ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৪৬(মধ্যাংশ) #হুমাইরা_হাসান

0
822

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৬(মধ্যাংশ)
#হুমাইরা_হাসান

– আপনারা এখনও চুপ করে আছেন? নিজের মেয়ের উপর এত বড়ো অন্যায় আমি কিছুতেই মেনে নেবো না মুর্তজা সাহেব

– চুপ থাকা ছাড়া তো আর কোনো রাস্তা দেখছি না

ধপ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ওয়াকিফ চৌধুরী, গায়ে জড়ানো পাঞ্জাবি টায় হাত বুলিয়ে টান করে আঙুল উঁচিয়ে বললেন

– প্রথমেই আপনারা আমার মেয়ের এতদিনের স্বপ্ন চুরমার হতে দেখেও কোনো স্টেপ নেননি, এরপর মেহরাজ দিনের পর দিন আমার মেয়েকে অপমান ও করেছে অনেক ভাবে। সেসব তো ছিলোই ওর সাহস হলো কি করে আমার মেয়ের হাতে এ’সিড ঢেলে দেওয়ার! এতো বড়ো সাহস! তিয়াসা আমার মেয়ে,আমার আদরের রাজকন্যা। ওর উপর কোনো আঘাত আমি ওয়াকিফ একচুল সহ্য করবো না বলে রাখছি

– তাহলে কি করতে চান আপনি?

গলার স্বর শক্ত করেই প্রশ্ন ছুড়লো আরহাম। কপালে তার অসংখ্য বলিরেখার ভাঁজ। এয়ারকন্ডিশনের আওতায় থাকা রুমটাতে বসেও কপালের ভাঁজে তার ঘামের ছোট বিন্দু অজস্র। চেহারায় রাগ,বিরক্তি আর দুশ্চিন্তা মিলিয়ে ত্রৈধ এক ছাপ ফেলেছে, ওয়াকিফ চৌধুরী শাণিত চোখে তাকালো একবার আজহার মুর্তজার দিকে, হয়তো তার থেকে এই প্রশ্নের জবাব টা তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন, তবে আজহারের নীরবতায় আরও তেঁতে উঠলো চড়া মেজাজ টাহ, আরহামের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল

– যা আপনারা করতে ভয় পাচ্ছেন তাই করবো প্রয়োজনে। মনে রাখবেন মেহরাজকে আপনারা সমীহ করে চললেও আমি নম নম করতে পারবো না, এমনিতেও ব্যবসায় আমি কোনো প্রফিট পাচ্ছি নাহ

– ব্যবসাতে কি প্রফিট একা আপনার যাচ্ছে নাকি আমাদের ও? কি বলতে চাচ্ছেন আমরা আপনাকে ঠকিয়ে নিজেদের পকেট ভরছি?

– মেহরাজ আর আপনাদের পকেট তো আলাদা দেখছি না। রিয়েল এস্টেটের যে নতুন টেন্ডার টা ধরলেন, ওটাতে কম হলেও কোটি টাকার লাভ, এগুলো আপনাদের পকেটে যাবে না বলছেন?

আরহাম মুর্তজার ভ্রু যুগল ব্যপক ভাবে কুঞ্চন হলো, চেহারাটায় রাগের লালাভ, কটমট করে বলল

– রিয়েল এস্টেটের সাইড টা মেহরাজের একার, মেহরাজ ওর শেয়ারের প্রোপার্টি থেকে ইনভেস্ট করেছে, আর মি.রায়ান গসলি অনেক আগে থেকেই মেহরাজের শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন তাই ওর আমাদের সাহায্য দূর আমাদের একবার বলার ও প্রয়োজন হয়নি।

ওয়াকিফ চৌধুরীর ক্রুর হাসলেন, তাতে তাচ্ছিল্যের রেশটুকু স্পষ্ট বিদ্যমান। এবার বেশ শান্তভাবে হলেও তীক্ষ্ণ গলায় বললেন

– ওর শেয়ারের! হাসালেন মুর্তজা ব্রাদার্স, সবই তো ওর আপনারা হলেন উড়ে এসে জুড়ে বসা, মেহরাজ একবার মত ঘুরিয়ে নিলে সব ফাঁকা। যাকে বলে কাক হয়ে কোকিলের ডিমে তা

বলেই সশব্দে হেসে উঠলো। মাঝারি গড়নের শরীর টা দুলে উঠলো বিকটভাবে। আরহাম ক্ষিপ্ত হয়ে দু কদম এগিয়ে গিয়ে বলল

– মুখ সামলে কথা বলুন। এই সম্পত্তি,টাকা ব্যবসা শুরু থেকেই আমাদের ছিলো। আমাদেরই থাকবে। মেহরাজ আমাদের সন্তান তাই এসবে ওর ও সমান হক থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

– আপনি কাকে কোনটা বোঝাচ্ছেন আরহাম, আমাকে? সব ইতিহাস আমার জানা আছে, আমার সাথে ভাউতাবাজি একদম না

আরহামের মেজাজ টা উর্ধ্বে চলে গেলো। ওয়াকিফ চৌধুরীর বলা প্রতিটি কথা যেনো শূলের মতো বিঁধছে শরীরে। আবারও চড়া গলা তুলবে তার আগেই ধমকে উঠলেন আজহার৷ এতক্ষণ নিশ্চুপতা দেখিয়ে ওদের বাকবিতন্ডা শুনলেও এবার ক্ষোভে তপ্ত মেজাজে বললেন

– আহ, কি হচ্ছে কি! দুজন মিলে রেষারেষি করছো কেনো। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করে কোনো সমাধান হবে নাহ

– নিজেদের মধ্যে ঝামেলা তো অনেক আগেই করে ফেলেছেন। আমার মেয়ের সাথে এতো বড়ো কাজটা করার আগে ভাবা উচিত ছিলো

আজহার মুর্তজা বসা থেকে দাঁড়ালেন। হাতের ফোনটা পকেটে পুরে বললেন

– দেখুন তিয়াসার সাথে যা হয়েছে তাতে আমরা দুঃখিত। কিন্তু এর সাথে আমাদের কোনো যোগসূত্র নেই। ওরা নিজেরাই নিজেদের ঝামেলা ডেকেছে। আমি এর আগেও তিয়াসাকে বুঝিয়েছি। আমি বলেছি ধৈর্য্য ধরতে, সাপের লেজে পা দিলে ছোবল খেতে হবে এটা ওর ও জানা ছিলো।

– তাহলে শুধু আমার মেয়ে কেনো? আপনাদের…

– ওকে আমরা নিজেরাই খোঁজ করে পাচ্ছিনা। কুজাত টাকে হাজার বার নিষেধ করেছি, ওর যেনো সহ্য হয়নি আর। এখন গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে, ওর জন্য আমাদের টেন্ডার আঁটকে আছে

– টেন্ডারের কথা ভুলে যান। কারণ অবস্থা যা দেখছি তাতে আপনাদের এই জা’লিয়াতির মেয়াদ খুবই স্বল্প

ক্ষীণ বিরতি নিয়ে আবারও বললেন ওয়াকিফ

– আমার মেয়ের হাতের চামড়া এখনো দগদগ করছে, আমি এর শোধ কড়াই গন্ডায় চুকিয়ে নেব। বেস্ট অফ লাক!

বলেই গটগট করে বেড়িয়ে গেলো। ওয়াকিফ বের হতেই আরহাম পা দিয়ে জোরে শব্দ করলো, তিক্ত মেজাজে চড়াও গলাটায় বেশ ক্ষুব্ধতা সহিত বলল

– এক ঝামেলা নিয়ে কূল পাইনা আবার আরেকজন। আমার আর এতো কিছু সহ্য হচ্ছে না ভাইজান। জলদি কিছু একটা করতে হবে, না তো একূল ওকূল সব হারাবে।

আজহার মুর্তজার চেহারায় প্রচন্ড দুশ্চিন্তার ছাপ। চুলহীন কপাল টার ঘাম রুমালে মুছে বলল

– ওই ইতরের ছা টাকে আগে খোঁজ করো। দুই ইঞ্চির কলিজা নিয়ে মেহরাজের বউয়ের গায়ে হাত দিতে ওর বুক কাঁপেনি? এখন কেনো গা ঢাকা দিয়েছে। ওটাকে যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে আনার চেষ্টা করো।

_________________________

সময়টা বিকেলের ৪ টা, মোহরের শিফট শেষ, ওয়ার্ড গুলো সব ভিজিট করে বের হলো কেবিন থেকে। হসপিটালের আজ দ্বিতীয় দিন, কোনো প্রকার র্ঝঞ্ঝাট ছাড়াই বেশ সুন্দর কেটেছে অভিজ্ঞতার দ্বিতীয় দিনটা, সব রোগীদের ডিটেইলস এর ফাইলটা হাতে করে মোহর হাঁটা ধরলো ফায়াজের কেবিনে। এটা দিয়ে আসতে পারলেই আজকের মতো ওর কাজ শেষ। মৃদুমন্দ পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে কেবিনের সামনে এসে দরজা টায় আলতো আলগা করে মোহর বলল

– আসতে পারি স্যার?

এটুকু বললেও বাকি কথা কণ্ঠনালীতে আঁটকে গেলো, বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে রইলো সামনের দুজনের দিকে। অপ্রত্যাশিত,ধারণাতীত দৃশ্য দেখেই পা আঁটকে গেলো। অপ্রকৃতস্থ চেহারাতে তাকিয়েই রইলো, ওর অপ্রতিভ চেহারাটা খুব একটা আমলে নিলো না ফায়াজ, সোজা থেকে গা এলিয়ে দিলো অফিস চেয়ারটাতে। চোখের ইশারায় মোহরকে আসতে বললে, মোহর অপ্রস্তুত চেহারাতেই এগিয়ে গেলো। ওর সামনেই বসে থাকা দ্বিতীয় জন ফোনে ব্যস্ত থাকায় এখনো মোহরের চেহারাটা দেখতে পারেনি। মোহর এগিয়ে যেতেই ফায়াজ হাত বাড়ালো, অপরপক্ষের নিস্ক্রিয়তা দেখে ফায়াজ গলা খাকারি দিয়ে বলল

– এহেম এহেম!

মোহরের ধ্যান ফিরলে ও হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলো। আড়চোখে তাকালো পাশের মানুষটার দিকে।

– বাবা ফোন দিয়েছে ভাইয়া, আমি যাচ্ছি। তুমি সন্ধ্যায় আসবে কিন্তু

বলে পাশে তাকালো, ঠিক কিছুক্ষণ আগে মোহরের চেহারাতে যেরূপ অভিব্যক্তি ছিলো, একদম সেটাই ছড়িয়ে পড়লো তিয়াসার চোখে মুখে। বিজড়িত চোখে একবার মোহরের দিকে তাকিয়ে আবার ফায়াজের দিকে তাকালো, তিয়াসার সকৌতুক দৃষ্টিকে লক্ষ্য করে ফায়াজ বলল

– সী ইজ মোহর, মোহর শিকদার। আমার নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট। তোমার কলেজেরই, জুনিয়র। চেনো নাকি?

তিয়াস অপলক তাকিয়ে রইলো খানিক মোহরের চেহারাতে, আগাগোড়া পরখ করলো ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে। যেই দৃষ্টির ফাঁকে হিংসার রেশটুকু স্পষ্ট বুঝতে পারলো মোহর। ভীষণ দাম্ভিকতার সহিত উঠে দাঁড়ালো, শক্ত গলায় বলল

– আমার কলেজে অনেক গেঁয়ো, বস্তির লোকজন ও পড়তে আসে। প্রয়োজন নেই যে আমি সবাইকে চিনবো

বলে ফায়াজের দিকে না তাকিয়েই ছোট করে ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে গেলো খটখট শব্দ করে। মোহর তিয়াসার যাওয়ার পানে তাকালে ওর ব্যন্ডিজে আবৃত হাতটা দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো।

– বোসো মোহর

ফায়াজের কথায় ধ্যান ফিরলে, ও ধাতস্থ হয়ে চুপচাপ ফায়াজের সোজাসুজি রাখা চেয়ারটাতে, মোহর বসলো নতমস্তকে। ফায়াজ ফাইল দেখার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তাকায় বারংবার মোহরের দিকে৷
ওর পদ্মলোচন আঁখিদ্বয়, পাতলা পাপড়ির ন্যায় ওষ্ঠ, টানা টানা ভ্রুর নিচের কৃষ্ণাভ চোখ দু’টোর চঞ্চলতা সবটা, সবটা যেনো বৈরাগী আবহাওয়ার মতন অন্তরের ভিতটাকে নাড়িয়ে দেয় ফায়াজের। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে, বুকের বাঁ পাশটায় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাভূত হয়। ঠিক যেমনটা হয়েছিলো বছর চারেক আগে। নিশ্চুপ, শান্তশিষ্ট, গম্ভীর কিশোরীকে দেখে। ওই পাতলা মুখ, নরম গাল, ভরা ভরা চোখ দু’টোর প্রতিচ্ছবি এখনো ফায়াজের মুখে ভাসে। ভেতরটা সুনসান শ্মশানের মতো হীম হয়ে আসে। হুট করেই ভাবনাচ্যুত হয় ফায়াজের. . ফোনের রিংটোনে ধাতস্থ হয়ে ফাইলটা হাত থেকে নামিয়ে রাখে, নরম গলায় বলে

– কাজ কেমন লাগছে মোহর?

– ভালো লাগছে স্যার

মোহরের সদা সর্বদার ন্যায় ছোট ছোট উত্তর। ফায়াজ হাসে মৃদু,ওর ফর্সা চেহারাটায় অদ্ভুত ক্লান্তির ছাপ বিদ্যমান হয়, নিষ্পলক চেয়ে বলে

– এখনই ফিরে যাবে?

মোহর ঘাড় তুলে ভ্রু গুঁটিয়ে বলে

– জ্বী?

– তোমার ডিউটি শেষ হয়েছে। এখন ফিরে যেতে পারো

মোহর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে, আরও কিছু কথা বার্তা সেরে উঠে আসলো। শ্রীতমাটার শিফট আজ আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন ওর একাই ফেরা লাগবে। হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে একদম গেটের সামনে এলেই দেখতে পেলো কাঙ্ক্ষিত গাড়িটা, আর তার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন চেহারা। অধর যুগল প্রসারিত হলো, মিষ্টি হেসে লাজুক চেহারায় এগিয়ে গেলো।
ও যেতেই মেহরাজ হাত থেকে অ্যাপ্রোন টা নিজের হাতে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলো, মোহর উঠে বসতেই নিজেও গিয়ে পাশে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল

– কেমন কাটলো আপনার সেকেন্ড ডে বিবিজান।

মোহর হাসলো মৃদু, প্রাণহরার চেহারাটায় চোখ ভরে তাকিয়ে থেকেই বলল

– ভালো, খুব ভালো

দেখতে দেখতে দৃষ্টির সীমানার বাহিরে চলে গেলো গাড়িটি, তার সাথে দুটো মানুষ। আর সেই দৃশ্যে চাতক পাখিত মতো চেয়ে রইলো এক জোড়া চোখ। কত সাধ ছিলো, স্বপ্ন ছিলো। প্রাণহারীনিকে ওর ঘরের রাণী করবে, খুব যত্নে এতগুলো বছর যার জন্যে এক জীবনের সুপ্তাকাঙ্ক্ষা গুলো জিইয়ে রেখেছিল. . অবশেষে সে কি না অন্য কারো! যার হাসির দিকে চেয়ে মাতোয়ারা হয়েছিলো বহু আগেই, হৃদমন্দিরে সুবর্ণখচিত অক্ষরে যার নামের প্রতিমা স্থাপন করেছিল সে কি না আজ অন্য কারো সঙ্গী! তার অংশ! তার,সবটাই অন্যের? ছোট একটা মুক্তোদানার ন্যায় চিকচিকে তরলে চোখের কোণ ভরে উঠলো, পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই, তাহলে সে কেনো কাঁদছে! কার জন্য? যার মনে তার প্রতি নূন্যতম কোনো স্থান নেই?

______________________

– এত কি ভাবছো বনু

তাথই অবিচলিত চোখে তাকালো, বৃদ্ধা পায়ে তেল ঘষে দিতে দিতে বলল

– নাহ, কি আর ভাববো

শাহারা বেগম পা গুটিয়ে নিলেন। আরাম করে হেলান দিয়ে বসে বললেন

– হ্যাঁ ভাবছো তো। বলো আমাকে আমিও শুনি

তাথই তেলের বাটি টা সরিয়ে রাখলো, নড়েচড়ে বসে বেশ আনমনা হয়ে বলল

– স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর একটা মেয়ের জীবন ওখানেই থমকে যায়, তাই না দিদা?

তাথইয়ের মলিন মুখটাই দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইলেন শাহারা বেগম। ক্ষীণ হেসে বললেন

– বোকা মেয়ে। জীবন কি আর এত সহজেই শেষ হয় নাকি! যতদিন হায়াত আছে ততদিনই বাঁচতে হয়। সম্পূর্ণ অধিকার, সুখ-শান্তি, ভালোবাসা নিয়েই বাঁচতে হয়। আমরা ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভেঙে পড়ি,ভাবি জীবন হয়তো এখানেই শেষ। কিন্তু হবে তাই-ই যা সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত করে রেখেছেন। আমাদের জীবনের প্রতিটি ভুল, দূর্ঘটনা এক একটা শিক্ষা। যা আমাদের জীবনকে ওখানেই থামিয়ে দেয়না,বরং সঠিক আর ভুলটা উপলব্ধি করিয়ে সামনের পথে এগিয়ে যাওয়া নূতন একটা রাস্তা তৈরী করে দেয়।

তাথই নীরব রইলো। সবকিছু কেমন এলোমেলো মনে হচ্ছে। কোনো দিশা, কোনো মঞ্জিল খুঁজে পাচ্ছে না। ভেতর টা থেকে থেকে মুষড়ে উঠছে, শাহারা বেগম হয়তো কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারলেন নাতনীর ভেতরের অবস্থাটা, ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন

– চলার পথে ভালো খারাপ দুটোই থাকবে বনু, খারাপ টার জন্য সাময়িক দুঃখ হলেও ওর জন্য ভালোকে হেলাফেলা করে দূরে সরিয়ে দেওয়া টাই সবচেয়ে বড়ো ভুল। অতীত সবারই থাকে, কিন্তু ওটা ভুলিয়ে নিজেকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার অধিকার সবার আছে, সুখে থাকা আমাদের মৌলিক চাহিদার চেয়ে কম না। খাবার,বাসস্থান, চিকিৎসা,শিক্ষার মতো সুখটাও আমাদের মুখ্য খোরাক। বেঁচে থাকতে হলে সুখে থাকাটা ভীষণ দরকার।

তাথই মৃদু হাসলো। দিদার দিকে তাকিয়ে হুট করেই জড়িয়ে ধরলো তাকে, ক্ষীণ গলায় বলল

– আমি তোমাদের সাথে কতই না খারাপ ব্যবহার করেছি তাই না দিদা? তবুও তো তোমরা আমাকে ভালোবাসো। এটাও তো ভালো, খারাপ কে ভুলিয়ে এই তোমাদের মতো ভালোর সাথেই তো আমি সুখে আছি।

শাহারা বেগম জড়িয়ে ধরলেন আদরের নাতনীকে। কপালে স্নেহভরা চুমু দিয়ে পরম মমতাময়ী গলায় বললেন

– আল্লাহ তোমাকে সেই সকল সুখের ভাগীদারী করুক যা তোমারই হওয়ার কথা ছিলো। ভাগ্য তোমায় রামধনুর মতো রাঙিয়ে দিক পবিত্র ভালোবাসায়।

.

গরম কফি কাপে ঢেলে সেটা ট্রে তে তুলে নিলো। সাথে একটা চায়ের কাপ। রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে সোফার উপরে আম্বি খাতুনকে বসা অবস্থায় দেখলে এগিয়ে গিয়ে ট্রে টা সেন্টার টেবিলে রেখে চায়ের কাপটা তুলে বলল

– মা?

মেয়েলী গলায় মা ডাকটা শুনে ছ্যাত্ করে উঠলো ভেতরটা, চোখ খুলে তাকাতেই স্নিগ্ধ একটা মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো এই মা ডাকটাতে যেনো দুনিয়ায় সমস্ত সুখ,আনন্দ, তৃপ্তি খুঁজে পেলেন আম্বি খাতুন। মখমলি নরম আবেশে ভেতরটা ভরে গেলেও তার স্থায়িত্ব হলো ক্ষীণ সময়ের। পরক্ষণেই মুখ খানা শক্ত,গম্ভীর করে নিলো। সেসবকে অগ্রাহ্য করে, মা বলে ডাকা স্বরটা তার নরম পালকের মতো গলায় আবারও বলল

– আপনার মাথা ব্যথা করছে বলে আমি আদা চা করে এনেছি মা। এটা খেলে ভাল্লাগবে

বলে আম্বি বেগমের হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিলো, ভদ্রমহিলার প্রত্যুত্তর বা অভিব্যক্তির অপেক্ষা না করে, একটা ছোট্ট কৌটার ভেতর থেকে সামান্য মলম আঙুলের ডগায় তুলে খুব সন্তপর্ণে কপালের দুপাশে লাগিয়ে দিয়ে বলল

– চা খেয়ে একটু রেস্ট করুন মা, কমে যাবে।

বলেই ঠিক যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেলো। শুধু রেখে গেলো একঝাঁক মিষ্টি আবেশ, মাধুর্য আর প্রাণভরা স্নেহ। আম্বির চোখ দু’টো খুব অজানা কারণেই ভরে এলো, চায়ের কাপটা হাতের কম্পনের সাথে কেঁপে উঠলো। শুধু বিড়বিড়িয়ে এইটুকুই বলল

– আমাকে খোদা দুনিয়ায় সবচেয়ে অসহায়দের একজন বানিয়েছে রে, আমাকে ক্ষমা করে দিও পারলে।

মোহর কফির মগটা এনে রাখলো মেহরাজের পাশে, সরে যেতে গেলেও টান পড়লো হাতের কব্জিতে। সপ্রতিভ হয়েই তাকালো মোহর,মেহরাজ মোহরের হাতটা টেনে ওকে নিজের কাছে আনলো, পাশে বসিয়ে চোখ দু’টো ল্যাপটপে রেখেই বলল

– কি ভাবছেন এত বলুন তো? কি জানতে চান আপনি?

মোহর কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। পাশে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল

– কই কিছুই তো না!

মেহরাজ এবার আঙুল টা থামালো। ঘাড় কাৎ করে মোহরের দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে বলল

– আমার কাছে লুকাচ্ছেন? পারবেন লুকাতে?

মোহর অপ্রতিভ হলো। খানিকটা আড়ষ্ট হলো, এই মানুষটা কি করে বুঝে ফেলে সব? এটা কি কোনো যাদুটোনা নাকি ম্যাজিক! তা ওর বোধগম্যতার বাহিরে।
মোহর স্থৈর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহরাজকে বলল

– যা জানতে চাই তা কি জানাবেন আপনি?

মেহরাজ কিঞ্চিৎ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। মোহরকে নিজের কাছে সরিয়ে এনে বলল

– শুধু বায়োলজিই তো পড়লেন এতদিন, ম্যাথ কেমন পারেন?

সম্পূর্ণ অহেতুক একটা ব্যাপার তুলে আনার কারণটা বোধগম্য হলো না মোহরের, কপালে সরু ভাঁজ ফেলে বলল

– ম্যাথ! হঠাৎ?

– পিথাগোরাসের নাম তো শুনেছেন?

মোহরের বিজড়িত, কৌতূহলী চোখে চেয়ে মেহরাজ ল্যাপটপের সাটার নামিয়ে দিতে দিতে বলল

– বিখ্যাত গণিতবিদ পিথাগোরাসের একটা সূত্র আছে জানেন? যদিও অনেক সূত্রই আছে, তার মধ্যে একটা হলো ” তোমার যা বলা উচিত, তাই তুমি বলবে। আর তোমার যা শোনা উচিত না তা তুমি কখনো শুনবে না ” এবার বলুন তো আপনি যা জানতে চান তা কি আদও আপনার শোনা উচিত?

মোহর বেশ কয়েক মুহুর্ত নীরব, স্থবির , অনড় তাকিয়ে রইলো মেহরাজের মুখে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো ওর সামনে বসে থাকা এই মানুষটা, যে কি না ওর স্বামী যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় একটা মানুষ মনে হচ্ছে এখন ওর। প্রতিটি কথা, কাজ, আর দৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজেও যেনো রহস্য। ধূসর চোখ দু’টিতে আস্ত একটা অজানা রাজ্যের উপস্থিতি। যা প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতিটি সময়ে মোহরের জ্ঞান আর চক্ষুর আড়ালে।

মোহরের ভাবনার মাঝেই সশব্দে হেসে উঠলো মেহরাজ। মোহর চমকপ্রদের মতো তাকিয়ে রইলো যেন কোনো আশ্চর্য কিছু দেখে ফেলেছে। ওর আড়ষ্ট মুখে তাকিয়ে মেহরাজ বলল

– আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন, ভীষণ ভীতু আপনি। আপনাকে কনফিউজড করা আমার জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ

মোহর ভ্রু কুঁচকে নিলো। মেহরাজের এমন রসিকতা মোটেও উচিত হয়নি ওর সাথে। মুখটা ভার করেই বসে রইলো ওভাবে। মেহরাজ ক্ষীণ স্বরে বলল

– রাগ করলেন বিবিজান?

মোহরের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে ও নিজেই পুনরায় বলল

– এই যে আপনি অদ্ভুত সব টপিক তুলে কথা বলে আমার কফিটা ঠান্ডা করে দিলেন আমি কিন্তু একটুও রাগ করিনি। তাহলে আপনি কেনো করছেন?

মোহর কফিটার দিকে তাকালো, কাপটা হাতে নিয়ে গুরুতর ভঙ্গিমায় বলল

– গরম করে এনে দিচ্ছি

বলে সরে যেতে গেলে মেহরাজ এবারও ওর হাত ধরে বসিয়ে দিলো। কাপটা নিয়ে সাইডে রেখে মোহরকে চেপে নিজের কাছে এনে বলল

– আপাতত আপনাকে দরকার,ঠান্ডা হতে।

কথাটি শোনার পর ঠিক কত সেকেন্ডের ভেতরে মোহর বুঝতে পারলো না, ঠান্ডা শীতল পাঁচটা পাঁচটা করে দশটা আঙুলের চাপ পড়লো ওর মেদহীন কোমরে। শক্ত হাতের আঙুল গুলো দেবে গেলো যেনো ইঞ্চি খানেক।মোহরের গলাটা ভিজিয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা ব্যর্থ করে মেহরাজ আস্তে আস্তে একটা হাতের বিচরণ অগাধে ছড়িয়ে দিলো সারা পিঠময়, আস্তে আস্তে চুলের ভেতর থেকে ঘাড়ে এনে আঙুলের চাপ বসিয়ে দিয়ে নিজের খুব কাছাকাছি জড়িয়ে নিলো মোহরকে। ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে সেখানে মুখ গুঁজে দিলো মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বিদ্যুতের বেগে শিরশিরানি টা ছড়িয়ে গেল, আড়ষ্টতায় দাঁতে দাঁত চেপে নিলো মোহর। মেহরাজ ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িময় গালটা মোহরের গলা, ঘাড়ে ঘষে দিলো। চোখ মুখ খিঁচিয়ে এলো মোহরের। মেহরাজ মুখটা মোহরের গালের সাথে লাগিয়ে নরম গলায় অতীব অনুরোধের সুর ঢেলে বলল

– আজকে ওই হলুদ রঙের শাড়িটা একটু পড়বেন মোহ.. শাড়িতে জড়ানো হলদে গোলাপটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here