#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আদি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা পরী চোখ খুলে একবার ছেলে আর মেয়েটিকে দেখে। আরেকবার চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে, আমমা নাই। ইশআ নাই। আববা মাববে।
খাঁচার ভেতর থাকা মিনি ডানা ঝাপটে ডাকে আদি,মিষ্টি। আদি,মিষ্টি। আদি বর, মিষ্টি বউ। আদি বর। মিষ্টি বউ।
মেয়েটি ছেলেটির বুক ভাসিয়ে দেয় কান্নাজলে। চোখেরজল লেপ্টে যায় বুকে। ছেলেটি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি চোখ তুলে তার দিকে তাকায় বহুক্ষণ পর। ছেলেটি ও তাকায়। কপালে তার ভাঁজ পড়া। চিন্তিত বিমর্ষ মুখ। কিছুক্ষণ আগের দেখা স্বপ্নটি তারমানে দুঃস্বপ্ন। মিষ্টি তারমানে আছে। মিষ্টি তার চোখের সামনেই আছে। মেয়েটি কান্না করে যাচ্ছে। আদি তার ভেজা চোখ,ভেজা গালটার দিকে চেয়ে রইল। ঝুঁকে পড়ে চুমু খেল মেয়েটির ঠোঁটের উপর। মেয়েটির কপালে,গালে। দু হাতের আলিঙ্গনে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে অভিমানী সুরে বলে,
‘ মিষ্টি..
মেয়েটি বহুদিন পর ডাকটি শুনে আর ও জোরে কেঁদে দেয়। অবশ্য ডক্টর অনেকবার এই ডাকটি মুখে নিয়েছে কিন্তু ভালোবেসে ডাকেনি। রাগ নিয়ে ডেকেছে, অভিমান নিয়ে ডেকেছে,ঘৃণা নিয়ে ডেকেছে।
আদি চেপে ধরে মিষ্টিকে । মিষ্টি তখন কান্নার তালে তালে মৃদুমধুর হাসছে। বিছানার উপর এক চোখ খোলা রেখে আরেক চোখ বন্ধ করে রাখা পরী দেখল তাদেরকে। এক চোখ বন্ধ করে বলল, মিননি ভোবব, আববা পাপ্পি মিততি…..
মিনি পরীর মিনমিন করে বলা কথা শুনে ডানা ঝাপটে ডাকল, পরররী ওয়াক আপ। ওয়াক আপ।
আদি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর সাথে সাথে চুপটি মেরে গেল মিনি। পায়ের ঠোকর দিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আদি দেখল বিছানার উপর শোয়া মেয়েটি ঘুম। তার কানে বেজে উঠল, আমমা ঘুম। পরী ও ঘুম। আমমা ঘুম। পরী ও ঘুম।
আদি ফুঁপিয়ে উঠল। ছেড়ে দিল তার বুকের সাথে লেপ্টে থাকা মেয়েটিকে। মেয়েটি অবাক হয়ে তাকাল আদির দিকে। হু হু করে কেঁদে দিয়ে বলল, সরি বলেছি ডক্টর। আর কিভাবে বললে আপনি শুনবেন?
আদি দৌড়ে যায় বিছানায়। বিছানায় শোয়া মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয়। আদর দিতে দিতে সে বসে বিছানায়। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির গালে তার গাল লাগিয়ে ডাকে, পরীহ? উঠো। ওই দেখো তোমার আমমমা। পরী ঘুমিও না। উঠো মা।
দুষ্টু পরী তো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আদি বলার সাথে সাথে সে পিটপিট করে চোখ খুলল। আদির গালে গাল ঠেসে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। হাত ঘুরিয়ে বলে, আমমা নাই। আদির গালে চুমু খেয়ে বলে, আমমা পাপ্পি নাই। আদির বুকে গুজে গিয়ে বলে, আমমা নাই। পরররী এততো। আমমা নাই।
আদি তাকে বুকে চেপে ধরে তাকায় মেয়েটির দিকে। মেয়েটি তাদের সামনে এসে বসে। না কাঁদলে ও গাল হয়ে আছে ভিজে। চোখ দুটো ফুলেছে মারাত্মকভাবে। মেয়েটি ফুঁপিয়ে উঠে হাত বাড়ায় বাচ্চাটির দিকে। বলে, আমার কোলে আসো।
পরী গুজে যায় আদির বুকে। মুখ একবার লুকায় আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকায়। ঠোঁট ফুলিয়ে হাত দেখিয়ে বলল, আববা মাববে। পরীইই মাববো।
মেয়েটি কেঁদে উঠে। বিছানার চাদর কুটতে কুটতে তাকায় ছেলেটির দিকে। ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির রূপ দেখতে তার ভালো লাগছে। সে চেয়েছে খুব করে,মেয়েটি কাঁদুক। মা ডাক না শোনার যন্ত্রণা অনুভব করুক। প্রিয়জন ছাড়া একা থাকাটা কতটা কষ্টের তা একটু বুঝুক। প্রিয়জন দূরে ঠেলে দিলে কতটা কষ্ট হয় তা বুঝুক। আজ নিজেকে স্বার্থক মনে হলে ও বেশকিছুদিন ধরে দেখা আজেবাজে স্বপ্ন গুলো তার মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। আজ ও কি ভয়ানক একটা স্বপ্ন ছিল। মিষ্টির কবর? মিষ্টি নেই। পরী ও নেই। কেউ নেই আদির পৃথিবীতে। আদি একা। নিঃসঙ্গ। ভাবতেই আদির চোখ লাল হয়ে এল, নাক কেঁপে কেঁপে উঠল। গলার কাছে এসে কান্নারা আটকে রইল। মেয়েটি তা খেয়াল করল। তার কপাল ঠেকাল আদির কপালে। বলল,
‘ আমি বাঁচতে চাই ডক্টর। আপনার সাথে। পরীর সাথে। আমাদের ছোট্ট একটি সংসার হবে। আমি মিষ্টি হয়ে থেকে যাব আপনার জীবনে। কথা দিচ্ছি তো। আর যাব না। যাওয়ার কথা বলবো না।
আদির চোখের কোটরে জমে থাকা জলগুলো গড়িয়ে পড়ে এবার বাধাহীন। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে সে বলে,
‘ মিষ্টি তুমি জানো তুমি আর পরী ছাড়া আমি কতটা একা। কতটা অসহায় আমি। জানো না মিষ্টি। তুমি অনুভব করতে পারোনা আমার কষ্ট। বুঝতে পারো না তুমি। তুমি আমাকে নয় আমার সন্তানকে এতিম করে যাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিলে। তোমার কি বুক কাঁপেনি মিষ্টি। কাঁপেনি। আমি বাজে স্বপ্ন দেখছি কিছুদিন ধরে । দেখছি তুমি নেই মিষ্টি। আমার কাছে নেই পরীর কাছে নেই। পরী কাঁদছে তোমার জন্য। তোমার কবর! আর সেই কবরের উপর কান দিয়ে পরী তোমায় শোনার চেষ্টা করছে। আমি সহ্য করতে পারছি না এসব। মিষ্টি আমি একটু শান্তি চাই। একটু ভালো থাকতে চাই। তুমি কেড়ে নিওনা আমার এই শান্তিটুকু। নিওনা।
তুমি জানো? পরী বলছে ওই ও তোমার কাছে চলে যাবে। আমমার কাছে চলে যাবে। তোমরা মা মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কেন ভাবো মিষ্টি। তোমরা একবার ভাবো না আমি কি করে থাকব এখানে। এখানে আমার কেউ নেই। থেকে ও নেই।
পরী দেখে আব্বার চোখে জল। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখ কচলে কচলে বলে, আমমমা আববা দুক্কু?
আমমা মাববো।
মেয়েটি ছেলেটির চোখে জল দেখে হাসে। পরী রেগে যায়। চেঁচিয়ে ডাকে,
‘ ইশআআআআআ……….
মেয়েটি যেন ভয় পেল। বুকে থু থু ছিটিয়ে বলল,
‘ ভয় পেয়েছি আমমা।
_______________
সেদিন বৃষ্টি জলে ভিজে ভিজে ইশা চলে গিয়েছিল হসপিটালে। চেকআপ করানোর কথা ছিল। এতগুলো দিন সে আইমির সাথে ছিল। তার অমন সময়ে মনে হয়েছিল আইমি একমাত্র সব সমস্যার সমাধান। ডক্টরকে একমাত্র আইমিই আগলে রাখতে পারবে তার অনুপস্থিতিতে । আইমি ও ডক্টরকে চায়। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আইমি সত্যিটা জানিয়ে দেয় আদিকে। আদি কিন্তু তার আগেই সত্যিটা জেনে গিয়েছে। আদি সেদিন অবাক হয়ে মিষ্টির যাওয়া দেখল। একটা মানুষ কতটা নির্দয়, কতটা পাষাণ হলে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে স্বামী ছেড়ে। সন্তান ছেড়ে। আদি পরীকে আইমির কাছে দিয়ে গিয়েছিল মিষ্টির পিছুপিছু। কিছুদূর যেতে না যেতেই পরী হাত বাড়িয়ে ডেকেছিল,
‘ আমমা আয়। আববা আয়। আমমা আববা আয় আয়।
আদির চোখের জল সেদিন বাঁধ মানেনি। বলেছিল,
‘ তোমার কি একটু এই ছোট্ট বাচ্চাটার প্রতি মায়া হয়না মিষ্টি। কি করে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারো। আদির মনে হলো রিপোর্টে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা ফুসফুসের ক্যান্সার শব্দটা মিথ্যে হয়ে যাক। একজন মা ফিরে আসুক তার বাচ্চার কাছে। মিষ্টি ফিরে আসুক তার ডক্টরের কাছে। আদি গিয়েছিল মিষ্টির পিছুপিছু।
হসপিটালে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে সেই দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, হসপিটালের করিডোরে বসে অবিরত কান্না করা মেয়েটিকে । আদি যদি না দেখত সেই দৃশ্য, আদির ভুল কি ভাঙত কখনো।
মিষ্টি সেদিন কেঁদেছে। তার কান্নার আওয়াজে পুরো হসপিটালের নার্স ছুটে এল। কিছুদিন ধরে অনুপস্থিত ডক্টর আদি চৌধুরীকে সেই দৃশ্য মনপ্রাণ ভরে দেখায় সবাই চকিতে তাকাল। আদি চৌধুরী ও কেন কাঁদছে?
মিষ্টি খেয়াল ও করেনা তার আশেপাশে এতগুলো মানুষ ভীড় জমিয়েছে। আদির ইশারায় ভীড় হালকা হয়। মিষ্টি চোখ তুলে তাকাতেই সে মুখোমুখি হয় ডক্টরের। ডক্টরকে অসহায় চোখে তাকাতে দেখে সে কন্ঠে মিনতি মিশিয়ে বলে,
‘ আমায় ক্ষমা করুন ডক্টর।
ডক্টর ততক্ষণে ও তার জায়গায় দাঁড়িয়ে। কষে চড় বসায় মিষ্টির গালে। মিষ্টি টাল সামলাত না পেরে পড়ে যায়। অবিশ্বাস্য চোখদুটো বেয়ে গড়গড় করে জল গড়ায়। ডক্টর তার গায়ে হাত তুলেছে। এমন সময়ে। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারে না। আদি বলল,
‘ আমার কোনো কষ্ট নেই মিষ্টি। শুধু একটাই আফসোস তোমার এমন দুঃসময়ে আমি তোমার ভরসাস্থল হতে পারিনি। আজ আইমি তোমার আপন হয়ে গেল,আর আমি পর। দিনের পর দিন যে আইমি তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে করে রেখেছে আজ সেই আইমির মুখ দিয়ে আমাকে শুনতে হচ্ছে। আদি মিষ্টির প্রপার ট্রিটমেন্টের দরকার। আজ আইমি তোমার কাছে কতটা ইমপোর্টেন্ট এন্ড কতটা ফেইথফুল তুমি তা বুঝিয়ে দিলে মিষ্টি। আমি তো কেউ না। তুমি কোনোকালেই আমাকে কিচ্ছু মনে করো নি। আমি কেউ ছিলাম না। কেউ নেই। হয়ত কেউ থাকব না। তুমি তো চলে যাবে ছেড়ে।
মিষ্টি কাঁদল। উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না।
আদি যখন দেখল মিষ্টি উঠতে পারছেনা। সে এগিয়ে যায়। মিষ্টিকে ধরার সাথে সাথে মিষ্টি ঢলে পড়ে তার বুকে । কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ ডক্টর আমি বাঁচতে চাই। পরীর জন্য বাঁচতে চাই। আপনার জন্য বাঁচতে,,,,,,,,, পরী ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারিনা ডক্টর। আমি কিভাবে থাকব আমার মেয়েকে ছাড়া। তার নরম হাতের স্পর্শ না পেলে আমি ভালো থাকিনা ডক্টর। তার মুখে আমমা ডাক না শুনলে আমি এলোমেলো হয়ে যায় ডক্টর। আমি পাগল হয়ে যায়। আমি এই কয়দিনে আর ও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছি তার ডাক না শোনায়। কিন্তু আমাকে তো দূরে দূরে থাকতে হবে। মায়া বাড়িয়ে নিজেকে আর কষ্ট দিতে পারব না আমি। কিন্তু আমি পরী, পরীর কি হবে ডক্টর। আমার পরী। আমার পরী তো আমমাকে খুঁজবে। সে কাঁদবে আমার জন্য। আমার মরতে ইচ্ছে হচ্ছে না ডক্টর। আমি মরতে চাইনা। কিন্তু আমাকে মরতে হবে। ওই রিপোর্ট,,,
মিষ্টি অন্যকিছু বলার আগেই ঢলে পড়ে কান্নায়। ঢলে পড়ে আদির কোলে। চোখবন্ধ হয়ে আসে। গাল বেয়ে আচমকা গড়িয়ে পড়ে রক্ত।
আদি সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছিল। যদি অজ্ঞান হয়ে পড়া মেয়েটি একটিবার দেখত ছেলেটির সেই কান্না তাহলে বুঝতে পারত, ছেলেটি তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। কতটা নিঃস্ব ছেলেটি মেয়েটিকে ছাড়া। সে ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। মিষ্টি নেই তার পৃথিবীতে। চারপাশ অন্ধকার। বৃষ্টি নেমেছে কিন্তু আদির মিষ্টি নেই পৃথিবীতে। বৃষ্টি এসেছে ঠিক কিন্তু মন কেমনের বৃষ্টি নয়। আদির অনুভব হচ্ছে না কোনোকিছুই। হালকা হয়ে গেছে সব অনুভবতা। ছোট্ট পরী হাত নেড়ে নেড়ে তা তা বলে চলে যায় আদিকে ছেড়ে। তার মায়ের মতো।
এসব ভাবতে ভাবতে আদি থেকে থেকে কেঁপে উঠে। শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখে মিষ্টিকে। আদির কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মিষ্টিকে কোনোমতে। আদির ছোট্ট বাচ্চাদের মতো করে কাঁদে। নিজের অর্জিত বিদ্যা আজ কোনো কাজেই আসছে না। নিজের উপর নিজের রাগ লাগছে। মিষ্টির জন্য সে কিছুই করতে পারল না। তার আর মিষ্টির একটি ছোট্ট সংসার কি কখনো সাজানো হবেনা?
আদি ভেঙে পড়ল কান্নায়। তার কান্না দেখে পুরো হসপিটালের ডক্টর,নার্স ছুটে এল। কেবিনের বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটির শিয়রে বসে সে নীরবে কান্না করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ডক্টর মেহতাব অবাক হয়ে জানতে চাই,
‘ ও তোমার স্ত্রী আদি? তারমানে আমি ওর বাচ্চার অপারেশনের রিপোর্ট দেখে ঠিকই ধরেছি। কিন্তু ইশা তো?
আদি দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে,
‘ স্যার ওকে বাঁচান প্লিজ। ছোট্ট পুতুলের মতো একটি বাচ্চা আছে তার। আমমা আমমা ডাকতে থাকে সারাদিন। ওই ছোট্ট মেয়েটি এভাবে এতিম হয়ে যাবে। আমি সহ্য করতে পারব না তার আর্তনাদ। পৃথিবীর এই কঠিন নিয়মগুলো কেন তৈরি?
যখন আমি ছিলাম না মিষ্টির পাশে, সে লড়াই করেছে সবার সাথে। আগলে রেখেছে মেয়েকে। আর এখন যখন আমি আছি তার পাশে সে থাকতে পারছেনা। চলে যাওয়ার জন্য তাড়া লাগিয়েছে। ওই ছোট্ট পরীর আমমাকে ছাড়া ঠিকই দিন কাটবে। কিন্তু দূর্বিষহ কাটবে। ওর কষ্ট হবে। ও হাঁটতে, চলতে ঘুমাতে আমমার বুক খোঁজে। আমমার ছোঁয়া পেতে চাই। একটা অবুঝ বাচ্চা কি করে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর কঠিন নিয়ম মানবে। কি করে তার আমমাকে ছাড়া পথ চলতে শিখবে?
ডক্টর মেহতাবের দুচোখ ছলছল করে উঠে। আদির কাঁধে হাত দিয়ে খানিকক্ষণের জন্য হলেও আশ্বাস দেয়,
‘ আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আদি। তুমি চাইলে আবার সিটিস্ক্যান করে দেখতে পারো। চলে যাওয়ার আগে তোমার হাতে না হয় একটু সেবা পাক। তোমারই তো স্ত্রী।
আদি কান্নায় ভেঙে পড়ে । ডক্টর মেহতাব চলে গেল সান্ত্বনা দিয়ে। আদি তার চোখের জল লেপ্টে দেয় মিষ্টির পুরো গালে। কান্নাজলে ভাসতে ভাসতে বলে,
‘ আমার জন্য না হলে ও পরীর জন্য তুমি থেকে যেতে পারতে মিষ্টি। আমি নয় এখন কষ্ট আমার মেয়ে ও পাচ্ছে। তার মায়ের অভাব হবেনা। আমি তুমি না থাকলে ওর আদর ভালোবাসার অভাব হবেনা। কিন্তু দিনশেষে পরীর তার আমমা আববাকে ঠিকই মনে পড়বে। এক ফোঁটা জল হলে ও গড়াবে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে কেঁদে কেঁদে একটিবার হলে ও ডাকবে, আমমা আয়। আববা আয়।
তাকে বুকে রেখে ঘুমানোর সব অধিকার আমি হারিয়েছি মিষ্টি। আইনের দৃষ্টিতে আমি তার বাবা নই। সে আমার মেয়ে নই। খান বাড়ির সবার হয়ত আমার প্রতি মায়া কাজ করছে তাই কিছুমুহূর্তের জন্য পরীকে আমার কাছে দিয়েছে। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর আমি তো একেবারেই নিঃস্ব মিষ্টি। তুমি আরামে ঘুমোবে আর আমি এখানে। আমাকে ও নিয়ে যাও মিষ্টি। আমি দেখতে পারব না তোমাকে মাটির নিচে চলে যেতে, না দেখতে পারব পরীর নীরব আর্তনাদ। আমি সইতে পারব না মিষ্টি। আমি পাগল হয়ে যাব। এই পাগলা ডক্টরকে সামলানোর জন্য ও তখন কোনো মিষ্টি এগিয়ে আসবে না। কোনো মিষ্টিই যে নেই আর। তুমি ছাড়া এই ডক্টরকে কে বুঝবে মিষ্টি? কেন চলে যাওয়ার জন্য এত তাড়া তোমার???
ডক্টর মেহতাব চেকআপ করিয়ে আদির সামনে বসে রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে। বলে, আদি দেখেছ মিষ্টির মুখ দিয়ে বের হয়ে আসা রক্ত?
আদি তার ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে মাথা দুলায়। ধরা কন্ঠে বলল, হ্যা।
মেহতাব বলেন,
রক্তবমি আর কফে রক্ত আসা একেবারেই আলাদা ব্যাপার। অনেকে এই দু’টো ব্যাপারকে এক ভেবে থাকেন। কফে রক্ত আসার ক্ষেত্রে মূলত আঠালো কফ ও তাতে রক্তের ছিটাকেই বোঝায়। কখনো এই রক্তের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। রক্তবমির ক্ষেত্রে সমস্যা পাকস্থলীতে হয়। কখনো এই রক্ত কালো হতে পারে, কখনো স্বাভাবিক রঙের হতে পারে।
সাধারণত, হজমের সমস্যা এবং পাকস্থলীর নানা সমস্যার কারণেই এমনটা হয়ে থাকে। আমরাই বিষয়গুলোকে জটিল বানিয়ে ফেলি আদি। মেডিকেল সাইন্স বলছে,
তোমার ওয়াইফের ব্রঙ্কাইটিস হয়েছে। ব্রঙ্কাইটিস হলো শ্বাসনালির প্রদাহ। এটি বেশিরভাগক্ষেত্রে সহজেই সেরে যায়। তবে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া খুবই প্রয়োজন। আর অন্যদিকে ব্রঙ্কিয়েকটেসিস। এই অসুখে শ্বাসনালির স্থায়ী ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে শ্বাসনালির মধ্যে বারবার সংক্রমণ হয়। সেকারণে রোগীকে প্রায় সারাজীবনই কষ্টে ভুগতে হয়। তবে সঠিক চিকিৎসা না হলে ফুসফুসের ক্যান্সারে পরিণত হয়। যার পরিণতি মৃত্যু।
নারীদের ক্ষেত্রে ইউটেরাসের ভিতরের আবরণ মাঝে মাঝে ফুসফুসে চলে আসে। ফলে প্রতিবার স্বাভাবিক রক্তক্ষরণের সময় হলে সেখান থেকে রক্তপাত হয়, যা কফের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। এর কারণে মাঝেমাঝে মেরুদেশে ব্যাথা হয়। হাড়ে হাড়ে ব্যাথা অনুভব হয়। যাকে আমরা নর্মালি পিঠ ব্যাথা নামে চিনি।
আজকের রিপোর্ট বলছে অন্যকথা। তুমি দেখতে পারো আদি। মিষ্টির রোগটি ব্রঙ্কাইটিস। ফুসফুসের ক্যান্সারে ঝুঁকি আছে যদি প্রপার ট্রিটমেন্ট না হয়। কিন্তু আগের রিপোর্টে ডিরেক্ট লেখা ফুসফুসের ক্যান্সার। কি করে সম্ভব? কে করল এই কাজ?
এই হসপিটালেই তো মিষ্টির চেকআপ করানো হয়েছে। আজ ও তুমি আমি নিজ হাতে করেছি। এই সামান্য রোগটাকে আমরা জটিল বানিয়ে ফেলেছি। মিষ্টিকে যে ঔষধ গুলো প্রেসক্রাইব করা হয়েছে,তাতে ওর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। রক্তপড়া বন্ধ না হয়ে আর ও বেশি পড়তে পারে। এতবড় ভুল এমন নামকরা হসপিটালের রিপোর্টে কি করে?
ব্রঙ্কাইটিসের চিকিৎসা না হলে ব্রঙ্কিয়েকটেসিস পরিণত হবে । আর ব্রঙ্কিয়েকটেসিসের চিকিৎসা না হলে ফুসফুসের ক্যান্সার। অনেক দূর। মিষ্টি এখন একজন পুরোপুরি সুস্থ মানুষ। ট্রিটমেন্ট হলে ও সুস্থ হয়ে উঠবে।
আদি তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ ডক্টর মেহতাবের দিকে। পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয় চেয়ার। উগ্র রোষে ফেটে পড়ে সে। চেকআপ রুমে গিয়ে সবার উপর চিৎকার চেঁচামেচি করে। জিনিস ভাংচুর করে। সব নার্স আর ডক্টর ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। আদি ক্ষোভ নিয়ে পুরো হসপিটালের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। ভেতরে ভেতরে আর কত অনাচার চলে এই হসপিটালে কে জানে?? কে করেছে রিপোর্টে গোলমাল? তা জানা গেল না। পুলিশ তদন্ত শুরু করল।
__________
পৃথিবী রঙিন হয়ে উঠল আবার আদির। সে স্বপ্ন দেখল আবার মিষ্টিকে নিয়ে। পরীকে নিয়ে। তার একটি ছোট্ট সংসার হবে।
কিন্তু তার রাগ কমল না। সে ছুটে যায় মেয়েটির কাছে। এলোমেলো ভাবে কেঁদে দেয় মেয়েটির ঘুমন্ত চেহারাটি দেখে। সেই দেখা দেখে আর যাইনি মেয়েটির সামনে। কথা ও বলেনি। অভিমান, রাগ সব গিয়ে পড়ে মেয়েটির উপর। মেয়েটি যদি একটিবার তার অসুস্থতার কথা আদিকে জানাত তাহলে আজ এই অবস্থা হতো না। এবার শাস্তি সে মিষ্টিকে দেবে। প্রিয়জন মুখ ফিরিয়ে থাকলে, দূরে চলে গেলে,হারিয়ে গেলে,সন্তান মা না ডাকলে, সন্তান দূরে চলে গেলে কতটা কষ্ট হয় এবার সে বোঝাবে মেয়েটিকে হাড়ে হাড়ে। মেয়েটি কষ্ট পাক। কষ্ট পেয়ে পেয়ে মরে যাক। কিন্তু আদির সামনে থাকুক।
________________
চারদিকে চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। সেই রাতের আলো আঁধারিতে ছাদের এককোণায় দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না বিলাস করছে মেয়েটি। পড়নে হালকা গোলাপি শাড়িটির আচঁল অবিন্যস্ত। মাথার চুল গুলো খোলা হাওয়ায় মৃদুমধুর উড়ছে।
পেছনে ঘাড়ের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পেয়ে মেয়েটি চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বকুল ফুল হাতে দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখেই ঠোঁট এলিয়ে হাসল সে। গলা জড়িয়ে ধরল ছেলেটির। নাকের ডগায় টুপ করে চুমু খেয়ে নিয়ে ডাকল,
‘ মিষ্টির ডক্টর! আমি পেরেছি আপনার অভিমান গলাতে। হুমম?
ছেলেটি তার কথা শুনে বিনিময়ে হাসল। ফিরিয়ে দিল মিষ্টির নাকের ডগায় তার ঠোঁটের স্পর্শ। রাতের আলোয় চেয়ে রইল মায়াবী মুখটার দিকে। মুখ আরেকটু নিচে নামিয়ে আনতেই মেয়েটি তাকে ছেড়ে দিল চট করে।
তাকে পিছু করে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি বড্ড বেসামাল ডক্টর। একদম ভালো না।
ছেলেটি হেসে মাথা চুলকাল। একে একে গেঁথে দিল সব বকুল ফুল, মেয়েটির চুলে। মেয়েটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেটি গুজে দিল সব বকুল ফুল। কতগুলো ঝড়ে পড়ল নিচে। কতগুলো লেপ্টে রইল চুলে।
ছেলেটি শুকল সেই চুলে লেপ্টে থাকা বকুল ফুলের গন্ধ। মেয়েটির কানের পাশে ঠোঁট ছুয়ে আলতোকরে জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। মেয়েটির কাঁধে তার চিবুক রাখল। নাকটা ঘষে দিয়ে গাইল,
‘ বেসামাল হয়েছি আজ বেসামাল,
তুই তাকালি এমন করে।
চলবে,
( আগামী পর্বে গল্প শেষ। আজকেই দেওয়ার চেষ্টা করব)