#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৮
“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না (২)
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাবো না।
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাবো না না না না ছেড়ে দেবো না।
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না। (২)
কথা: দ্বিজ ভূষণ
সুর: বৈষ্ণব কীর্তন
শিল্পী: লোপামুদ্রা মি
(বাকিটা নিজ দায়িত্বে ইউটিউবে শুনে নিবেন।)
গান শেষ হতেই রাইমার টি*ম্পনি!
“কাকে হৃদমাঝারে রাখবিরে, মীরা? আমাদের বল।”
মীরা নিজের ভ্রদ্বয় কুঁচকে ফেলে বলে,
“তোর কপালে শ*নির দশা লেগেছে বুঝতে পেরেছি! দাঁড়া!”
মীরা উঠতে নিলে রাইমা পা*লানোর প্রস্তুতি নিয়ে বলে,
“ক্লাম ডাউন, বেইব। চি*ল! তুই মুখে না বললেও এখানে সবাই বুঝতে পারছে!”
“তুই! তোকে তো! কোথায় কী বলতে হয় তোকে আজকে উ*ত্তম-মধ্য*ম দিয়ে শেখাতে হবে দেখছি।”
মীরা উঠে ছুটতে নিবে তৎক্ষণাৎ শেহজাদ ওর ডান হাতের কব্জি ধরে থামায়। ওইদিকে নিধি, রাইমাকে আটকিয়ে ইশারায় মীরা ও শেহজাদের দিকে ইশারা করে। অতঃপর নিধি, রাইমা সহ সবাই মিটিমিটি হাসছে। শেহজাদ সকলের দিকে নজর বুলিয়ে কণ্ঠে কিয়ৎ রাগী ভাব এনে বলে,
“সিট ডাউন!”
মীরা ভয় না পেলেও কিছুটা লজ্জা পায়। তারপর শেহজাদ হাত ছেড়ে দিলে চুপচাপ সে শেহজাদের পাশে বসে পড়ে। এরপর আসে বাচ্চাদের কবিতা আবৃতির পালা। মৃদুলার কণ্ঠে বাংলা কবিতা ও ফ্রিশার কণ্ঠে ইংরেজি রাইম। পালাক্রমে চারজন বাচ্চা সদস্য মিলে বিভিন্ন গানের তালে যেভাবে পেরেছে নেচে সবাইকে হাসিয়েও ছেড়েছে।
_______
বিকেলে আসরের নামাজের পর মীরার পরিবার বেরোনোর প্রস্তুতি নেয়। একটু পরেই বের হবে। মীরার মা বলেন,
“শেহজাদ বাবা, তোমরা তো আজকে গেলে না। বৃহস্পতিবার কিন্তু অবশ্যই যাবে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আমরা যাব।”
এরপর মীরার বাবা বলেন,
“তোমরা এলেই আমরা কাছের আত্মীয়-স্বজনদের আবার দাওয়াত করব। বিয়ের দিন তো জামাইয়ের সাথে ঠিক ভাবে পরিচিত হতে পারলো না।”
শেহজাদ সম্মতিসূচক হাসে। মীরা তার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আই মিস ইউ। এতোদিন ইন্ডিয়াতে থেকেও এতোটা মিস করিনি যতোটা এই দুইদিনে করেছি।”
মীরার মা মলি জাহান, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আবেগী স্বরে বললেন,
“বিয়ে এমনি, মা। বিয়ের আগে যতো দূরেই থাকো, সেটার সাথে বিয়ের পরের সময়কার অনেক পার্থক্য।”
মায়ের ভেজা লোচনদ্বয় দেখে মীরার নেত্রকোণও ভিজে ওঠলো। মাকে জড়িয়ে আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। সেখানে উপস্থিত সকলেরই মন ভার ভার। হুট করে রাইমা ফ্রিশার কাছে গিয়ে কানে কানে কিছু বলে, ফ্রিশাে হাত ধরে মীরার কাছে নিয়ে আসে। ফ্রিশা মীরার ওড়না ধরে আকুল কণ্ঠে বললে,
“ডোন্ট ক্রাই, ফেইরিমাম্মাম। আই লাভ ইউ।”
মীরা তার মাকে ছেড়ে হাঁটি গেড়ে মেয়ের সামনে বসে। অতঃপর দুই হাতের আঁজলায় ফ্রিশার আদুরে মুখখানি আগলে বলে,
“আই লাভ ইউ টু, ফ্রিশামনি।”
“সো ডোন্ট ক্রাই। ইফ ইউ ক্রাই, দেন ফ্রিশা উইল স্টার্ট ক্রায়িং।”
“না, বাচ্চা। তোমার ফেইরিমাম্মাম কাঁদবে না। এই দেখো, আমি হাসছি।”
মীরা মুচকি হাসলে ফ্রিশাও হেসে মীরাকে জড়িয়ে ধরে। সবার মাঝে অন্যরকম আনন্দ পরিলক্ষিত হয়। কিছুটা দূর থেকে শেহজাদ নিষ্পলক এই দৃশ্য অবলোকন করে চলেছে। তার নেত্রপল্লব ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। হঠাৎ এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু তার বুকে ভাজ করে রাখা হাতে পড়তেই তৎক্ষণাৎ পিছনে ঘুরে চোখ মুছে অন্যত্র চলে যায়। নিজেকে কিছুটা সময় একা রাখতে চায় সে।
_____
প্রায় মিনিট দশেক পর শেহজাদ নিচে নেমে সবার সাথে মীরার পরিবারকে বিদায় দিলো। এরপর এলো রাইমা ও কুঞ্জর পালা। মীরা, শেহজাদ ও ফ্রিশা, এয়ারপোর্টে ওদেরকে ছাড়তে যায়। এয়ারপোর্টে পৌঁছে রাইমা, মীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আই উইল মিস ইউ ব্যাডলি, ইয়ার। তুই কিন্তু ইন্ডিয়াতে অবশ্যই আসবি। আর আমাদের প্ল্যানিংটা মনে আছে তো তোর? একসাথে পিএইচডি করতে যাব। আর আমার বিয়েতে যদি তুই না আসিস তবে আমি ছাদনাতলায় যাবই না। তোর বেচারা কুঞ্জদা তখন আইবুড়ো থেকে যাবে!”
(আমি সঠিক জানিনা যে ছেলেরা আইবুড়ো থাকে কী-না?)
পাশ থেকে কুঞ্জ বলে,
“প্লিজ, বোন। বিয়েতে এসো। নয়তো তোমাে বান্ধবীকে তো চেনোই। যা বলে তাই করবে।”
মীরা ও শেহজাদ হেসে ওঠলো। ফ্রিশা ওদেরকে দেখে হাসছে। মীরা বলে,
“চিন্তন করবেন না, ভাইয়া। আপনার বিয়েটা হওয়ানোর জন্য হলেও আমরা যাব।”
তারপর আরও কিছুক্ষণ থেকে ওদের ফ্লাইটের সময় হয়ে গেলে ওদের বিদায় দিয়ে মীরা, শেহজাদরা চলে আসে।
_______
পরদিন সকালবেলা শেহজাদ ভার্সিটির জন্য তৈরি হচ্ছে। মীরা ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রুমে এসে বলল,
“নাস্তা রেডি। আসুন।”
এই বলে সে চলেই যাচ্ছিলো। শেহজাদ ও-কে থামায়। তারপর বিস্মিত হয়ে মীরার চুলের দিকে আঙুল তা*ক করে শুধায়,
“তোমার চুলে ফ্লোউর লেগে আছে। যু*দ্ধ করেছ নাকি!”
মীরা অবাক হয়ে আয়নার সামনে যেয়ে নিজের অবস্থা দেখে চোখ ছোটো ছোটো করে বলে,
“এটা ফ্রিশামনির কাজ! ও একটু আগে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে এসেছিল। তারপর থেকে মুখ চেপে হাসছিল। দেখেছেন! কী দুষ্টু!”
“ফ্রিশা? রিয়েলি? ও তো কিচেনে যায় না। গেলেও মেবি খুব রেয়ার।”
শেহজাদের অবিশ্বাস্য কণ্ঠ শুনে মীরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,
“আমি রান্না করার সময় নিজের মা*থায় আটা কেন লাগাবো? আর শুনুন, আপনার মেয়ে উপযুক্ত মানুষের অভাবে এতোদিন দুষ্টমি করতে পারেনি। এখন আমার মতো ভোলাভালা ফেইরিমাম্মাম পেয়ে দুষ্টমি করছে। কাল রাতে আমার সামান্য চোখ লেগে যাওয়াতে, আমার হাতে কালার পেন দিয়ে আমার নাম লিখে দিয়েছিল। দেখেন (নিজের জামার হাতা সামান্য উঠিয়ে)।”
শেহজাদ এবার হাসলো। ফের বলল,
“আসলেই সে দুষ্টমি করার জন্য উপযুক্ত মানুষ পেয়েছে!”
শেহজাদকে হাসতে দেখে মীরাও হাসে। তারপর মীরা লেগে থাকা আটা ঝেড়ে নিয়ে দুজনে একসাথে ডাইনিংটেবিলে যায়। সেখানে গিয়ে মীরা সবার সামনে পরোক্ষভাবে বলে,
“আজ না রান্নাঘরে ঘূর্ণিঝ*ড় হয়েছিল! তারপর বয়াম থেকে আটা উড়ে এসে আমার মা*থায় লেগেছে।”
মিসেস শাহিদা বুঝতে না পেরে শুধালেন,
“রান্নাঘরে ঘূর্ণিঝ*ড়! কী বলছো?”
“হ্যাঁ, ফুফিজান! ঘূর্ণিঝ-ড়ের নাম ফ্রিশা! তাই না, বাচ্চা?”
ফ্রিশা মুখ চেপে হাসছিল। এবার মুখ থেকে হাত সরিয়ে প্রকাশ্যে হাসতে হাসতে বলে,
” তোমাকে খুব ফানি লাগছিল, ফেইরিমাম্মাম।”
মীরা সরু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“ওহ তাই! তোমাকেও লাগিয়ে দেখব?”
“ওকে, লেটস গো!”
ফ্রিশা চেয়ার ছেড়ে উঠেও গেছে। ফ্রিশার এক্সাইটমেন্ট দেখে, মীরা বোকার মতো বলে,
“আরে…. আমি তো ফান করে বলেছি, বাচ্চা। খেতে বসো তুমি। চুল নোং*রা করার কোনো দরকার নেই।”
“শ্যাম্পু করে ফেলব। চলো।”
“না না। বসো তুমি। দেখো, আজকে সবার জন্য ডিমরুটি, সবজি ও চিকেন ভুনা করেছি। ডিফরেন্ট ব্রেকফাস্ট। টেস্ট করে বলোতো, কেমন হয়েছে?”
ফ্রিশা চেয়ারে বসে প্লেট এগিয়ে এনে রুটি ছিঁ*ড়ে মুখে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর বলে,
“ওয়াও! ইটস ইয়ামি। আমাকে এরকম রুটিই বানিয়ে দিবে। কতো সুন্দর পুরো রুটিতে ছোটো ছোটো হোল।”
মীরা বেশ খুশি হয়। বাকি সবার দিকে তাকালে দেখে, তাঁরাও মজা করে খাচ্ছে। ড: আকবর রেহমান বলেন,
“মীরা, তুমি সপ্তাহের ছুটির দিন গুলোতে এগুলো বানাতে পারো। প্রতিদিন তো একই রকম ব্রেকফাস্ট ভালো লাগে না। ছুটির দিনে ডিফরেন্ট কিছু হলো।”
ফ্রিশা প্রতিবাদ করে বলে ওঠলো,
“আমি প্রতিদিন খাব।”
“তুমি প্রতিদিনই খাবে, ফ্রিশামনি। আমি তো ব্রেডের কথা বলছিলাম। তোমার মাম্মাম তো প্রতিদিন সবার জন্য বানাতে পারবে না। তারও ক্লাস আছে।”
“ওহ ওকে।”
ফ্রিশা মন খারাপ করে আস্তে আস্তে খাচ্ছে। মীরা তা লক্ষ্য করে বলে,
“তোমার জন্য প্রতিদিন বানাব। এখন জলদি খাও। ক্লাস আছে তো তোমার। আজ তোমাকে আমি নিয়ে যাব।”
ফ্রিশা খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি খেতে থাকে। শেহজাদ মেয়েকে ও স্ত্রীকে দেখে নিরবে হেসে খাওয়াতে মনোযোগ দেয়।
________
ফ্রিশাকে নিয়ে ফ্রিশার স্কুলে এসেছে মীরা। ফ্রিশার ছুটি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে মীরা। সেখানে আসা অন্য বাচ্চাদের গার্ডিয়ানরা হঠাৎ ফ্রিশার সাথে অচেনা গার্ডিয়ান দেখে মীরাকে এসে জিজ্ঞাসা করে,
“হ্যালো। আমি ফ্রিশার ফ্রেন্ড আনিতার মা।”
ফ্রিশা একা একা বসে ফোন ঘাটছিল। অচেনা কারও কণ্ঠে পরিচিত হওয়ার আভাস পেয়ে মৃদু হেসে জবাব দেয়,
“হ্যালো। আমি ফ্রিশার ফেইরিমাম্মাম।”
“ফেইরিমাম্মাম? সেটা আবার কী?”
“ও আমাকে ডাকে। এমনিতে আমি ওর মাম্মাম।”
“মাম্মাম? কিন্তু ফ্রিশার মা তো দুই বছর আগেই মা*রা গেছেন। তাহলে আপনি কে?”
মীরা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। জবাব দিতে কয়েক মূহুর্ত ভাবছে। কিন্তু অপরপাশের মহিলাটি তার অধৈর্য চেতনার পরিচয় দিয়ে ফের শুধায়,
“তাহলে কি আপনি ফ্রিশার স্টে*পমাদার!?”
চমকে উঠলো মীরা। অপরপাশের মহিলাটির কণ্ঠস্বরটা কেমন আশ্চর্যান্বিত ও উঁচু শোনালো মীরার কাছে। মুখশ্রীতেও কেমন একটা তাচ্ছিল্য ভাব ফুটে উঠেছে তার। মহিলাটির দৃষ্টিতে মীরার জন্য যেন উপহাসের অস্পষ্ট ছাঁপ দেখা যাচ্ছে। আরও ৪-৫ জন মহিলা এসে মহিলাটির পাশে দাঁড়ালো। মীরা নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলো,
চলবে ইনশাআল্লাহ,
কালকে আরেক পর্ব পাবেন। ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।