#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৮ + ১৯
#পুষ্পিতা_প্রিমা
ইশা গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলে, ‘ বাজে কথা বলবেন না। মুখ সামলে কথা বলুন।
বৃদ্ধ মন খারাপ করে তাকালেন। মেয়েটা এত বিরক্ত হচ্ছে কেন? নিজের মেয়ের মতো তাই তো জানতে চাইল। দেখতে দেখতে আর ও লাইন পড়ল ফার্মিসিতে। মোটা একটা মহিলা এসে ইশাকে পেছনে পাঠিয়ে দিল। বলল, আমার একটু ইমার্জেন্সি লাগবে।
ইশার পিঠের ব্যাথা আর ও বাড়তে লাগল। দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার পা ব্যাথা হওয়ার উপক্রম। সে অন্য ফার্মিসিতে যেতে চাইল। কিন্তু বাকিগুলোতে সবগুলো পুরুষ। তাই আর গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। হসপিটালের পাশে এই ফার্মেসিগুলোতে প্রচুর ভীড় থাকে সবসময়। বিরক্তিকর। ইশার পিঠের ব্যাথা ছড়াতে লাগল। সে বলল, এই ভাই আমারটা দিয়ে দিন। শুধু মাত্র একটি ঔষধ। কেউ শুনলই না তার কথা।
উগ্র রোষে ফার্মেসির সামনে থাকা গাড়িটা থেকে নামল আদি। কেউ ভুলে ও ভাবেনি গাড়িটাতে কেউ বসেছিল। হসপিটালের সুনামধন্য ডক্টর আদি চৌধুরী হঠাৎ ফার্মিসির দিকে এগোতেই লোক সাইড দিল। অনেকেই আদিকে চেনে বলে কুশলসংবাদ জানতে চাইল। ফার্মেসিওয়ালা বললেন, ডাক্তারকে সাইড দিন। মনে হয় কোনো প্রয়োজনে এসেছেন।
আদি প্রথমেই মাস্ক খুলল। ছুড়ে ফেলল। ইশা চমকাল। পিছু হটল। এ তো?
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আদি কেড়ে নিল ইশার হাত থেকে সেই ঔষধের পাতা। ভ্রুকুঞ্চন করে দেখল সেই ঔষধের নাম। চোখ তুলে তাকাল ইশার দিকে। ইশা স্পষ্ট দেখল, ছেলেটির চোয়াল শক্ত। কপাল বেয়ে পড়ছে ঘাম। থরথর করে কাঁপছে ঠোঁট। চকচক করছে চোখ। বুঝা দায় লোকটা কি চাইছে? কেন চাইছে?
ঔষধের পাতা দেখানোর সাথে সাথে ঔষধ বিক্রেতা চট করে ঔষধ বের করে দিল আদিকে। জিজ্ঞেস করল, আর কিছু লাগবে ডাক্তার সাহেব?
আদি কারো কোনো প্রশ্নের জবাব দিল না। গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। ইশার হাত পা কাঁপা থামেনি এখনো। তাকে নিয়ে গুণগুণানি শুরু হয়ে গেল। সে সেসবের তোয়াক্কা না করে আদির পিছু পিছু ছুটল। লম্বা লম্বা ফেলে হাঁটা আদির পিছু দৌড়াতে গিয়ে তার পিঠে খিঁচে ধরল। সে একহাতে পিঠ চেপে ধরে বিড়বিড় করে ডাকল, ডক্টর?
লোকজন গাড়ির হর্নের আওয়াজে সেই আওয়াজ শোনা গেলনা। সে দৌড়াল আদির পিছু পিছু আবার ও । আদি একবার ও পিছু ফিরল না। হঠাৎ তার মনে হলো তাদের পিছু নিচ্ছে একটি গাড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে আদি ডুকে পড়ল অন্য রাস্তায়। দু একজন লোকের আনাগোনা। গাড়ির আওয়াজ নেই তেমন। চাঁদের জ্যোৎস্নায় আলোকিত রাস্তা। ইশা জোরে জোরে শ্বাস নিল। দাঁড়াল। আবার দৌড় লাগাল। আদির সাথে পেরে উঠল না। আদি তারপর ও হেঁটে যাচ্ছে লম্বা লম্বা পা ফেলে।
ইশা রাস্তার পাশে বাঁকা হয়ে গাছটার সাথে পিঠ এলিয়ে দিল। ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছে ঝি ঝি পোকার ডাক। ইশা জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। গাছটাকে সম্বল বানিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পিঠের ভার ছেড়ে দিল গাছটার উপর।
পেছনে পায়ের আওয়াজ না পেয়ে আদি পেছন ফিরল। রক্তবর্ণ চোখ নিমেষেই আতংকে পরিণত হলো। নীরবে নিঃশব্দে সে খুঁজতে লাগল সেই পাষাণ মেয়েটিকে। কোথায় সে? কোথায় সে হৃদয়হীনের মুখ? কোথায় সে ভয়ংকর নুপূরের আওয়াজ? সে শুনতে পাচ্ছে না কেন? তাকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
ইশা ছুটতে ছোটাছুটি করল দুইজন লোকের হাত থেকে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল গাড়ির ভেতর বসা লোকটিকে। লোকটি কি সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখে? নিজের ছেলের দোষটা দেখতে পাচ্ছে না সে?
লোকদুটি তার মুখ চেপে ধরল। ঝোপঝাড়ের ভেতর টেনে নিয়ে গেল। ইশার শক্তি আর তাদের সাথে পেরে উঠল না। সে ডাকতে পারল না ডক্টরকে। লোকদুটি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ঝোপঝাড়ের ভেতর। ইশা আঘাত পেল। হাত পা কোমর নিশ্চয় কিছু ভেঙ্গেছে। তার হাত মুখ বেঁধে দিল কাপড় দিয়ে। কাটা জাতীয় কিছুর জন্য তার হাত পা মুখ ছিড়ে রক্ত বেরোলো। তার ভয় লাগল। বাঁচার জন্য সে ছটপট করল। লোকদুটো তাকে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে রাখল ঝোপঝাড়ের ভেতর। নীরব হয়ে বাঁচার আকুতি,ভয় নিয়ে ইশা তাকিয়ে রইল,পড়ে রইল অন্ধকার ঝোপঝাড়ে। কিসের এত শাস্তি পাচ্ছে সে? কে তার এত কষ্টের কারণ? ডক্টর নয় কখনো। ডক্টরকে তো সে ভালোবেসেছিল? ভালোবাসার শাস্তি এতটা ভয়ংকর কি করে হতে পারে? নাকি বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে যাওয়ার শাস্তি?
আদি লোকদুটোকে পালাতে দেখল। আবছাআলোয় দূরের সরু রাস্তার মাথায় গাড়িটির ভেতর বসে লোকদুটোকে পালাতে দেখল। সে দৌড় লাগিয়ে ও কোনো লাভ হলোনা। অজানা অচেনা ভয় তাকে ঘিরে ধরল। ঝোপঝাড় লতাপাতা সরিয়ে সে কি ডাক দিবে বুঝে উঠতে পারল না। কি নামে মেয়েটিকে সম্বোধন করবে বুঝে উঠতে পারল না সে। মেয়েটি তার কেউ না। কেউ হয়না। আদি শেষমেশ দিশেহারা হয়ে পড়ল। ডাকল, শুনছেন, কোথায় আপনি। সামনে আসুন। লুকিয়েছেন কেন? বেরিয়ে আসুন।
উু উু শব্দ বেরোলো ইশার মুখ দিয়ে। হাত পা নাড়ানোর শক্তি নেই তার। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে এগোনোর আগেই তার পায়ের নিচে নরম কিছুর নড়াচড়া টের পেল সে। হাতের উপর ভয়ংকর চাপ পড়ায় ইশার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। শ্বাস যেন এবার বন্ধ হয়ে এল। নিভু নিভু হয়ে এল যেন তার পৃথিবীর আলো। আদি পা সরিয়ে বসে পড়ল ইশার মাথার কাছে। গভীর অনুনয় করে বলল, সরি,সরি, আমি দেখতে পায়নি। হাত মুখ বাঁধা দেখে আদি ভড়কাল। তাড়াতাড়ি খুলে দিল হাত মুখ। সামনে ফিরাল ইশাকে। ইশা মুখ থুবড়ে পড়ল তার বুকে। লেগে গেল। আদির পড়নের সাদা শার্টে লেগে গেল রক্ত। ইশা নিভু নিভু চোখ নিয়ে তাকাল আদির দিকে। আদি দেখল ঠোঁট, মুখে রক্ত। গলার একপাশে রক্ত। আদি গর্জে উঠল, কিছুক্ষণ আগে ও তো আপনি ঠিক ছিলেন। কি করে এসব হলো? কখন হলো?
ইশা বহুকষ্টে একটি আঙুল তুলে। ডুকরে উঠে সেই আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁটের রক্ত নিল। নিজেই নিজের রক্ত দেখে ঢোক তুলে কেঁদে উঠল। আদির বুকের পাশে সেই রক্তের ফোঁটা লাগিয়ে দিল। তারপরই ঢলে পড়ল আদির বুকে। আদির বাহুডোরে।
আদি শক্ত হয়ে শুধু বসে রইল। তার বুকে পড়ে থাকা রমণী অচেতন। অজ্ঞান। আদির তারপর ও রাগ লাগল মেয়েটির উপর। কি করে সে বলল সে বিবাহিত? কখন হলো বিয়ে? কার সাথে? কবে? কিভাবে?
আদি এসব একটু ও বিশ্বাস করেনা। বিশ্বাস হচ্ছেনা। হওয়ার নয়। আসল কথা তো সে স্বীকার করতে চাইছেনা, বিশ্বাস হচ্ছেনা নয়। বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। রক্তক্ষরণ যদি কেউ খুব গভীরভাবে দেখত তবে দেখতে পেত মেয়েটির নয় বরঞ্চ ছেলেটির বুকেই বেশি রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যা থামার নয়। সহনীয় নয়। অসহ্য। যন্ত্রণার।
_______________________
ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল রিপ। সোফায় গা এলিয়ে দিল । নিজের ইউনিফর্ম রাখল সোফায়। পরী দৌড়ে আসল। ডাকল, রিইইইইই ফিপপপি…..
রিপ হাসল। সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে ডাকল,
‘ ইশু এক গ্লাস পানি দে তো।
অন্যদিন হলে বলতে হয়না। আজ বলতে হলো কেন? চাপা অভিমান কাজ করে রিপের? কোথায় মেয়েটা? রিপ ডাকল,
‘ ইশু?
কারো সাড়া পাওয়া গেলনা। পানির গ্লাস হাতে মুনাকে দেখা গেল। মুনা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ নে।
রিপ পানির গ্লাস হাতে নিল না। পরীর সাথে এমনভাবে কথা বলতে লাগল যেন সে মুনাকে দেখলই না।
মুনা বলল,
‘ পানি নে। মা ডাকছে আমায়।
রিপ চোখ তুলে তাকাল মুনার দিকে। মুনা রিপের ক্লান্ত চোখ দেখে ভড়কাল। বলল,
‘ এভাবে কেন দেখছিস? নে পানি।
রিপ উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ তোমাকে পানি আনতে বলেছি আমি। আশ্চর্য!
মুনা অবাক হয়ে বলল,
‘ এখন তো শুনলাম।
রিপ কোনো কথা বলল না। গটগট পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল। ধপ করে দরজা বন্ধ করল। ঘর্মাক্ত শার্ট খুলে দূরে ছুড়ে মারল। ডাকল, এই ইশা?
সবাই জানে খুব রেগে থাকলে ইশাকে রিপ এইভাবেই ডাকে। তালহা বেগম থেমে গেলেন রিপের রুমের সামনে।
রিপ দরজার দিকে তাকিয়ে বোকাবনে গেল। দরজা খুলে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
প্রায় সাত আট মিনিট পরে যখন অভিমান নিয়ে বের হয়ে এল তখন ও দেখা পেল না ইশুর। কি আশ্চর্য! মেয়েটি কি তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তার যে গলা শুকিয়ে এল। একদলা অভিমান ভর করল গলায়। সে চিৎকার করে ডাকল, এই ইশা। কোথায় রে তুই?
তালহা বেগম ছুটে এলেন রুমে। বললেন,
‘ কি হয়েছে রিপ? বাড়ি ফেরার সাথে সাথে কি শুরু করেছিস? ওঁ কি তোর বিয়ে করা বউ, যে ডাকামাত্র চলে আসবে?
রিপের মেজাজ খারাপ হলো। তারপরও শান্ত গলায় বলল,
‘ আমি ডাকছি। ও কি শুনতে পাচ্ছে না? কোথায় সে?
মুনা ডুকে এল রুমে। রিপের মনে হলো ইশা এল। মুনাকে দেখে তার মেজাজ আর ও চড়ে গেল। সে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘ ইশা কোথায়? আমি ওর কাছ থেকে পানি চেয়েছি। কি সমস্যা তার?
মুনা আমতাআমতা করে বলল,
‘ ইশা বাসায় নেই। একটু বাইরে গেছে।
রিপ চমকাল। কোনো আওয়াজ করল না। পরক্ষণে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেন গিয়েছে?
তালহা বললেন,
‘ আমার ডায়াবেটিসেরর ঔষধের জন্য। চলে আসবে। ইশা অনেকবার গিয়েছে এরকম। চলে আসবে।
রিপ চুপ করে থাকে। বলে, কিন্তু আমি আসার পর থেকে তো একবার ও দেখিনি।
তোমরা কিসের উপর ভরসা করে একটা মেয়েকে এমন রাতের বেলা একা ছেড়েছ? তোমার কি এখনো একটু মায়া হয়না মেয়েটার প্রতি। তুমি এখনো আগের মতো রয়ে গেছ মা।
তালহা বেগম কিছু বলতে পারেনা। রিপ শার্ট গায়ে দিতে দিতে বেরিয়ে পড়ে। বাইক নিয়ে ছুটে যায়।
ঔষধের ফার্মেসিগুলোতে তন্নতন্ন করে খুঁজে। কিন্তু ইশার দেখা পায়না। আশেপাশের লোকদের জিজ্ঞাসা করল। তারা বলল,
‘ নীল রঙের কাপড় পড়া মেয়েটি কিছুক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে।
রিপের এবার চিন্তা হয়। তার শুকনো গলা আর ও শুকনো হয়। গলা ধরে আসে তার। ক্লান্ত হয়ে সে বসে পড়ে হসপিটালের সামনে বাইকে। বলে,
‘ কোথায় তুই ইশু? এমনটা কেউ করে? আমার পানির তেষ্টা পেয়েছে খুব।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ইশু তো এখানে নেই। কোথাও নেই। রিপ ফোন লাগাল রিককে। রিক চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল,
‘ আমি আসছি। তুই দাঁড়া।
রিপ বসে থাকল বাইকের উপর উদাস ভঙ্গিতে। তার চুল নড়ছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। তার হঠাৎ মনে হলো গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মেয়ে তার সামনে। মেয়েটির মুখে লেপ্টে রয়েছে দীপ্তিময় হাসি। চুলগুলো উড়ছে এলোমেলো হয়ে। ঠোঁটের সাথে হাসছে তার দুচোখ। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলছে,
‘ গলাটা ভিজিয়ে না ও তো। তুমি কেন এমন করো রিপুদা। তোমাকে এভাবে দেখলে আমার কষ্ট হয় তুমি জানো না।
রিপ পানির গ্লাস হাতে নেয়না। মাথা নামিয়ে বলে,
‘ তুই আমায় কখন বুঝবি ইশু। তোর অবহেলা আমার সহ্য হয়না। আমি সহ্য করতে পারিনা। তুই আমার সাথে এমন করিস না।
ইশা হাসে। বলে, পানি না খেলে তাহলে চলে যাচ্ছি।
রিপ পানির গ্লাস হাতে নেয়না।
‘ এ তার ইশু নয়। কারণ ইশা তাকে ইউনিফর্ম খোলার আগে পানি খাইয়ে দেয়। পানি খেতে বলেনা। রিপ মুখ ফিরিয়ে রাখে। আর ইশা হাসতে হাসতে নিরুদ্দেশ হয়।
রিপের যখন ধ্যান ফিরল তখন আকাশে মেঘের গুডুম গুডুম আওয়াজ। আচমকা বাতাস বইতে লাগল। রিপ চমকাল। তার কষ্ট লাগল। চোখ ধুলোবালিতে ঝাপসা হয়ে এল। সে অসহায় কন্ঠে ডাকল, ইশু,আমি তোকে কোথায় খুঁজব এখন? এই মন কেমনের জ্যোৎস্না ভরা রাতটা কেমন যেন বিদঘুটে লাগছে আমার কাছে। তুই তাড়াতাড়ি চলে আমার কাছে। কোথায় আছিস তুই?
সে বাইক রেখে দৌড়াল পুরো রাস্তা। রাস্তার আশপাশ দেখল। সব দোকানে দোকানে গিয়ে দেখল। পুরো হসপিটাল ঘুরল। পরপর অনেকবার খুঁজে ও পাওয়া গেলনা ইশাকে। রিক ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল পেয়েছিস? রিপ কিচ্ছু বলল না। রিক যা বুঝার বুঝে নিল।
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টি শুরু হলো। চারদিকে হঠাৎ করে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। চাঁদ ঢেকে গেল মেঘের আড়ালে। লোকজন দোকানপাট থেকে সরে গেল। পরিষ্কার হয়ে গেল রাস্তা। একা একা নীরবে বাইকের উপর বসে রইল রিপ স্তব্ধ হয়ে। তার ক্লান্তি, তেষ্টা মুছে গেল বৃষ্টিজলে। বৃষ্টিতে ভিজে সে জবজবে হয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। দূরে কোথাও প্রচন্ড ভয়ংকর শব্দ করে বজ্রপাত ঘটল। রিপ চমকাল না। সে শুধু ভড়কাল। লাল টকটকে শাড়ি পড়ে তার সামনে খিলখিল করে বৃষ্টিতে ভেজা মেয়েটির দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। মেয়েটি তার দিকে শাড়ির আঁচলের সবটুকু পানি ছুড়ে মেরে খিলখিল করে হেসে উঠল। রিপ এগোলো মেয়েটিকে ধরার জন্য। একটুখানি ছোঁয়ার জন্য। একটুখানি ধমক দেওয়ার জন্য। একটুখানি অভিমান্য শব্দগুচ্ছ শুনিয়ে দেওয়ার জন্য। একটুখানি ভালোবেসে জড়িয়ে ধরার জন্য। কিন্তু সে ছুঁতে পারেনা মেয়েটিকে। ধরতে পারেনা। মেয়েটি তার হাতের নাগালের বাইরে । খিলখিল করে হেসে মিলিয়ে যায় বৃষ্টিজলে, বাতাসে। রিপ তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। রিপের পড়নের কালো শার্ট ভিজে লেপ্টে যায় তার গায়ে। কপালের চুল এসে পড়ে চোখের কাছে। সে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
ধপ করে বসে পড়ে হসপিটালের সামনে ইট সিমেন্টের টিলায়। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ভীষণ। ঘোর অন্ধকার। রিপ মাথা নামিয়ে রাখে হাতের উপর ভর দিয়ে। এই মন কেমনের রাতটাই তারপাশে ইশু থাকলে খুব একটা ক্ষতি হতো না। বরঞ্চ বেশ ভালোই হতো।
বৃষ্টি জলে ধোঁয়া চকচকে হসপিটালের মেঝেতে পড়ে থাকে একটি সুন্দর সোনালি রঙের নূপুর। রিপ সেদিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। এই নূপুরটি তার দেওয়া। নিজ হাতে পড়িয়ে দিতে গিয়ে ইশু কতই না হেসেছিল সেদিন। বলেছিল, রিপুদা আমি সত্যিই লাকি। তোমার মতো একজন ভাই আছে।
রিপ কুড়িয়ে নেয় সে নূপুর। নূপুরটির দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে,
‘ তুই সেদিন ও আমায় বুঝলি নারে ইশু। আর কতভাবে বোঝালে তুই বুঝবি। মুখে কেন বলতে হবে আমায়? তুই কেন আমার চোখের ভাষা পড়তে পারিস না ইশু। তোকে আমি ভালোবাসি, আর তুই আমাকে ভাই ডেকে দূরে পাঠিয়ে দিস। আমি তোকে আমার করে চাই,তুই আমাকে ভাইয়ের অজুহাত দিয়ে চুপ করিয়ে দিস। আমি তোকে ভালোবাসি, কিভাবে বোঝালে তুই বুঝবি? তুই কেন বুঝিস না ইশু। কেন বুঝতে চাস না? আমার তোর মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে ইচ্ছে হয়। তোকে ভালোবাসি বলতে ইচ্ছে হয়। এক মন কেমন করা ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, তুই কি আমার মন কেমনের বৃষ্টি হবি?
কিন্তু তুই আমায় সেই সুযোগ দিসনা। আমাকে বলতে দিসনা। শুধু পালিয়ে বেড়াস আমার কাছ থেকে। আমি কি তোর অতটাই অযোগ্য? আমার কষ্ট হয়। অভিমান আমার ও হয়। আমার ও তোকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তুই অবুঝ। তুই অন্ধ। কার প্রেমে তুই অন্ধ হলিরে ইশু? কে তোকে অন্ধ বানাল? কাকে ভালোবাসিস তুই? আমাকে কেন ভালোবাসিস না। আমার চাইতে ও কি তোকে কেউ বেশি ভালোবাসে?
রিপ না না করে উঠে। বলে, আমার চাইতে ও বেশি তোকে কেউ ভালোবাসবে না। এই রিপ তোকে ভালোবাসে। বিনিময়ে তুই ও একটু ভালোবাসিস। শুধু একটুখানি।
মুষলধারায় পড়তে লাগল বৃষ্টি। আঁকাবাঁকা, এলোমেলো, ছন্নছাড়া। ঠিক রিপের মতো। কবে আসবে মেয়েটি তার এলোমেলো প্রলাপ বন্ধ করতে। কপালের ছড়ানো ছিটানো চুল সরিয়ে দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিতে। কবে আসবে একমুঠো বকুল ফুল বাড়িয়ে দিয়ে বলতে আমার চুলে গুজে দাও। কবে আসবে আলতোকরে বুকে মাথা রেখে বলতে, ‘ ভালোবাসি, খুব বেশি ভালোবাসি।
কেবিনের জানালার কপাট বন্ধ করে দিল আদি । মৃদুমধুর হাওয়ায় দুলছে কেবিনের পর্দা। সে অচেতন হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটির দিকে একটিবার তাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। নার্স আছে দুজন। নার্সগুলো তাদের কাজে ব্যস্ত। আদি থেমে গেল দরজার সামনে এসে। কিছু একটা ভেবে আবার পিছু হাটল। আলতাহাতে সরাল কেবিনের পর্দা। দেখা গেল চোখবন্ধ করে শুয়ে থাকা মেয়েটির মুখ। হৃৎপিন্ড যেন থেমে যেতে চাইল। কানে যেন এসে বাজল,
‘ ডক্টর মিষ্টি আপনাকে ভালোবাসে। আপনি বাসেন তো?
আদির মনে হলো। ইশশ মেয়েটি যদি হতো তার মিষ্টি। নতুন করে হতো আবার মন কেমনের বৃষ্টি।
চলবে,
( আপনাদের মতামত জানাবেন)