#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩১
#পুষ্পিতা_প্রিমা
পরী ধপ করে বসে পড়ে গেইটের কাছাকাছি। উচ্চস্বরে কান্না করে। মুনা এসে কোলে নেয়। হাত পা ছুড়ে কান্না করে পরী। মুনাকে প্রশ্ন করে,
‘ আমমমা নাই?
মুনা বুকে চেপে ধরে। আদর দেয়। পরী ঘেমে একাকার হয়। বলে, মিননি নাই। রিইইইই নাই। পাপপা নাই। ইশআআ নাই। নাই। নাই।
মুনা ও কেঁদে দেয় তার সাথে। বলে, আছে মা। সবাই আছে। সবাই আসবে। রিইইই আসবে। পাপপা আসবে। ইশআআ আসবে। মিননি ও আসবে।
পরী কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়ে। নাকের পানি চোখের পানি মুছে দেয় মুনার গায়ে। বলে, আমমমা নাই??
_____
ঘুমের ঔষধ কেন খেয়েছে ডক্টর মেহতাব প্রশ্ন করলে ও তার সঠিক উত্তর দিতে পারল না জহির মিয়া।
‘ ইশা সুইসাইড করার মতো মেয়ে না। ও সুইসাইড করেনি।
‘ কিন্তু এটা বললে তো হবেনা। পুলিশ তো এটা শুনবে না। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ তো কখনো এতগুলো ঘুমের ঔষধ খাবেনা। কারণটা কি?
জহির মিয়া বলেন। আপনি পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করুন। ও উঠলে তারপর না হয় ওর জবান নেবেন।
_______
চোখের দুটোর নিচে অর্ধচন্দ্রকার কালো ছাপ। চেহারা মলিন,বিবর্ণ, ফ্যাকাসে। মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে । চারপাশ বিষণ্ণ লাগছে ইশার। চোখমেলে তাকানোর আগে চোখে জমে থাকা জলগুলো কানের দিকে গড়াল। পিটপিট করে তাকাতেই চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের অবয়ব। বাচ্চা মেয়েটি কাঁদছে। নাকের পাটা,গালের দুপাশ,চোখদুটোর আশপাশ ভীষণ লাল। চোখদুটোর পানিগুলো ও বোধহয় লাল। বাচ্চা মেয়েটি ঠোঁটে এলিয়ে হাসার চেষ্টা করল তাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে। ডাকল, আমমমমা।
ইশা অবাক হয়ে দেখল মেয়েটিকে। আদুরে কন্ঠে ডাকল মেয়েটিকে,
‘ মা,,,,
ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি তার ডাক শুনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তার চোখ। ঠোঁট ফুলিয়ে নিজের চোখের জল দেখিয়ে বলল, “আমমমা দুক্কু।
ইশা হেসে দিল। বলল, আমমমা দুক্কু দিয়েছে?
পরী মাথা নাড়ল দুপাশে। বলল, দুক্কু মিননি। দুক্কু ইশআআ। দুক্কু রিইইইই। দুক্কু পাপপপা।
ইশা হেসে দিল এবার। মেয়েকে বুকের উপর শুইয়ে চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিয়ে দিয়ে বলল,
‘ মাকে সবাই দুক্কু দেয়? কেউ পাপ্পি দেয় না? কেউ আদর করেনা?
পরী ইশার বুকের উপর শুইয়ে মিনিমিন করে বলে, নান নান না।
নাই। রিইইইই নাই। নাই নাই।
ইশার বুক কেঁপে উঠে। নাই মানে? পরক্ষণে নিজেকে বুঝ দিল পরী কি না কি বলছে। কিন্তু বেশিক্ষণ নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারল না। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ডাকল জহির মিয়াকে।
‘ মামা…..
পরী তার বুক থেকে মাথা তুলে তাকাল। ইশার মতো করে ডাকল, মামমমমমা…..
ইশা হাসল। বলল, এটা তোমার মামা নয়।আমার মামা।
পরী তার বাম হাত দিয়ে ঠাসস করে চড় মারল ইশার ঠোঁটের উপর। ঠোঁট টেনে বলল,
আমমমাল মামমমা!
ইশা বলল, না আমার।
পরী বলল, নান না আমমমাল।
ইশা আবার ও বলল, আমার মামা। শুধু আমার মামা।
পরী হাত পা ছুড়ে মারল ইশাকে। প্রশ্ন করার মত করে চিকন গলায় বলল, আমমমাল উমম আমমমাল?
ইশা হেসে দিল। বলল, বলেছি না আমার। তোমার না। আমার মামা।
পরী মাথা দিয়ে মারল ইশাকে। ধমক দিয়ে বলল, ইশআআ ভোববব।
ইশা হো হো করে হাসল। বলল, তুমি চুপ। একদম কথা বলবে না।
পরী ইশার মত করে বলার চেষ্টা করল। ‘ ববববেনা। না। না। বববেনা। মাববো।
ইশা হাসতে হাসতে ডাকল,মামা তুমি আছ?
দেখো পরী আমায় মারছে।
পরী যেন বুঝল তার নামে নালিশ দেওয়া হচ্ছে। ইশার গলায় মুখ নিয়ে গিয়ে কামড় দিতে চাইল। কিন্তু চোখ গেল কেবিনের দরজার সামনে।
একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। চোখ সরাচ্ছে না। পরী ভয় পেল। ইশার গলায় মুখ গুজল। মিনমিন করে ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, মাববো।
ইশা কিছু না বুঝে বলল, কাকে মাবববেন।
সারাক্ষণ শুধু মাবব মাবব করেন কেন? হাতটা আজকাল বেশি চলছে আপনার।
পরী আবার ও মুখ তুলে তাকাল ছেলেটির দিকে। আবার ও ইশার গলায় মুখ গুজল। কান্নাকন্ঠে ডাকল, মাবববো! মাববো।
ইশা হাসল। বলল, আচ্ছা মারিয়েন। মারছেন না কখন?
পরী তার কথা শুনল না। আড়চোখে তাকাল আবার ছেলেটির দিকে। চোখ রাঙিয়ে তাকাল ছেলেটির দিকে। ছেলেটি ও তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। পরীর এবার জোরে চেপে গেল ইশার গলায়। এক নিঃশ্বাসে বলল, মাবববো মাববো। পরররী নাই নাই।
ইশা বলল, জানি নাই পরী। এবার সরো ফিপির উপর থেকে, ব্যাথা পাচ্ছি।
পরী ঠাস করে মারল ইশাকে। বলল, না না নান না।
ইশা তাড়াতাড়ি বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, ব্যাথা পাচ্ছিনা। ব্যাথা পাচ্ছি না। তুমি থাকো। মা কি ঘুমোবে?
পরী দেখল দরজার পাশটাই। ওমা ছেলেটা গেল কোথায়। পরী হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগল,
‘ নাই। নাই। পরররররী নাই। ইশআ নাই।
কিন্তু পরেই আচমকা ঠোঁট বাঁকাল। ঠোঁট টেনে লম্বা করল। ইশা অবাক হলো। বলল, কি হয়েছে মা?
পরী হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠোঁট টেনে ভাঙা কন্ঠে বলল,
‘ নাই। রিইইই নাই। পাপপা নাই। নাই। নাই। মিনননি নাই।
ইশার ডাক দিল আবার,
” মামা……
জহির মিয়া আসল। তবে চেহারায় একরাশ বিষণ্ণতা ঢেউ খেলে যাচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ইশার। পরীর সাথে হাসে। ইশা চেয়ে থাকে দরজার দিকে।
‘ রিপদা, বড়দা কোথায় মামা? তারা আসেনি? সামান্য কিছুর জন্য আমায় হসপিটালে কেন আনলে?
জহির মিয়া মলিন হাসল। বলল, এখানে তোর ডক্টর নেই। আমি জিজ্ঞেস করেছি অন্যান্য ডক্টরদের। আদি চৌধুরী বেশ কয়েকদিন ধরে ডিউটিতে একটিভ নেই। ইশা মাথা এলিয়ে দিল বালিশে। হাঁফ ছেড়ে বলল,
‘ বিয়ের বলে কথা। ব্যস্ততা ভীষণ।
জহির মিয়া চেয়ে রইল ইশার মুখের দিকে। কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলি কেন?
ইশা চোখ উপরে তুলে দেখল জহির মিয়াকে।
‘ ঘুম আসছিল না। খারাপ লাগছিল। তাই খেয়েছি। পরীর সাথে একটু ঘুম….
‘ পুরো স্লিপিং ফিলের পাতা খেয়ে নিয়েছিস। তুই কি পাগল ইশু? আজ রিপ থাকলে কি হতো? ছেলেটা শুনলে কি হবে?
ইশা বসে পড়ল। পরীকে কোলে রাখল। জহির মিয়ার দিকে তাকিয়ে একরাশ চিন্তা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ রিপদা থাকলে মানে? কোথায় রিপদা? মামা চুপ থেকোনা। কোথায় রিপদা? রিপদা নেই?
ইশার আওয়াজ বড় হয়। তার উচ্চবাচ্য শুনে পরী ভড়কে গেল। কোল থেকে নেমে দাঁড়াল। তারপর বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে জহির মিয়ার পেছনে পান্জাবী ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।
ইশার গাল ভিজে গেল মুহূর্তে। সে নেমে গেল বেড থেকে। জহির মিয়া আটকাল। কোথায় যাবি তুই। নেই রিপ। চলে গেছে। আমার ছেলেটাকে এবার একটু ভালো থাকতে দে ইশা। ইশা চুপ হয়ে যায়।
‘ রিপদা ভালো ছিল না এতদিন? আমি খারাপ রেখেছি তাকে? আমিই?
জহির মিয়া বলতে পারেনা আসল কথা ছেলের দিয়ে রাখা উদ্ভট শর্তের কারণে। ছেলেটা কি চেয়েছে? শেষমুহুর্তে এসে ও তো মেয়েটা কিছুই বুঝল না।
ইশার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না জহির মিয়া। শুধু চেয়ে রইল নিচের দিকে।
ইশা দৌড়ে গেল কেবিনের বাইরে। মাথার একপাশে হাত দিয়ে এদিকওদিক দেখল। কাউকে দেখল না। কয়েকটা নার্স দৌড়ে এল। ইশা তাদের বারণ শুনল না। দৌড়াতে লাগল হন্য হয়ে। হোঁচট খেয়ে পড়ল আবার হসপিটালের মেঝেতে। হাতে ব্যাথা পেল। নার্স এসে তুলল। ইশার কান্না থামল না। নার্সদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাটুগুজে কাঁদতে লাগল। জহির মিয়া ইশারায় নার্সদের কেবিনে নিয়ে যেতে বলল। সবাই তাই করল। কেবিনে নিয়ে গিয়ে ইশাকে শুইয়ে দিল নার্স। ডক্টর মেহতাব আসলেন। বললেন, তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না ইশা। পুলিশ না আসা পর্যন্ত।
ইশা শুনল না কারো কথা। কাঁদতে কাঁদতে মাথা রাখল বালিশে। রিপদা চলে যাওয়ার আগে একটিবার তাকে কেন জানাল না? এতটা পর সে। রিপদা তাকে কেউ মনে করেনা। আবার রিপদাকে দেখবে না সে? রিপদা এটা কেন করল?
কান্না চোখে ঘুম ভর করল। দুচোখ ঝাপসা ঝাপসা হতে হতে সে দেখল ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটিকে। বাচ্চা মেয়েটি তাকে ঘুম যাওয়ার জন্য ইশারা করে বলছে, ইশআআআ তা তা। তা। তা।
তলিয়ে যায় সে ঘুমের দেশে। জহির মিয়া পরীকে শুইয়ে দেয় ইশার পাশে। বলে, দাদাই ঘুমাও। আমি এক্ষুণি। আসছি। মাম্মামের কাছ নিয়ে যাব।
জহির মিয়া বেরোয়। পরী ইশার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ও ঘুম আসে। আজ সোজা মায়ের বুকে শুয়ে পড়ল সে। ঘুম এল দুচোখে। কিন্তু সে নিজেই তা স্থায়ী হতে দিল না। ইশার গালে গাল লাগিয়ে বলল, ইশআআ,, পরী নাই। পরী নাই। নাই। নাই।
হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়ে বলল,
‘ তা তা। ইশআআআআ তা তা।
পরী বেরিয়ে গেল কেবিনের বাইরে। গুটিগুটি পায়ে হাঁটল। দু একজন নার্স এসে জিজ্ঞেস করল,
‘ কোথায় যাচ্ছ বাবু। এদিকে এসো। কোলে এসো।
পরী রেগে তাকাল। হাত দেখিয়ে বলল, ভোবব। মাববো।
নার্সগুলো গেল পরীর পিছু পিছু। পরী তাদেরকে পিছু পিছু আসতে দেখে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়াল। বলল,
‘ মাববো।
নার্স মেয়েদুটো হাসল। বলল,
‘ তুমি মারতে জানো?
পরী দৌড়ে এল। নার্স মেয়েটির গালে ঠাসস করে চড় বসাল। বলল, মাবববববো।
ছোট্ট মেয়েটি খেয়ালই করল না একটা বাজে ছেলে তার পিছু পিছু তাকে ফলো করছে।
পরী এক পা এক পা করে হাঁটল। নার্স মেয়েটি তার পিছু পিছু ঘুরল। ডক্টর মেহতাব দেখল পরীকে। খালি পায়ে পরীকে দেখে বলল, খালি পায়ে কেন? জুতো কোথায় মামুনি?
পরী ভ্রুকুঞ্চন করে তাকাল ডক্টর মেহতাবের দিকে। বলল, দুতো নাই। নাই। নাই।
ডক্টর মেহতাব হাত বাড়িয়ে বলল, কোলে আসো। পাপ্পি দেই।
পরী মারার জন্য হাত পেছনে করে তুলল। চোখ রাঙিয়ে বলল, ইননা মাবববো।
পরী দৌড়ে গেল অন্যদিকে। নার্স মেয়েটি দৌড়ে গেল। পরী ততক্ষণে কোথায় উদাও হলো। নার্স মেয়েটি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল। এটুকুনি একটা ছোট্ট মেয়ে, কি অসভ্য! গেল কোথায়?
_______________
জহির মিয়া আসল কেবিনে হাতে চিপসের প্যাকেট নিয়ে । কানে ফোন। মুনা বলছে, বাবা পরীকে নিয়ে আসুন। ওঁকে খাওয়াতে হবে। গোসল করাতে হবে। অনেকক্ষণ হয়েছে। জহির মিয়া মাথা নেড়ে ইশার দিকে তাকাতেই দেখল ইশা বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু পরী কোথায়?
জহির মিয়া চেঁচিয়ে উঠল। ইশু? পরী কোথায়??
ইশাকে গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকল জহির মিয়া। ইশা হকচকিয়ে উঠে বসল। বুকে হাত দিয়ে জোড়াল শ্বাস নিয়ে বলল, কি হয়েছে মামা?.
জহির মিয়া মাথায় হাত দিয়ে বলল, পরী তোর সাথে ঘুমিয়েছে না? কোথায় গিয়েছে?
ইশার বুক ধড়ফড় করে উঠল। ক্লান্ত শরীর চলতে চাইল না। সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল বেডে। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
‘ সবাই চলে যাচ্ছে আমাকে ছেড়ে। রিপদা চলে গেল। পরী কোথায় গেল। তুমি বাইরে দেখো না?
জহির নিয়া মাথায় হাত দিয়ে বলল। ও হেঁটে হেঁটে বেরিয়ে গেছে মনে হয়। বেশিদূর যেতে পারবে না। আচ্ছা আমি দেখছি। হসপিটালের নার্সগুলোর সাথে দেখা হলো জহির মিয়ার। তারা ক্ষোভ নিয়ে বলল,
” আপনারা কেমন অভিভাবক? ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়েকে ছেড়ে দিয়েছেন?
‘ কোথায় এখন পরী?
নার্স মেয়েটি বিতৃষ্ণা নিয়ে উচ্চারণ করল।
‘ জানিনা। ওর পেছন পেছন অনেক দৌড়লাম। কোথায় লুকিয়ে গিয়েছে আর বেরোচ্ছেনা।
ডক্টর মেহতাব আসলেন। বললেন, পুঁচকুটা তো আমার সাথে অনেক কথা বলেছে। কোথায় গিয়েছে?
ইশা বের হয়ে আসল। জহির মিয়াকে বলল, মামা ফোনটা দাও। আমি জানি পরী কোথায় গিয়েছে।
জহির মিয়া ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কোথায় গিয়েছে? ও একা একা কোথায় যাবে? কার কাছে ফোন দিবি?
ইশা নাম্বার তুলে ফোন দেয় আজিজ চৌধুরীকে। আজিজ চৌধুরী ফোন ধরার সাথে সাথে ইশা উদ্ভ্রান্তের মতো চেঁচিয়ে বলল,
‘ আমাকে নিজের গোলাম বানিয়ে রাখিয়ে রাখার জন্য এখন ছোট্ট মেয়েটাকে ও ব্যবহার করছেন? লজ্জা হয়না। লজ্জা নেই আপনার? ছিঃ পশুর চেয়ে ও অধম আপনি। আপনারা।
পুরোটা সময় আজিজ চৌধুরী চুপ থাকলেন। কোনো টু শব্দ করলেন না। ইশা যখনই রাগ ঝেড়ে খানিকটা শান্ত হলেন তখন আজিজ চৌধুরী বললেন,
‘ ও আমার কাছে নেই। যদি আমার কাছে থাকত আমার চাইতে খুশি কেউ হতোনা।
ইশা কানে নিল না সেই কথা? বলল, মিথ্যুক। একদম মিথ্যে বলবেন না। আমি বিশ্বাস করিনা আপনাকে।
ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ইশা কাঁপাকাঁপা পায়ে হাঁটে। ডক্টর মেহতাব ইশাকে আর আটকাল না। ইশা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায় হসপিটাল থেকে। মিনুমাকে ফোন দেয়। কান্নার আওয়াজ আরো জোড়াল ও হয়। মিনুকে কিছু বলতে না দিয়ে সে বলে,
‘ ওরা আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে গেছে মিনুমা। পরী নেই আমার কাছে। আমি যেটা নিয়ে ভয় পায় সেটাই হয়। ডক্টর! ডক্টর কোথায়? মিনুমা ডক্টর কোথায়?
মিনুমা শক্ত জবাব দেয়।
‘ ও বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। আসিস কাল বিয়ে বাড়ি। তোর তো খুব শখ নিজের স্বামীর আবার বিয়ে দেখার। কাঁদছিস কেন তুই? তোর মেয়ে দেখ হয়ত নিজে নিজেই তার জন্মদাতাকে খুঁজে নিয়েছে।
মিনু ফোন কেটে দেয়। ইশা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ডক্টরের কাছে পরী? না এ কি করে হয়? পরীকে আমি দেব না। কাউকে দেব না। পরী আমার মেয়ে।
ইশার পেছন পেছন আসে জহির মিয়া। বলল, তুই চলে যাহ চৌধুরী বাড়ি। নিয়ে আয় পরীকে। পরীকে ওখানেই আছে। যাহহহহ।
রাস্তায় পুরোটা সময় ইশা চুপ হয়ে ছিল। কিন্তু বাসায় পা রাখার সাথে সাথে ইশার মনে হলো পুরো বাড়িটা খালি। রিপদা নেই। পরী ও নেই। রিক বেরিয়ে আসল। বলল, পরী কই? বাবা পরী কোথায়? কোথায় রেখে এসেছ? কার কাছে পরী?
ইশা ছুটে গেল রিকের কাছে। বলল, বড়দা রিপদা কোথায়? চলে গিয়েছে? নেই এখানে? রিপদা চলে গেলে আমি আমার মেয়েকে আর ফিরে পাব না। রিপদা পারবে ওকে এনে দিতে। বলোনা রিপদা কোথায়?
রিক দাঁড়িয়ে থাকল শক্ত হয়ে। বলল, আবার ও ইশু। আমি কি এবার ও চুপ করে থাকব? তুই বলেছিলি এমনটা কখনো হবেনা। তাহলে? এখন তো বারবার সেটাই হচ্ছে। ওরা কি শুরু করেছে?
ইশা কিচ্ছু বলতে পারল না। দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না তাই বসে পড়ল মেঝেতে। কাঁদল না। দিশেহারা হয়ে পড়ল। কি করবে এখন সে। ডক্টর সত্যই নিয়ে গেছে পরীকে? কি চাইছে ডক্টর?
ইশা শুনল। মুনা কথা বলছে ফোনে কারো সাথে। তার কন্ঠস্বর কান্নায় ভরপুর। ইশা ফোন কেড়ে নিল মুনার হাত থেকে। ফোনের ওপাশের ছেলেটির সাথে দুটো কথা বলার আগে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। হিঁচকি তুলে তুলে ডাকল, রিপদা……..
ছেলেটি চুপ হয়ে শুনল মেয়েটির কান্না। ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিল তার এতদিনের রাগগুলো। মেয়েটির কান্নাগুলো যে দেখার মতো না। শোনার মতো না। ছেলেটি বলল, আমি পুলিশ স্টেশনে আছি। দেখছি।
ইশা আর ও জোরে কেঁদে দিল। এই মানুষটাকে সে ঠকিয়েছে? যে তাকে আগলে রেখে এসেছে চিরটাকাল। এখন তার মেয়েকে ও। জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে কেন জানাল না একটিবার রিপদাকে। এই অপরাধবোধ আর কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে ?
এই বিয়েটাই যে সব নষ্টের মূল। সে একদিনের জন্য ও ভালো ছিল না এই বিয়েটার পর। না এখন ভালো আছে। তার ঘেন্না হয় নিজের উপর। অমন একটা মানুষকে সে কেন ভালোবাসল। যাকে ভালোবেসে শুধু কষ্টই পেতে হলো।
_________________
ইশা যখনি পৌঁছাল পুলিশ স্টেশনের সামনে। বাইরে ওই নির্জন জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে একটি ছেলেকে রেগে কথা বলতে দেখা গেল ফোনে। ইশাকে দেখার সাথে সাথে সে কথা বলা বন্ধ করে দিল। ইশা দৌড়ে গেল। জাপটে জড়িয়ে ধরল। বলল, আমি জানতাম তুমি যাবে না। তুমি আমাকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারো না রিপদা। তুমি যেওনা।
রিপ দাঁড়িয়ে থাকে শক্ত ভঙ্গিতে। সোজাসাপ্টাভাবে বলে, ছাড়।
ইশার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। রিপ কর্কশ গলায় বলে,
” আমি আজ হোক না কাল ঠিকই যাব । পরীকে পার্মানেন্ট ভাবে বড়দার কাছে দিয়ে যাব। আর যারা এই নোংরা খেলা খেলছে তাদের শাস্তি দেব। আপনি মিসেস চৌধুরী,, আপনাকে যেতে হবে আদি চৌধুরীর কাছে। আদি চৌধুরীর মুখোমুখি হয়ে জানতে চাইব বউ রেখে সে আবার বিয়ের পিড়িতে বসে কি করে?
ইশা দু পা পিছু হাঁটে। বলে,,আমি? আমি চাইনা ডক্টরের কাছে যেতে। আমি যেতে পারব না। তুমি এমনটা করো না রিপদা। তোমাদের সাথে থাকব আমি। থাকতে চাই শেষ অব্ধি। আমি যেতে চাইনা ডক্টরের কাছে। ডক্টর দূরে থাকুক। আমি ফিরতে পারব না। বুঝার চেষ্টা করো রিপদা।
রিপ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ইশা তার পা ধরে রাখে, মাথা এলিয়ে দেয়। বলে, তুমি যাবেনা রিপদা। আমি দেখতে চাই তোমাকে শেষঅব্দি। আমাকে এতবড় শাস্তি দিওনা রিপদা। শাস্তি শব্দটাকে আমি ভয় পাই রিপদা। আমার ভয় হয়। আমি আর নিতে পারছিনা। আমি ভালো নেই রিপদা। তুমি আমাকে ইশু বলে ডাকোনা। আমার মাথায় হাত রাখোনা। আমার সাথে ভালো করে দুটো কথা বলোনা। বারবার দূরে চলে যেতে বলো। আমার কষ্ট হয় রিপদা। তুমি প্রতিশোধ নিচ্ছ রিপদা? তোমাকে দেওয়া কষ্টগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছ?
তুমি এমনটা করোনা রিপদা। ডক্টরের কাছে যেতে বলোনা। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে দুবছর আগে। আমি ডিভোর্সি। ডক্টর আর আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। আমি চাই ডক্টর এখন ভালো থাকুক। অন্য কারো সাথে ভালো থাকুক। কারণ ডক্টর আমার সাথে ভালো থাকবে না। আমি ভালো রাখতে পারব না। আমি জড়াতে চাই না আর। ফেরা সম্ভব নয় রিপদা। আমি শেষটা অব্ধি তোমাদের সাথে থাকতে চাই। আমাকে এই শেষবারের মতো আশ্রয় দাও রিপদা। দূরে ঠেলে দিওনা। আমি যাওয়ার আগে কারো কাছে আশ্রয় চাই না রিপদা। শুধু তোমার কাছে চাই। তুমি আমাকে আগলে রেখেছ এতগুলো বছর। শেষ পর্যন্ত ও আগলে রেখো রিপদা। যেওনা তুমি।
রিপ পা সরায়। সামনাসামনি বসে ইশার। তার গলার কাছে যেন কাঁটা বিঁধে গেছে। বহুযন্ত্রণায় কাতর কাতর হতে হতে জিজ্ঞেস করল,
‘ তোর কি হয়েছে ইশু?
ইশা যেন এবার ধরা পড়ল। রিপ গর্জে উঠল। তার গর্জনে আকাশ বাতাস একাকার হলো। ইশাকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ এই তুই চুপ মেরে গেলি কেন? কি হয়েছে তোর? তুই চলে যাবি? কোথায় যাবি। দেশ ছেড়ে? নাকি পৃথিবী ছেড়ে? তুই কোথায় যাবি? বল।
ইশা হাসল। শক্ত করে রিপকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আমি কতদিন পর তোমার মুখে ইশু ডাকটি শুনলাম রিপদা। দেখো তুমি এখনো আমায় নিয়ে কতটা ভাবো। কে বলেছে, তুমি আমার কেউ নও?
রিপ শক্ত হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। এই ছলনাময়ী তার আসলরূপ বের করার জন্য এতক্ষণ অভিনয় করছিল? রিপ উঠে দাঁড়াল। আর পিছু ফিরে তাকাল না। মেয়েটির দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করল না।
________________
বাথটাবে বসিয়ে রাখা মেয়েটির দিকে এক নজরে চেয়ে থাকল ছেলেটি। বাচ্চা মেয়েটির কান্না থামল বাথটাবে বসিয়ে দেওয়ায়। আদি দেখল ডাগর ডাগর দুটো চোখ। নরম তুলতলে হাত পা। চিকন চিকন চুল। চোখের পাপড়িগুলো লম্বা লম্বা। বাথটাবের পানিতে হাত নেড়ে নেড়ে খেলা করছে। ফোলা ফোলা চোখমুখে খিলখিল করে হাসছে। ডাকছে,পাপপপপা। মামমমমা। আদির কষ্ট লাগল। কাঁপাকাঁপা হাতে ছুঁল মেয়েটিকে। বাথটাব থেকে তুলতেই মেয়েটি আবার ও কেঁদে দিল। ডাকল, মামমা, পাপপপা।
আদি আবার বসিয়ে দিল তাকে বাথটাবে। একা এই ফ্ল্যাটটাতে আর কেউ নেই। এখন কে শান্ত করাবে মেয়েটিকে। কে বুঝাবে তাকে, এই ছেলেটিই তার বাবা। বাবার কোলে আসতে কি সমস্যা। কান্নাকাটি কেন?
পরী হাত দিয়ে নেড়ে নেড়ে পানি ছিটকি দেয় আদির মুখে। আদি কোলে তুলে নেয় বলে,, ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
পরী কান্না করে। চেঁচিয়ে কান্না করে। আদির চুলগুলো ইচ্ছেমত টানে। কেঁদে কেঁদে বলে, মাবববো।
আদি হাসতে পারেনা। তার হাসি আসেনা। তার নিজের মেয়ে তার কাছে থাকতে চাইনা। সব মিষ্টির দোষ। মিষ্টিকে সে ছাড়বে না। আর ও কষ্ট দেবে। নিজের কাছে এনে। ছুঁতে দেবেনা মেয়েকে।
পরী কান্না করে। আদি পরীর জন্য আনা কাপড়গুলো থেকে বেছে একটা লাল রঙের ফ্রক নেয়। সেটি পরীকে পড়িয়ে দিতে কষ্ট হয়। পরী অনবরত কাঁদে। কিচ্ছু খায়না। আদির দিকে ফিরে তাকায় না। আদি মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে খাটের উপর বসে পা মেলিয়ে কান্নারত মেয়েটির মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে অসহায় হয়ে। এটি তো তার মেয়ে। নিজের মেয়ে। তাকে চিনতে পারছেনা কেন? তার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।
পরী নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদে। ডাকে, পাপপপা মামমমা।
আদি খাবার আনে। বক্স ভর্তি চকলেট আনে। পুরো রুম খেলনাপাতি দিয়ে সাজায়। পরীকে মাঝখানে বসিয়ে রাখে। তারপর হাসানোর চেষ্টা করে। পরী নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মিনমিন করে বলতে থাকে, নাই ইশআ নাই। পাপপা নাই। মামমা নাই। রিইইই নাই। দাদদা নাই। মিননি নাই।
আদি পরী কি বলছে তা শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝতে পারেনা।
আদি ফোন দেয় আলিয়াকে। সিক্ত কন্ঠে ক্ষোভ নিয়ে বলে, মা আমার মেয়ে আমায় চিনতে পারছেনা। কান্না করছে। ও খেলছে না। কথা বলছেনা। আমার হাতে খাচ্ছে না। সব তোমাদের জন্য হয়েছে। ও যতদিন আমায় না চেনে, আমায় বাবা না ডাকে ততদিন আমি তোমাদের কাছে ফিরব না। তোমাকে মা ডাকব না। আজিজ চৌধুরীকে ও বাবা ডাকব না। আর মিষ্টি? মিষ্টিকে আমি ছাড়ব না।
________________
অবিরত নিজের ফোনটা বাজায় ইশা মেঝে থেকে উঠে। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিল।ফোনের ওপাশ থেকে তীব্র ক্রোধ নিয়ে বসে থাকা ছেলেটি শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছ মিষ্টি?
রাগ দেখাতে পারল না। কি আশ্চর্য!
ইশা সোজাসুজি বলল,
‘ আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছেন আমি কেমন আছি?
‘ তোমার মেয়ে কি করে হয়? সে তোমাকে মা ডাকে?
ইশা চুপ থাকেনা। ক্ষোভ নিয়ে বলে, আপনার জন্য ডাকেনা। কারণটা আপনি। আপনি শেষ করে দিয়েছেন আমার জীবনটা। আপনাকে বিয়ে করে দয়া দেখানোটা আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আদি চোখবন্ধ করে হেসে আবার আলুথালু হয়ে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটিকে টেনে নেয় নিজের বুকের কাছে। ফোলা ফোলা চোখদুটোতে ঠোঁট ছোঁয়ায়। নিজের চোখদুটো চেপে ধরে ছোট্ট মেয়েটার ছোট্ট হাতটাতে। ফোনের ওপাশের মেয়েটিকে বলে,
‘ তোমার রেখে যাওয়াটা শাড়িটা আমার কাছে আছে মিষ্টি। পুতুলটা ও আমি রেখেছি যত্নে। বকুল ফুলের মালাটি ও। তোমার প্রত্যেকটা স্মৃতি আমি আঁকড়ে ধরে রেখেছি। কিন্তু তুমি রাখোনি। কিচ্ছু রাখোনি। তুমি নিজেই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে। নিজেই আমাকে বিয়ে করেছিলে। নিজেই আমাকে ভালোবেসেছিলে। ওহ সরি। ভালোবেসে ছিলে নয়, দয়া দেখিয়েছিলে।
ইশা চুপ থাকে।
আদি এবার গর্জে বলে,
‘ আমি বলেছি আমাকে দয়া দেখাতে। বলো? চুপ করে থাকবে না মিষ্টি। বলো। আমি বলেছি দয়া দেখাতে। বলেছি আমাকে বিয়ে করতে? করেছ কেন? কেন করেছ? আমি যাইনি তোমার কাছে। তুমি নিজেই এসেছ। আবার চলে গিয়েছ। এখন দোষটা আমার?
তুমি আমার মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছ অন্যের কাছে মিষ্টি। সে আজ অন্যকে বাবা ডাকে। আমাকে নয়। তুমি এত বড় অন্যায় করেছ তোমার ক্ষমা হয়না। তোমার কতবড় সাহস তুমি অন্যের হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিয়েছ। তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয় মিষ্টি। তুমি আসলেই সাহসী। অতটা সাহস না থাকলে কেউ নিজের স্বামীর বিয়ে শুনে চুপ থাকতে পারেনা। আসলেই সাহসী তুমি। তোমাকে কিভাবে ভাঙানো যাবে মিষ্টি। কিভাবে কষ্ট দিলে তুমি ভাঙবে। কষ্ট পাবে। তুমি সত্যিই কোনোদিন আমাকে ভালোবাসোনি মিষ্টি। দয়া দেখিয়েছ। দেখাচ্ছ।
ইশা চুপ করে শোনে। বলে, বিয়ে করে নিন। আর আমায় শাস্তি দিন। যান।
আদি হাসে।
‘ করব। কেন করব না? সেজন্যই তো মেয়েকে এনেছি। ইমিকে দিয়ে দেব পরীকে। তোমার কাছে ফিরতে দেব না। তুমি দেখবে না আর পরীকে। তোমার শাস্তি এটাই। যাও এবার যা করার করো। থানা পুলিশ, কোর্ট-কাছারি,আদালত এক করো। পরী আমার কাছে থাকবে। তোমার মতো নিকৃষ্ট মহিলার কাছে নয়। ঘৃণা করি আমি তোমায়।
ফোন কেটে দেয় আদি। ইশা হাঁটুগুজে বসে থাকে। কাঁদেনা শুধু হাসে। পাগলের মতো হাসে। হেসে হেসে বলে,
‘ আপনি মিথ্যেবাদী ডক্টর। ঠিক আপনার বাবা মায়ের মতো। আমি দেব না পরীকে। কেড়ে নিয়ে আসব আইমির হাত থেকে। ও শুধু আমার মেয়ে। এতবছর পর এসে বাবা হতে আসছেন?
_________________
তখন মাত্র বিয়ের তোড়জোড় চলছে। আইমিকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে না। আদি তাকে কেন নিচে ডাকল। তাদের তো রাতেই ভালোমন্দ কথা হলো।
আইমি কিছুক্ষণ এদিকওদিক হাঁটল। তারপর তার চোখ গেল তার দিকে এগিয়ে ছেলেটির দিকে। কোলে একটি ছোট বাচ্চা। বাচ্চা মেয়েটি কেঁদেই চলেছে। আইমি অবাক হলো। কে মেয়েটি?
আদি আসার সাথে সাথে পরীকে দেখাল আইমিকে। বলল, চিনতে পারছ ইমি কে হতে পারে বলোতো?
আইমি হাসার চেষ্টা করে বলল, আজ আমাদের বিয়ে আদি?
এটা কেমন মজা? কে এই বাচ্চাটি?
আদি হাসল। বলল, আদি চৌধুরীর মেয়ে।
আইমির বিস্ময় আকাশ ছুঁল।
‘ মানে? কি?
আদি নির্বিকার জবাব দিল।
‘ কি জিজ্ঞেস করছ? তাহলে শোনা এই ছোট বাচ্চা মেয়েটিই হলো তোমার শাস্তি।
আইমির চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু ফোটা জল। আদি হাসল তা দেখে।
বলল, কিসের শাস্তি জানো?
‘ আমাকে মিথ্যে বলার শাস্তি। আমার কাছ থেকে মিষ্টিকে দূরে সরানোর শাস্তি। আমি মিষ্টিকেই ভালোবাসি সেটা মিথ্যে প্রমাণ করার শাস্তি। আমাকে পাওয়ার লোভ করার শাস্তি। আমাকে ভুল বোঝানোর শাস্তি। জোর করে ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়ার শাস্তি। আমি তো অর্ধেক সুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম মিষ্টির সেবায় কিন্তু তোমার কারণে আমাকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্ল্যানটা তোমার ছিল ইমি। আমি এতদিন কোথায় ছিলাম জিজ্ঞেস করেছিলে না? রহস্য খুঁজে বের করতে গিয়েছিলাম। আর আমার ট্রিটমেন্ট। আমি তোমাকে ধরে ফেলেছি ইমি।
তুমি কেমন ভালোবেসেছ আমাকে? দুটো আঘাত পেলে নাহয় পেতে? তারপর ও আমার অসুস্থতার সময় আমার পাশে থাকতে পারতে। মিষ্টির মতো। আমি মিষ্টিকে কত আঘাত দিয়েছি। শুধু আমি নয় চৌধুরী বাড়ি প্রত্যেকটা সদস্য তাকে যেখানে সহ্য করতে পারত না সেখানে,,, ও আমার জন্য থেকে গেছে। দিনরাত আমার সেবা করেছে। আমি আঘাত দিলে ও ভালোবাসা হিসেবে গ্রহণ করেছে। আজ মিষ্টি আমাকে চায়না ইমি। ও স্বীকার করে আমাকে ভালোবাসাটাই ওর ভুল। আমাকে বিয়ে করাটাই ওর অপরাধ। কেন বলে জানো? তোমাদের জন্য বলে। তোমরা শুধু নিজের স্বার্থ চেয়েছ ইমি। মিষ্টির ভালোটা দেখোনি? মিষ্টির মতে করে তুমি কখনো আমায় ভালোবাসোনি ইমি। দেখো মিষ্টির কোনো লোভ নেই আমার প্রতি। ও ফিরতেই চায়না আমার কাছে। তোমার জন্য। তোমাদের জন্য। এই দেখো এই বাচ্চাটা আমার। আমার মেয়ে। আমাকে বাবা ডাকেনা তোমার জন্য ইমি। আমাকে চেনে না ইমি। আমার কষ্ট হয় ইমি। তুমি কেন করলে ইমি? এটা কেমন ভালোবাসা? ভালোবাসাই শুধু চাওয়ার শব্দটা থাকলে হয়না ইমি। দেওয়ার শব্দটা ও থাকতে হয়। তুমি আমায় কিচ্ছু দাওনি ইমি। দিয়েছ মিথ্যে আশ্বাস, মিথ্যে বিবৃতি। নিজের ভালো থাকাটাকে মূল্য দিয়েছ। আমার ভালো থাকাটা কোথায় তা জেনে ও তুমি আমাকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছ। তুমি জানো, জানতে সেই প্রথম থেকে আমি তাকে ভালোবাসতাম। সেই বৃষ্টিরূপে। তখন ও তুমি মাকে বলে মিথ্যে কথা বলেছিলে আমাকে। সবাই আমাকে মিথ্যে বলেছে,
‘ মিষ্টি অন্য কাউকে ভালোবাসে। তার বিয়ে ঠিক আছে। সবটা মিথ্যে বলেছ। মা মিথ্যে বলেছে আমায়।
মিষ্টি শুরু থেকে আমার ছিল। আমার আছে। মাঝখানে তোমার ষড়যন্ত্রের কারণে আমাকে দূরে যেতে হয়েছে মিষ্টির কাছ থেকে। কতটা কষ্ট হয়েছে মিষ্টির? অনুভব করতে পারো? পারো না। কারণ তোমার মন বলতে কিচ্ছু নেই। তুমি নির্দয়। পাষাণ ইমি। তুমি ঠকিয়েছ আমায়। তুমি অপরাধী ইমি। ভালোবাসি শব্দটা তোমার মুখে মানায় না ইমি। তুমি ভালোবাসতে জানো না। পারো না। শিখে নিও। চলি।
আদির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আফাজ আহমেদ ও। পেছনে ইমদাদ সাহেব। আইমির দিকে তাকায় আফাজ আহমেদ। বলে, ইমি আদির মেয়ে????
আইমি কাঁদে না। শুধু বলে আজ সবটা শেষ হয়ে গেল বাবা। সবটা শেষ হয়ে গেল। আইমি সত্যি ভালোবাসতে জানে না। কিন্তু আমি তো শিখতে চেয়েছিলাম। পেরে উঠতে পারিনি। আমাকে শেখানো হয়নি বাবা। আদি ঠিকই বলেছে। কোথায় মিষ্টি কোথায় ইমি?
চলবে,