#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৫
দিনটা একুশে মার্চ। দিন পেরিয়ে রাতের আধারের ডুবে গেছে খোঁটা পৃথিবী। ঘড়ির কাঁটায় বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। আর আধ ঘন্টা পরেই ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে পোঁছালেই তীরের আটারো তম জন্মদিন। প্রত্যেকবারে তীর নিজের জন্মদিনটা নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড থাকে কিন্তু এবারের জন্মদিনে ওর মাঝে কোনো প্রকার এক্সাইটমেন্টই কাজ করছে না। তার এক মাত্র কারণটা হলো ইশান। ইশান প্রায় তিন দিন ধরে তীরকে ইগনোর করছে। কেন ইগনোর করছে কারণটা তার অজানা। তীরের জানা মতে এমন কোনো কাজ করে নি যাতে করে ইশান ওকে ইগনোর করতে পারে। যতো বারেই তীর ইশানের সামনে পড়েছে তত বারেই ইশান ইগনোর করেছে। এই ইগনোরটা যেন তীর মেনে নিতে পারছে না কোনো ভাবেই।
কিন্তু তারপরও তীর সকল অভিমান ভুলে অধীর আগ্রহে বসে আছে ইশানের কাছ বার্থডে উইশ শোনার জন্য। তীরের কাছে ওর এই আটারো তম জন্মদিনটা একটু স্পেশাল তার কারণ ইশানের সাথে প্রনয়ের সম্পর্ক হওয়ার পর এটা তার প্রথম জন্মদিন আর ইশান সেটা খুব ভালো করেই জানে মার্চের বাইশ তারিখে তীরের জন্মদিন। কারণ আজকে যত বারেই তীর ইশানের সামনে পড়েছে তত বারেই তীর আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ওর জন্মদিন। তীর ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে জন্মদিনের প্রথম শুভেচ্ছাটা শুনতে চায়। এটাই একমাএ প্রত্যাশা ইশানের কাছে ওর। এখন দেখা যাক মিস্টার ইশান ফরাজী তার প্রেয়সীর মনের ইচ্ছেটা পূরণ করে কি না!
তীর পড়ার টেবিলে বসে বার বার ফোন চেক করছে ক’টা বাজে দেখার জন্য। ঘড়ির কাঁটা যেন আজ তীরের সাথে বেই’মানি’টা একটু বেশিই করছে ঘড়ির কাঁটা নড়ছেই না এক জায়াগাতেই স্থির হয়ে বসে আছে। তীরের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না। তীর রেগে গিয়ে এবার ফোনটা উপুর করে রেখে দেয়। পড়ায় মনোযোগ দিতে পড়ছে না টেনশনে। হাতে রাখা কলমটা টেবিলের রেখে দিয়ে ফোনটা নিতে চাইলে বলে উঠে।
–নাহ আর চেক করবো না। ওনি ফোন দিলে দিবে, না দিলে না দিবে তাতে আমার কি?
মুখে এক কথা বলেছে ঠিকেই কিন্তু মন বলছে অন্য কথা। তীর মনেপ্রাণে চায় ইশান যেন তাকে ফোন দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। তীর যখনেই কলমটা নিয়ে আবার লেখা শুরু করবে ওমনি ফোনের রিং টোন বেজে উঠে। তীর ঝ’ড়ে’র বেগে ফোনটা তুলে দেখে ফোনের স্ক্রিনে ইশার নামটা জ্বল জ্বল করছে। তীর হাতাশ হয়ে ফোনটা পিক করতেই ইশা ওপাশ থেকে বলে।
–হ্যালো বার্থডেগার্ল! কি অবস্থা আপনার?
তীর মিনমিনিয়ে বলে।
–ভালো।
–তা ভাইয়া ফোন করে উইশ করেছে তোকে!
–নাহ।
–এখনো করে নি। আচ্ছা সমস্যা নেই বারোটা বাজতে আরো দশ মিনিটি’স বাকি আছে। আমি বরং এখন রাখি পরে যদি তোকে ভাইয়া ফোনে না পায়।
ইশা ফোন কেটে দেয়। তীর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় সাত মিনিট কম বারোটা বাজে। সময় চলে যায় কিন্তু ইশান আর কল দিলো না তীরকে। ঘড়ির কাঁটায় এখন বাজে আপাতত বারোটা পাঁচ। তীরের কিশোরী ছোট্ট নরম হৃদয়ের মনটা নিমিষেই কা’লো মেঘে ঘিরে গেছে। বুক ফেঁটে কান্না আসছে। ইশানের কাছ থেকে সে তো এমন কিচ্ছু চায় নি জাস্ট বারোটার সময় জন্মদিনের শুভেচ্ছা টুকু শুনতে চেয়েছিলো। ইশান সেই ইচ্ছেটাও পূরণ করলো না এত্ত নি’ষ্ঠু’র লোকটা। তীরের কি কোনো মূল্য নেই লোকটা কাছে। যদি মূল্য থাকতো তাহলে হয়তো এভাবে ক’ষ্ট দিতো না তাকে।
ঠোঁট ভে’ঙ্গে কা’ন্না আসছে তীরের। তারপরও তীর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। কিন্তু না চাওয়া শর্তেও চোখে নোনা জলে ভরে গেছে। চোখের পলক ফেললেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। জোরে জোরে কয়েক বার শ্বাস ফেলে হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা চোখের জল মুজতে মুজতে বলে।
–দরকার নেই আপনার উইশ আমার। কোনো দরকার নাই…
তীরের কথার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠে। তীর ঝপসা চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ইশা ফোন করছে। ধরবে না তীর কারো ফোন ধরবে না আজকে আর। রিং হতে হতে কেটে গেল কল। পুনরায় ইশা কল করে কিন্তু আগের বারের মতোই এবারও কল ধরলো না তীর। কিন্তু তারপরও ইশা লাগাতার কল দিয়েই যাচ্ছে। এবার আর তীর কল না ধরে থাকতে পারলো না চোখের পানি মুজে নিজেকে সামলে কল ধরতেই ইশা অ’স্থি’র কন্ঠে বলে।
–কি হলোটা কি তোর? ফোন ধরছিলি না কেন?
তীর ফোনটা কানের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে ঠোঁট দুটো গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে।
–আরে ওয়াসরুমে গিয়েছিলাম। তাই ধরতে লেইট হয়েছে আর তাতেই তোর ধৈর্যের বাদ ভেঙ্গে গেলো।
–একদম মিথ্যে কথা বলবি না তীর। তুই এতোক্ষন ফোনের কাছেই ছিলি আমি জানি।
–হুম তুই তোর একটা চোখ আমার রুমে রেখে গেছিস তাই সবকিছু দেখতে পারছিস আমি কি করছি না করছি।
ইশা কোমল কন্ঠে বলে।
–তুই কি কা’ন্না করেছিস তীর?
থমকে যায় তীর। মেয়েটা এত চালাক যে কিছু হলেই ধরে ফেলে। তীর ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে।
–কি সব উল্টা পাল্টা বকছিস তুই। আমি কোন দুঃখে কান্না করতে যাবো আজব।
ইশা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে।
–তোর কন্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে।
তীর চুপ করে যায়। কি বলবে সে ইশাকে সত্যিই তো সে না চাইতেও কান্না করেছে। তীরকে নিরব থাকতে দেখে ইশা আবারও বলে।
–বার্থডে গার্লদের কান্না করা মানায় না। তারা এসময় হাসিখুশি থাকে।
তীর অস্পষ্ট স্বরে বলে।
–হুম।
–আমি জানি কেন তোর মন খারাপ! ভাইয়া নিশ্চয়ই তোকে ফোন দেয় নি। এর জন্য মন খারাপ করিস না প্লিজ। ভাইয়া মনে হয় কাজের চাপে ভুলে গেছে তোর জন্মদিনের কথা।
তীর মনে মনে আওড়ায়।
–সত্যিই ভুলে গেছে ওনি আমার জন্মদিনের কথা। রাত বারোটার সময় কি এমন এতো কাজের চাপ থাকে যে নিজের ভালোবাসার মানুষটার জন্মদিনের কথাটাও ভুলে যায়।
অন্যদিকে ইশা তীরকে চুপ থাকতে দেখে বলে।
–কি রে কথা বলছিস না?
–কিছু নারে! এখন রাখি রাত হয়েছে অনেক ঘুম পাচ্ছে আমার।
ইশাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টাস করে কলটা কে’টে দেয়। ইশা অবাক নয়নে ফোনটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় আর সোজা ঘর থেকে বের হয়ে চলে যায় ইশানের রুমে সামনে। ইশান এখনও সজাগ ঘরের লাইট জ্বলছে। ইশা ভাইয়ের দরজা নক করতেই ইশান ভেতরে থেকে বলে।
–কে?
–ভাইয়া আমি!
–হুম আয়।
ইশা ঘরের ভেতরে ডুকতেই ইশান ল্যাপটপে কাজ করতে করতে বলে।
–কিছু বলবি?
–ভাইয়া এটা কিন্তু একদম তুমি ঠিক করছো না।
ইশান ভ্রু-কুচকে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে।
–কোনটা?
–তীরকে এভাবে কষ্ট দেওয়াটা।
ইশান বোনের দিক থেকে নজর ফিরিয়ে ল্যাপটপে নজর নিবদ্ধ করে বলে।
–কেন? ও কেন কষ্ট পাচ্ছে?
–তুমি জানো না বুঝি ওর যে আজকে জন্মদিন। ও তো তোমার কাছ থেকে দামি কিচ্ছু চায় নি শুধু জন্মদিনের শুভেচ্ছা টুকু শুনতে চেয়েছে আর তুমি সেই আশাটাই পূরণ করলে না ওর।
–বলা শেষ।
ইশানের কথা শুনে ইশা হতভম্ব হয়ে বলে।
–মানে?
–বলছি তোর কি বলা শেষ হয়েছে নাকি আরো কিছু বলবি।
ইশা নাকের পাটা ফুলিয়ে নিচের ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে। রাগে মাথার দু সাইডের রগ গুলা যেন ফেটে যাচ্ছে। তার বলা কথাগুলার কোনো মুল্যই দিলো না ইশান। ইশাকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে ইশান বলে।
–কি হলো এমন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
–নাহ আমার আর কিছু বলার নেই।
–ওকে তাহলে তুই যা এখন আমার অনেক কাজ বাকি আছে।
ইশা এবার রেগেই বলে উঠে।
–শুধু কাজ আর কাজ, থাকো তুমি তোমার কাজ নিয়ে পড়ে। কিন্তু আমার বেস্টুর যদি কিছু হয় তোমার জন্য ভাইয়া তাহলে তোমার খবর আছে এই আমি বলে দিলাম তোমাকে।
ইশা রাগের বশে ঘর থেকে প্রস্থান নেওয়ার সময় দরজাটা এমন ভাবে বিকট এক শব্দ করে যার কারণে ইশান ভ’য়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। বোন যে ক্ষে’পে গেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। নারী জাতি একবার রা’গ আর অভিমান করলে সেটা যে কি পরিমাণ ভ’য়ংক’র আকারে রুপ ধারণ করে সেটা বলে বুঝানো যাবে না। নারী জাতি বরই র’হ’স্য’ম’য় এক জাতি। তাদের মনে যে কি চলে একমাএ উপরওয়ালা আর সে নিজে জানে।
ইশান ঘরের দরজাটা লক করে সোজা বেলকনিতে চলে যায়। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েই প্রথমেই তাকায় তীরের বেলকনির দিকে। বেলকনিতে লাইট জ্বললেও তীরের ঘর অন্ধকার। ইশান দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে তারা ভর্তি খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে।
–সরি জান! তোকে এভাবে আঘাত দেওয়ার জন্য। খুব বেশি আঘাত দিয়ে ফেলেছি কি তোকে আমি? কথায় আছে যে ভালোবাসতে পারে সে নাকি আঘাত দিতেও পারে। একটু দূরত্ব বাড়িয়ে দেখলাম তোরে মনে কি আসলেই আমার জন্য জায়গা আছে নাকি এটা শুধুই মোহ। কিন্তু এখন যেটা বুঝতে পারলাম তুই তো দেখি আমার থেকেও বড় পাগল। যাই হোক যেই আঘাত গুলা দিয়েছি সেই আঘাত গুলা না হয় আজকেই তোর মন থেকে নির্মূল করে দিবো ইনশাল্লাহ।
বলেই চোখ বন্ধ করে প্রেয়সীর মিষ্টি মুখখানা চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলে।
________
সকালে তীর ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই পরিবারের সকল সদস্যরা হ্যাপি বার্থডে বলে চিৎকার করে উঠে। হঠাৎ এমনটা হওয়াতে তীর অবাক হয়ে যায়। তার পরিবারের লোকজন তাকে একেকবার একেক ভাবে সারপ্রাইজ দেয়। আজিজুল আহমেদ মেয়ের কাছে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।
–কি হয়েছে মা? মুখটা এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন এমন একটা দিনে?
তীর মলিন হাসি দিয়ে বলে।
–তেমন কিছু হয় নি বাবা। আসলে আর ক’দিন পরে এক্সাম তো তাই একটু চিন্তিত।
–এতো চিন্তা করার কিচ্ছু হয় নি আমার মায়ের পরীক্ষা খুব ভালো হবে।
–তোমাদের সকলের দোয়া মাথায় থাকলে ইনশাল্লাহ ভালো হবে।
–হুমম। এবার যাও দাদুকে গিয়ে সালাম করো।
তীর দাদুর কাছে গিয়ে সালাম করতে নিলেই বলে।
–সালাম করতে হবে না আমাকে দাদু আমার দোয়া সবসময় তোমার উপরে আছে।
এমন সময় ছোট অভি বোনের সামনে এসে একটা ক্যাডবেরি চকলেট এগিয়ে দিয়ে বলে।
–আপু এটা তোমার জন্মদিনের গিফট। আমি তো চাকরি করি না তাই বাবার টাকা দিয়েই তোমাকে গিফট দিলাম। যখন আমি চাকরি করে এত্ত টাকা কামাবো তখন তোমাকে আমি অনেক কিছু গিফট করবো তোমাকে।
তীর ভাইয়ের কথা শুন মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে বসে ভাইয়ের সরু নাকটা টেনে বলে।
–থাঙ্কু আমার ভাইয়া। আর আমি তোর চাকরি পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম তখন কিন্তু অনেক গিফট কিনে দিতে হবে আমাকে।
–হে দেবো তো।
তীর ভাইয়ের কথা শুনে ভাইয়ের মাথা ভর্তি চুল হাত বুলিয়ে দেয়। অভি আবারও বলে।
–আপু জানো আম্মু তোমার জন্য তোমার প্রিয় খাবার পায়েস রান্না করেছে। চলো খাবে চলো।
এর মাঝে আয়েশা সুলতানা বলে।
–ওখানে বসো সবাই আমি আনছি সবার জন্য পায়েস।
পায়েসের বাটি সেন্টার টেবিলের উপর রাখতে সবাই একএক করে পায়েসের বাটি তুলে নেয়। আয়েশা সুলতানা আগ্রহ নিয়ে সকলকে প্রশ্ন করে।
–কেমন হয়েছে?
তীর ধীর কন্ঠে বলে।
–ওই প্রতিবার যেমন হয়।
মেয়ের কথা শুনে আয়েশা সুলতানা মুখটা কা’লো করে বলে।
–এবারও
–সমস্যা নেই মা তোমার তো এই একটাই সমস্যা বেশি মিষ্টি দিয়ে ফেলো পায়েসে কিন্তু এছাড়া খুব মজা হয়েছে খেতে।
আয়েশা সুলতানা হাতাশ কন্ঠে বলে।
—আর মজা বেশি মিষ্টি হয়ে গেলে আর খাওয়া যায় নাকি।
#চলবে_______