#ফিরে_আসা
৪১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
চোখের পলকে কেটে গেল তিনটি মাস। পাঁচ মাস হলো আরশাদ এবং অরার বিয়ের। এই পাঁচ মাসে একটু একটু করে এই বাড়িটার সঙ্গে মিশে গেছে অরা। এটা এখন আর আরশাদের বাড়ি নেই। হয়ে দাঁড়িয়েছে তার নিজের বাড়ি। এ বাড়ির সবকিছুকেই একটু একটু করে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে অরা।
এই যেমন আগে বাজার করার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। মতিউর যখন সময় পেত তখনই বাজারে যেত। অরা এখন সুন্দর করে কতগুলো লিস্ট তৈরি করে দিয়েছে। একটা মাসিক লিস্ট, একটা সাপ্তাহিক লিস্ট আরেকটা দৈনিক লিস্ট। অরার লিস্ট অনুযায়ী এখন বাড়িতে বাজার আসছে। পুরোদমে নিজের সংসারের মতো করে সবটা গুছিয়ে নিয়েছে অরা। আগে এ বাড়ির কোনো কাজ করতে গেলেই তার মনে হতো, “আমি কেন এ বাড়ির কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাবো। এটা তো আর আমার সংসার নয়। এক বছর পর তো এখান থেকে চলেই যেতে হবে।” এখন আর সেই চিন্তা তার মাথায় আসে না। এক বছর পর ডিভোর্স সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা যেন সে ভুলেই গেছে।
বাড়িটার পাশাপাশি খোদ আরশাদকেও যেন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে অরা। এই যেমন নতুন চরিত্রের জন্যে তার হেয়াস্টাইল কেমন হবে অরা ঠিক করে দিয়েছে। আরশাদ ইন্টারভিউতে যাবে, কোন শার্ট পড়বে সেটাও অরা ঠিক করে দিচ্ছে। আরশাদ তার জীবনে আরও হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। তবুও কোনো এক অদ্ভুত কারণে মেয়েটার এই ছোট ছোট হস্তক্ষেপ দারুণ উপভোগ করছে সে।
ইদানিং একটা আননোন নম্বর বড় বিরক্ত করছে অরাকে। আরশাদ হকের ম্যানেজার হিসেবে বহু আননোন নম্বর থেকে আসা কল রিসিভ করতে হয় তাকে। তবে সকলেই ফোন রিসিভ করার পর নিজের পরিচয় দেয়। এক্ষেত্রে সেসব কিছুই হচ্ছে না। অরা কল রিসিভ করার পর অপরপ্রান্তের আগন্তুক চুপ করে থাকে। কোনপ্রকার কথাবার্তা বলে না।
অরা ওই নম্বর একবার ব্লক করেছে। পরের দিন আবারও ওই ব্যক্তি নতুন নম্বর থেকে ফোন দেয় তাকে।
বিষয়টা নিয়ে অরা খুব একটা মাথা ঘামালো না। দ্বিতীয় নম্বরটাও ব্লক করে ফিরে গেল নিজের জীবনে। মেয়েদের নম্বরে মাসে দুয়েকবার এমন অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়।
ভাইরাল ভিডিওর মধ্যে অদৃশ্য একটা প্রকারভেদ রয়েছে। এক ধরনের ভাইরাল ভিডিও থাকে যা দেশের বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। তারা সেই ভিডিও দেখে এবং নিজেদের মতামত দেয়। যেমন আরশাদ এবং অরার হোটেলের সেই সিসিটিভি ফুটেজ। আবার আরেক ধরনের ভাইরাল ভিডিও আছে যা দেশের সবার কাছে পৌঁছায় না। তাদের বিচরণ ফেসবুকের গোটাকয়েক
গ্রুপে গ্রুপে। তেমনই স্বল্পবিস্তর এক ভাইরাল ভিডিও আরশাদ প্লে করে দিলো নিজের মোবাইলে। ভিডিওটা অরার।
গত পরশু অরা গিয়েছিল আরশাদের প্রোডাকশন হাউজের অফিস হবে যে বিল্ডিংটায়, সেখানে। বিল্ডিংয়ের ভেতরটায় ভাঙচুর করে আরশাদের পছন্দ অনুযায়ী ঘরগুলো তৈরি করা হচ্ছে। অরা একাই গিয়েছিল সেই কাজ দেখতে, আরশাদের সেদিন শুটিং ছিল। বিল্ডিং থেকে বের হবার সময়ে একদল সাংবাদিকদের মুখে পড়ে যায় অরা। এসব সাংবাদিকরা হঠাৎ হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয় কে জানে?
অরাকে বের হতে দেখেই কয়েকজন সাংবাদিক মাইক হাতে ছুটে গেল তার দিকে। আর কয়েকজনের হাতে ক্যামেরা। তাদের এমন আকস্মিক আগমনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল অরা।
ভিড়ের মাঝ থেকে একজন সাংবাদিক বলে উঠলো, “ম্যাম! এখানেই কি আরশাদ স্যারের প্রোডাকশন হাউজের অফিস হবে?”
অরা ইতস্তত করে বলল, “জি।”
আরেকজন সাংবাদিক উৎসুক গলায় বলল, “প্রোডাকশন হাউজের নাম কী হতে চলেছে ম্যাম?”
অরা কম্পিত স্বরে বলল, “সেটা এখনো ঠিক হয়নি।”
“শোনা যাচ্ছে আপনাকে না-কি প্রোডাকশন হাউজের বিশেষ কোনো দায়িত্ব দেওয়া হবে। এটা কি সত্যি?”
অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “আমি এখন কিছুই বলতে পারছি না। সময়মতো স্যার ঘোষণা দিয়ে আপনাদের জানাবেন।”
কথাটা বলেই অরা ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। এক মিনিটেরও কম সময়ের এই ভিডিও নানান গ্রুপে গ্রুপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষের একটাই প্রশ্ন, অরা বিয়ের পাঁচ মাস পরেও কেন আরশাদকে স্যার ডাকছে? একদলের অভিমত অনেকদিন ধরে সে আরশাদের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছে। তাই স্যার ডাকার অভ্যাসটা এখনো রয়ে গেছে। তবে আরেকদল বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে ওদের বিয়েতেই কোনো গন্ডগোল আছে।
রাগে আরশাদের নাক লাল হয়ে গেছে। দুকান দিয়ে যেন গরম বাষ্প বের হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ এই বিয়েটাকে মিথ্যা ভাবতে শুরু করবে। আরশাদ বারবার মেয়েটাকে বারণ করে দিয়েছিল মানুষের সামনে স্যার স্যার না করতে। আরশাদের রাগ সকল সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন কেউ তার কথার অবাধ্য হয়।
বহু চেষ্টা করেও রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না আরশাদ। উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো অরাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। অরাকে তার ঘরেই পাওয়া গেল। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নিজের কাপড় গোছাচ্ছিল।
আরশাদ দৃপ্ত পাওয়া ঘরে ঢুকে গম্ভীর গলায় বলল, “অরা? তুমি কি ভিডিওটা দেখেছো?”
অরা অবাক ভঙ্গিতে বলল, “কোন ভিডিও স্যার?”
অরার মুখে আবারও স্যার ডাকটা শুনে আরশাদের গা বেয়ে রাগের প্রবল হওয়া বয়ে গেল। নিজেকে সামলে সে মোবাইল থেকে ভিডিওটা বের করে অরার হাতে ধরিয়ে দিলো। অরা পুরো ভিডিওটা দেখলো ঠিকই কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।
অনিশ্চিত গলায় বলল, “কোনো সমস্যা হয়েছে স্যার?”
আরশাদ প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “বারবার স্যার ডাকো কেন আমাকে? কতবার বারণ করেছি মানুষের সামনে স্যার ডাকবে না।”
অরার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। এমন নয় যে আজ সে প্রথম আরশাদের ধমক খাচ্ছে। এর আগেও বহুবার আরশাদ ধমক দিয়েছে তাকে। তবে কোনো এক বিচিত্র কারণে আজই যেন প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার।
আরশাদ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “কে বলেছিল সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে? ওদের অ্যাভয়েড করে গাড়িতে চলে যেতে পারতে না?”
অরা নিচু গলায় বলল, “ওরা আমার সামনে চলে এসেছিল তাই…”
অরার কথা শেষ হবার আগেই আরশাদ আবারও ধমক দিয়ে বলল, “Just shut up! তোমার একটা বোকামির কারণে আবারও নতুন করে কথা উঠছে। মানুষ ভাবছে এই বিয়েটা আসল না।”
অরার চোখে এবার জল এসে গেল। আচমকা তার চোখে জল দেখে আরশাদ হকচকিয়ে গেল। এর আগেও তো সে বহুবার এমন কড়া ভাষায় কথা বলেছে অরার সঙ্গে। কই তখন তো এমন চোখের জল ফেলেনি মেয়েটা।
অরা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল, “সবসময় শুধু আমার সাথেই এমন ঝাড়ি মেরে কথা বলেন আপনি। এই কথাটা একটু ভালো করে বললে কী হতো?”
অরার কণ্ঠস্বরে মিশে আছে একরাশ অভিমান। আরশাদের দিকে সে তাকিয়েও আছে অভিমানী দৃষ্টিতে। আরশাদ ধাঁধায় পড়ে গেল। কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। অরা ঝড়ের গতিতে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
অরা গিয়ে বসেছে ছাদের দোলনাটায়। কষ্টের সুরে বুক ধুকপুক করছে। এমন অনুভব কেন হচ্ছে তার? ঘোর অভিমান আকড়ে ধরেছে তাকে। এই অভিমান জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। আমরা তার ওপরেই অভিমান করতে পারি যে আমাদের সবথেকে বেশি আপন। অরা তাহলে আরশাদের ওপর অভিমান করে আছে কেন?
কয়েক মিনিটের মাথায় আরশাদের আগমন ঘটলো ছাদে। অরা চোখ তুলে তাকালো না তার দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলো। যে মানুষটা ধমক ছাড়া তার সঙ্গে কথাই বলতে পারে না তার দিকে তাকিয়ে কী হবে?
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে অরার পাশে বসতে বসতে বলল, “তুমি এমন ছিচকাঁদুনি হলে কবে থেকে অরা?”
অরা অন্যদিকেই মুখ ফিরিয়ে রইলো, তাকালো না আরশাদের দিকে। একে তো তাকে ধমক দিয়েছে, এখন আবার ছিচকাঁদুনি ডাকা হচ্ছে।
আরশাদ নরম স্বরে বলল, “দেখি! আমার দিকে তাকাও।”
অরা তার দিকে তাকাতেই আরশাদ পরম যত্নে মেয়েটার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলগুলো মুছে দিলো। তরঙ্গের ন্যায় বিচিত্র এক অনুভূতি খেলে গেল অরার সমস্ত শরীর জুড়ে। আরশাদের এই স্পর্শে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত প্রশান্তি অসহনীয় হয়ে ওঠে।
অরা অভিমানী স্বরে বলল, “আপনি সবসময় আমাকে ধমক দেন!”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ঠিকই করি। তুমি ধমক খাওয়ার মতো কাজ করো বলেই তোমাকে ধমক দেওয়া হয়।”
অরা পাল্টা জবাব দিয়ে বলল, “বললেই হলো? আপনার কোন কথাটা অমান্য করেছি এতদিনে?”
আরশাদ রহস্যময় একটা হাসি হেসে বলল, “আমার সাথে এভাবে কথা বলছো তুমি? এর পরিণাম কী হবে জানো?”
“কী আর হবে? এতদিন তো চাকরি থেকে ফায়ার করে দেওয়ার হুমকি দিতেন। এবারও দিন! এমনিতেও দুদিন পর আপনার নতুন ম্যানেজার আসবে।”
আরশাদ ঠোঁটে হাসিটা বজায় রেখে তার মোহনীয় স্বরে বলল, “আর কাঁদবে না। যদিও কাঁদলে তোমাকে সুন্দর লাগে, তবুও কাঁদবে না।”
আরও একবার ওই তরঙ্গ খেলে গেল অরার সমস্ত শরীর জুড়ে। আরশাদ কি তাকে সুন্দর বলল? ছেলেরা না জানি কত কায়দায় মেয়েদের রূপের প্রশংসা করে। অথচ এই পর্যন্ত অরার রূপের প্রশংসা কেউ করেনি। কিংবা অরা সুযোগ দেয়নি। আজ সর্বপ্রথম কেউ করছে। সেই ‘কেউ’টা আবার আরশাদ হক! ভাবা যায়?
বহুকষ্টে নিজেকে সামলে অরা বলল, “কেন? কী হবে কাঁদলে?”
“বলবো না। সেটা সিক্রেট।”
“তাহলে তো আমাকে বলতেই হবে।”
“আচ্ছা। একদিন সময় করে বলবো। আর শোনো অরা, তুমি আমাকে স্যার ডাকবে না। বাড়িতেও না মানুষের সামনেও না।”
অরা হতবাক গলায় বলল, “ওমা! আমার এতদিনের অভ্যাস!”
“নতুন করে স্যার না ডাকার অভ্যাস করো।”
অরা চুপ করে রইল। আরশাদ বলা প্রতিটা কথার মতো এই কথাটাও তাকে মানতে হবে। অরা ভেবে পায় না বাড়িতে স্যার ডাকলে কী সমস্যা? বাড়িতে তো আর কেউ তাদের দেখতে আসছে না।
আরশাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে হালকা গলায় বলল, “আমার না একটা ইচ্ছা আছে।”
“কী ইচ্ছা স্যা…?”
কথাটা শেষ করার আগেই আরশাদের অগ্নিদৃষ্টির সম্মুখীন হলো অরা।
আরশাদ বলল, “ইচ্ছাটা হলো আমি কয়েকদিনের জন্যে এমন কোথাও ছলে যাবো যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না। আমার সঙ্গে সেলফি তোলার জন্যে ভিড় জমাবে না। নিজের মতো করে যেখানে আমি কেবল প্রকৃতিটা উপভোগ করতে পারবো।”
অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “সুন্দর ইচ্ছা তো!”
“তার থেকেও বড় কথা ইচ্ছাটা আমি পূরণ করতে যাচ্ছি।”
“তাই না-কি? কবে?”
“দুই দিন পর। রাঙামাটিতে ছোট্ট একটা পাহাড়ি এলাকার আছে। ওখানে বেশি মানুষ থাকে না। যারা থাকে তারা বেশির ভাগই উপজাতি। আমাকে চেনার কথা না। আগামী সপ্তাহের আমার সমস্ত শিডিউল ক্যানসেল করো।”
“এর মধ্যে এতকিছু ঠিক করে ফেললেন? আমি তো কিছুই জানলাম না।”
“এখন তো জানলে। আমার সব শিডিউল ক্যানসেল করে দাও। আর তোমার কোনো প্ল্যান থাকলে সেটাও ক্যানসেল করো।”
অরা হতবিহ্বল হয়ে বলল, “আমার প্ল্যান ক্যানসেল করবো কেন?”
আরশাদ অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, “কারণ তুমিও আমার সাথে যাচ্ছো।”
অরা আশ্চর্যের চূড়ায় পৌঁছে বলল, “আমি?”
“হুঁ।”
“আপনার ইচ্ছা একা একা নির্জন প্রকৃতিতে ছুটি কাটানোর। যেখানে কেউ আপনাকে চিনবে না। সেখানে আমাকে নিতে চাচ্ছেন কেন?”
“সেটা তো না গেলে বুঝতে পারবে না।”
(চলবে)