাড় হাত দিয়ে মুছে ফেলে বলে,
‘ কিছু হবেনা। আমি পানি দিয়ে মুছে নেব।
পরীর ঠোঁট ফুলিয়ে তাকায় রিকের দিকে। যার অর্থ মাম্মা এভাবে কেন বলবে? সে রাগ করেছে।
রিক হেসে দেয় দেয় পরীর কান্ডে। বলে,
‘ রাগ করেছে আমার মা?
পরী মাথা দুলায়। তারপর রিককে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মুনাকে। বলে, উফ।
মুনা হেসে উঠে। বলে,
‘ বাবাকে পেলে তার আর কাউকে লাগেনা। আবার অভিযোগ কত?
রিক ও হেসে দেয়। পরী লেগে থাকে রিকের সাথে। যেন সে আন্দাজ করতে পেরেছে রিক এখন তাকে রেখে চলে যাবে। কোর্ট শক্ত করে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। তারপর মাথা ফেলে রাখে রিকের কাঁধে। ইশার পাশ কেটে রিপ নেমে আসে। জিজ্ঞেস করে, খেয়েছিস ইশু?
ইশা হ্যা বলে জবাব দেয়। রিপ এগিয়ে আসে পরীর দিকে। বলে, পরীমা কই? খেয়েছে?
পরী মাথা তুলে রিপের দিকে ফিরে। ডাকে, রিইইইই……
উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠে। রিপ মুখ কালো করে বলে, দাভাই দেখেছ তোমার মেয়ে আমাকে নাম ধরে ডাকে। ডাকে তো ডাকে। সুন্দর করে ও ডাকে না। রিইইইই কারো ও নাম হয়?
ইশা নিচে নেমে আসে। সামান্য হেসে বলে, তোমাকে রিইইই ডাকছে রিপুদা । কাল আমাকে রেগে কি ডেকেছে জানো? শাআআআ,,
আমার নাম নাম কি শআআআআ?
আরেকদফা হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল। রিক কথার ফাঁকে রিপকে ইশারা করল পরীকে কোলে নিয়ে নেওয়ার জন্য। রিপ ভুলিয়ভালিয়ে কোলে নিয়ে নেয়। যখনি পরী বুঝতে পারল রিক তাকে আদর করার কারণ,,, রিপের চুল টেনে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়। রিপ ওরেব্বাপ বলে ঘোরাতে থাকে পরীকে।
রিক হেসে বেরিয়ে যায়। এসব অফিস টফিস কেন থাকে কে জানে? সারাক্ষণ মেয়ের সাথে সময় কাটাতে পারলে কতই না ভালো হতো।
পরী ঢোক তুলে তুলে কাঁদে। অনেক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে যায়। মাথা ফেলে রিপের কাঁধে। তাকায় আড়চোখে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ইশার দিকে। ইশা ইশারায় হাসতে বলে। পরী মুখ ফিরিয়ে রাখে অন্যদিকে। ইশা কেন কোলে নিচ্ছে না তাকে? পরী কিছুক্ষণ পর আবার তাকায় ইশার দিকে। কিন্তু তারপরে ও ইশা তাকে কোলে নিচ্ছে না। রিকের ঘাড়ে জোরে চেপে ধরে মুখ। ই, ই, ই, ই শব্দ বের হয় মুখ দিয়ে। রাগে। অবহেলায়। চোখের জলে ভেসে যায় রিপের কাঁধ।
ইশা তা দেখে হাসে। পরী আড়চোখে দেখে ইশার হাসি। আবার ও ঢোক তুলে কাঁধে। জোরে কামড় বসায় রিপের কাঁধে। রিপ চেঁচিয়ে উঠে। ইশার কোলে দিয়ে দেয় তাকে। বলে,
‘পরী রিইই ব্যাথা পেয়েছে। তুমি ব্যাথা দিয়েছ।
পরী কাঁদতে কাঁদতে ইশার চুল টেনে ধরে। ওড়না টেনে ধরে। গলার কাছে গিয়ে জোরে কামড় বসায়। সর্বশক্তি দিয়ে। ছোট্টছোট্ট নখগুলো দিয়ে আঁচড় কাটে ইশার গলায়। দাঁত বসিয়ে দেয় গলায়। সবাই পরীকে ছাড়িয়ে নিতে যেন ভুলে যায়। ইশা ও ছাড়ায় না। তার চোখ বেয়ে শুধু হঠাৎ করে জল গড়ায়। পরী তার রাগ মিটিয়ে ইশার মুখের দিকে তাকায়। ইশার চোখে জল দেখে আর ও জোরে কাঁদে। মুখে মুখ লাগিয়ে তারপর আবার আদর করে। ডাকে,,, আমমমমা।
রিপ অবাক হয়ে দেখে ইশা আর পরীর কান্ড।
এগিয়ে যায়। পরীকে কোলে নিয়ে নেয়। চোখেমুখে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে বলে,
এই ইশু তুই কাঁদছিস? তুই বেশি ব্যাথা পেয়েছিস? পরী কি করেছ তুমি এটা?
পরী চোখ বড় বড় করে তাকায় ইশার দিকে। ইশা হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘ না ব্যাথা পাইনি। আর ও বেশি দেওয়া উচিত ছিল।
_____________________________
আকাশে মৃদুমৃদু মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টি নামবে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া অলরেডি শুরু হয়ে গিয়েছে। রিকশায় বসে তার বাড়ি ফেরার তাড়া। ইশা রিকশাচালককে বলে,
‘ মামা একটু তাড়াতাড়ি যাবেন। ছাতা আনিনি আজ। ভিজে যাব নয়ত। যাচ্ছি ও।
রিকশাচালক তার নিয়মেই চালায়। মেঘ ধীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে চারদিকে। তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় রত। ইশার চিন্তা বেড়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজলে তার জ্বর সর্দি লেগে যায় সাথে সাথে। জ্বর বাড়লে আনুষঙ্গিক ব্যামোগুলো ও বেড়ে যায়। বিছানা থেকে উঠতে ও তখন কষ্ট হয় খুব।
রিকশা চলতে থাকে। নীরা অর্পি আজ আসবে না জানলে সে ও আসত না। তাদের দুজনকে ছাড়া ক্লাসে ও মনোযোগ বসেনি আজ। তারা জানত বোধহয় আজ বৃষ্টি নামবে। বিরক্তিকর।
ঝিরঝির বৃষ্টি রূপ নেয় মুষলধারায়। রিকশাচালক ভিজে জবজবে হয়ে যায়। ইশার বিরক্তি নিয়ে বৃষ্টিকে বকে। আর আসার সময় পেলনা।
আঁকাবাকা করে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা দেখে হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় একটি কথা। একটি চিরকুটে সে লিখেছিল, ডক্টরের সাথে বৃষ্টিবিলাসের কথা। এমন একটা দিন আসবে। চারদিকে নির্জন,নিস্তব্ধ পরিবেশ থাকবে। হয়ত রাত, হয়ত দুপুর,নয়ত বিকাল। বৃষ্টির ঝুপঝুপ শব্দের সাথে বাজবে তার নুপূরের রিমঝিম শব্দ। পড়নে থাকবে তার সাদা শাড়ি। বকুল গন্ধের ভরপুর থাকবে পরিবেশ। ডক্টর বকুল ফুলের মালা পড়িয়ে দেবে তার গলায়। বকুল দিয়ে ছুঁইয়ে দেবে তার নাক। সে লজ্জায় তখন নতবদনে হাসবে। ডক্টর সেই আগের ভোলাভালা চাহনি দিয়ে তাকাবে তার দিকে। পড়নে থাকবে সাদা ধবধবে পান্জাবী। চুলগুলো থাকবে কপালের কাছে ছড়ানো ছিটানো। খুব সযত্নে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি রেখে বলবে,
‘ মিষ্টি,,,,, এই মন কেমনের বৃষ্টি আমাদের। এই বৃষ্টিবিলাস আমাদের। তোমার আমার। আদি মিষ্টির।
সেই চিরকুট তো ডক্টরের আর দেখা হলোনা। দেখলে কি একটা বাজে পরিস্থিতি হতো। ভালোই হয়েছে সরিয়ে ফেলেছে মিনুমা। ডক্টর তো এখন আইমির সাথে বৃষ্টিবিলাস করবে। এখন আইমিকে বলবে,
‘ ইমি এই বৃষ্টিবিলাস আমাদের। এই মন কেমনের বৃষ্টি আমাদের। আমার তোমার। আদি ইমির।
ইশা হেসে উঠে। রিকশা চলতে থাকে। তার আবার ও মনে পড়ে তিনবছর আগের ডক্টরের বলা সেই কথা।
‘ মিষ্টি,,, এই আদি,এই ডক্টর তোমায় ভালোবেসেছে। কিন্তু তুমি বাসোনি। কখনোই ভালোবাসোনি।
তুমি কষ্ট পাবে। খুব কষ্ট পাবে। ঠিক আমার মতো। ধুঁকে ধুঁকে মরবে। কাউকে দেখাতে ও পারবেনা, কাউকে বোঝাতে ও পারবেনা তোমার কষ্ট। তোমার যন্ত্রণা।
বৃষ্টির আওয়াজের সাথে মিশে যায় তার ডুকরে কেঁদে উঠা। ডক্টর এই কোন ধরণের অভিশাপ দিল তাকে? এত বড় অভিশাপ ডক্টর কি করে দিতে পারল? এই শাপের বোঝা আর কত বইতে হবে। এবার সে ক্লান্ত। মিষ্টি এবার খুব ক্লান্ত। ডক্টর কি কখনো এই ক্লান্তির গ্লানি মুছে দিতে আসবে না?
মিষ্টি যে ডক্টর নামক রোগটিতে আক্রান্ত হতে হতে নিঃশেষ হওয়ার পথে। ডক্টর কি করে অন্য কারো সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে? ডক্টর যদি একটিবার খোঁজ নিত তাহলে খুঁজে পেত, তার খুব সুন্দর একটা পৃথিবী আছে। সেই পৃথিবীতে তার একটি রাণী আর একটি রাজকন্যা আছে। ডক্টর কেন খোঁজ নেয় না।
আনমনা হয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে যখন সে মগ্ন তখন চোখ যায় তার দূরে। রাস্তার মাঝখানে। শাড়ি পড়া মেয়েটি দুহাত মেলে চরকির মতো ঘুরছে। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। ছেলেটি হাত ধরে টান দিল। থামানোর চেষ্টা করল। মেয়েটি তারপর ও ঘোরা বন্ধ করল না। থামল না। ছেলেটি শেষমেশ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটির কান্ড দেখতে লাগল। ইশা রিকশাচালককে থামিয়ে দেয়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নেমে যায়। রিকশাচালক বলে,
‘ আর ও পথ বাকি আছে।
ইশা বলে,
‘ পথ আজ এখানেই থামুক।
ভাড়া মিটিয়ে সে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা ধরে।
আদি ক্লান্ত ভঙ্গিতে গাড়িতে হেলান দেয়। বলে, চাকা পাঞ্চার হওয়ার আর সময় পেলনা। বিরক্তিকর।
আইমি শাড়ির আচঁলে পানি কুড়ায়। আদিকে ডেকে বলে,
‘ আদি ভালোই হয়েছে বৃষ্টি এসেছে। সাথে চাকা ও পাঞ্চার। মাঝরাস্তায় বৃষ্টিবিলাস। উফ দারুণ।
আদি হাসে। বলে, ‘ ইমি জ্বর সর্দি বাঁধালে বলোনা। আদি আমার জ্বর উঠেছে। সর্দি পেয়েছে।
আইমি হাসতে হাসতে ঘোরে। শাড়ির আঁচলের সবটুকু পানি নিয়ে আদির সামনে এসে দাঁড়ায়। আদি তখন গাড়িতে মাথা রেখে হেলান দেওয়া। আইমি দুষ্টুমি করে সব পানি ছুড়ে মারে আদির দিকে। আদি হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে।
বলে,ইমি কি করছ?
ইমি খিলখিল করে হেসে উঠে। আদি দেখে সেই হাসি। আইমি শাড়ির আঁচলের পানি আবার ছুড়ে মারার আগে আদি খপ করে ধরে ফেলে তাকে। আইমি হকচকিয়ে যায়। বলে, ছাড়ো।
আদি হাসতে হাসতে বলে, ভয় পেলে?
আইমি মাথা নেড়ে বলে, একদম না।
আদি হেসে আইমিকে ঘুরিয়ে নেয়। লজ্জায় কুঁকিয়ে উঠে আইমি। আদি শাড়ি জড়িয়ে দেয় ইমির গায়ে। পকেট থেকে বের করে একমুঠো বকুল ফুল। কানে বেজে উঠে,
‘ যখনি আপনি মিষ্টিকে মনপ্রাণ দিয়ে খুঁজবেন তখনি গিয়ে দাঁড়াবেন বকুল তলায়।
বকুল ফুলের সুবাসে আপনি মিষ্টিকে খুঁজে পাবেন। মিষ্টিকে অনুভব করতে পারবেন।
সে সত্যিই গিয়েছিল আজ বকুল তলায়। অনুভব করতে পেরেছে কিনা কে জানে? কিন্তু এই বকুল ফুলগুলো পেয়েছে। মিষ্টি তো অন্যকারো। ইমিকে দিলে কেমন হয়? আইমি নড়েচড়ে উঠে। বলে, কি করছ আদি?
আদি পুরোটা সময় নিশ্চুপ। বকুল ফুলগুলো একে একে আইমির ভেজা চুলে গেঁথে দেয়। অনেকক্ষণ সময় লাগে। আইমি যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছিল পুরোটা সময়। আদির দিকে হুট করে ফিরল।
বলল, আমার জন্য?
আদি মাথা হেলিয়ে হ্যা জানাল। আইমি হাসল। তৃপ্তির হাসি। প্রশান্তির হাসি। আলতো করে সে মাথা রাখল আদির বুকে। মন কেমন করা ভালোবাসায় ডুব দিয়ে উচ্চারণ করল,
‘খুব,খুব ভালোবাসি আদি।
আদি কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করল। আইমিকে ধরতে চাইল। দু হাত বাধার আগেই চোখ যায় দূরে দাঁড়ানো একটি মেয়ের দিকে। যদি সে খুব কাছ থেকে, খুব গভীরভাবে অনুভব করার চেষ্টা করত তাহলে বুঝতে পারত কি পরিমাণ যন্ত্রণা হচ্ছে মেয়েটির। কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে। কি পরিমাণ তোলপাড় হচ্ছে তার বুকে। এ কখনোই তার ডক্টর নয়। ডক্টর কখনোই মিষ্টিকে ছাড়া অন্যকাউকে তার বুকে মাথা রাখতে দেবেনা। কখনোই অন্য কারো চুলে বকুল ফুল গুজে দেবেনা। অন্যকাউকে এত কাছে ঘেষতে দেবেনা। কখনোই না। এ কখনোই তার ডক্টর নয়। হতেই পারেনা। ডক্টর কখন এত পাষাণ হলো?
বৃষ্টিজলে ধুয়ে মুছে যায় মেয়েটির চোখের নোনাজল। তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে বারবার। গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ পৌঁছায় না ডক্টরের কানে। পৌঁছায় না নীরব অনুভূতিদের আর্তনাদ। পৌঁছায় না নীরব কান্নার আওয়াজ। পৌছাই না দীর্ঘশ্বাস। মেয়েটি খেয়াল করে তার দিকে দৌড়ে দৌড়ে আসছে একটি ছেলে বাইক থেকে নেমে। ছেলেটির হাতে ছাতা। ছেলেটি তার সামনাসামনি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ তুই এখানে কেন? রিকশা থেকে এখানে নেমে গিয়েছিলি? দেখ কিভাবে ভিজে গেছিস। জ্বর সর্দি বাঁধিয়ে বসবি। সবার রাতের ঘুম হারাম করবি। তোর কি একটু ভালো থাকতে ইচ্ছে করেনা? ভালো রাখতে ইচ্ছে করেনা? কেন এমন তুই?
মেয়েটি খেয়াল করে এই আদুরে শাসন শুনে তার চোখের জল আর বাধা মানছেনা। এ কাকে ঠকিয়েছে সে? যে মানুষটা তাকে নিয়ে এতটা ভাবে। সে ডুকরে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে।
রিপ হকচকিয়ে যায়। বলে,
‘ এই ইশু কাঁদছিস কেন তুই। এই ইশু।
ইশা কেঁদে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়ে ছেলেটির বুকে। বলে,
‘ রিপুদা আমি অন্যায় করেছি। তুমি আমাকে শাস্তি দাও। আমাকে মেরে ফেলো।
রিপ ছাতা মেলে ধরে। মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে বলে,
‘ যতবার ঝড় আসবে আমি ঢাল হয়ে দাঁড়াব তোর পাশে। যতবার ভুল করবি আমি শুধরে দেব। যতবার দূরে যাবি ততবার কাছে নিয়ে আসব। কিন্তু কখনো আমায় পর করে দিস না। আমার সব আপনজনের মাঝে তুই আমার খুব খুব প্রিয় একজন। আমাকে ছেড়ে কখনো যাস না। কখনো আঘাত দিসনা। তোর দেওয়া আঘাত আমি সহ্য করতে পারব না। আমি মরে যাব।
কান্নার আওয়াজ বৃষ্টির আওয়াজে মিলিয়ে একাকার হয়ে রিপের আকুতি। মেয়েটি শুনল কিনা কে জানে? অপরাধবোধ তার জাগ্রত হয় ধীরে ধীরে। কেন রিপদা তার কাছ থেকে এতকিছু আশা করে সে বুঝে পায়না। সে শুধু জানে এই মানুষটি তার ভরসাস্থল। তার আশ্রয়। তার একজন ভাই।
এমন এক বৃষ্টির দিনে আবার ও দুই বন্ধুর দেখা। রিপের পেছনের মেয়েটিকে গলা কাত করে দেখে আদি। আইমি ও। তার পায়ের তলার মাটি যেন সরে যায়। এতবছর পর এই মেয়েটা আবার তার আর আদির সামনে। দেখে মনে হচ্ছে এখনো ছোট্ট একটি মেয়ে। কলেজে পড়ে। ইশা গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে রিপের পেছনে। রিপ বকবক করে আদির সাথে। আদি ও বলে। আড়চোখে ওই মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করে।
কথা বলা শেষ করে রিপ বাইকে গিয়ে বসে। ইশা ধীর পায়ে হেঁটে যায় রিপের পিছু পিছু। থমকে দাঁড়ায়। চোখ তুলে তাকায় আইমির দিকে। আইমির চোখে ভয় দেখে সে তাচ্ছিল্যর হাসি হাসে। তার চোখে হাসি দেখে আইমি যেন স্বস্তি পেল। আদির হাত শক্ত করে ধরল। আদির বাহু ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মাথা রাখল।
ইশা আর পিছু ফিরেনা। গটগট পায়ে হেঁটে উঠে বসে বাইকের পেছনে। রিপ বলে,
‘ ভালো করে বোস।
ইশা বসে। ছেলেটির কাঁধে হাত রাখে। বাইক ছেড়ে দেয়। চলে যায় বহুদূর। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয় ডক্টর। ডক্টরের সেই চাহনি।
আদি অবাক চোখে তাকায় বাইকটি চলে যাওয়ার দিকে। দেখতে দেখতে একসময় বিলীন হয়ে যায় সেই বাইক।
ইশা কিছুদূর যেতে না যেতেই আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। ছেলেটির পিঠে মাথা রাখে। কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠে। কিছুদূর যেতে না যেতেই ছেলেটি বাইক কষে। মেয়েটি ভড়কে যায়। ছেলেটি মেয়েটির দিকে ফিরে বলে,
‘ এভাবে ধরিস কেন ইশু? আমি বাইকে চালাতে মনোযোগ দিতে পারছিনা। এভাবে ছুঁবিনা আমায়।
আদি হাঁটা ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে। আইমি তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারেনা। বলে, আদি আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল।
আদি হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়।
‘ আজ আর কোথাও যাব না ইমি। আমার শরীর খারাপ লাগছে। হঠাৎ করে। যা অপ্রত্যাশিত। এমনটা হওয়ার কথা ছিলনা।
চলবে,