মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া #লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_২০

0
316

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২০
মিষ্টি গোলাপি রঙের বেনারসি পড়ে স্টেজে বসে আছে, মীরা। মীরাকে ঘিরে তার কাজিনরা, ভাবিরা, বন্ধু-বান্ধব ও কলিগরা হাস্যরসে মেতে আছে। চলছে ফটোশুট। এখনও বরযাত্রী এসে পৌঁছায়নি। চারিদিকে মরিচবাতির আলোকসজ্জায় কৃষ্ণাভ সায়াহ্নে যেন অজস্র তারাদের মেলা বসেছে। ঝলমলে সন্ধ্যা আজ মুখরিত নতুন অধ্যায় রচনাতে। পবনে তার আলাদা ছোঁয়া। মীরার ওষ্ঠকোণে ফুটে আছে স্নিগ্ধ হাসি। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য একটা কমিউনিটি সেন্টারের রুফটফ পুরোটা বুকিং করা হয়েছে। একদম টপ রুফটফে বর ও কনের জন্য কম্বাইন্ড স্টেজ। এদিকে কুঞ্জ প্রথম থেকেই সবটা ক্যামেরায় রেকর্ড করছে। তাকে কিঞ্চিত ক্লান্তও দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা রাইমার নজর এড়ায়নি। সে খাবার এনে মীরাকে খাইয়ে আবার খাবার নিয়ে এসেছে। এবার সে ঘুরে ঘুরে কুঞ্জকে খাওয়াচ্ছে। সেইসাথে ঝ*গড়া তো ফ্রি! স্টেজ থেকে ওদের এই খুনশুঁটি দেখে বাকিরাও হাসছে। মীরার এক ফ্রেন্ড বলে,

“সত্যিরে, রাইমা মেয়েটা অনেক কিউট। বিকেলে যার সাথে ঝ*গ*ড়া করে শেষ! রফাদফা অবস্থা! এখন দেখ, তাকে নিজ হাতে খাওয়াচ্ছেও।”

মীরা হেসে বলে,
“ও এমনি। কখোনো উড়নচণ্ডী তো কখোনো আদুরে ও যত্নশীল। দ্যাটস হোয়াই অ্যাই লাভ হার এন্ড মিস সো ব্যাডলি।”

জিনিয়া, মীরার কাঁধে সামান্য ধা*ক্কা দিয়ে রম্যস্বরে বলে,
“স্যার থাকতে তুই রাইমাকে মিস করিস! ছি ছি মীরা!”

জিনিয়ার সাথে উপস্থিত সকলে হেসে ওঠে। মীরা ও-কে দুই ঘা লাগিয়েও সেরেছে। হঠাৎই সোরগোল পড়ে গেল। একে একে মীরার পাশ থেকে সকলে উঠে নিচে নামলো। রুফটফের গেইটে বরপক্ষ এসেছে। মীরার ফ্রেন্ড ও কাজিনরা গেইট ধরলেও ফ্রিশা তার বাবার হাত ছেড়ে ছুটে ভেতরে চলে এসেছে। তারপর মৃদুলার হাত ধরে টপ রুফটফে একাকি বসে থাকা মীরার কাছে যায়। মীরাকে দেখা মাত্রই ফ্রিশা গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে,

“ইউ আর লুকিং সো বিউটিফুল, ফেইরিমাম্মাম! লাইক অ্যা কুইন।”

মীরা মুচকি হাসে। অতঃপর হাত বাড়িয়ে ফ্রিশাকে কাছে ডাকে। ফ্রিশা ও মৃদুলা, দুজনেই গিয়ে মীরার দুইপাশে বসে। মীরা ওদেরকে দুইহাতে আগলে নিয়ে প্রথমে মৃদুলা ও পরে ফ্রিশাকে বলে,

“মাই বার্বিডল এন্ড মাই প্রিন্সেস।”

দুজনের ললাটে উষ্ণ ঠোঁ*টের স্পর্শ এঁকে দেয়। ফ্রিশা বলে,
“জানো ফেইরিমাম্মাম, বাবাকে কিংয়ের মতো লাগছে। গোল্ডেন শিওয়ানি! গোল্ডেন ব্রুজ।”

“বাচ্চা, ওটা শেরওয়ানি। প্রিন্সেসের বাবা তো কিং হয়ই।”

“ইয়েস, এন্ড প্রিন্সেসের ফেইরিমাম্মাম কুইন হয়।”

ফ্রিশা আদুরে ভঙ্গিতে মীরার দিকে তাকায়। মীরা যেন মুগ্ধ। তার দৃষ্টি এক মায়াবি মুখশ্রীতে রুদ্ধ হয়েছে। অক্ষিকোণে জলবিন্দুদের উপস্থিতি ঝর্ণা বয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মীরা টিসুর সাহায্যে আড়ালেই তা মুছে নিলো। ফের বলল,

“তুমি টায়ার্ড তো। ওয়েট, আমি জুস আনাচ্ছি।”

মীরা কাউকে বলে জুস আনালো। ফ্রিশা এক ঢোকে খেয়েও নিয়েছে।

গেইটের ঝামেলা দীর্ঘসময় স্থায়ী হয়নি। ড: আকবর রেহমান কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই মিটিয়ে নিয়েছেন। সবাই এখন শেহজাদকে নিয়ে স্টেজে আসে। মীরার পাশে বসানো হয় তাকে। আসার পথে শেহজাদ মাথা উঁচু করেনি। দেখেনি মীরাকে। তার জন্য এটা দ্বিতীয় বিয়ে হলেও এভাবে বরবেশে বিয়েটা এবারই প্রথম। সবার সামনে মীরার সাথে চোখাচোখি হলে যদি মীরা অস্বস্তিতে পড়ে! তাই নিরবে এসে পাশে বসেছে। ফ্রিশা ওদের মাঝে বসে বলে,

“বাবা, দেখো। ফেইরিমাম্মামকে কত সুন্দর লাগছে। একদম কুইন কুইন। তুমি কিং, ফেইরিমাম্মাম কুইন আর আমি প্রিন্সেস।”

শেহজাদ মেয়ের দিকে একবার চেয়ে নিরব হাসে। মীরাও ফ্রিশার হাত ধরে নত মস্তকে লাজুক হাসে। সামনে দাঁড়িয়ে কুঞ্জ ওদের তিনজনের একটা সুন্দর ক্যান্ডিড ছবি ক্যাপচার করে নিয়েছে। ভাড়া করা ক্যামেরাম্যান এবার ছবি তোলার জন্য ওদেরকে নিজের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকতে বলে। অনেক অনেক ছবি তোলা হয়। এখন মীরার বাবা রফিক তালুকদার ও ড: আকবর রেহমান কাজিকে নিয়ে স্টেজের কাছে আসে। কাজি সবকিছু লিখে ও বলে প্রথমে মীরাকে কবুল বলতে বললে মীরার নেত্রকোন বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রকণা টুপ করে তার নিজের হাতেই পড়ে। ধিমি স্বরে তিনবার ‘কবুল’ পড়ে পাশে দাঁড়ানো ছোটো ভাবিকে জড়িয়ে নিরবে অশ্রুপাত করতে থাকে। সবার মাঝে আলহামদুলিল্লাহ র*ব ওঠে।
অতঃপর শেহজাদকে ‘কবুল’ বলতে বললে। শেহজাদ চোখ বন্ধ করে। অক্ষিপটে ভেসে উঠে তার প্রথমা স্ত্রীর মুখখানা। ওষ্ঠকোণে তার স্নিগ্ধ হাসি। নিঃসন্দেহে ফিওনা সুন্দরী। হবে নাই বা কেন? রাশিয়ান মা ও আমেরিকান বাবার মেয়ে সে। ভেসে উঠে ফিওনা তার বিয়ের সাজে। হালকা বেবি পিংক গাউনে। শেহজাদের কল্পনায় ফিওনা বলছে,

“মাই ইমেনস লাভ ফর ইউ উইল নেভার ইন্ড। বাট মাই লাভ ওয়ান্টস ইউ টু বি ভেরি হ্যাপি এন্ড লিভ উইথ লাভ। (তোমার প্রতি আমার অসীম ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না। কিন্তু আমার ভালোবাসা চায় তুমি খুব সুখে থাকো এবং ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকো।)”

ফ্রিশার ডাকে চোখ খুলে শেহজাদ।
“বাবা, ‘কবুল’ বলো? হোয়াট আর ইউ থিংকিং?”

শেহজাদ মেয়ের কৌতুহলী ও উদ্বেগী মুখাবয়ব পর্যবেক্ষণ করে মীরার দিকে তাকায়। মীরা মুদিত নয়নে নত মস্তকে বসে নিজের আঙুল খুঁটছে। দৃষ্টি স্থির রেখেই শেহজাদ ‘তিন কবুল’ বলে দেয়। অতঃপর সবার মাঝে আনন্দ ধ্বনি। মিষ্টি মুখ করাচ্ছে একে অপরকে।

তারপর মীরার কাজিনরা আয়না ও ওড়না নিয়ে আসে। আয়নাটা ফ্রিশার হাতে দেয়। অতঃপর তিনজনের মাথাে উপর ওড়না ছড়িয়ে দিয়ে একই সাথে আয়নায় মুখ দেখানোর ব্যবস্থা করে। গোলাকার আয়নায় একই সময়ে ভেসে উঠে তিনটি মুখচিত্র। ফ্রিশা উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে,

“কিং, কুইন এন্ড লিটল প্রিন্সেস!”

ফ্রিশার মতো বাকিরাও খুশি। ওড়না সরানোর পর হঠাৎই মীরার কর্ণকুহরে কারও অপ্রত্যাশিত ডাক বেজে ওঠে। মীরা ও শেহজাদ দুজনেই সম্মুখে তাকিয়ে দেখে বর্ণ দাঁড়ানো। বর্ণর বুকের সাথে বেল্ট দিয়ে আগলে রাখা তার ছেলে বর্ষণ ও হাতে লাল গোলাপের তোড়া। বর্ণর পেছনে তার বাবা-মা। বর্ণ এগিয়ে এসে হাসি মুখে বলে,

“বেস্ট উইশেস ফর ইউ গাইজ। অ্যাই উইল প্রে দ্যাট বোথ অফ ইউর লাইভস উইল বি ফিলড উইথ লাভ এন্ড হ্যাপিনেস। হ্যাপি ম্যারিড জার্নি।”

বর্ণ গোলাপের তোড়াটা সামনে বাড়িয়ে দেয়। মীরা ও শেহজাদ উঠে দাঁড়িয়ে একে-অপরের পানে তাকায়। অতঃপর মিষ্টি হেসে তোড়াটা নিয়ে বলে,

“থ্যাংকিউ বর্ণ। তোমার জন্যও অনেক অনেক শুভ কামনা।”

“আজ রাতেই আমার ফ্লাইট। এবার সাথে করে বাবা-মাকেও নিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিন সেখানে থেকে আসবে। স্যার, আপনার কথা অনুযায়ী আমি বর্ষণের মায়ের সাথে কথা বলেছি। অ্যাই হোপ, সেখানে গিয়। সব সলভ হয়ে যাবে।”

শেহজাদ মুচকি হেসে বলে,
“বেস্ট অফ লাক।”

বর্ণর বাবা এসে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“নিজের ছেলের কর্মকাণ্ডে আমরা খুবই লজ্জিত। মাফ করে দিও মা।”

মীরা দ্রুত বলে ওঠে,
“না না আঙ্কেল। আপনি কেন মাফ চাচ্ছেন! আমার ভাগ্যে ছিল বলেই হয়েছে। আমি এখন আর বর্ণর প্রতি অভিযোগ রাখিনি। আমি চাই ও সুখে থাকুক।”

বর্ণর মা তার ছেলের কাছ থেকে নাতিকে নিজের কোলে নিয়ে মীরাে কাছে এগিয়ে আসে। বলে,
“একবার ও-কে কোলে নিবে? দোয়া করে দিও যেন ওর মধ্যে ওর বাবার কোনো খারাপ দোষ না আসে।”

মীরা, বর্ষণকে কোলে নিলো। বর্ষণের চেহারায় তাে বাবা মুখশ্রীর ছাঁপ স্পষ্ট। জাপানি মায়ের থেকে হয়তো শুধু নাকটাই পেয়েছে। মীরা, বর্ষণে কপালে আদরের স্পর্শ এঁকে বলে,
“ভালো মানুষ হও, ভালো থেকো।”

তারপর শেহজাদও বাচ্চাটাকে কোলে নিলো। আদর করে বর্ণর কোলে দিয়ে বলল,
“ভালো থেকো।”

বর্ণ ও তার বাবা-মা বিদায় নিয়ে চলে যায়। মীরা ও শেহজাদ দুজনে একসাথে ফ্রিশাকে আগলে নিয়ে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here