#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৯
#পুষ্পিতা_প্রিমা
ডক্টর ইমদাদ ইশাকে গাড়িতে উঠে বসতে বললেন। ইশা একবার গলা উঁচিয়ে আদিকে দেখে। আদি এখনো সেই জায়গায় দাঁড়ানো ইশা চট করে গাড়িতে উঠে বসে। পেছনের সিটে। ডক্টর ইমদাদ বললেন,
‘ তুমি ওভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন মিষ্টি? এনি প্রবলেম।
ইশা এবার জবাব দিল না। গাড়ির কাচ ডিঙিয়ে দেখার চেষ্টা করল আদিকে। কষ্ট লাগল তার। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে কে জানে?
ইমদাদ সাহেব আবার ও প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ এনিথিং রং মিষ্টি?
‘ আমার নাম মিষ্টি নয় স্যার। ইশা। ইশা আফরোজা।
ইশার সহজ গলায় সোজাসুজি জবাব।
‘ খুব সুন্দর নাম। ডক্টর কি মিষ্টি নাম দিয়েছিল নাকি?
‘ জি।
‘ এখনো মিষ্টি ডাকে? ডক্টর আছে তোমার কাছে?
ইশা থতমত খায়। বলে,
‘আমি এক জায়গায় যাব স্যার। আমাকে নামতে হবে।
ইমদাদ সাহেব হাসল। বলল, আমি জানি তুমি কোথায় নামবে। বসো। নামিয়ে দেবে ড্রাইভার। আমি আর কোনো প্রশ্ন করছিনা।
ইশা অপ্রস্তুত কৃত্রিম হাসল।
গাড়ি খান বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ইশা তড়িঘড়ি করে নামল। ইমদাদ সাহেবকে সালাম দিয়ে গেইটের ভেতর ডুকে যাওয়ার আগেই ইমদাদ ডাকলেন ইশাকে।
ইশা থমকাল। পিছু ফিরল।
ইমদাদ সাহেব হেসে বললেন,
‘ আদি তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল মিষ্টি তাই না??
তুমি ওকে দাঁড়িয়ে রেখে চলে এলে কেন?
ও কিন্তু মিষ্টির জন্য দাঁড়িয়েছিল। এই মিষ্টিকে আদি চিনবে কি করে, আমি নিজেই তো চিনতে পারছিনা। তুমি কি সেই মিষ্টি যে সারাক্ষণ ডক্টরকে হারানোর ভয়ে থাকত? আদি তোমায় ভালোবাসে মিষ্টি। জানো?
ইশা আর দাঁড়াল। এই চরম সত্যির মুখোমুখি হতে পারবে না বলেই তো ইশা মুখোমুখি হয়নি আদির। ডক্টরেরর মুখে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা খুবই লোভনীয়। তার চোখের কাতর চাহনি ও খুবই লোভনীয়। যে চাহনি দেখার মতো না। ইশা দেখতে পারবে না। তার লোভ করা মানায় না। সে ভালো এভাবে । খুব ভালো।
_________________
ছোট্ট পরীর পড়নে লাল শাড়ি। সাইজে একটু বড় হওয়ায় কুচি গোজায় পেটটা বড় লাগছে। মাথায় ঘোমটা পড়িয়ে দিল রিক। পায়ে একজোড়া নূপুর পড়িয়ে দিল। হাতে ছোট্টছোট্ট লাল চুড়ি। গলায় মালা পড়িয়ে দিলে পরী তা টান দিয়ে খুলে ফেলল। চুলকাচ্ছে। রিক শাড়ি পড়ানো শেষে সাজানো শেষে কোলে করে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসল পরীকে। পরীর হাতে আয়না ও দিল। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই আয়না দেখে কেঁদে উঠল।
ঠোঁট দেখিয়ে বলল, ইইইইইইই।
কেউ কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারল না।
মুনা চিনতে পারল না পরীকে। তালহা বেগম আর জহির মিয়া অবাক হয়ে দেখল পরীকে। ইশা তো চলতে চলতে থেমে গেল। পরী ইশার দিকে তাকিয়ে ডাকল, ফিপপপি ইইইইইই।
ইশা কিছু বুঝতে পারল না। রিক ইশার কোলে পরীকে দিল। বলল,
‘ একটু নে। আমি আসছি।
রিক চলে গেল উপরে। পরী ইশার দিকে তাকিয়ে বলল, ফিপপপি ওয়াহ না??
ইশা খিক করে হেসে দিল। বলল,
‘ মা বউ সেজেছে।
পরী ইশার মত করে টেনে বলল,
‘ মাআআ বৌউউউউউ।
পরী মাথা এপাশওপাশ দুলিয়ে বলল,
‘ বৌউউউ বৌউউউ….
রিক নেমে এল নিচে। হাতে মুনার শোকেসে রাখা সব লিপিস্টিক। রিক যতগুলো পারল ততগুলো নিয়ে আসল। মুনা অবাক হলো রিকের কান্ড দেখে। বলল,
‘ এসব আপনার হাতে কেন?
রিক কিচ্ছু বলল না। পরী রিকের হাতে লিপিস্টিক দেখে চিৎকার করে বলে উঠল,পাপপপা ইইইইইইই।
ঠোঁট দেখিয়ে বলল ইশাকে, ফিপপপপি ইইইই।
ইশাসহ বাকি সবার ঠোঁটদুটো আপনাআপনি আলগা হয়ে গেল। পরী লিপিস্টিক দিবে বলছে? ও আল্লাহ।
রিকের হাত কাঁপল। সে দিয়ে দিতে পারল না। ইশাকে বলল, ইশু একটু ইইই দিয়ে দে তো মা কে।
রিক কোলে নিল পরীকে। ইশা হাসার জন্য কিছু বলতে পারল না। পরী রাগ করল। ফিপি এভাবে হাসছে কেন?
তাকে কি সুন্দর লাগছে না?
পরী ঠোঁট টেনে বলল, ইশআআআআ ওয়াহ না?
ইশা হাসি থামাল। পরীর গাল জোরে টেনে দিয়ে বলল, ওয়াহ,ওয়াহ। মা খুব সুন্দর। বিউটিফুল প্রিন্সেসস।
পরী ইশার মত করে বলতে চাইল, বিটটটিফু।
ফু বলার সময় ঠোঁটটা গোল করে ফেলল। ইশা হাসতে হাসতে লিপিস্টিক লাগাতে পারল না। পরী ধমক দিল,
‘ ইশআআআআআআ ভোববববব। ইইইইইই। ইশআআআআআ???
ইশা থেমে গেল। রিক বলল,
‘ আর হাসিস না। একটু ইইইই দিয়ে দে তো।
পরী মাথা নাড়াল। বলল, ইইইইই ওয়াহ।
ইশা বলল, তাহলে নড়বে না। ওকে?
পরী মাথা নাড়াল। ইশা পরীর খুব কাছে গেল। কোলে নিয়ে সোফায় বসিয়ে লিপিস্টিক লাগাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কয়েকদিন থেকেছে দাদীর কাছে,, সব ডং শিখে গেছে।
পরী বুঝতে পারল ফিপপি তাকে বকা দিচ্ছে। ঠাসস করে চড় মারল ইশার নাকে। ইশা হকচকিয়ে গেল।
‘ মারলে কেন? আর দেব না ইইইইই।
পরী রেগে তাকাল। তুষ্টপুষ্ট গাল দুটো লাল টকটকে হলো। সোফা থেকে নিচে নেমে মেঝেতে বসে পড়ল। ঠাস ঠাস চড় মারল
মেঝেতে। যেন নিজের রাগ ঝাড়ছে। দুহাতের তালু দিয়ে ঠাসসস ঠাসস মেরে যাচ্ছে মেঝেতে। যেন কাউকে মারছে। ইশার এমন হাসি পেল রুম ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে করল। পুরো ড্রয়িংরুমের সবাই হাসল। পরী কাঁদতে কাঁদতে তাকাল রিকের দিকে। ইশার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,
‘ পাপপপপপপা ফিপপপি দুক্ককু। ইইইইই নায় নায়।
রিক হাসল। ইশা বলল,
‘ বড়দা ধরবে না। দেখি কি করে? কত বড় সাহস, হাত নাড়ানো শিখে গিয়েছে। যাকে তাকে মারছে। মাইর গুলো ও শক্ত। আমি ব্যাথা পেয়েছি। খুব মারব তোমায় পরী।
পরী ঠোঁট টেনে তাকাল মুনার দিকে, রিকের দিকে। মুনা এগিয়ে আসতে চাইল। ইশা বলল, যেওনা। দেখি কি করে।
পরী ধমক দিল ইশাকে। ইশআআআ, ইনননা।
ইশা হাত দেখিয়ে বলল, খুব খুব খুব মারব।
পরী কেঁদে দিল। হাত দেখিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, মাবববববো।
ইশা হেসে দিল। বলল, মুখে মুখে কথা বলা ও শিখে গেছে?
পরী হাত তুলে আবার নিচে নামিয়ে মেঝেতে আঘাত করল। বলল, ইশবআআআ মাবববো।
ইশা কোমড়ে হাত দিয়ে বলল, ঠাসস করে মারব।
রিক বলল, থাম না। কান্না করছে না?
পরী সবাইকে অবাক করে দিয়ে, মেঝেতে এবার মাথা ঠুকল। দুমদুম মাথা ঠুকল মেঝেতে। যেন সিজদাহ দিচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে গেল। পরী রাগে গজগজ করে করে মেঝেতে মাথা ঠুকে ঠুকে বলল,
‘ ইশআআআ মাববববো…. ইইই নায় নায়।
রিক দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল পরীকে। বুকের সাথে চেপে ধরল। পরী রিকের মুখে ঠাসস ঠাসস চড় মারল। বলল, ইশআআআআ মাবববো।
রিক শান্ত করতে করতে বলল, হ্যা হ্যা মারব। খুব খুব মারব।
সাথে সাথে পরীর কান্না থেমে। ইশার দিকে আঙুল দেখিয়ে হেসে বলল, ইশআআআআআ মাবববো।
ইশা আড়চোখে তাকাল। পরী আবার গুজে গেল রিকের কাঁধে। ইশাকে ভয় পেল। রিক স্পষ্ট শুনল পরী মিনমিন করে বলছে, ইশআআ মাবববো।
লাল টকটকে শাড়ি পড়ে পুরো ড্রয়িংরুম ঘুরল পরী। মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা বউ। পায়ের নূপুরগুলো শব্দহীন। হাতের চুড়িগুলো আওয়াজ তুলছে। পরী দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, পরররররী বৌউউউউউ।
রিক বলল, আমার মা লাল বউ।
পরী খিলখিল করে হেসে বলল, মাআআ নানন বৌউউউউ। সবাই হাসে। পুরো বাড়িটা যেন হাসে। ইশা হাসতে হাসতে আড়াল করে দাঁড়ায় সবাইকে। নিজেকে আড়াল। সাথে নিজের দুঃখগুলোকে। পরী এভাবেই হাসিখুশি থাকুক সবসময়। ভালো থাকুক। মা বাবা পরিবার নিয়ে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হোক। ভালো থাকুক তার বাচ্চা।
আর ভালো থাকুক বাচ্চার বাবা। ডক্টর। আইমির সাথে বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো। ডক্টর আবার এব্রোড চলে যাবে। নতুন করে সংসার সাজাবে। নতুন জীবনে পা রাখবে। দূরে যাবে কিন্তু ডক্টর তো ভালো থাকবে। তার অনিশ্চিত জীবনের সাথে ডক্টরকে জড়িয়ে কোনো লাভ নেই। ডক্টর কষ্ট পাবে অযথা। ডক্টরের জীবন ও তার সাথে সাথে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সে চেয়েছে,আজ ও চায় ডক্টর ভালো থাকুক।
সদর দরজা পেরিয়ে ডুকে পড়ল রিপ। হাতের ইউনিফর্মটা সোফায় ছুড়ে দিয়ে বসতে না বসতেই চোখ গেল লাল টকটকে শাড়ি পড়া ছোট্ট মেয়েটার দিকে। কি সুন্দর লাগছে মা টাকে। পরী দৌড়ে এল রিপের কাছে। মুখের সামনে দুহাত দিয়ে লজ্জা ঢেকে বলল, রিইইইইই পরররী বৌউউউউউউউ। ওয়াহ না??
রিপ হাসল। তবে নিঃশব্দে। বলল,
‘ মা,,, বর কই?
পরী কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবল। পরক্ষণে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল,জহির মিয়াকে। বলল,ওততততো।
উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠল। রিপ ও হাসল।
পরী কোমড়ে হাত দিয়ে ধমকে বলল,
‘ রিইইইই চককো দো।
রিপ পরীকে কোলের উপর বসাল। উচু করে রাখা ঠোঁট দুটো টেনে দিল। পরী হাত ডুকিয়ে দিল রিপের পকেটে। এত্তগুলো চকলেট বের করল। দুম করে রিপের গালে চুমু খেয়ে হাত দেখিয়ে রিপকে বলল,
‘ রিইইইইইই মাববববববো।
রিপ হেসে দিল। বলল, চককো নিয়ে আবার মাইর????
পরী মাথা নাড়াল। হাসল। নিজেকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলল, রিইইই বৌউউউউ।
ইশা দৌড়ে এল। হাতে পানির গ্লাস। বলল, রিপদা পানি নাও। রিপ পরীর সাথে বকবক করল। কিন্তু পানি হাতে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকাল না।
তালহা বেগম আসল। পরীকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘ এবার বউ নিয়ে আয় ঘরে। পরী ঠিকই বলছে। বিয়েশাদী তো করতে হবে। তাইনা?
পরী হাত তালি দিল। বৌউউউ বৌউউউউউউ।
রিপ চেয়ে থাকল মায়ের দিকে। অনেকক্ষণ চুপ থাকল। নীরবতা ভেঙে বলল,
‘ আমি তো এখানে থাকব না মা। আমি এখানে থাকার জন্য আসিনি। একেবারে আসিনি আমি। আমাকে যেতে হবে আবার। বিয়ের কথা কেন উঠছে?
ইশা চোখ পাকিয়ে দেখল তালহা বেগমের দিকে। মুনা অবাক হয়ে বলল,
‘ কোথায় যাবি। এখানেই তো ভালো পজিশনে আছিস? আর যাওয়ার কি দরকার?
রিপ কিচ্ছু বলল না। শুধু চলে যাওয়ার আগে এটুকু বলল,
‘ আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমার একার। আর কারো না। আমি যেটা বলব সেটাই হবে।
ইশার অবাক দৃষ্টি দেখল না রিপ। রিপদা আবার চলে যাবে? এরকম তো কথা ছিল না।
পরী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিপের দিকে তাকায়। ডাকে, রিইইইই।
তার ডাকের এই অর্থ হচ্ছে, রিইইই এসব কি বলছে। সে বুঝতে পারছেনা কেন?
____________________
আদি আসল চৌধুরী বাড়ি। আদি ফিরতে না ফিরতেই মিনি এসেই ভর করল তার কাঁধে। ডাকল, আদি। আদি। মিস ইউ। মিস ইউ।
আদি চুপচাপ বেরিয়ে আসল মিনিকে নিয়ে। পিছু ফিরে দেখল না কাউকে। মিনুমা দাঁড়াতে বলল, রাইনা বলল। দাঁড়াল না। রেহানের হাতে চকলেট বক্স দিয়ে বলল, এটা রাখো। কোনো প্রশ্ন করবে না। চাচ্চু আবার আসবে।
আলিয়া চৌধুরী নিচে নেমে আসার আগেই আদি গাড়ি ছেড়ে দিল। অত কথা শোনার সময় কই তার? তার যে অনেক কাজ বাকি? অনেক বোঝাপড়া বাকি।
এবার মেয়েটাকে মুখোমুখি হতেই হবে আদি চৌধুরীর সামনে। লুকিয়ে আর কতদিন থাকবে। কতদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে।
আদি ভেবে পায়না, কিসের এত ভয়,এত লাজ মেয়েটির?
নিজে দোষ করে এখন আবার গা ঢাকা দিয়ে আছে? কতটা নিষ্ঠুর,পাষাণ হলে মানুষ এমন করে?
তার তো কোনো দোষ নেই। সব দোষ ওই মেয়েটার। সব দোষ মেয়েটার। সব দোষ আলিয়া চৌধুরীর। সব দোষ আজিজ চৌধুরীর। সব দোষ ইমির। সব দোষ ওই মেয়েটার। কি নামে সম্বোধন করবে আদি তাকে? মিষ্টি নামে?
_____________________
সন্ধ্যে নামল শহরটাতে । বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। নীরা তার রুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। মৃদুমধুর পানির ছিটকি এসে পড়ছে তার মুখে। সে সরল না। আজ এই মন কেমনের সন্ধ্যায় বৃষ্টির স্পর্শ অদ্ভুত ভালোলাগা হানা দিচ্ছে মনেপ্রাণে। আজ নয়, এ কয়েকদিন ধরে। কারণ তার বাসার পেছনেই রয়েছে একটি দীঘি। ওই দীঘির স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা ছেলেটিই তার ভালোলাগার কারণ। তাদের বাসাটা দীঘির কিছুটা দূরে। জানালা দিয়ে দেখা যায় সেই দীঘির স্বচ্ছ জল। চারপাশে ঝোপঝাড় সেই দীঘির। ঝোপঝাড় বলা যায় না অবশ্য। কারণ ওই ঝোপঝাড় গুলোই সেই দীঘিটার সৌন্দর্য দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বড় করে বাঁধা একটি ঘাটের মতো। বেশকিছু দিন ধরে সে লক্ষ্য করল একটি ছেলের অবয়ব সেই দীঘির ঘাটে। তার কখনো দীঘিটিকে সুন্দর মনে হয়নি। দীঘির স্বচ্ছ জলে কখনো নিজেকে দেখার ইচ্ছে জাগেনি। দুতলায় তাদের বাসা। ঘনঘন বাসা চেন্জ করতে হয়। বাবার চাকরির বদলির জন্য। দুবছর হয়েছে এই বাসায় তারা উঠেছে। এবারই বোধহয় প্রথম, যেখানে তারা দুবছর থেকেছে। বাসা পাল্টাতে হয়নি। কিন্তু এই বাসার প্রতি তার কোনোকালেই মায়া জন্মায়নি। সবাই বলে দীঘিতে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলের কলকল ধ্বনিতে ও হারিয়ে যাওয়া যায়। মুগ্ধ হওয়া যায়। সেই কথা আজ অবিশ্বাস্য ভাবে সত্যি মনে হলো নীরার। ইচ্ছে করল ওই ছেলেটার পাশে বসে দীঘির স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে ঘোলা করে দিতে। তখন না হয় ছেলেটি একটি বার অন্তত রেগে কথা বলবে। তার দিকে তাকাবে। বলবে,
‘ এই মেয়ে কি করছ? নোংরা করছ কেন পানি?
তখন সে এক নিঃশ্বাসে চট করে বলে দেবে।
‘ করব না? আপনি যে আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। আপনি জানেন আমি কতরাত ঘুমায় না?
নিজের মনের এই অদম্য ইচ্ছাকে চট করে পূরণ করে ফেলতে ইচ্ছে হলো নীরার। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ওই ছেলেটার দিকে তাকাতেই তার হৃৎপিন্ড কেঁপে উঠে। সেখানে পাশে বসার ইচ্ছাটা পোষণ করা আর মুখে মুখে তর্ক করার বিষয়টা কি হাস্যকর নয়??
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির প্রকোপ বাড়ছে। ফোটা ফোটা বৃষ্টির ফোটা মিলিয়ে যাচ্ছে দীঘির জলে। নীরা গুনতে লাগল বৃষ্টির ফোটা।
‘ এক,দুই,তিন,চার,পাঁচ,ছয়,সাত…..
কিন্তু তার খেয়াল হলো ছেলেটি তো ভিজছে। আশ্চর্য ছেলেটা কি পাগল হলো? এভাবে ভিজছে কেন? আর এখানে এভাবে একা একা বসে থাকে কেন?
ইশা কি জানে তার ভাইটা পাগল হয়ে গেছে? এডভোকেট সাহেবকে তো দেখে মনে হয়না, প্রেমে পড়ে ছ্যাকা খাওয়ার মতো। তাহলে কিসের দুঃখে উনি ওভাবে ভিজবেন? আচ্ছা ছাতা নিয়ে গেলে কেমন হয়?
নীরা এবার আর দাঁড়াল না। নিজের এই দুদর্মনীয় ইচ্ছা পূরণ করার উত্তেজনায় সে খেয়াল করল না মা বাবার চোখে অদ্ভুত চাহনি। নীরার বাবা হেসে আওড়াল,
‘ প্রেমে পড়লে এমন হয় মাঝেমাঝে। আমি ও কি কম করেছি?
নীরা ছুটল ভিজে ভিজে। হাতের ছাতাটা ও খুলতে ভুলে গিয়েছে। বৃষ্টি শব্দটা পাল্টে সত্যি সত্যি এবার ঝড়ে রূপান্তর হলো। বৃষ্টি আর বৃষ্টি রইল না। তীব্র বাতাসে এলোমেলো হলো নীরার চুল। বৃষ্টির পানিতে লেপ্টে গেল সেই চুল মুখে, গলায় । নীরা সৌজন্য রক্ষার্থে হাতের ছাতাটা খুলল। কিন্তু সে কি কান্ডজ্ঞানহীন?
ছেলেটি ও তো ভিজেছে। সে ও ভিজে গেছে। এখন ছাতা দিয়ে কি হবে? এমন পাগলামোর কোনো মানে হয়? ছেলেটা দেখলে কি ভাববে কে জানে?
নিজেই নিজেকে বকল নীরা। দীঘির কাছাকাছি পৌছাতে সময় লাগল। যখন পৌঁছাল তখন দেখল ছেলেটি ভিজে জবজবে। আশেপাশের লোকজন অবাক হয়ে ছেলেটিকে দেখছে। নীরা বিরক্ত হলো নিজের উপর। সে কি চলে যাবে?
এতদূর এসেছে। আবার চলে যাবে?
বাতাসের ঝাপটায় রিপের মাথার চুলগুলো ও এলোমেলো হলো। তারপর ও তার ভাবনায় ছেদ পড়ল না। তার স্থির দৃষ্টি আর ও দৃঢ় হলো দীঘির জলে পড়া ফোঁটা ফোঁটা জলে। কি সুন্দর মিলিয়ে যাচ্ছে সব জল। তার অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো ও যদি মিলিয়ে যেত এভাবে। লুকিয়ে তো রেখেছে। এবার মিলিয়ে গেলে মন্দ হতো না।
নীরা যখন তার উলটপালট ভাবনায় মগ্ন তখন রিপ তাকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। নীরা তখন তার জায়গায় দাঁড়িয়ে। লজ্জায় তার কান্না করে দিতে ইচ্ছে হলো। পিছু ফিরে দৌড় দিতে পারল না। না সামনে তাকাতে পারল। ছাতাটা ও বাতাসের দাপটে হাত থেকে উড়ে যেতে চাইল। সে ছাতাটাকে শক্ত করে ধরল। মুখ বরাবর ধরে রাখল যাতে না সরে, কেউ তার মুখ না দেখে। রিপ এগোতে এগোতে থমকে গেল । নীরা ছাতায় মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে দোয়া দরূদ পড়তে লাগল।
তার প্রার্থনা সফল হলোনা। বাতাস তার বড়ই উপকার করল। ছাতাটাকে নিজের করে নিল। উড়িয়ে ফেলে দিল। পড়ে রইল ছাতাটি এককোণায় । নীরার ভয়ার্ত মুখশ্রী ভূমিষ্ঠ হলো ছেলেটির সামনে। সে ছাতা উড়ে যাওয়ায় চট করে চোখ খুলে সামনে তাকাল। চোখগুলো তখন বড় বড় অবস্থায়। ভয় ঢেউ খেলে খাচ্ছে চোখেমুখে । ভয়ে ভয়ে সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি ভাবলেশহীন। অনুভূতিহীন। চাহনি অবাককর নয়। প্রেমে পড়ার মতো নয়। প্রেমে ফেলার মতো। ঠিক সেটাই হলো। প্রেমে পড়ে গেল তার সামনে দাঁড়ানো রমণীটি। আবার ও। নতুন করে।
যদি সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি তার দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে না থাকত, বৃষ্টি জলে ভিজে ভিজে সে বলে উঠত,
‘ আজ প্রেম এসেছে বৃষ্টি হয়ে। মন কেমনের প্রেম এসেছে আজ মন কেমনের বৃষ্টি হয়ে, মন কেমনের সন্ধ্যায় ।
কিন্তু সে বলতে পারল না। নড়তে পারল না। শুধু চোখ বন্ধ করে নিল। সেইভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় বিড়বিড় করে বলল,
‘ থেমে যাক। থেমে যাক। সময়টা এখানেই থেমে যাক। এখানেই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাক। তার চোখের দৃষ্টি শুধু আমাতে,শুধু আমাতেই নিবদ্ধ থাক।
কিন্তু মেয়েটি যদি একটিবার চোখ মেলে দেখত,তাহলে দেখতে পেত ছেলেটি বহুআগেই উদাও হয়েছে তার সামনে থেকে। তার যে নতুন করে আর কারো প্রেমে পড়া সম্ভব নয়। সে তো বোধহয় নীরা নামের মেয়েটিকে দেখলই না। প্রেমে কিভাবে পড়বে? বরঞ্চ প্রেমে ফেলে চলে গেল।
মেয়েটি চোখ মেলে সত্যিই কাউকে দেখল না। ছেলেটি রেখে গেল তার এক মন কেমন করা নিঃশ্বাসের মিষ্টি সুবাস। রেখে গেল এক মন কেমন করা অনুভূতিদের তীব্র আন্দোলন। রেখে গেল এক তৃষ্ণার্ত প্রেমিকার দুটো চোখ। কিন্তু দেখে গেলনা একটিবার পিছু ফিরে,,, নীরা নামের মেয়েটির হৃদয়সিন্ধুকে তারই নাম লেখা হয়েছে বহু আগে, বৃষ্টিপথিক নামে। দেখে গেল না। দেখা হলো না। কবে দেখবে? কবে চোখে পড়বে?
চলবে,,