#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা
ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির খুব করে আজ আবার পাপপা আর মামমামের কথা মনে পড়ছে। তার চোখ, নাকের ডগা টকটকে লাল। চোখদুটো ফোলা। গালের ভেতর আঙুল রেখে ছোট ছোট পা দুটো দিয়ে কতক্ষণ এদিকে, আবার কেঁদে কেঁদে কতক্ষণ ওদিকে হাঁটছে। ছোট্ট মাথাটাই আচমকা আচমকা রাগ হানা দিচ্ছে । দাঁত কিড়মিড় কিড়মিড় করছে। কাউকে কামড় দিতে ইচ্ছে করছে। চুল একটা একটা ছিড়তে ইচ্ছে করছে। সবাই ওকে একা একা রেখে কোথায় যায়?
তার খিদে ও পেয়েছে। বন্ধ দরজায় হাতের ছোট্টছোট্ট তালু দিয়ে সে থপথপ আওয়াজ করল। ছোট্ট হাতের সেই আওয়াজ আর কতদূর এগোয়?
প্রায় চেঁচিয়ে কেঁদে অনেকক্ষণ সে দরজায় আঘাত করে। পরক্ষণে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। শুধু কাঁদে। কেঁদে কেঁদে ডাকে, পাপপপপপা, মামমমমা…….
দরজার বাইরে দাঁড়ানো লোকটি পরীর পাহারাদার। নাম জামাল। আজিজ চৌধুরী রেখেছে তাকে। তার বাড়িতে ও একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে আছে তার ছোট ভাইয়ের। পরীকে প্রথম দেখায় তার খুব আদরণীয় মনে হয়েছিল। খুব ভালো লেগেছিল। কোলে নিয়ে আদর করতে মন চেয়েছিল। এমন একটা বাচ্চা মেয়েকে আজিজ চৌধুরী কেন একলা একটা ফ্ল্যাটে বন্ধ রুমে বন্দী করেছেন? আজিজ চৌধুরীর কি মেয়েটার প্রতি একটু মায়া হয়না? মেয়েটা তো সম্পর্কে তার নাতনী হবে মনে হয়। এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছে, ইচ্ছে করছে দরজাটা খোলে দেই। কিন্তু আজিজ চৌধুরীর কড়া নিষেধ। জামাল দরজার কাছাকাছি মুখ নিয়ে গিয়ে ডাকল,
‘ মামুনি তোমার কি খিদে পেয়েছে?
পরী শুনল না। জামাল আবার ও ডাকল,
‘ মামুনি তুমি শুনতে পাচ্ছ।
পরী তারপর ও শুনল না। পরপর চার পাঁচ বার ডাকার পর,দরজা ধাক্কানোর পর পরীর চোখ গেল দরজার দিকে। না তাকে তো কেউ পরী বলে ডাকছেনা। শুধু কিসব বলে ডাকছে। তারপর ও সে মেঝেতে হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে দরজার কাছাকাছি গেল। দরজার সাথে মুখ লাগিয়ে ডাকল,
‘পাপপপপপা আমম।
জামাল শুনতে পেল পরীর কন্ঠস্বর। কিন্তু কি বলল বুঝল না। সে বলল,
‘ মামুনি কিছু খাবে?
পরী দরজার সাথে মুখ লাগিয়ে আবার বলল,
‘ আমমম।
কন্ঠে কান্না মেশানো। কথা বলতে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। পরী এবার দরজায় হাতের তালু দিয়ে আবার ও থপথপ আওয়াজ করল। জামাল এবার স্পষ্ট পরীর ডাক আর কান্না শুনতে পেল।
সে ফোন লাগাল আজিজ চৌধুরীর ফোনে। কিন্তু আজিজ চৌধুরী ফোন তুলল না। ক্রমাগত অনেক বার ফোন দিয়ে ও আজিজ চৌধুরীকে ফোনে পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে জামাল ফোন দেয় চৌধুরী বাড়ির ফোনে।
প্রথমবার রিং হতেই ফোন তুলে কেউ। কিন্তু কোনো টু শব্দ করেনা। জামাল গড়গড় করে বলে যায়।
‘ স্যার বাচ্চাটি কাঁদছে। এমন একটা ফ্ল্যাটে একা রুমে একটি মেয়েকে বন্দী রাখাটা কি ভালো হচ্ছে? মেয়েটির বোধহয় খিদে ও পেয়েছে। স্যার শুনতে পাচ্ছেন?
জামাল বকবক করে কিন্তু কথা শেষ করে উঠতে না উঠতেই ফোন কেটে দেয় ফোনের ওপাশের জন। জামাল বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে বলে,
‘ পাষাণ হৃদয়হীন মানুষ।
নিজের হাতে থাকা চাবিটা দিয়ে জামাল রুমটার লক খোলে। পরী দরজার সাথে হেলান দিয়ে থাকায় ধপ করে পড়ে যায়। ব্যাথা পেয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে। জামাল দুঃখিত হয়ে কোলে তুলে নেয় পরীকে। বলে, মামুনি কোথায় ব্যাথা পেয়েছ।
পরী আদুরে কথা শুনে নিজের হাত দেখিয়ে দেয়। ঠোঁট টেনে টেনে বলে, দুক্কু।
জামাল তার হাতের দিকে তাকায়। বলে, এখানে?
পরী মাথা উপর নিচ দুলাতে দুলাতে বলে, উমমমমম, দুক্কু। জামাল হেসে দেয়। পরী ভয়ে ভয়ে এগোয় জামালের কাছে। সংকোচ করে জামালের কাঁধে হাত দেয়। জামাল কিছু বলছে কিনা দেখে গলা কাত করে। তারপর যখন দেখল জামাল কিছু বলছে না তখন জামালের পকেটে হাত ডুকিয়ে দিল। অন্য হাত গালে ডুকিয়ে বলল, আমমমম।
জামাল পরী কি চাইছে তা এবার বুঝতে পারল। হেসে দিল। পরীর রাগ লাগল তার হাসি দেখে। পকেট থেকে হাত বের করে ঠাসস করে চড় মারল জামালের গালে। গাল ফুলিয়ে বলল, ভোববব।
জামাল গালে হাত দিয়ে আবার ও হেসে বলল, মাইর গুলো তো শক্ত আছে। নরম হাতের মাইর এত শক্ত কেন?
পরী আবার হাসি দেখে এবার চুল টেনে ধরে।কিছুক্ষণ চুলগুলো ইচ্ছে মত টানল। তারপর আবার গালে আঙুল দিয়ে কেঁদে উঠল। জামালের গালে ঠাসস ঠাসস চড় মেরে বলল, আমমমম।
জামাল কোনো উপায়ন্তর না দেখে বলল, মামুনি তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি এক্ষুণি আমমম নিয়ে আসছি। যাব আর আসব।
পরী তাড়াহুড়ো করে জামালের গলা জড়িয়ে ধরে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, নান নান না।
জামাল হাসে। পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, না গেলে আমম কি করে আনব? যেতে তো হবে।
পরী জামালকে ছেড়ে দেয়। জামালের পকেটে আবার হাত ডুকিয়ে দেয়। পাপা আর রিইইইই তো এখান থেকে তাকে চকলেটস আর লিলি বের করে দিত। তাহলে এ লোকটার এখানে চকলেটস আর লিলি নেই কেন?
পরী কেঁদে দিল। জামালকে দুমদাম মেরে মেরে বলল,
‘ চকককো লিলি……. আমমমম।
জামালের খারাপ লাগল। নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে। জামাল সাতপাঁচ না ভেবে পরীকে কোলে তুলে নিল। পরী হাত তালি দিল। জামালের দিকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে মেরে বলল, আমমমমাহ।
জামাল রুমেরর দরজা লক করে বেরিয়ে পড়ল পরীকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে। আজিজ চৌধুরী খাওয়ালে তো কিচ্ছু বলবে না। তারই তো নাতনী।
_________________________
রিপ রিক বেরোনোর সাথে সাথে পিছুপিছু ইশা বেরিয়ে যায় হসপিটালের উদ্দেশ্য। আজ তার দুইটা কাজ বাকি। প্রথম কাজ নিজের চেকআপটা করিয়ে নেওয়া, দ্বিতীয়টি ডক্টরের খোঁজ নেওয়া। কিন্তু হসপিটালে এসেই সে আদির সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল আদি বেশকিছুদিন ধরে হসপিটালে ইনএক্টিভ। ইশা বিস্মিত হওয়ার বদলে চিন্তিত হয়ে পড়ল। কোথায় গিয়েছে ডক্টর? ভালো আছে তো?
পিঠের ব্যাথার জন্য একটি চেকআপ দিয়েছিল ডক্টর মেহতাব । করানো হয়নি। রিপ আর রিকদার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে বেরিয়েছে। মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছে রিপোর্টে যাতে খারাপ কিছু ধরা না পড়ে। তাকে বাঁচতে হবে
চেকআপ করা শেষে নার্স তাকে ওয়েট করতে বলল। ইশা কলেজব্যাগ কাঁধের একপাশে ঝুলিয়ে এদিকওদিক দেখছে। হঠাৎ চোখ গেল কিছুটা দূরে কেবিনের সামনে বসা একটি মহিলার দিকে। মহিলাটির কোলে বসা একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে। মহিলাটি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সেই মেয়েটিকে। আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে মেয়েটির মুখ। ছোট্ট মেয়েটি হাসছে মৃদু মৃদু। খুব ভালোবেসে ডাকছে, মাআআআআআ….
ইশার কানে বাজে সেই ডাক, মাআআআআ.
কত সুন্দর! কত মিষ্টি একটি ডাক?
কোথায় তার মেয়ে? কোথায় পরী? যে মেয়েকে নিজের চোখের সামনে রাখার জন্য তার এত ত্যাগ,এত লুকোচুরি। আজ সেই মেয়েই নেই তার কাছে। তার বুকে। সে লুকিয়ে ও আদর করার জন্য হাতের নাগালে পাইনা মেয়েকে। বুকে চেপে ধরতে পারেনা। গালে গাল লাগিয়ে আদর করতে পারেনা। মা তো বহুদূর ফিপি ডাকটি ও ভেসে আসেনা। প্রত্যেকটা রাত নির্ঘুম কাটে। চোখে ঘুম নামেনা। ঘুম ভর করে এলে ও আচমকা কোথা থেকে আমমমমা ডাকটি ভেসে আসে। আবার ঘুম ছুটে যায়। আর ঘুম আসেনা। গত কয়েকদিনে শারীরিক অসুস্থতা দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে খুব। আজ যদি পরী থাকত তার কষ্টগুলো কষ্টই মনে হতো না। কিন্তু সব ব্যাথা আর ও বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে পরীর অনুপস্থিতির কারণে। আর কতদিন না দেখে থাকবে সে? কোথায় আছে? কেমন আছে? কি খাচ্ছে মা টা? আমমমমা বলে কি একবার ও আনমনে সে ডেকে উঠছে না?
সে কবে ডাকতে পারবে আবার, এই মা। আমার পরী। আমি তোমার মা।
নার্স এসে ধরিয়ে দিয়ে গেল রিপোর্ট। আর ও ধরিয়ে দিয়ে গেল তার আগের সেই অপারেশনের রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে ইশা চোখ বুলায়। হঠাৎ চোখ আটকে যায় একটি জায়গায় এসে। তার বুক কেঁপে উঠে। হাত থরথর করে কাঁপে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। মাতার নামের জায়গায় নাম ইশা আফরোজা। ভূমিষ্ঠ সন্তান, বেবিগার্ল । সন্তানের পিতা মৃত আদি চৌধুরী।
ইশার গাল বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ে সেই রিপোর্টে। সেদিন স্বামী ছাড়া অপারেশন থিয়েটারে ডুকাচ্ছিল না ইশাকে। অনেক বুঝিয়ে ও কাজ হয়নি। শেষমেশ রিক পিতার নামের আগে যুক্ত করে দিতে বললেন মৃত। যদি ও ইশার কাছ থেকে ও জিজ্ঞেস করা হয়েছে সেই কথা। সত্যতা প্রমাণসই হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য। সেদিন ইশা চোখে অন্ধকার দেখেছিল। প্রসববেদনায় কাতর হতে হতে আর্তনাদ করতে করতে উচ্চারণ করেছিল,
‘ মৃত। আমার স্বামী মৃত।
তার জবানবন্দি শুনে তাকে অপারেশন থিয়েটারে ডুকানো হয়েছিল। যেহেতু স্বামী মৃত সেহেতু ভাইয়ের পারমিশন যথেষ্ট।
নিজের চোখের জল মুছতে না মুছতেই মাস্ক পড়া একটি নার্স ছেলে তার হাত থেকে কেড়ে নিল সেই রিপোর্ট। ইশা কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই ছেলেটি হাঁটা ধরল আবার ফিরতি পথে। ইশা পিছু পিছু দৌড়াল। বলল,
‘ আমার আগের রিপোর্টগুলো! আরেহ। আগের রিপোর্টটি ও কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? সেটি আমায় দিয়ে যান। শুনছেন?.
ছেলেটি শোনেনা। হনহন গনগন করে হেঁটে নিমেষেই উদাও হয়। ইশা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এদিকওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকে সেই কাঙ্ক্ষিত ছেলেটিকে। পায় না খুঁজে। একটি নার্সের সাথে ধাক্কা লাগে ইশার। ইশা দুঃখিত হয়ে বলে,
‘ আই এম সো সরি। একটা ছেলে আমার রিপোর্টগুলো কোথায় নিয়ে গেছে। এইমাত্র যেটি হাতে পেলাম সেটি ও দেখতে পায়নি। আগের রিপোর্টগুলো ও নিয়ে গেছে। কিছু একটা করুন প্লিজ
নার্স মেয়েটি বলে,
‘ আপনি ওনার পিছু পিছু যান। পেয়ে যাবেন।
ইশা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এদিকওদিক তাকাতেই দেখতে পায় ছেলেটিকে। ছেলেটি পুনরায় ফিরে আসছে। ইশার দিকে রিপোর্ট গুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ সরি ম্যাম। ডক্টর মেহতাব নিয়ে যেতে বলেছিলেন। তাই নিয়ে গিয়েছিলাম। ডক্টর মেহতাব এখন আপনাকে ওনার চেম্বারে ডাকছেন। প্লিজ দেখা করে আসুন।
ইশা মাথা নাড়ায়। খুব শীতল দৃষ্টি প্রয়োগ করে দেখে দ্বিতীয় রিপোর্টটি । পুরো শরীরটাই তখন শীতল রূপ ধারণ করে । ঠোঁটে ফুটে নিজের প্রতি অবহেলিত হাসি। আজ তার খুশির দিন। আর ও একটি কারণ খুঁজে পেল সে স্বামী সন্তানের কাছ থেকে দূরে থাকার। তাদের কাছে না পাওয়ার। তাদের আপন করে না পাওয়ার।
ডক্টর মেহতাবের কাছে সে গেল। ডক্টর মেহতাব তার না বলা সব রোগ ধরে ফেলল। তারপর ব্যঙ্গ করে ইশাকে বলল,
‘ লুকিয়ে কি লাভ হলো। রিপোর্টে তো সব ধরা পড়েছে। এখন উপায়?
মুহূর্তেই ইশার কান্নার বাঁধ ভাঙল। প্রায় কয়েক মিনিট পর যখন তার কান্না থামল তখন ডক্টরকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করল,এই সুসংবাদ যাতে তৃতীয় কেউ না জানে,না শোনে। ডক্টর মেহতাব রাজী হয়। ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, যতদিন থাকো ভালো থাকার চেষ্টা করো। পৃথিবীর রঙিন অংশটা উপভোগ করার চেষ্টা করো।
ইশা হাসে অবজ্ঞার হাসি। কান্নাহাসিতে ভেসে বলে, রঙিন রূপটা উপভোগ করতে করতে একসময় যদি মায়া লেগে যায়। লোভ লেগে যায়। সেই মায়া, সেই লোভ ছাড়তে তো আর ও বেশি কষ্ট হবে। তারচাইতে বরঞ্চ এটাই ভালো। এভাবেই থাকি। কারণ আমি এভাবেই ভালো আছি।
রাস্তায় আনমনা হয়ে হাঁটছে সে । রোদ আর মেঘ দুটোই একসাথে উঁকি দিচ্ছে। ইশা তাকিয়ে দেখে আকাশ। কি সুন্দর!
বৃষ্টি নামবে নাকি কড়কড়ে রোদ উঠবে বোঝা মুশকিল। ইশার হঠাৎ মনে হলো যাহ আজ বৃষ্টি নেমে যাহ। আমি আজ ভিজব। উপভোগ করব একা একা। কাউকে শামিল হতে দেব না। কিন্তু তার কথার কি অত মূল্য আছে? বৃষ্টি কি তার কথায় আসবে?
আজ আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছেনা। বাড়ি ফিরলেই নিজেকে আর ও বেশি একা একা লাগে। পরীর শূন্যতায় পুরো হা হা করে। রিপদার সামনে দাঁড়ালেই নিজেকে অপরাধী লাগে। রিক আর মুনার সামনে দাঁড়ালে তো নিজেকে সন্তানহারা সন্তানহারা মনে হয়। মনে হয় পরীর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে সব দায় তার। আসলেই কি সব দায় তার?
সে ভাবল আজ আর রিকশা নেবেনা। হেঁটে যাবে। যতসময় লাগে লাগুক। যত কষ্ট হয় হোক।
_____________________
রাস্তার পাশে নিউমার্কেট। নিউমার্কেট থেকে বের হয় রিপ। বাইকে চেপে হাতে থাকা সেই চুড়িগুলো দেখে নিজে নিজে। এই চুড়িগুলো সে কিনেছিল লন্ডন থেকে ফেরার পর। ইশুর জন্য। কিন্তু দেওয়া হয়ে উঠেনি। ভেবেছিল নিজ হাতে পড়িয়ে দেবে। কিন্তু তার এই ইচ্ছে অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। সেই দোকানটাতে সে এসেছে চুড়িগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য। সেলসম্যান চুড়িগুলো ফেরত নিল না। রিপ বলেছে এমনিই রেখে দিন,টাকা লাগবে না আমার। কিন্তু দোকানদার তাতে ও রাজী হলোনা। মনে মনে রিপকে পাগল উপাধি দিল। এত দামী চুড়িগুলো কেউ এমনি এমনি ফেরত দেয়?
রিপ চেয়েছিল এমন এক প্রেমিকের হাতে চুড়িগুলো তুলে দেবে। যেই প্রেমিক টাকার কারণে প্রেমিকার হাতে দুটো চুড়ি পড়িয়ে দিতে পারেনা। প্রেমিকার ঠোঁটের কোণার অপ্রতিভ হাসিটা ও দেখতে পারেনা। কিন্তু এমন প্রেমিককে কোথায় পাবে রিক? কোথায় সেই প্রেমিকের বাড়ি? কোথায় থাকে সে? এই চুড়িগুলো যে ফেলনা নয়। কি করে সে ফেলে দেবে এমনি এমনি। কতটা ভালোবাসা মেশানো এই চুড়িগুলোতে সে তো এক প্রেমিক চোখই বুঝতে পারবে। বাকিরা কি করে বুঝবে?
এই চুড়িগুলো থেকে ভেসে আসছে এক মিষ্টি সুঘ্রাণ। কারো ঠোঁটের এক চিলতে হাসি। দুচোখের ঘন কাজলের রেখা। আর মুখে বলা একটি কথা,
‘ রিপদা চুড়িগুলো খুব সুন্দর। চুড়িগুলো তুমি তোমার বউয়ের জন্য রেখে দাও।
আচমকা সব চুড়ি ছুড়ে ফেলে দেয় রিপ। মাধুরী মেশানো সেই কথা আবার ও বাজতে থাকে রিপের কানে,
‘ তোমার বউ!!!!!
রিপ ঘুরে বসে বাইকে। মাথায় তার যন্ত্রণা হয়। বুকে যন্ত্রণা হয়। নিজের উপর নিজের রাগ হয়। একটি বিবাহিত মেয়ের কথা সে এখনো কেন ভাবছে? কেন শুধু এখনে ওই একটি মেয়ের কথা তার কানে বাজে? রিপ কি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য পাগল হয়? রিপের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কেউ পাগল হয়না?
রিপ খুব করে চাই। এমনটা কখনো না হোক। রিপের মতো করে কষ্ট কেউ না পাক। ভালোবেসে যাওয়ার মতো কষ্ট কেউ ভোগ না করুক। ভালোবাসার মতো মস্ত বড় ভুল কেউ না করুক। রিপ ফিরে তাকায়না সেই চুড়িগুলোর দিকে।
চোখ যায় নিমেষেই ওই দূরের রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়ানো লোকটির কোলে থাকা একটি বাচ্চা মেয়ের উপর। দুচোখ টলমল করে উঠে। সেই কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে ছুটে যায় সেদিকে। অজানা খুশি আর উত্তেজনায় যেন তার পা দুটো এগোতেই চায়না। সে হোঁচট খেয়ে পড়ে। পেছন থেকে কেউ একজন আঁতকে উঠে। রিপ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে উচ্চারণ করে,
‘ মা। আমার পরী মা…….
পেছনে দাঁড়ানো মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়ায় তার বাবা। বলে, নীর,,,,! মা হাতে এসব কি? নীরা পড়ে থাকা বাকি চুড়ি দুটো ও কুড়িয়ে নেয়। চেয়ে থাকে ওই ছেলেটির যাওয়ার দিকে। নীরার বাবা আবার বলে উঠে,
‘ কি কুড়াচ্ছিস তুই এসব?
নীরা বাবার দিকে ফিরে। দুহাতে তালুতে মেলে দেখায় সব চুড়ি। হাসে। তার বাবা মেয়ের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। বন্ধুর মতো তার বাবা মেয়ের মাথায় চাটি মারে। বলে, কি কুড়ানো হচ্ছে?
নীরা চুড়িগুলো হাতের তালুতে নড়াতে চড়াতে বলে,
‘ প্রেম। প্রেম কুড়ানো হচ্ছে। তুমি ও তো একসময় কুড়িয়েছিলে তাইনা? তুমিই তো বলো আমার মা তোমার কুড়িয়ে পাওয়া সহস্র সাধনার প্রেম। কি বাবা ঠিক বলছি তো?
নীরার বাবা নিঃশব্দে হাসে। রিপের যাওয়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,
‘ ওহহ,,, এই তাহলে সেই রাজকুমার?
___________
ইশা হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর এগোয়। একটি কালো গাড়ি এসে থামে তার সামনে। গাড়ির কাচ ভেদ করে বের হয় একটি মুখ। ঘৃণায় ইশার গা গুলিয়ে আসে। সে ঘৃণাসূচক শব্দ বের করে মুখ দিয়ে। বলে,
‘ কোথায় রেখেছেন আমার মেয়েকে?
‘ কি করে তোমার মেয়ে হয়? যদি তোমার মেয়ে হয় তাহলে তো মেরেই ফেলব। তুমি স্বামীর সাথে সাথে সন্তানহারা ও হবে।
ইশা হাসে। হাতের রিপোর্ট তুলে ধরে আজিজ চৌধুরীর সামনে। রিপোর্ট দেখে আজিজ চৌধুরীর চোখ কপালে উঠে।
‘ তুমি না এবরশন করিয়ে নিয়েছিলে? তাহলে ওই রিপোর্টটা?
‘ আপনাকে কেন বলব? শুধু এটুকু জেনে রাখুন, যাকে মারার জন্য ঘুরঘুর করছেন সে আর কেউ নয়। ডক্টর আদি চৌধুরীর কন্যাসন্তান। চৌধুরী বংশের উত্তরাধিকারী।
আজিজ চৌধুরী দাঁড়াল না। গাড়ি আবার ছেড়ে দিল। চলে গেল। ইশা সেই গাড়ির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যর হাসি হাসল। সে জানে আজিজ চৌধুরী কোনো ক্ষতি করবে না পরীকে। কিন্তু পরীকে যদি রেখে দেই???? এই ভয়টাই তো এতদিন সে পেয়ে আসছে।
____________
রিপ কেড়ে নেয় পরীকে জামালের হাত থেকে। জামাল হকচকিয়ে যায়। বলে, কে আপনি? কেড়ে নিলেন কেন?
পরী রিপের সাথে লেগে যায়। রিপকে আদর দিয়ে ডাকে, রিইইইইই।
রিপ কারো কথা শোনেনা। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় পরীকে। বুকের সাথে চেপে ধরে । পরীর মাথায় চুমু দিয়ে বলে, আমার মা……
পরী মা আমার। তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? কতটা মিস করেছি তোমায়? আদর দাও রিইইইকে।
পরী খিলখিল করে হেসে উঠে। রিপকে আদর দিতে দিতে চুল টেনে ধরে। চুলগুলো টেনে গালে দিতে চায়। রিপ আটকায়। পরীর কপালে চুমু দেয়। বলে, রিইইইকে মিস করেছ????
পরী খিলখিল করে হাসে। হাসতে হাসতে গাল লেপ্টে রাখে রিপের গালে। রিপের মাথা সে তার দিকে টানে। তার বুকের সাথে রিপকে লাগিয়ে রাখে। তারপর রিপের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে ডাকে,রিইইইইই আমমম।
রিপের নরম হাতগুলোর স্পর্শ পেয়ে হেসে কুটিকুটি হয়।
জামাল অবাক হয়ে দেখে পরীর কান্ড। যেন মা তার ছেলেকে বুকে নিয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। পরী তার মুখ লাগিয়ে রাখে রিপের মাথায়। জামালের দিকে তাকায়। ঠোঁট ফুলায় তারপর মোচড়ে দেয়। জামাল অবাক হয়ে দেখে পরীর কান্ড। বলে, মামুনি আসো।
রিপ শোনেনা জামালের কথা। পরী জামালকে ধমক দিয়ে বলে,
‘ ভোবববব।
জামাল ভড়কে যায়। ও মা মেয়েটার এত সাহস কখন হলো। তাকে ভোবব বলছে।
রিপ মাথা তুলে পরীর দিকে তাকায়। পরী তার দিকে তাকাতেই শান্ত হয়ে যায়। তারপরে কান্নাকন্ঠে জিজ্ঞেস করে,পাপপপপা? মামমমমমা?
রিপ হেসে দেয়। পাপপা আর মামমমা তোমাকে ছাড়া ভালো নেই মা। তুমি যাবে তাদের কাছে?
পরী মাথা নাড়ায়। জামালের দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলে, রিইইইই ওততো দুক্কু।
রিপ জামালের দিকে অগ্নিচোখে তাকায়। বলে, কে মেরেছে? কোথায় মেরেছে?
পরী তার ছোট্ট আঙুল দিয়ে ঠোঁট টেনে টেনে দেখিয়ে দেয় কপাল, হাত,মুখ। তারপর বলে, এতততো দুক্কু।
রিপ এদিকওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে থাকে। জামাল বুঝতে পারে তাকে মারার অস্ত্র খুঁজছে রিপ। সে দেয় ভৌ দৌড়। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। এটুকুনি একটা মেয়ে তাকে কেমন ভাবে ফাঁসায় দিল। বাপরে বাপ। এজন্যই বলে কারো ভালো করতে নাই। জামালের ওভাবে পালানো দেখে পরী হেসে কুটিকুটি হয়। রিপের গায়ে ঢলে পড়ে। রিপ ও হাসে। তৃপ্তির হাসি। কি আনন্দ! এই মা টাকে আগলে রাখবে সে । হারাতে দেবেনা আর। তার মায়ের মতো। কখনোই না।
_________________
আজিজ চৌধুরীকে দেখানো রিপোর্ট টা ব্যাগে ডুকানোর আগেই তার সামনে এসে দাঁড়ায় আর ও একটি গাড়ি। ইশা কিছু বুঝে উঠার আগেই ছেলেটি নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। ইশার হাত থেকে কেড়ে নেয় সেই রিপোর্ট। ইশা বিরক্ত হয়ে তাকায় ছেলেটির দিকে । তার ভাঁজ পড়া কপাল মিলিয়ে যায়। চোখদুটো আপনাআপনি বড় হয়। বুকের ভেতর ধুকপুকানি আপনাআপনি বেড়ে যায়। হাত পা ঠান্ডা বরফ। সে নড়তেচড়তে ভুলে যায়। ভুলে যায় ছেলেটির চেহারা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে। ভুলে যায় কথা বলতে। ভুলে যায় ছেলেটির হাত থেকে রিপোর্টটি কেড়ে নিতে। ভুলে যায় এক মুহূর্তেরর জন্য ছেলেটির কাছ থেকে তাকে দূরে থাকতে। তার মুখ দিয়ে বের হয় একটি শব্দ বহুদিন পর, ডক্টর????
ছেলেটি চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘ আজিজ চৌধুরীর সাথে আপনার কি??
এই রিপোর্টটা কিসের?……
বলতে বলতে থেমে যায় ছেলেটি। ডক্টর ডাকটি সে শোনে। কিন্তু তার বোধগম্য হয়না।
ইশা কেড়ে নেয় চট করে সেই রিপোর্ট। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটে। ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকে তার জায়গায়। ইশা সামান্য সামান্য দৌড়ে ও। এতবড় সত্যির মুখোমুখি হতে সে রাজী না। সে চায় চিরতরে এই সত্যিটা একেবারে লুকিয়ে যাক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার চাওয়া কখনোই পূরণ হবেনা। সত্যিটা এবার সামনে চলে আসল। পেছন থেকে পুরুষালি কন্ঠে ভেসে এল,
‘ ডক্টর আদি চৌধুরী কি করে মৃত হয়? আদি চৌধুরী বেঁচে আছে। আর সন্তান? মেয়ে? আমার মেয়ে? আর মিষ্টি? আপনিই কি মিষ্টি? তাহলে আমার বাচ্চা কোথায়? কার কাছে?
চলবে,