#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩২
#পুষ্পিতা_প্রিমা
অবিরত কাঁদার কারণে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে পরীর। আদির কাঁধে পড়ে রয়েছে ক্লান্ত হয়ে। আদি মলিন চেহারায় পা রাখল চৌধুরী বাড়িতে। তাকে দেখে আগে ছুটে এল মিনি। মিনি এখানে কি করে এল আলিয়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে দেরি হলোনা আদির। আদি মিনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এখানে এসেছে। মিনি উড়ে এল। আদির কাঁধে বসল। ডাকল,
আদি প্রিন্সেস। মিস ইউ। মিস ইউ।
পরী আদির কাঁধ থেকে মাথা তুলে তাকাল। মিনিকে দেখে ফোলা ফোলা চোখমুখে একটুখানি হেসে ডাকল,
‘ মিনননি……
মিনি খুশি হয়ে এদিকওদিক উড়ল। ডানা ঝাপটাল। আলিয়া মিনুমা রাইনা ছুটে এল। আলিয়া পরীকে আদির কোলে দেখে খুশিতে যেন কেঁদে দিল। সে এক্ষুণি যাচ্ছিল আইমিদের বাসায়। আফাজ আহমেদ ডেকেছেন শীঘ্রই। এমন সময় আদির আগমন অপ্রত্যাশিত। আর আদির কোলে পরী কি করে?
পরী এতক্ষণ পর হাসল। হাত হাতে তালি দিয়ে ডাকল, মিননি..
মিনি উড়ে পরীর হাতে ঠোকর দিয়ে আবার উড়ে গেল। পরী আদিকে হাত দেখিয়ে বলল, দুক্কু। মিনননি মাবববো।
আদি হাসল। হাতটাতে ফুঁ দিয়ে বলল, মিননি দুক্কু দিয়েছে?
পরী মাথা নাড়াল। আদি জড়িয়ে ধরল। বলল, আমরা এখন বাসায় যাব। মিননিকে সেখানে খুব মারব।
পরী তার মতো করে বলল, মাববো।
আলিয়া চৌধুরী সামনাসামনি এসে দাঁড়াল। পরীকে ছুঁতে চাইল। আদি সরে গেল। বলল, মিসেস চৌধুরী আমি এখানে থাকতে আসিনি। আর আমার মেয়েকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না।
আলিয়া চৌধুরী এবার সবার সামনে কেঁদে দিল। বলল, ওকে আমার কোলে দাও আদি। তুমি এখানে থাকো। ও থাকুক। সবার সাথে থাকলে আর কাঁদবেনা। দাও।
আদি সরে গেল। বলল, না। ও শুধু আমার সাথে থাকবে। দেব না।
মিনুর কাছে ছুটে গেল আলিয়া। বলল, মিনু তুমি আটকাও না আদিকে। আদিশা আমাদের সাথে থাকলে ভালো থাকবে। মিনু গেল। আদি অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকল। মিনু পরীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এসো দাদু আমম খাবে?
আদি বলল, আমম কি?
পরী হাতের মুঠো গালে দিয়ে বলল, আমম। মাম। পাপপা, মামমা।
আদি দেখল পরীকে। বলল, আমি খাওয়াব। চলো।
আলিয়া ধরে ফেলল আদির হাত। নিজের দুহাতের মুঠোয় আদির হাত নিয়ে বলল,
‘ এমন করোনা আদি। ওর একটু ও অযত্ন হবেনা।
পরী তারমধ্যেই কেঁদে উঠল। বলল, পাপপা,মামমা নাই। নাই।
আদির চেহারা আবার ও বিবর্ণ রূপ ধারণ করল। আদি পা বাড়াল চলে যাওয়ার জন্য। আলিয়া আদির হাত ধরে রাখল। বলল, এতবড় শাস্তি দিওনা আদি। আমি মিষ্টির কাছে ক্ষমা চাইব। দোষ স্বীকার করব। তুমি নিয়ে যেওনা আদিশাকে। প্লিজ আদি। অনুরোধ করছি।
আদি মিনুর দিকে তাকাল। মিনু মাথা নাড়াল। পরী সিড়ি বেয়ে নামা রেহানকে দেখে আদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওতততো।
আদি রেহানকে দেখে বলল, ভাই….. তোমার ভাই…
পরী আদির মুখে মুখে জপতে লাগল, ব্বেই ব্বেই….
রেহান দৌড়ে এসে আদিকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আমার চাচ্চু। পরী আদির কোলে থেকে নিচু হয়ে রেহানকে ছুঁতে চাইল। হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল রেহানের চুল, বলল, আমমাল চুচচচু।
আদি হেসে দিল। রেহান তার চুল ধরে বলল, চাচ্চু আমি ব্যাথা পাচ্ছি। ছাড়তে বলো।
পরী ছাড়ল না। রেহানের চুল টেনে গালে দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, আমমমাল।
আদি আর ও নামিয়ে দিল পরীকে। পরী রেহানের চুল শক্ত করে ধরল, মুখের কাছে রেহানের কপালে লালা লাগিয়ে দিয়ে বলল, আমমমাল চুচচু আমমাল।
রেহান একগাল হাসল। সাথে হাসল আদি। পরী ও হাসল। হাসতে হাসতে ঝাপ দিল রেহানের কোলে।
রেহান কোলে নিয়ে আদর করল পরীকে। পরী রেহানের দুগালে মেরে মেরে বলল, ব্বেই ব্বেই। মিননি।
রেহান পরীকে কোলে নিয়ে বলল, তোমার মা কোথায়? কাকিয়া কোথায় চাচ্চু? কাকিয়া আসবে না?
পরী রেহানের মুখে মুখে বলল, আমমা। আমমা নাই। নাই নাই।
আদি তাকাল আলিয়ার দিকে। আলিয়া মাথা নিচু করে ফেলল। আদি কোলে নিয়ে নিল পরীকে বলল, আববা আছে। আমমাকে দরকার নেই।
পরী ঠাস করে মারল আদির নাকের উপর।বলল, আমমা নাই? মাববো। মাববো।
আদি চলে গেল নিজের রুমে। পরীকে দিল না কাউকে। রাইনা গেল। বলল,তুই ফ্রেশ হয়ে নে। পরীকে আমাকে দে।
আদি দিতে চাইল না। পরে বলল, আর কাউকে দেবে না। এখানেই বসে থাকো।
রাইনা তাই করল, পরীকে নিয়ে বসে থাকল। আদি ফ্রেশ হয়ে আসল। পরীকে ফ্রেশ করে দিল। রাইনা বলল, ওকে নিয়ে খেতে আয়।
পরীর সামনে বসল আদি। পরী কতক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওর দিকে,যেন নতুন করে চিনছে। নতুন করে অনুভব করছে। কিন্তু মুখে ফুটে বাবা ডাকটি বেরোলো না। যা শোনার জন্য আকুঁল হয়ে অপেক্ষা করছে ছেলেটি। পরী আদির ভেজা চুলে হাত ডুকিয়ে দিল। এলোমেলো করে দিল আদির চুল। খিলখিল করে হাসল। চুলগুলো টেনে গালে দেওয়ার মতো করে বলল, আমম।
আদি তাকে কোলে নিয়ে নিল। বলল, চলো আম খাবে।
পরীকে আদি নিজ হাতে খাওয়াল। মিনু আর রাইনা আর রেহানকে ছাড়া কাউকে ছুঁতে ও দিল না। আজিজ চৌধুরী আর আলিয়া চৌধুরীকে ছুঁতে দিল না। নিজ হাতে খাওয়াল। নিজ হাতে সবটা করল। পুরোটা দিন মেয়ের সাথে কাটাল। মেয়েকে বুকের উপরে শুইয়ে ঘুম পাড়াল। মিননিকে পেয়ে পরী তার কান্না যেন ভুলে গেল। মিনি আর আদির সাথে খেলতে খেলতে উচ্চারণ করল, পাপপা নাই। মামমা নাই। রিইইই নাই। আমমা নাই।
আদি শুনল মেয়ের মুখ থেকে বের হওয়া কথাগুলো। যখন আদি ছিলনা তখন কি পরী বলেছিল, বাবা নাই?
বুকের ভেতর হওয়া নীরব আর্তনাদ গুলো কেউ দেখল না। কেউ বুঝল না।
পরী খেলা করছে মিনির সাথে। অদৃশ্য কিছু খাইয়ে দিচ্ছে মিনিকে। যখন আদিকে দেখল আদির দিকে হাতের মুঠো বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমম?
আদি ছোট্ট হাতটাতে আলতো করে কামড় দিল। বলল, খেয়েছি আম্মি।
পরী খিলখিল করে হাসল। আদির কাছাকাছি গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পাপ্পি।
আদি বুঝে হাসল। মেয়ের গালে মমতা,স্নেহ, ভালোবাসার স্পর্শ দিল বেশ গাঢ় করে। পরী ও দিল। বাবার চোখের নিচে লালা লাগিয়ে বলল, আমমমমি।
আদি বলল, আববা ডাকো একবার। ডাকো।
পরী চেয়ে থাকল আদির দিকে। হাতটা উপরে তুলে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, ইননননা মাবববো।
আদি সরে গেল। নিজের দুচোখ যেন লুকোলো। ফোন দিল মিষ্টিকে। মিষ্টি শুনল না তার আঁকুতি। বলল, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন আমার কাছে। নইলে আমি পুলিশের কাছে যাব।
আদি চুপ হয়ে গেল। সে বলতে পারল না,
‘ মিষ্টি পরীকে বলো আমাকে বাবা ডাকতে।
কিন্তু বলল না। পুলিশে যাবে মিষ্টি। যাক।
আদি হাসল। দুষ্টুমি করে বলল, মিষ্টি তোমার মেয়েটা তোমার মতোই হয়েছে। পুরোটাই বজ্জাত, নিমকহারাম।
ইশা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।
‘ আমার মেয়ের নামে উল্টাপাল্টা বলবেন না। নাহলে,
‘ নাহলে কি করবে? মেরে ফেলবে। উফফ ভয় পেয়েছি।
ইশার বিরক্ত লাগল। এই লোকটা তাকে নিয়ে মজা করছে??
আদি বলল, মিষ্টি আমার আর ও একটা পরী লাগবে। এই পরীটা আমায় চেনেনা। পরী টু যখন আসবে আমি তাকে আমার কাছে রেখে দেব। তোমাকে যখন ও চিনবে না, তোমাকে যখন মা ডাকবে না তখন তুমি বুঝবে কতটা কষ্ট হয়। তার আগে বুঝবে না। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে পরী টু আনার ওয়েটা কি?
আবার কি পাগলা ডক্টর সাজতে হবে নাকি? আমি তো কিছুই জানিনা।
রাজ্যের বিরক্তি ভর করল ইশার কন্ঠে। আর রাগ। বলল, বেয়াদব লোক।
ফোনটা কেটে দিলল তারপর পরই। আদি হো হো করে হেসে উঠল। পরী চেয়ে রইল তার হাসির দিকে। বলল, মাববো।
আদি তার মুখ বাড়িয়ে দিল পরীর দিকে। বলল, সারাক্ষণ মাবব মাবব করেন কেন? আমমা শিখিয়েছে তাই না?
পরী মাথা দুপাশে দুলিয়ে বলল, আমমা নাই।
আদি একগাল হাসল। বলল, আমমা আছে, ফোন দেব? হ্যালো বলবে?
পরী মাথা একপাশে কাত করে সায় দিল। আদি ফোন দিল ইশাকে। ইশা ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে বলল, দেখুন মিঃ চৌধুরী ডং করার সময় নেই আমার। যা বলতে চাইছেন ক্লিয়ার করে বলুন।
আদি বলল, আমার মেয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।
ইশা অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনার মেয়ে কখন হলো? ও আমার মেয়ে।
আদি বলল, ‘ ঝগড়া পরে করো এখন নাও কথা বলো। ও আমার মেয়ে।
আদি পরীর কানের কাছে ফোন রাখল। পরী ফোনটা আদির কাছ থেকে কেড়ে নিল । নিজে নিজেই রাখল কানের নিচে। মৃদুস্বরে ডাকল, আমমমা?
ইশা চুপ হয়ে শুনল সেই ডাক। বলল, মা টা কেমন আছে?
পরী মৃদুস্বরে আবার ও ডাকল, আমমা…
ইশা হাসল। বলল, আমমার কাছে আসবে না?
পরী আবার ও ডাকল, আমমা।
ইশা বলল, পাপপা মামমমা মিস করছে তোমায়। দাদাই মিস করছে। রিইইই মিস করছে। কখন আসবে?
পরী আচমকা দুম করে কিল বসাল বিছানার চাদরে। আওয়াজ করে বলল, মাবববো।
ইশা অবাক হলো। মেয়েটা সারাক্ষণ এসব কি বলে?
ইশা হাসল। বলল, কাকে মাববেন আপনি?
পরী কাঁদোকাঁদো হয়ে আবার বিছানার চাদরে মেরে বললো মাবববো ইনননা মাবববো।
ইশা বুঝতেই পারল না সব আদির কারসাজি। আদি চোখ রাঙিয়ে তাকাচ্ছে পরীর দিকে। যাতে পরীর মুখ দিয়ে বের হয় মাবববো। আর মিষ্টি তা শুনুক।
আদি হাত নাড়িয়ে বলল, পরী মাবববো।
পরী চেঁচিয়ে উঠল। রাগ ঝেড়ে বলল, মাবববববো।
তারপর পরই চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। আদি তাড়াহুড়ো করে ফোন কেড়ে নিল। ইশাকে বলল, আমার মেয়ে তোমাকে সহ্যই করতে পারে না। দেখো ও আমাকে আদর করছে, আর তোমাকে মারবে বলছে। সো স্যাড মিষ্টি। মাত্র দুদিন হয়েছে এনেছি এরমধ্যেই তোমাকে ভুলতে বসেছে। ওহহো এবার দেখো কি হয়?
ইশা অবাক হলো। বলল, কি করছেন ডক্টর। পরী কাঁদছে। ওকে থামান আগে।
আদি চুপ মেরে গেল। পরীকে কোলে তুলে নিল। পরীকে শান্ত করিয়ে বললো।
‘ ভালো লাগল।
ইশা ক্ষেপে বলল,
‘ কি?
আদি হেসে বলল,
‘ ওই যে ডক্টর ডেকেছ?
ইশা ধরে পড়ে চোর যেমন করে তেমন তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমি…….
আদি কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘ ভাগ্যিস ডক্টর হয়েছি, যদি ডক্টর না হয়ে অন্যকিছু হতাম,তাহলে তুমি কি ডাকতে?
নিশ্চয় ডাকতে মুচি,নাপিত, দর্জি, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, ব্যবসায়ী, মাস্টার,প্রকৌশলী?
কেমন কেমন লাগত মিষ্টি! ডক্টরই বেস্ট। তোমার মুখে ওটাই ভালো মানায়।
‘ আমার নাম মিষ্টি নয়। ইশা। যদি ডাকতে হয় ওটাই ডাকবেন। আপনি করে বলবেন। তুমি করে নয়। আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই অহেতুক ফোন দিবেন না। কাল যথাসময়ে আমার মেয়েকে এনে দেবেন খান বাড়িতে। ওর সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ওর মুখে বাবা ডাক শোনার চেষ্টা করবেন না। আপনি ওর কেউ নন।
আদি অবাক হলো মিষ্টির মুখে অতটা কঠোর কথা শুনে। কিন্তু দেখাল না । মিষ্টিকে বুঝাল না। বলল, ও যদি তোমার মেয়ে হয় তাহলে ও আমার ও মেয়ে। একশবার বলব। হাজারবার বলব।
ইশা সাথে সাথে রুক্ষ কন্ঠে জবাব দিল।
‘ ও আমার মেয়ে নয়। আমার ভাইয়ের মেয়ে। আমার ভাইঝি। ও আমাকে ফিপি ডাকে। আমার ভাইঝিকে কোন সাহসে আপনি আপনার কাছে রেখেছেন? দিয়ে যাবেন নাহলে দেখবেন আমি কি করি? কেড়ে নিয়ে আসবো।
বিষাক্ত তীরের ফলা হয়ে বিঁধল সেই কথাগুলো ছেলেটির কানে। একজন বাবার কানে, ও আমার মেয়ে নয়। আমার ভাইয়ের মেয়ে।
মেয়েটি এতটাই পাষাণ যে বুঝতে পারল না। অনুভব করতে পারল না ছেলেটির হাহাকার। মেয়েটি ফোন রেখে দেওয়ার আগেই শোনা চাপা কন্ঠস্বর,
‘ বুক কাঁপল না এমনটা বলতে? কাঁপল না?
ইশা ফোন কেটে দিল সাথে সাথে। ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে মেরে শুয়ে পড়ল। চোখদুটো বালিশে চেপে ধরল,সেই অবস্থায় কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরী আদির কাঁধে পড়ে রইল। ছোট্টছোট্ট করে ডাকল, এব্বে এব্বে এব্বে।
আদি তার মাথা তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু পরী উঠল না। উল্টাপাল্টা বকতে বকতে ঘুমিয়ে পড়ল বাবার কাঁধে । আদি সারারাত নিজের উপর শুইয়ে রাখল পরীকে। ভয় ভর করল তার সাহসী মনে। মিষ্টি পরীকে কেড়ে নেবে না নাতো? মিষ্টির সাথে কি সে লড়াইয়ে পারবে?
___________________
একটি মিষ্টি সকাল এল। সেই মিষ্টি সকালটাতে আলিয়ার চোখে পড়ল এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একটুকরো সোনালি রোদের আভা ছুয়ে দিল বেতের চেয়ারে বসা বাবা, আর তার কোলে ঘুমন্ত ছোট্ট মেয়েটির মুখটাতে। মেয়ের মাথায় মুখ লাগিয়ে চোখবুজে আছে ছেলেটি। আলিয়া ছুঁতেই যেন কেঁপে উঠল। মেয়েকে কোলের উপর যত্নসহকারে নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
‘ ও ঘুম থেকে উঠে কান্না করছিল। তাই এখানে এসে বসেছি। আপনি এখানে কি করছেন?
আলিয়া বলল, ‘ আদিশা কয়দিন থাকবে এখানে?
আদি রেগে গেল অমন কথা শুনে।
‘ ও আমার মেয়ে। আমি যেখানে থাকব ও সেখানেই থাকবে। যতদিন,যতবছর থাকতে ইচ্ছে হয়। কেন আপনার কি সমস্যা?
পরী নড়েচড়ে উঠল। আদির কন্ঠস্বর শুনে বিরক্তি নিয়ে নড়েচড়ে আওয়াজ করল, উমমম,উমমমম।
আদি পিঠে চাপড় দিয়ে আবার ও ঘুম পাড়াল। বলল, আপনার সাথে আমার কথা নেই। যান।
আলিয়া চলে গেল। আসল কথাটি সে বলতে পারল না। ছেলের হাসিখুশি মুখটা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখতে মন চাইল না।
পরীর ঘুম ভাঙল সাড়ে সাতটার দিকে। আদি ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে বসে আছে মেয়ের পাশে গালে হাত দিয়ে। পরী নড়েচড়ে উঠল। উপুড় হয়ে শুয়ে মুখ তুলে তাকাল আদির দিকে। আদি যখন তাকে দেখে হাসল,সে ঘুম ঘুম কন্ঠে হাতটা উপরে তুলে বলল, মাবববো।
আদি আবার ও হাসল। বলল, মাববেন নিন মারেন। কিন্তু আপনার মায়ের মতো মারিয়েন না। আপনার মা বেশি আঘাত দেয়। আমি বেশি আঘাত পায়। আপনি ও কি দেবেন?
পরী সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। হাত পা এক জায়গায় কুড়িয়ে আদিকে তার দিকে টেনে নিল। হাত পা ছুড়ল তার মুখে। আঁকিবুকি করতে করতে বলল,
‘ আমম। মামম।
আদি একগাল হাসল। মুখ দিয়ে সুড়সুড়ি দিল পরীর পেটে। পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। আদির চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, মাববো।
আদি ছোট্ট মুখটা ধরে আদর দিল পুরো মুখে। ছোট্টছোট্ট হাত দুটোতে চুমু দিল। কোলে তুলে নিয়ে পানি দিয়ে মুখ মুছে দিল, কাপড় বদলে দিল।
তারপর কোলে নিয়ে আদর করতে করতে নেমে গেল নিচে। রাইনাকে ডেকে বলল, খেতে দাও আমার আম্মিকে। আম দাও। মাম দাও।
রাইনা স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে এগিয়ে এল। বলল, নে খাইয়ে দে।
পরী দুপাশে মাথা নাড়াল। আদির দিকে তাকিয়ে বলল, চককো, লিলি……
আদি হাসল। বলল, এখন কি চককো খাওয়ার সময় প্রিন্সেস? এখন এগুলো খাবে,তারপর এত্তগুলো চককো দেব।
পরী ভালো মেয়ের মতো চুপচাপ খেল। আজিজ চৌধুরী আর আলিয়া চৌধুরী আড়চোখে দেখল বাবা মেয়ের কান্ড। আদি পরীকে বসিয়ে দিল টেবিলের উপর। পরী হামাগুড়ি দিয়ে আজিজ চৌধুরীর প্লেট কেড়ে নিল। চামচ নিয়ে ডিমের পোচে প্যাচ মারতে মারতে কাটল। আদি চুপচাপ দেখল। আজিজ চৌধুরী অবাক হয়ে বলল, এসব কি হচ্ছে?
পরী হামাগুড়ি দিয়ে আদির কাছে চলে আসল। ধমক দিয়ে বলল, ভোববব।
আলিয়া শাড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে হেসে উঠল। নীরবে হাসল মিনুমা রাইনা। রেহান তো হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
” দাদাভাই ভয় পেয়েছে। দাদাভাই ভয় পেয়েছে।
আজিজ চৌধুরী বলল, আদি তুমি ওকে টেবিলে কেন তুলে দিয়েছ?
পরী খালি চামচটা আদির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে খেতে বলল, দিইইই উমমম উমম।
আদি খালি চামচটা গালে দিল। আর ছাড়ল না। পরী চেহারা খারাপ করে ফেলল। বলল,
‘ মাববো।
আদি তারপরে ও ছাড়ল না। পরী কেঁদে দিল। আদি ছেড়ে দিল চামচ। পরী সেই চামচটা ছুড়ে মারল আজিজ চৌধুরীর দিকে। আজিজ চৌধুরী দাঁড়িয়ে পড়ল। আলিয়াকে বলল,
‘ লিয়া খাবার টেবিলে এসব কি হচ্ছে?
আদি ও দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,
‘ এটা ওর বাড়ি। যাই ইচ্ছে তাই করবে।
পরী আঙুল দেখিয়ে বলল, ভোববব।
আলিয়া কোলে নিয়ে নিল পরীকে। সেই সুযোগে আদর করে দিয়ে বলল, ও কি বুঝে আজিজ? তুমি একটা বাচ্চা মেয়ের উপর রাগ করছ।
আলিয়া চোখের ইশারায় আজিজকে দেখিয়ে দিল আদিকে। চুপ হতে বলল।
আদি পরীকে কোলে নিয়ে নিল। বলল, থাকব না আমি এমন লোকদের সাথে। আমার মেয়েকে আমি রাখব না এখানে।
_____________
আদি নিজে রেডি হতে গেল। পরী বসা বিছানার উপর। আদি আয়নায় দেখল পরী পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে চোখ টিপল পরীকে। পরী মুখের উপর হাত দিল। আদি আবার ও চোখ টিপল, পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। দুহাতে মুখ ঢাকল। বলল, নাই, নাই পরীইইই নাই।
আদি আয়নায় তারপর ও তাকিয়ে থাকল। পরী ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে দেখল আদিকে। আদি চোখ টিপল আবার। পরী হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আদি ও কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। পরীকে তার কাছে টেনে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল, কাতুকুতু কাতুকুতু।
পরী হাসতে হাসতে বলল, কুততুকুততু। দিইইই ভোবব। ভোবব।
আদি তার ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে বলল, আচ্ছা ভোবব।
পরী হাসল। আদির মতো করে চোখ টিপে বলল, পররীইই ভোবব।
আদি হেসে বলল, বাহ চোখ টেপা শিখে গিয়েছ? গুড ইমপ্রুভ। মিষ্টিকে এভাবেই চোখ টিপে দেবে ওকে?
পরী হাসল। বলল,মিততততি?
আদি বলল, ইয়েস মাই প্রিন্সেস। তোমার আমমার নাম মিততি।
পরী খিলখিল করে হাসল। বলল, মিততি দিইইইই মাববো।
আদি হো হো করে হাসল। পরীর বুকের উপর আলতোকরে মাথা রাখল ভার না দিয়ে। বলল, আম্মি চুলে বিলি কেটে দাও।
পরী চুপচাপ আদির চুলগুলো নিয়ে খেলল। কিছুক্ষণ পর বলল, দিইইই দুক্কু।
আদি মাথা তুলে গাঢ় চুম্বন করল মেয়ের গালে,কপালে,নাকের উপর।
পরী বলল, দিইইই মাববো।
আদি হাসল। দুহাতের উপরে মেয়েকে নিয়ে বলল, একবার বাবা ডাকো। আববা ডাকো। ডাকো। একবার।
পরী তার শার্টের বোতাম গুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলল, বেব্বে,বেব্বে,এব্বে।
আদি জোরে চুমু খেল কপালে। বলল, আমাকে বলেছ?
পরী বোতাম ছেড়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। হাত তুলে বলল, ইনননননা মাবববো।
______________
চৌধুরী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল আদি। কারো আকুতি মিনতি, চোখের জল কোনোটা তাকে আটকাতে পারল না। মেয়েকে কোলে নিয়ে সে বেরিয়ে গেল। পুরোটা রাস্তায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখল শক্ত করে। পরী ও যেন চুপচাপ। আদির ফোনে কল এল। ফোনদাতার নাম দেখে অন্ধকারে তলিয়ে গেল তার প্রশান্তির মুখ। ফোন রিসিভ করল ঠিক, কিন্তু ফোনের ওপাশে কথা বলা মেয়েটিকে সে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো দেখল ফোন কানে দিয়ে। মেয়েটি এগিয়ে এল তার দিকে। ফোনে কথা বলল না। দৌড়ে এসে কোলে নিতে চাইল পরীকে। কিন্তু নিতে পারল না। আদির বাধঁন এতটাই শক্ত। ইশা পুরো গালে আদর দিল পরীর। আদি তা মুগ্ধ চোখে দেখল। মিষ্টি যেন দেখলই না তার ডক্টরকে। ইশা নিজের চোখমুখ মুছে নিয়ে আগলে ধরল পরীর মুখ। বলল, কেমন আছ মা? আমম খেয়েছ? কে খাইয়েছে?
আদি বলল, না খায়নি। চৌধুরী বাড়িতে রান্না হয়না তো। জানো না?
রান্না করার জন্য একটা মিষ্টির খুব অভাব।
ইশা কানে নিল না। বলল, পরী কোলে আসো। ফিপির কোলে আসো। পাপপার কাছে,মামমমার কাছে যাবে।
পরী হাত তালি দিল। চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, পাপপা, মামমা রিইইই?
ইশা মাথা নাড়াল। হাত বাড়িয়ে দিল। আদি পরীকে চেপে ধরল। বলল, না, ও যাবে না।
ইশা অনেকক্ষণ পর তাকাল আদির দিকে। গলতে গলতে আর ও শক্ত হলো সে। বলল,
পরী আমার মেয়ে।
আদি চেপে ধরল তাকে। বলল, ও শুধু, শুধুই আমার মেয়ে।
পরী আদির বুক থেকে মাথা তুলে তাকাল। দুহাতে দুজনকে ঠাস ঠাসস করে কষে চড় মারল নাকের উপর। বলল, ইনননা পরীইইইই আমমমাল। উমম, উমম আমমমাল।
আদি হো হো করে হেসে দিল। বলল, হ্যা হ্যা পরী তোমমাল মেয়ে। শুধুই তোমমাল মেয়ে।
ইশার হাসি পেলে ও হাসল না। চেয়ে থাকল আদির দিকে। এত হাসির কি আছে?
আদি পরীর কানে ফিসফিস করে বলল, আমমি চোখ টিপে দাও মিতততিকে এভাবে।
পরী আদির চোখ টেপা দেখল। তারপর ইশার দিকে ফিরল। ইশা পরীর তাকানো দেখে বলল, কি মা?
পরী কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আচমকা চোখ টিপে দিল। বলল, মিতততি?
ইশা চোখ লাল করে তাকাল আদির দিকে। বলল, সব অসভ্যতামি শিখিয়ে ফেলেছেন তাইনা? অসভ্য লোক একটা?
আদি ঘাড় কাত করে হাসল। ইশার মুখের সামনে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ঠিক, তোমার চাইতে বেশি কে জানে?
ইশা ব্যঙ্গ করে হাসল। বলল, এটাই পারেন আপনি। মেয়েদের আবেগ নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। আইমিকে কি করলেন,শেষমুহুর্তে এসে তাকে ও ছেড়ে দিলেন। যাকে এতগুলো বছর স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন,এক নিমেষেই তার স্বপ্নগুলো ভেঙ্গচুড়ে দিলেন? কত মহান আপনি মিঃ চৌধুরী। প্রশংসা করতেই হয়।
আদি চুপ হয়ে গেল।
নীরবতায় পার হলো কয়েক মুহূর্ত। আদি কোনো জবাব দিল না। হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে থাকল মিষ্টির দিকে। কতদিন এভাবে দেখেনা। কতগুলো মাস। বছর।
দুজনের নীরবতাকে ভেঙ্গে দিয়ে পুলিশ আসল। আদি অবাক হলো। মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল অবিশ্বাস্য চোখে। অফিসার শাহেদ বলল, বাবা ছেলে কখন থেকে কিডন্যাপিং শুরু করেছেন মিঃ চৌধুরী। আজ না এলে তো দেখতেই পারতাম না। আদি শুনল না কারো কথা। তাকিয়ে রইল মিষ্টির দিকে। বলল, এসব কি মিষ্টি?
ইশা অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকল। মহিলা পুলিশ এসেই কোলে নিয়ে নিল পরীকে। আদি ইশা দুজনই অবাক হলো। শাহেদ বলল, আদালতে কেস উঠেছে, আদিশা খানমকে নিয়ে। তাই পুলিশের তদারকিতে থাকবে আদিশা।
মিঃ চৌধুরী আপনারা নিয়োগ করুন উকিল। মিঃ খানের পক্ষে নাম্বার ওয়ান উকিল তো আছেনই।
আদি বিস্ময় নিয়ে তাকাল মিষ্টির দিকে। বলল, কেন এসব?
ইশা বলল, এরকম কথা ছিল না অফিসার। পরী আমার কাছে থাকবে।
শাহেদ বলল, পরীকে দাবি করছেন দুই পরিবার। কার কাছে রাখার অনুমতি দেবে আদালত। চিন্তা করবেন না। পরী ভালো থাকবে। ওর অযত্ন হবে না।
আদি গর্জে উঠল। বললেই হলো? আমি দেব না ওকে। আমার কাছে থাকবে ও।
শাহেদ মহিলা পুলিশটিকে ইশারা করল। পরী আদির দিকে তাকিয়ে ডাকল, এব্বে, এব্বে, বেব্বে।
আদি ছুঁতে পারল না পরীকে। ঘটনা এতই দ্রুত ঘটল ইশা নিজে ও কিচ্ছু বুঝতে পারল না। ইশা আদি দুজনই পরীর পিছু পিছু গেল কিন্তু শেষ রক্ষা হয়না।
ইশা থমকে দাঁড়ায়। গাড়ি ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। পরী ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। আদি স্পষ্ট দেখল পরীর চোখে কান্না।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার পেছনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে। মেয়েটি কিছু বলতে চাইল, আদি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতে টাল সামলাতে পারল না ইশা। পরে গেল। পিঠে ব্যাথা পেল। হু হু করে কেঁদে দিল। আদি বসল তার সামনে। একহাতে খামচে ধরল ইশার বাহু। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, আর কত নিচে নামবে মিষ্টি? আর কত? তুমি শেষপর্যন্ত আইনকেই বেছে নিলে? তোমার কি আমার সুখ সহ্য হয়না? আমি তোমার কোন জন্মের শত্রু? বলো? কোন জন্মের শত্রু। আমি আজ নিজ হাতে ছুঁয়েছি আমার মেয়েকে। খাইয়েছি। ঘুম পাড়িয়েছি। স্বর্গসুখ পেয়েছি এই একটা দিনে। মিষ্টি আমি শুধু ওকে নিয়ে থাকতে চেয়েছি। তুমি দিলেনা? তুমি এমন কেন?আমার সুখ তোমার কেন সহ্য হয়না। তুমি কেন আমার ভালো দেখতে পারোনা? কেন আমাকে সহ্য করতে পারো না মিষ্টি? কি পেয়েছ তুমি ওকে আমার কাছ থেকে দূরে পাঠিয়ে? কি পেয়েছ? নিজেকে দেখো মিষ্টি। নিজেকে আয়নায় দেখো। কি হাল হয়েছে তোমার? তুমি নিজে কতটা ভালো আছ? নিজে ভালো নেই তাই আমাকে ও ভালো থাকতে দিচ্ছ না তাই না?
তোমাকে আমি ছাড়ব না মিষ্টি। এই তুমি কাঁদবে না। তোমার চোখের জলগুলো ও অভিনয়।
সব অভিনয়। তুমি প্রতারক। বেঈমান। যাও আমার সামনে থেকে। যাও।
ইশা নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদে। বলে, আমি জানিনা, জানিনা,,,,,,,,,
আদি তার হাতের বাহু ছেড়ে দিল। নিজে বসে পড়ল সেই লনের উপর।
ইশা হাটুগুজে কাঁদল। আদি কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর আচমকা আবার আক্রমণ করল ইশাকে। হাতের বাহু জোরে শক্ত করে চেপে ধরে গর্জন করে বলল,
‘ আমি কিচ্ছু পাইনি। কিচ্ছু না। সেই শুরু থেকে তোমাকে ভালোবেসে আমি কিচ্ছু পাইনি মিষ্টি। তুমি একের পর আমাকে কষ্ট দিয়ে গেছ। তুমি কি ভেবেছ আমি ভালো ছিলাম এতদিন? সুখে ছিলাম? তুমি ভালো রেখেছ আমাকে? ভালো থাকতে দিয়েছ? আমি জানি কতটা নিঃস্ব আমি। ছিলাম। আছি আর…থাকব। কারণ তুমি যতদিন থাকবে আমার জীবনে ততদিন আমি এইরকম নিঃস্ব থাকব। তুমি বলেছিলে না আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই? আসলেই কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো সম্পর্ক থাকার প্রশ্নই উঠে না। যদি থাকত মনের সম্পর্ক তাহলে আমি যা চাইতাম তুমি ও তাই চাইতে, আমি যা বলতাম তুমি ও তাই বলতে। তুমি পাষাণ, হৃদয়হীন মিষ্টি। আমি ঘৃণা করি তোমায়। ঘৃণা করি এই আমাকে। কারণ একটাসময় আমি ও তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।
ইশা কাঁদে। আদির বলা প্রত্যেকটা কথা আঘাত করে তাকে। সে বলতে পারেনা কোনোকিছুই।
আদি আর কোনোকিছু বলেনা। উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। ইশা ও উঠে দাঁড়ায় কাঁপা কাঁপা পায়ে। বলে, ডক্টর আমায় ভুল বুঝবেন না।
আদি তার মুখ মুছে হাতের কব্জি দিয়ে। সাথে চোখ ও। কিচ্ছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, আমি যতদিন থাকব আপনার জীবনে ততদিন আপনি নিঃস্ব থাকবেন, তাই তো আমি চলে গিয়েছি। আপনি কত সহজে বলে দিলেন কথাটা। আমি আপনাকে নিঃস্ব করে দিয়েছি তাই না?
আদি পুরোটা সময় নীরব থাকল। কথা বলল না, তার কথা বলতে ইচ্ছে করল না।
ইশা বলল, আমি কাগজেকলমে দিয়ে দিয়েছি পরীকে। আপনি এসব লড়াইয়ে নামবেন না ডক্টর।
আদি তীব্র ক্রোধ নিয়ে বলে,
‘ আমি! আমি নেমেছি? এসব কার প্ল্যান?
ইশা সোজাসুজি জানায়,
‘ আপনার বাবা করেছে।
আদি অবাকের চরম পর্যায়ে। বলল, কাগজেকলমে দিয়ে দিয়েছ? আমার অনুমতি ছাড়া? তোমার সাহস কি করে হয়? আমার মেয়েকে আমার, আমার পরিবারের অনুমতি ছাড়া বিক্রি করে দেওয়ার।
ইশা কোনোকথা বলেনা। আদি বলল,
‘ তুমি এমনই চালাক যে আমাকে ইন্ডিয়া যেতে বাধ্য করেছ। তোমার কথা শুনতে বাধ্য করেছ। আর এখন আমার মেয়ের বেলায় ও। এবার তোমার চালাকি কাটবেনা।
ইশা এবার মৃদু হাসল। বলল, বারবার আপনার মেয়ে আপনার মেয়ে করছেন কেন? কি প্রমাণ করতে চাইছেন? একদিন নিজের কাছে রেখে, বাবা হয়ে গেছেন। ও বাবা ডেকেছে আপনাকে?
আদির তীব্র আক্রোশ গিয়ে পড়ল মেয়েটার উপর। এখন ও কি ঘাড়ত্যাড়া কথা বলছে?
এই মেয়েটা নরম হবে কিসে??
আদি ধাক্কা মারল তাকে। ইশা গিয়ে পড়ল দূরে। ব্যাথা পেল তীব্র। আদি তার সামনে একহাটু গেড়ে বসে একহাতে মুখটা চেপে ধরে শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু শক্ত কথা বেরোলো না। কন্ঠ তার নরম হয়ে এল,সাথে মিষ্টির চোখেরজল দেখে হাতের বাধঁন। বলল,
‘ সেদিন ও আমায় দয়া দেখিয়েছিলে মিষ্টি, ভালোবাসোনি। আজ ও দেখাতে পারতে দয়া। আজ আমার তোমার ওই লোকদেখানো দয়াটার খুবই প্রয়োজন ছিল। তোমার দয়ায় যদি আমি ফিরে পায় পরীকে তাহলে আমি তা মাথা পেতে নেব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ ভালোবাসারা বহুদূরে। ভালোবাসা তো বহু বহুদূর, আমার প্রতি তোমার দয়াটা ও কাজ করছে না। তুমি এতটাই পাষাণ হয়ে গেছ যে একজন বাবার আর্তনাদ তুমি শুনতে পারছ না। শুনতে পারবে কি করে? কোনোদিন বাবা বলে ডেকেছ কাউকে? ছিল কেউ?
ইশার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ফোটা ফোটা জলের নহর। সে অবাক হয়ে শুনল ডক্টরের মুখ দিয়ে বের হওয়া প্রত্যেকটা তিক্ত কথা। বলল, আজ যদি বাবা বলতে কেউ থাকত আমার, তাহলে তিনবছর আগে আপনার সাথে আমার বিয়েটা কখনো হতোনা। আপনি আর আমি দুই মেরুর বাসিন্দা। আমি মাতৃহীন পিতৃহীন। আমি ও চেয়েছিলাম নিজের শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে মা বাবার জায়গায় বসাতে। পারিনি আমি ডক্টর। আপনার মা বাবা আইমির মুখে মা বাবা ডাক শুনতে চেয়েছিল। তাই আমার দিকে ছুড়ে মেরেছিল ডিভোর্স পেপার। আমি ও মাতৃপিতৃহীন। এত অন্যায়ের প্রতিবাদ কেই বা করবে? একজন ভুল মানুষকে বিয়ে করে আমার অবস্থা দেখুন।
আদি দাঁড়িয়ে পড়ে। একপলক তাকিয়ে থাকে মিষ্টির দিকে । ইশা অন্যদিকে মুখ করে ফেলে। আদি বলল অনেকক্ষণ পর, আমি ভুল? আমি ভুল ছিলাম? তোমার মুখ দিয়ে আর কত বিষাক্ত তীর বেরোবে মিষ্টি? তুমি আজ ও আমায় বুঝলে না। বুঝলে না।
ইশা দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, আপনার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই। যা হবে কোর্টে।
আদি তার অসহায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করল মিষ্টির উপর। মেয়েটি যখন তাকাল না। তাকে দেখল না, সে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। ইশা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই লোকটা কি পাগল? কি করছে?
প্রায় কেটে গেল এভাবে অনেকক্ষণ। আদি শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। বলল, আমি ঠকেছি মিষ্টি। তোমাকে ভালোবেসে। আইমি ও ঠকিয়েছে আমায়। এতদিন আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করে তলে তলে আমার ক্ষতি করে এসেছে। আমাকে থাকতে দেয়নি স্ত্রী সন্তানের পাশে। চিনতে দেয়নি। জানতে দেয়নি। কিন্তু আজ যখন চিনেছি, যখন তাদের নিয়ে সাজাতে যাচ্ছি আমার পৃথিবী তখন তুমি এসে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছ। মিষ্টি আমি তোমাকে চায়,পরীকে চায়। তোমাদের দুজনকেই আমার চায়। আমার সাথে এমনটা করোনা মিষ্টি। আমার কষ্ট হচ্ছে। এতটাই যে আমি তোমাকে বুঝাতে পারব না। কিসের শাস্তি দিচ্ছ মিষ্টি? একটিবার ভেবে দেখ আমার দোষটা কোথায়? আমার কি দোষ? আমি তো ছাড়িনি তোমার হাত, তুমিই ছেড়েছ। তাহলে এখন কেন আমি কষ্ট পাচ্ছি। চুপ থেকোনা মিষ্টি। তুমি ফিরে এসো আমার কাছে, পরীকে নিয়ে। আমায় আর কষ্ট দিওনা মিষ্টি। এভাবে মেরো না। আমি অসহায় খুব। চারপাশে সবাই থাকলে ও দিনশেষে আমি খুব অসহায়। আমি এই মিষ্টিকে তো কখনো ভালোবাসিনি, আমি তাকেই ভালোবেসেছিলাম যে আমি কাঁদার আগে কেঁদে দিত। আমার কষ্টে সে ও ব্যাথিত হতো। আমার দুঃখ কষ্টগুলো আমার আগে তাকে গিয়ে ছুঁতো। তাহলে আজ কি হলো মিষ্টি? আজ কেন ছুঁতে পারছেনা। তুমি কি তাহলে বদলে গেছ মিষ্টি? তুমি ভালোবাসোনা আমাকে? ডক্টরকে ভুলে গিয়েছ?
ইশা কোনোকথা বলেনা। আদি ছেড়ে দেয় তাকে। দুহাতে মুখ আগলে ধরে বলে, মিষ্টি পৃথিবীটা উল্টেপাল্টে যাক তুমি আমি পরী এক থাকি? আমাদের ছোট্ট একটি সাজানো সংসার হোক? তুমি কি চাওনা মিষ্টি?
অনেকক্ষণ পর ইশা আওয়াজ করে বলে, চেয়েছিলাম।
হাত আলগা হয়ে আসে আদির। হাতের বাঁধন থেকে মেয়েটি ছুটে যায়। যেতে যেতে বহুদূরে চলে যায়। ফিরে তাকায় না ছেলেটির দিকে। ছেলেটি বসে পড়ে সেই সবুল তৃণের উপর। প্রায় ঘন্টাখানেক পর নামে আকাশের বুক ছিড়ে বৃষ্টি। আকাশ গর্জন করে তার কষ্টগুলো জানান দেয়। কিন্তু চিৎকার করে শোনাতে পারেনা তার কষ্টগুলো। আজ এসময়টাতে মিষ্টি নেই তারপাশে। বৃষ্টি নামার সাথে সাথে চারপাশ অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকল। বজ্রপাত হচ্ছে আশেপাশে কিন্তু ঠিক জায়গায় হচ্ছেনা। যদি হতো তাহলে মুক্তি পেত ছেলেটি। মুক্ত করে দিত সবাইকে। ভালো থাকত সবাই তাকে ছাড়া। কিন্তু আফসোস বজ্রপাত হয়না তার মাথার উপর। হঠাৎ আচমকা তার মনে হলো কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ডাকছে, আয় আয় আয়। দিইইই আয়।
আদি ছুটে গেল সেদিকে। ছোট্ট মেয়েটি তখন সামনের দাত দুটো দেখিয়ে হাসছে। আর হাত বাড়িয়ে বলছে, আয় আয় আয়।
আদি হাত বাড়িয়ে দিল তার কিন্তু মেয়েটিকে ছুঁতে পারল না। মেয়েটি খিলখিল করে হেসে হেসে মিশে গেল,হারিয়ে গেল বৃষ্টির জলের মাঝে।
সেই মধ্যরাতে আদির ঘুম ভেঙে গেল আচমকা। সে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। ঘড়ির এলার্ম ও বাজেনি। তাহলে ঘুম ভাঙল কেন?
সে রুম থেকে বেরোতেই শুনতে পেল সেই ডাক, দিইইই আয় আয় আয়।
বারান্দা গ্রিল ধরে বাইরে চোখ মেলল সে। দেখল ছোট্ট মেয়েটির চোখমুখ লাল। কেঁদে কেঁদে ডাকছে দু হাত বাড়িয়ে ডাকছে,,,, আমমা আববা আয় আয়।
চলবে,