#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৪৪
দিনটা ১২ জুন। তীর আর ইশার বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার দিন। রেজাল্ট দেওয়ার দুই দিন আগে থেকেই তীর চিন্তায় চিন্তায় মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্লাস তো পাবে না তীর এটা নিশ্চিত সে জানে। এখন কি পয়েন্ট পেতে পারে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে আছে মেয়েটা। তবে ইশার ক্ষেত্রে পুরোটাই উল্টো ও হাসিতে, খুশিতে, খাচ্ছে, ধাচ্ছে। মানে রেজাল্ট নিয়ে ওর মনে কোনো প্রকার ভ’য় ড’র বলতে কিচ্ছু নেই। এ নিয়ে ইশান যে কথা শুনিয়েছে ইশাকে তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু ইশার তো গন্ডারের চামড়া তাই ও ভাইয়ের ফা’ল’তু কথায় পাত্তা দেয় নি। এক কান দিয়ে ডুকায় তো আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। ইশার এক কথা “যা হওয়ার হবে এতো চিন্তা করে কোনো লাভ নেই শুধু শুধু মস্তিষ্কের উপরে প্রেসার পড়বে”।
ইশা তীরের এমন ছটপটানি দেখে ফোনের স্ক্রিন থেকে নজর সরিয়ে তীরের দিকে নজর দিয়ে চেহারায় বিরক্তিকর ভাব এনে বলে।
–এই তুই এমন ব্যাঙের মতো লাফা লাফি করচ্ছিস কেন? একটু শান্ত হয়ে বস তো।
তীর পায়চারী করতে করতে বলে।
–রেজাল্টের টেনশনে আমার মাথা কাজ করছে না। আর তুই বলচ্ছিস শান্ত হয়ে বসতে। তুই কি করে এমন চিন্তামুক্ত হয়ে বসে বসে এভাবে ড্রামা দেখতে পারিস আমার তা বুঝে আসছে না।
ইশা আধশোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে বলে।
–শোন যা হওয়ার হয়ে গেছে তাই এতো টেনশন করে কোনো লাভ নাই। আচ্ছা আগে এটা বল তুই তো পরীক্ষা দিয়েছিস তাহলে তোর কি মনে হয় তোর পয়েন্ট কত আসতে পারে।
–উমমম 4.50 এর উপরে আসতে পারে।
–তাহলে তো হলোই 4.50 এর উপরে পেলেই ভালো রেজাল্ট যা। এখন এতো টেনশন না করে তার চেয়ে ভালো তুই আর আমি মিলে ড্রামা দেখি তাহলে রেজাল্টের কথা মাথায় আর আসবে না।
–তুই তোর ড্রামা দেখ।
–আরে এমন করিস কেন? আয় ড্রামাটা দেখ আইসা সেই মজা।
–তুই দেখ তোর ড্রামা চামা।
বলেই সোফায় বসে মনে মনে দোয়া করা শুরু করে দেয় খোদার কাছে যেন পরীক্ষার রেজাল্টটা ভালো আসে। পরীক্ষার রেজাল্ট দুই বান্ধবী এক সাথে জানার জন্যই তীর ফরাজী ভিলাতে আসে। ভেবেছিলো ইশাও হয়তো তার মতো রেজাল্ট নিয়ে টেনশন করবে কিন্তু না তার ভাবনা এই মেয়েটা একদম মিথ্যে প্রমাণ করে দিলো এমন বিহেভ করে।
____
ঘড়ির কাটা বারোটায় ছুইছুই এমন সময় রেহেলা খালা এসে জানায় ইশান ইশা আর তীরকে নিচে যেতে বলে। ইশা মুখে যাই বলুক না কেন মন মনে ঠিকেই ভয় পাচ্ছে রেজাল্ট নিয়ে। যতো রেজাল্ট প্রকাশের সময় এগিয়ে আসছে ততোই টেনশন বাড়ছে। ইশা আর তীর নিচে নামাতেই ইশান ইশার উদ্দেশ্যে বলে।
–আসেন আসেন চিন্তাহীন মানবী একটু পরেই আপনার ঐতিহাসিক রেজাল্ট প্রকাশ পাবে। আপনার রেজাল্ট জানার জন্য দেখুন আজকে কেউ এই বাড়ি ছেড়ে এক পাও বাইরে এগোইনি।
ইশানের কথা শুনে ইহান বলে উঠে।
–উফফ! ইশান আমার বোনটাকে এভাবে বলবি না দেখবি ইনশাল্লাহ ওর রেজাল্ট ভালোই হবে।
সোহেল ফরাজী বলেন।
–হে ইশান তুমি একটু বেশি বলছো আমার মাটাকে। দেখবে ওর রেজাল্ট ভালো হবে তাই না মা।
ইশা বাবার কথা শুনে মুচকি হাসি দেয়। এমন সময় ইশান আবার বোনকে খুচা দিয়ে বলে।
–উমম। দেখা যাবে কেমন রেজাল্ট করে না করে। একটু পরেই তো প্রকাশ হবে।
এদিকে তীরের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ভয়ে। বার বার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরছে। ইশান এবার ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তীরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত কন্ঠে বলে।
–তীর!
তীর অসহায় চোখে ইশানের দিকে তাকায়। ইশান তীরের অসহায় মুখটা দেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে।
–রেজাল্ট নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছে।
তীর মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বুঝায়। ইশান হেসে বলে।
–এতো টেনশন করার কিচ্ছু হয় নি যা হবে ভালোই হবে। তোর পাশের জনের তো রেজাল্ট নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথাই নেই তাই তোরও উচিত এতো চিন্তা না করার বুঝলি।
ইশা এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না ভাইয়ের উদ্দেশ্য চিৎকার করে বলে।
–ভাইয়া তুমি এমন একটা ভাব ধরছো যেন নিজে একেবারে গোল্ডেন প্লাস পেয়ে এসেছো সব পরীক্ষায়। তুমি কি ভাবো আমি কিচ্ছু জানি না বুঝি তুমি যে টেনে থাকতে টেস্ট পরীক্ষায় দু সাবজেক্টে ডাব্বা মেরেছো সেটা কি।
ইশান চোখ বড় বড় করে বলে।
–এই তোকে এসব কথা কে বলেছে হুম?
–যেই বলুক তোমাকে বলতে হবে।
–শোন তখন আমি অসুস্থ ছিলাম তাই….
ইশানের কথার মাঝেই ইশা বলে।
–থাক তোমাকে আর এতো এক্সকিউজ দিতে হবে না আমি জানি সব।
–কি জানিস তুই?
–জানি জানি সব বলেছে একজন আমাকে।
ইশান ভ্রু কুচ করে বলে।
–এই একজনটা কে?
–তোমাকে কেন বলবো?
ইশান আর ইশার এমন কথা কাটাকাটি দেখে তীর মনে মনে হাসে। এই দু ভাই বোন এক সাথে হলেই সাপে নেউলের মতো লেগে থাকে সারাক্ষণ। নেহা বেগম রান্না ঘর থেকে ভাই বোনের চিল্লাচিল্লি শুনে ছুটে এসে বলে।
–এই তোরা দুই ভাই বোন ঝগড়া বন্ধ করবি। আর ইশান তুই এতো বড় হয়েছিস তারপরও তোর হাটুর বয়সি বোনের সাথে এভাবে লেগে থাকিস কেন আমি সেটা বুঝতে পারি না?
তারপর স্বামীর দিকে নজর দিয়ে বলে।
–আর তুমি ছেলে মেয়ে দুটো ঝগড়া করছে আর তুমি তা বসে বসে দেখছো মুখ ফুটে কিচ্ছু বলছো না কেন?
–আমি কি বলবো।
–থাক তোমাকে আর কিচ্ছু বলতে হবে না। আর ইশান তুই…
মায়ের কথার মাঝেই ইশান বলে।
–মা তোমার আদরের মেয়ের কার্যক্রম দেখলেই এসব কথা আমার মুখ দিয়ে অটোমেটিকলি বের হয়ে পড়ে।
–আর বের করতে হবে না কথা। এবার দেখ মেয়েটার রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে কি না।
–রেজাল্ট প্রকাশ তো হয়েছে কিন্তু সার্ভার ডাউন হয়ে গেছে।
ইশানের কথা শুনে তীরের বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠে। অন্য দিকে ইশাও টেনশনে পড়ে যায়।
রেজাল্ট জানতে পেরেছে তীরের পয়েন্ট 4.78 আর ইশার পয়েন্ট 4.81। ইশা তো ভীষণ খুশি এই রেজাল্ট নিয়ে তীরও মোটামুটি খুশি হয়েছে। যেই রেজাল্ট আশা করেছিলো তার থেকে বেশি পয়েন্ট পেয়েছে এতে আল্লাহ কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে। ইশান রেজাল্ট জানার পরেই অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার পূর্বে তীরের কাছে গিয়ে বলে।
–ভালো করেছিস। তবে আরেকটু ভালো করে পড়লে আরেকটু ভালো হতে পারতো রেজাল্টটা।
তীর ইশানের কথায় মুচকি হাসি দেয়। ইশানও মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে। ইশান চলে যেতেই ইশা তীরের কাছে এসে বলে।
–তোর কি মন খারাপ?
তীর অবাক হয়ে বলে।
–কেন?
–এই তোর থেকে আমার পয়েন্ট যে একটু বেশি।
ইশার কথা শুনে তীর ইশার মাথা টুকা মেরে বলে।
–তুই আমাকে এমন হিংসুটে ভাবিস নাকি রে। যেমন পরীক্ষা খাতায় লিখেছি তেমন রেজাল্ট হয়েছে তার জন্য তো রেজাল্ট দেখে মন খারাপ করবো কেন?
ইশা হেসে বলে।
–জানি তো আমার তীর সোনা এমন মেয়েই না। সে গুড গার্ল।
_____
তীর মা বলে চিৎকার করতে করতে বাড়িতে ডুকছে। আয়েশা সুলতানা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো মেয়ের রেজাল্ট কি এসে জানার জন্য। তীর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে।
–মা 4.78 পেয়েছি।
–ইশা কি পয়েন্ট পেয়েছে?
তীর মায়ের কাছ থেকে দুরে সরে এসে বলে।
–4.81।
–দুজনেই ভালো রেজাল্ট করেছিস।
তীর মন খারাপ করে বলে।
–তুমি কি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছো মা।
আয়েশা সুলতানা ভ্রু কুচ করে বলে।
–হঠাৎ এই কথাটা বললি কেন?
–আমার রেজাল্ট নিয়ে।
–আরে ধুর বোকা মেয়ে তোর প্রতি অসন্তুষ্ট হবো কেন? খুব ভালো রেজাল্ট করেছিস।
তীর হেসে বলে।
–তাহলে আমি বরং বাবাকে ফোন দিয়ে জানাই গিয়ে আমার রেজাল্টের কথা।
–যাহ। আর হে তোর দাদুকে বলিস।
তীর চলে যেতে নিলে মায়ের ডাক শুনে থেমে গিয়ে বলে।
–কি হয়েছে মা?
আয়েশা সুলতানা মেয়ের গলার লকেটটা হাতে নিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে।
–এই লকেটটা তোর গলায় কোথা থেকে এসেছে তীর? কে দিয়েছে তোকে?
তীর এতোদিন লকেটটা ওড়না দিয়ে ডেকে রাখতো কিন্তু আজকে অসাবধানতার কারণে ওড়না সরে গেছে আর মাও দেখে ফেলেছে। তীর আমতা আমতা করে বলে।
–মা এটা আসলে..
–আসলে কি? কে দিয়েছে এটা তোকে এতো দামি একটা জিনিস।
তীর এবার কি বলবে সত্যিটা তো তাকেই বলতে হবে মিথ্যে বললে মার কাছে নিশ্চিত ধরা পড়ে যাবে। তাই ভ’য়ে ভ’য়ে বলে।
–মা আসলে এটা আমাকে ইশান ভাই দিয়েছে আমাকে।
আয়েশা সুলতানা চোখ ছোট ছোট করে বলে।
–ইশান তোকে এটা দিয়েছে।
–হুমমম।
–কেন দিয়েছে?
–মা আসলে….
এমন সময় শাপলা বেগম নাতনিকে ডেকে উঠেন নিজের ঘর থেকে। আয়েশা সুলতানা ভারী গলায় বলে।
–যাহ দাদু ডাকছে তোকে।
তীর হাফ ছেড়ে বাঁচলো এতোক্ষণ মনে হচ্ছিলো যেন কেউ গলা চেপে ধরেছে। আরেকটু সময় মায়ের সামনে থাকলেই শ্বাস আটকে মা’রা যেত। তীর গুটি গুটি পায়ে মায়ের সামনে থেকে চলে যায়। আয়েশা সুলতানা সোফাতে বসে মনে মনে বলে।
–ইশান তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করি নি আমি। তুমি যে এভাবে সুযোগটা নিবে আমি ভাবতেও পারি নি। তবে এর উত্তর তোমাকে দিতে হবে আমাকে আজ কালকের মধ্যেই কেন তুমি এটা করলে?
_____
চার চারটে দিন পেরিয়ে গেছে ইশান আবারো তীরকে ইগনোর করা শুরু করে দিয়েছে। কল দিলেই বলে ব্যস্ত আছি পরে কথা বলি। তীর ভেবে পাচ্ছেন না কেন ইশান কয়েকদিন পর পর তার সাথে এমন করে কেন? কি সমস্যা ইশানের কি চায় সে? এ সবকিছুর উত্তর জানতে চায় ইশানের কাছ থেকে। কিন্তু এতো সব কিছুর মাঝে আরেক ঝামেলা এসে হাজির হয়েছে। তীরের সাথে দেখা করতে চায় তার মায়ের পছন্দ করা ছেলে। গতকালকেই নাকি লন্ডন থেকে দেশে এসেছে আর এসেই ছেলে চাইছে তীরের সাথে দেখা করতে। এমন কথা শুনে যেন তীরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। অচেনা অজানা একটা ছেলের সাথে কি করে দেখা করবে ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। মাকেও ভয়ে না করতে পারছে যে সে দেখা করবে না। তীরের কিচ্ছু ভালো লাগছে না মাথায় এতো চাপ নিতে পারছে না। এক দিকে ইশান তো অন্য দিকে মা। তারা তার সাথেই কেন বার বার এমন করছে? কি চায় তারা?
#চলবে_____
আজকের পার্ট তেমন ভালো হয় নি অনেক ব্যস্ততার মধ্যে লিখছি।