#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা
জীবনটা বড়ই অদ্ভুত মেয়েটির। সে না পেল মা বাবার আদর,স্নেহ,মমতা। না পেল একটু বিশ্বাস,ভরসার একটা মানুষ। যাদেরকে বসিয়েছে মা, বাবার জায়গায় তারা ও তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। যার উপর ভরসা করে সে দেশে নেই। আর যার উপর সে ভরসা করতে চেয়েছে সে তার কান্না দেখে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। কি অদ্ভুত!
সেদিনের ঘটনার পরদিন সকালে সে বসেছিল খাটের পিছু পিঠ লাগিয়ে যার কারণে তাকে দেখা যাচ্ছিল না। আদির ঘুম ভাঙল সকাল সকাল। ততক্ষণে নেশা কেটে গেছে তার। ঘুম থেকে উঠেই মিষ্টিকে দেখতে না পেয়ে আচমকা তার রাগ উঠল। সে বেশ জোরে আওয়াজ করে ডাকল, মিষ্টি।
খাটের ওপাশে থাকে মিষ্টি কেঁপে উঠল। তারপর ও সাড়া দিল না। সে কখনোই আর ডক্টরের কাছ থেকে কিছুই আশা করবেনা। না দয়া না ভালোবাসা। জীবনটা তার একার। আদি যখন পেলনা মিষ্টির সাড়া। সে খাট থেকে নেমে মিনির কাছে গেল। জানতে চাইল মিষ্টি কোথায় মিনি?
মিনি ডানা ঝাপটাল। ডাকল, মিষ্টি, মিষ্টি।
আদি গটগট করে হেঁটে কিচেনে চলে গেল। সেখানে শুধু মিনুকে দেখল। আবার হেঁটে বাগানে গেল। দেখল না। ছাদে গেল। সেখানে ও দেখল না। আলিয়া চৌধুরী আদিকে এই অবস্থায় দেখে চিন্তায় পড়ে গেল । এভাবে রেগেমেগে কাকে খুঁজছে আদি?
যখন আদির মুখ থেকে শোনা গেল, মিষ্টি ডাক। তখনই সবাই ও খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। কিন্তু শেষমেশ ফলাফল শূন্য। কোথাও পাওয়া গেল না মিষ্টিকে। আদির রাগ চিন্তা আর ভয়ে পরিণত হলো। মিষ্টি তাকে ফেলে চলে যায়নি তো?
আফি যখন নিচে নেমে এল। সে আদিকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, তোর বউ পালাইছে আদি। এখন কি হবে? বেচারা বউ পাগলা!
আলিয়া চৌধুরী গর্জন করলেন। তোমার কি কান্ডজ্ঞান নেই আফি? দেখছ আদি রেগে আছে তারপরে ও তুমি! কি চাইছটা কি তুমি আফি? এমন চলতে থাকলে তো আমাদের কিছু একটা করতেই হবে।
আফি মায়ের কথা কান দিল না। আদিকে বলল, জিনিস ভাঙচুর করার মতলব করছেন আদিসাহেব?
আদি চোখে রাগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে আফির দিকে। চিল্লিয়ে ডাকে, মিষ্টি!
আফি জোরে হো হো করে হেসে উঠে। আদি গিয়ে চেপে ধরে আফির গলা। অনেকক্ষণ পর ও ছাড়াছাড়ি নেই। আফির শ্বাসরোধ হয়ে আসে। আদির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে
সে এক্ষুণি মেরে ফেলবে আফিকে। আলিয়া চৌধুরী আর আজিজ চৌধুরী আদিকে টেনে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, আদি,,, ভাই মরে যাবে। আদির হাত আলগা হয়ে আসে। ছেড়ে দেয়।
যখন সে আলিয়া আর আজিজের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত তখনই তার চোয়াল বরাবর ঘুষি মারে আফি। আদি কপালে হাত দিয়ে ঢলে পড়ে। আফি আরেক ঘুষি লাগায় আদির মুখ বরাবর। যাতে আদির ঠোঁট ফেটে,নাক ফেটে রক্ত বের হয়। আলিয়া চৌধুরীর আহাজারিতে চৌধুরী বাড়ি কল্লোলিত হয়। মাথা চাপড়ে কাঁদে আলিয়া। আজিজ আহমেদ আফিকে কষে চড় বসান। তার চোখ ফেটে ও জল বের হয়। অন্যর ছেলেকে প্রশয় দিতে গিয়ে,নিজের ছেলে ভাবতে গিয়ে, আজ তার নিজের ছেলে ও বিপদে। এর একটা দফারফা তো করতেই হয়। দাড়োয়ান আর কাজের লোক সগিরের সাহায্যে আফিকে ঘরবন্ধী করা হয়। আদি ঢলে পড়ে আলিয়ার কোলে। আলিয়ার চোখের পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে আদির মুখে। আদি চেতন হারায়। মিষ্টি এত চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে যখন নিচে নেমে আসে। পড়ে থাকা আদির দিকে তাকাতেই তার চোখ গলে পানি আপনাআপনি বেরিয়ে আসে। নিঃশব্দে, নীরবে,নির্জনে। সে স্তব্ধ হয়ে যায় মুহূর্তে। আদির অচেতন মুখটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। ছুটে ও যায়না। সে বুঝে গিয়েছে সে সরলেই ডক্টর ভালো থাকবে না। একটু ও ভালো থাকবে না। ডক্টর মিষ্টিকে ছাড়া ভালো থাকার কথা ও নয়।
আজিজ চৌধুরী ডক্টর ডেকে আনলেন। ডক্টর এসে আদির রক্তঝরা বন্ধ করল। ঠোঁটের এককোণায় ব্যান্ডেজ করে দিল। আদির যখন সেন্স ফিরল তখন সে তার ঘরে। চোখখোলার সাথে সাথে সে বসে থাকতে দেখল আলিয়া আর আজিজকে। সে টু শব্দটি করল না। এদিকওদিক তাকাল শুধু। যখন আবার ও দেখল না মিষ্টিকে। রাগে-অভিমানে তার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। একপাশে মুখ করে ডাকল,মিষ্টি?
আলিয়া আর আজিজ কিছু বললেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইশাকে বললেন,আদি ডাকছে।
ইশা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যখনই সে ধীরপায়ে হেঁটে আদির সামনাসামনি যায়। আদি ছলছল চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। একটুখানি আওয়াজ করে ডাকে,মিষ্টি। মিষ্টি এ ডাকটিতে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনা। মিষ্টি এ মিষ্টি আহ্বানে ছুটে না গিয়ে থাকতে পারেনা। মিষ্টি এই মায়াময় ডাকটিতে হারিয়ে যায় বারংবার। সে বিভার হয় ডাকটিতে। তাই ছুটে যায় ডক্টরের কাছে। চোখের নোনা জলে ভাসিয়ে দেয় ডক্টরের বুক। বলে, ডক্টর মিষ্টিকে কষ্ট দিলে আপনি ও কষ্ট পাবেন। তাই মিষ্টিকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
আদি চোখ পিটপিট করে শুধু তাকায় মিষ্টির দিকে। তার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে থাকা মেয়েটির মাঝে কি কোনো মেডিসিন আছে? সে ছুঁতেই খারাপলাগা দূর হয়ে যায় কেন?
মিষ্টি মাথা তুলে তাকায় ডক্টরের দিকে। পিঞ্চ কেটে বলে, এত চুপ কেন? আমি তো কিছু বলছি তাই না। আপনাকে ও কিছু বলতে হবে।
আদি মিষ্টির রাগ দেখে ভয় পেয়ে যায়। বলে, আমি কি বলব মিষ্টি? তুমি যদি আবার রাগ করে চলে যাও?
মিষ্টি চোখ রাঙিয়ে তাকায়। বলে, আমি তো এমনিতে ও চলে যাব।
আদি অন্যভাবে তাকায়। বলে, চলে যাবে? আমাকে ছেড়ে?
ইশা কথা ঘুরায়। বলে, আপনি কথা না বললে চলে যাব।
আদি ততক্ষণে হেসে দেয়। চট করে উঠে পড়ে। মিষ্টিকে তার সামনাসামনি বসিয়ে বলে, মিষ্টি আজ তাহলে আমরা সারাদিন গল্প করব। কেমন?
________________________________
প্রায় পাঁচ মাস অতিক্রম হলো বিয়ের । ইশার ছোঁয়ায় আদি সুস্থ হলো কিন্তু স্বাভাবিক হলো না। ট্রিটমেন্ট চলতে লাগল। ইশা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আদির দেখাশোনা করতে লাগল। স্ট্রেস ফ্রি রাখার চেষ্টা করল। আগের চাইতে সুস্থ হলো। হুটহাট করা রাগ কমল। আজিজ চৌধুরী আফিকে তাদের অন্য বাড়িতে রাখল। শর্ত দিল আদির সুস্থ হওয়া অব্ধি যাতে আফি এ বাড়িতে পা না রাখে। ইশা চিন্তামুক্ত হলো। আদিকে মাতিয়ে রাখল হাসিতে খুশিতে। আদি ও যেন দায়িত্ব নিল ইশার হাসিখুশি থাকার। সে তো আগের চাইতে সুস্থ হয়ে উঠল,কিন্তু পুরোপুরি মিষ্টির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠল। মিষ্টিকে ঘিরে সে তার নতুন পৃথিবী সাজাল। মিষ্টি তার বন্ধু,তার ভরসার স্থল,তার শান্তির জায়গা,তার ঠোঁটের কোণার একটুকরো হাসির কারণ,তার অর্ধাঙ্গিনী। মিষ্টিকে ছাড়া সে কিছুই ভাবতে ও পারেনা। মিষ্টি যখন কোমরে শাড়ির আচঁল গুজে রান্না করে তখন সে মুগ্ধ হয়ে দেখে। যখন মিষ্টির নাকের ডগায় ঘাম জমে উঠে তা ও সে মুগ্ধ হয়ে দেখে। মিষ্টি যখন ভেজা চুলে তার সামনে এসে দাঁড়ায়,তখন মিষ্টির স্নিগ্ধ মুখের দিকে তার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। মিষ্টি যখন তার দিকে তাকিয়ে হাসে,তখন সে হাসিতে তার মরতে ইচ্ছে হয়। মিষ্টি যখন কাদেঁ তখন সব লন্ডভন্ড করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। মিষ্টি যখন তার চোখে চোখ রাখে,তখন তার হুট করে বলে ফেলতে ইচ্ছে হয়,মিষ্টি তুমি খুব সুন্দর। মিষ্টি যখন নতবদনে হাসে তখন মিষ্টির ঘর্মাক্ত নাকের ডগায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে হয়। মিষ্টি যখন ঘুমায় তার হাসি লেপ্টে থাকা মুখটা দেখলে শুধু দেখে থাকতে ইচ্ছে হয়। ঘুমের ঘোরে মিষ্টি যখন তার বুকের কাছে চলে আসে, মুখ গুজে দেয়। তখন শান্তি শান্তি অনুভব হয়। মিষ্টি যখনই দুহাতে মুখ দিয়ে চেয়ে থাকে ডক্টরের দিকে তখন তাকে মনে হয় একটি জীবন্ত পুতুল। তখন সেই পুতুলটিকে বুকের খাঁচায় একেবারে বন্দি করতে ইচ্ছে হয়। আদি জানে মিষ্টির কাছে এসব অন্যায় আবদার। তবু ও তার এমন, এমন করতে ইচ্ছে হয়। মিষ্টি শুনলে কি রাগ করবে?
ইশা তার মামা মামিকে ফোন দিয়ে ও ফোনে পায়না। এতগুলো দিন চলে গেল, কেউ একটিবার ফোন দিয়ে জানতে ও চাইল না সে ভালো আছে কিনা শুধু রিপুদা ছাড়া। যদি ও মানুষটা জানেনা সে অন্যকোথাও আছে। তালহা বেগম যখনই শেষমেশ ফোন ধরে,তখনই কাঠ গলায় বলে দেয়, আবার কি ফেরার মতলব হচ্ছেনা কি তোর? মামার সাথে কথা বলে মামাকে গলাতে চাইছিস?
ইশা ফোনের এপাশে ডুকরে কেঁদে উঠে। বলে, তোমরা কেমন আছ সেটা জানার জন্য ও কি একটিবার ফোন দিতে পারব না?
তালহা বেগম রেগে ফোন রেখে দেয়। ন্যাকাকান্না শোনার সময় কই?
জহির মিয়া যখন দেখে তালহা বেগম এভাবে কথা বলছেন তখন সে ছুটে এল। বলল, মেয়েটা ফোন করেছে আমাকে দিলেনা কেন?
তালহা চেঁচিয়ে বলেন, কেন দেব? দরদ উতলে উঠছে একেবারে তাই না?
জহির মিয়া শান্ত গলায় বললেন, এটা বলতাম। যে তাকে বিক্রি আমি করিনি। তার মামি করেছে। রিপুকে কি জবাব দেবে ভেবেছ একবার? ছেলেটা মেয়েটাকে বড্ড বেশিই ভালোবাসে। তুমি ওর কত বড় ক্ষতি করেছ ভাবতে পারছ?
তালহা বেগম চিন্তায় পড়ে যায়। বলে, আমি আমার ছেলের জন্য আর ও ভালো থেকে দেখে বউ আনব। আমি কেন জোর করে বিয়ে দেব? তোমার ভাগনী রাজি না হলে বিয়েটা হত নাকি? সে কখনো ভালোবেসেছে আমার ছেলেকে? আমার ছেলেটা একাই ভালোবেসে গেছে। সে তো সারাদিন রিপুদা,রিপুদা করে বেড়াই। সে আমার ছেলেকে চাইলে একটা কথা?
জহির মিয়া মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। বিরক্ত হয়ে বলে, তুমি তাদের দুজনকে সে সময় দিলে কোথায়? ইশুকে তো জানার সুযোগ,সময়টুকু ও দিলেনা। আর রিপু? রিপু তো ইশু বড় হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। ছেলেটা মেয়েটাকে বড় হওয়ার পর সামনাসামনি একটিবার দেখল না তুমি তাকে অন্যছেলের সাথে জড়িয়ে দিলে। আমি ভাবতেই পারছিনা। রিপু জানলে কি করবে? আমার ছেলেটার মন ভেঙ্গে দিলে তুমি।
তালহা গটগট করে হেঁটে চলে যায়। এসব আজাইরা কথা শোনার সময় তার নেই। তার ছেলে পচেঁ যায়নি যে একটা মেয়ের জন্য সে পাগল হয়ে যাবে। আপদ দূর হয়েছে এতেই স্বস্তি।
_________________________
ছোট্টছোট্ট প্রশ্নগুলো এবড়োথেবড়ো ভাবে লিখে আদির আলব্যামে রেখে দেয় ইশা। মিষ্টি নামক মেয়েটির কিছু স্মৃতি ডক্টরের মনে না থাকুক অন্তত আলব্যামের ভাঁজে থাকুক। দিনশেষে রাত নামলেই যখন ডক্টর আলব্যাম হাতে নেবে তখন না হয় চোখে পড়বে। মিষ্টির অদক্ষ হাতের কিছু অভিমানী লেখা। ছোট ছোট কাগজের টুকরোগুলো অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে আলব্যামের বুকে। ঠিক যেভাবে মিষ্টি জায়গা করে নিয়েছে ডক্টরের বুকে। ডক্টরের মনে প্রাণে। ডক্টর তারমত দুঃখীনির জীবনে এক ফালি চাঁদ। একটি ফুলের সুবাস। একটুখানি হাসি। এক পৃথিবী ভালোবাসা। মিষ্টি তার ডক্টরকে সারাজীবন তার পাশে চায়। ডক্টরের কাধেঁ মাথা রেখে শান্তিতে চোখ বুজতে চায়। ডক্টরের হাসিতে সে পাগল হতে চায়। ডক্টরের প্রত্যেকটা স্পর্শে সে পাগলপারা হতে চায়। ডক্টরের চোখে চোখ রেখে সে হারিয়ে যেতে চাই দূর দুরান্তে। ডক্টর নয় এবার সে নিজেই ডক্টরের রোগী হতে চায়। ডক্টর নামক রোগটিতে সে তো কবেই আক্রান্ত হয়েছে। এবার আর ও বেশি বেশি করে আক্রান্ত হতে চায়। সে ডক্টরের জীবনসাথী হতে চায়। ডক্টরের মুখ দিয়ে খুব করে শুনতে চায়’ ভালোবাসি’ নামক মধুর শব্দটি। ডক্টর কি একটিবার বলবে? শোনার সৌভাগ্য কখন ও হবে কি?
_______________
এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ ছাড়া ও মিষ্টি জড়িয়ে গেছে একটি ছোট্ট পাখির সাথে। যে পাখিটি তার রাগ ঝাড়ে গালে ঠোকর মেরে মেরে। আর আদর দেয় গালে গাল ঘষে। মিষ্টি খিলখিল করে হেসে ডক্টরকে বলে, ডক্টর মিনি ও আপনার মতো অসভ্য।
ডক্টর বুঝে কি বুঝে না। শুধু বলে, মিষ্টি মিনিকে এভাবে ছুঁতে দেবে না।
মিষ্টি আবার ও খিলখিল করে হাসে। বলে, ডক্টর আপনার মিনিকে নিয়ে জেলাস হচ্ছে?
ডক্টর মিষ্টির হাসি দেখে রাগ করে বসে থাকে। তার কথা মিষ্টি শুনবে না কেন? মিষ্টি তখন ডক্টরের সামনাসামনি বসে বলে, মিনি ও তো আমার বন্ধু। আপনাকে ছুঁলে আমাকে ছুঁবে না কেন?
ডক্টর তখন মিষ্টির দিকে রেগে তাকায়। মিষ্টি হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে ডক্টরের কোলের কাছে। যখন চোখ তুলে তাকায় ডক্টরের চোখে চোখ পড়ায় সে থেমে যায়। বলে,কি?
ডক্টর তখন তার নাক, গাল, মুখ ছুয়ে বলে, এটা,এটা,এটা,এটা আমার। শুধু আমার। অন্যকারো কখনো নয় মিষ্টি। আমি রেগে আছি।
মিষ্টি হাসি আটকে রাখতে পারেনা আর। ডক্টরকে টেনে তার মুখের কাছে এনে বলে, আপনি তো শুধু পাগল নন ডক্টর। আপনি একজন পাগলা প্রেমিক। পাগলা বর আমার। তাহলে এই পাগলা বরটা ও শুধুই আমার। আর কারো নয় ডক্টর।
আদি বিনিময়ে উপহার দিল হাসি। খুব সুন্দর হাসি। মিষ্টি কানে কানে বলল, ডক্টর ভালোবাসি।
আদি কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর মিষ্টির দিকে ঝুঁকে মিষ্টির মত করে বলে, মিষ্টি ভালোবাসি।
ডক্টর তো না বুঝেই বলে। তারপর ও মিষ্টির বারবার শুনতে ইচ্ছে হয় কেন? ডক্টরের মুখ থেকে এই শব্দটি শোনার লোভ কি আদৌ শেষ হওয়ার কথা?
রান্নাঘরে মেয়েটি যখন রান্নায় ব্যস্ত। তখন দৌড়ে রান্নাঘরে ডুকে পড়ে ছেলেটি। মিষ্টিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,মিষ্টি দেখো মিনি ঠোকর দিচ্ছে আমাকে। মিনু হকচকিয়ে যায়। লজ্জায় মাথা নামিয়ে রাখে। ইশা লজ্জায় পড়ে যায়। সামনে ফিরে বলে, কি হচ্ছেটা কি ডক্টর?
মিনি এসেই বসল আদির কাধেঁ। আদির মুখে ঠোকর দিতে দিতে বলল,আদি ব্যাড বয়। ব্যাড বয়। ইশা মিনিকে হাতে নিয়ে নেয়। বলে,কি হচ্ছে মিনি ?
মিনু মিটিমিটি হেসে মাথা নামিয়ে চলে যায়। মিনি ডাকল, খাব মিষ্টি। খাব। খাব।
মিষ্টি এতক্ষণে বুঝল মিনির রাগের কারণ। মিনিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শেল্ফের উপর থাকা পাউরুটির টুকরো। মিনি উড়ে যায়। ইশা মিনির থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ডক্টরের দিকে তাকায় । নিজের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, এখনো ধরে রেখেছেন ডক্টর? ছাড়ুন। আপনার কি লজ্জা নেই?
আদি মাথা নাড়িয়ে বলে, লজ্জা কি মিষ্টি? মিষ্টিকে ধরতে হলে লজ্জা পেতে হবে কেন?
ইশা হতাশ হয়। মাথা একপাশে কাত করে বলে,ডক্টর খুব পাজি হয়ে গেছেন। পানিশ দিতে হবে।
মিনি ওদিকে খেতে খেতে বলে, পাজি, পাজি, আদি, পাজি।
আদির রাগ হয় মিনির উপর। ধমক দিয়ে বলে, শাটআপ মিনি। তুমি কথা বলবে না।
মিনি কেঁপে উঠে যেন। পড়ে যেতে গিয়ে আবার শক্ত করে শেল্ফ আঁকড়ে ধরে। ডাকে, আদি ব্যাড বয়।
ইশা হাসে। চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে, দেখেছেন ডক্টর মিনি ও আপনাকে পাজি বলছে। আপনি সত্যিই পাজি।
আদি এবার রাগ করেনা। হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে,মিষ্টি আমি তোমার সাথে দুষ্টুমি করছি। তুমি রাগ করবে না। কেমন?
মিষ্টি চোখমুখ কুঁচকে বলে, এগুলো কি ধরণের দুষ্টুমি ডক্টর? সবাই হাসবে।
আদি মিষ্টির চুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলে, হাসুক। তুমি বলেছ হাসলে ভালো।
_______________
চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে আকাশ। আর ঝলমল করছে পুরোটা ছাদ। তারসাথে ঝলমল করছে মেয়েটির মায়াবী মুখশ্রী। তার পড়নে লাল শাড়ি। মাথায় খোঁপা। সে আজ সেজেছে সুন্দর করে। আজ ডক্টরের জন্মদিন। আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী গিফট কিনে ইশার হাতে দিয়ে বলেছে, আদিকে দিতে। অনেকদিন তারা আদির সামনে যায়নি। কারণ তাদের দেখলেই আদি হাইপার হয়ে যায়। যা আদির জন্য ক্ষতিকর। আদির বন্ধুবান্ধব আসতে চাইলে ও সবাইকে বারণ করে দেয় আজিজ চৌধুরী। কোনো ফাংশন হবেনা।
ছাদের এককোণায় ছোট্ট করে একটি টেবিল বসিয়েছে মিষ্টি। তার উপরে রাখা একটি কেক আর মোমবাতি। কয়েকটা কাঠগোলাপ। মিষ্টি যখন আদিকে বলল, শুভ জন্মদিন ডক্টর। এই দিনটা বারবার আসুক। কিন্তু এভাবে নয়। সেভাবে আসুক যেভাবে আপনি উপভোগ করতে পারেন। আপনার আগামী জন্মদিনে তো আমি থাকব কিনা জানা নেই ডক্টর। তখন আমার বদলে মনে হয় অন্যকেউ থাকবে। তাই না?
আদি তখন কিছুই বুঝেনা। ঘুম ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে, মিষ্টি তোমাকে আজ খুব,খুব সুন্দর লাগছে। বেশি বেশি সুন্দর লাগছে।
মিষ্টি হেসে ফেলল। বলল, ডক্টর কেক কাটুন,আমাকে খাইয়ে দিন। প্রশংসা পরে করুন।
আদি তাই করল। মিষ্টি ও খাইয়ে দিল। আদি মিষ্টির নাকের ডগায় কেক লাগিয়ে বলল, মিষ্টি তোমাকে এভাবে ও সুন্দর লাগছে। মিষ্টি আবার ও হাসে। বলে, আর কতবার বলবেন ডক্টর। আর কি কোনো কথা নেই?
আদি ভাবে বেশকিছুক্ষণ। অনেকক্ষণ পর মিষ্টি মায়াবী চেহারায় ডুব দিয়ে ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বলে, মিষ্টি,,,,,, ভালোবাসি।
মিষ্টি অবাক হলো। গলার সুর টেনে বলল,কি?
আদি আবার ও বলল,ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। তুমি ও এভাবেই বলো মিষ্টি।
মিষ্টি চেয়ার ছেড়ে উঠে বলে, আপনি একদম নির্লজ্জ ডক্টর। হুটহাট কিসব বলেন?
আদি তার পিছু পিছু এসে দাঁড়ায়। বলে, বললে কি হয়েছে!
মিষ্টি ফিরল। হেসে গলা জড়িয়ে ধরল আদির। বলল, ডক্টর এটার মানে কি জানেন?
আদি বোকার মত করে তাকাল। বলল, তুমি বলো তাই আমি ও বলি। তোমার কি তাতে রাগ উঠছে মিষ্টি?
মিষ্টি ডানে বায়ে মাথা নাড়ায়। বলে, রাগ কেন উঠবে? আমি তো বারবার শুনতে চায়।
খুশিতে আদির চোখ চকচক করে উঠে। বলে,তাহলে আমি বারবার বলব মিষ্টি।
মিষ্টি হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে ডক্টরের বুকে। কিছুক্ষণ পর বলে,আপনি এভাবেই থেকে যান ডক্টর। এভাবেই মিষ্টির ডক্টর হয়ে থেকে যান। ক্ষতি নেই তো?
আদি মিষ্টির চুল নিয়ে খেলা করতে করতে বলে, আমি এভাবেই থেকে যাব মিষ্টি।
আজিজ আর আলিয়া পিছু পিছু দৌড়ে আসে মেয়েটির। মেয়েটি আদি,আদি বলে চলে আসে ছাদে। ইশা আওয়াজ শুনে ডক্টরকে ছেড়ে দূরে এসে দাঁড়ায়। দূরে দাঁড়ানো সাদা কুর্তি পড়া মেয়েটির চোখের জল যেন বাঁধা মানছে না। আদি অবাক হয়ে তাকায়। বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ে আদির বুকে। আদি ভ্রুকুঞ্চন করে শুধু ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। হুটহাট রেগে যাওয়া রোগটি তার কমে এসেছে। তার তেমন কিছু অনুভব হচ্ছেনা। শুধু অনুভব হচ্ছে তার বুকের এত কাছের মেয়েটি মিষ্টি নয়। তাহলে কে সে? অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে তার।
ইশা তার জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। কি আশ্চর্য তার ও কোনো অনুভব হচ্ছেনা। শুধু তার হাতে,পুরো শরীরে লেগে আছে ডক্টরের শরীরের উষ্ণতা। কিছুদূরে মেয়েটি তার ডক্টরকে ওভাবে জড়িয়ে ধরে আছে অথচ তার কষ্ট হচ্ছেনা। শুধু গাল বেয়ে বিরতিহীনভাবে জল পড়ছে।
বেশখানিক্ষণ ওভাবে থাকার পর আইমি যখন মাথা তুলে তাকাল আদির দিকে। আদি ও তখন তাকাল। আদির চোখের সামনে আবার ও ঝাপসা হয়ে দেখা দিল ওই আবছা আবছা অবয়বটি। আদির মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। তার সম্ভিৎ ফিরল, আদি ডাকে। আদি তাকাল আইমির দিকে। বলল, মিষ্টি?
আইমি কাঁদল। বলল, আদি তুমি আমায় চিনতে পারছ না? আমি আইমি? তুমি আমাকে কি করে ভুলে যেতে পারো আদি? আমি বিশ্বাস করিনা আদি।
আদি পিছু হাঁটে দুই পা। ঘাড় ফিরাতেই মিষ্টির দেখা। আইমি এতক্ষণ খেয়াল করেনি। শাড়িপড়া ছোট্ট মেয়েটি কে হতে পারে তার মাথায় এলোনা। আদি ছুটে গেল। বলল, মিষ্টি তুমি বলেছ তাই আমি রাগছি না। তুমি দেখছ না ওরা আমাকে ছুঁচ্ছে। তুমি কিছু বলছ না কেন?
আইমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল আদিকে দিকে । কানে যা শুনল তা ও তো অবিশ্বাস্য। সে আলিয়া আর আজিজ চৌধুরীর দিকে অসহায় চোখে তাকাল। বলল,মেয়েটি কে আন্টি?
আলিয়া জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
আদি মাথা চেপে ধরল। চিল্লিয়ে ডাকল,মিষ্টি?
ইশা আইমির দিকে তাকিয়ে থাকল শুধু। মেয়েটার কষ্ট দেখে তার দ্বিগুণ কষ্ট লাগছে। আদি তার বাহু ঝাকিয়ে বলল, মিষ্টি চুপ করে আছ কেন? ওদেরকে চলে যেতে বলো। আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে।
ইশা কাউকে কিচ্ছু বলেনা। আদির দিকে ও তাকায় না। আদির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে নিজেই চলে যায়।
আদি একরাশ অভিমান নিয়ে তাকিয়ে দেখে মিষ্টির চলে যাওয়া। আইমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। গর্জন করে বলে, মেরে ফেলব সবাইকে দ্বিতীয়বার আমাকে ছুঁলে।
আইমি অবাক চোখে তাকায় আদির দিকে। তার বিশ্বাস হচ্ছেনা আদির মুখ থেকে বেরোনো কথা। তার চোখ থেকে জল ঝড়ে বহুদিন পর, বহুসময় পর।
আদি কাউকে কিচ্ছু বলতে না দিয়ে মিষ্টির পিছু পিছু দৌড়ে যায়। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে,মিষ্টি দরজা খোলো।
অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর মিষ্টি দরজা খুলে দেয়। শাড়ি পাল্টে ফেলেছে সে। সাজগোছ কিচ্ছু নেই। আগের মতই সাদাসিধে। চৌধুরী বাড়ির চোখে সে কাজের লোক। আদি তাকায় মিষ্টির লেপ্টে থাকা কাজলচোখে। বলে,আই হেইট ইউ মিষ্টি। তুমি আমাকে একা ফেলে পালাচ্ছ। আই রিয়েলি হেইট ইউ। তুমি আর কখনো আমার সাথে কথা বলবে না মিষ্টি। কক্ষনো না।
মিষ্টি শুধু ক্ষীণ কন্ঠে আওয়াজ তুলে বলে, আচ্ছা।
আদি পিঠ করে দাঁড়ায় মিষ্টিকে। তার চোখ ছলছল করে উঠে। মিষ্টির উপর তার রাগ উঠে। মিষ্টি পিছু ফিরে চলে যাওয়ার আগে আদি আবার তাকে চেপে ধরে। ঝাকিয়ে বলে, আই সুয়ের মিষ্টি, আমার কষ্ট হচ্ছে,খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি কেন দেখছ না? মিষ্টি, এই মিষ্টি তুমি পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছ না তো?
মিষ্টি তারপর ও চুপ থাকে। আদি শান্ত হয়ে যায়। শান্ত গলায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, মিষ্টি আই হেইট ইউ। রিয়েলি হেইট ইউ। তুমি আমার মতো কষ্ট পাবে মিষ্টি । ঠিক আমার মতো।
চলবে,
( আপনাদের অনুভূতি জানাবেন)