#পরাণ_দিয়ে_ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ)
#পর্বঃ২৭
#Jhorna_Islam
বাইরে ঝড় হলে টের পাওয়া যায়, কিন্তু মনের ভিতর যে ঝড় উঠে সেই ঝড়ের না আবাস পাওয়া যায় আর না অন্য কেউ তা একটুকু আচ করতে পারে।নীরবে নিভৃতে মনে তোলপাড় তুলে সবকিছু লন্ড ভ’ন্ড করে দিয়ে যায়।
ইসরাত একইভাবে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।এমন ভাব করছে দেখে মনে হচ্ছে তালহা নামের কোনো ব্যক্তি এখানে উপস্থিত নেই। তালহা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে মেয়েটার কান্ড দেখছে।কতো বড় সাহস তাকে ইগনোর করছে।
এইদিক ওইদিকে কি দেখছো তুমি? আমার দিকে তাকাও।(তালহা)
এক্সকিউজ মি? আপনি কি আমাকে বলছেন কিছু স্যার?(ইসরাত)
নাহ তো তুমি ছাড়া এখানে পাশের বাসার কাকিমা ও আছে, উনাকেই বলছি।(তালহা)
ছিঃ ছিঃ শেষে গিয়ে কাকিমাদের উপর নজর দিয়েছে।আর হ্যা ঐ পাড়ার কু’টনি কাকিমা গুলোই আছে আপনার কপালে। আমি দোয়া করি ঐগুলার মতো একটাই পরুক। (ইসরাত)
তালহা রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,, ভুলে যেওনা আমি তোমার স্যার হই। আর আসো আমার সাথে কথা আছে।
হ্যা স্যার হোন কিন্তু এক্স স্যার। আর আমি কোথাও যাবো না আপনার সাথে।
কিসের এক্স স্যার হ্যা কিসের এক্স স্যার? বলে জোরে চিল্লিয়ে উঠে তালহা স্যার।আশেপাশের কয়েকটা স্টুডেন্ট ওদের দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকায়। তালহা নিজেকে সামলে লো ভয়েসে বলে,,চলো তুমি আমার সাথে। এখানে আমি কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না।
তো কে বলছে আপনাকে করতে সিনক্রিয়েট? যানতো এখান থেকে যান আপনি আমার না কথা বলতে ইচ্ছে করছে আর না অন্য কিছু প্লিজ যান বলেই কেঁদে দেয় ইসরাত।তার কিছু ভালো লাগছে না এখন। তালহা কে দেখলেই ঐ ঘটনা টা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে।
ইসরাত কে কান্না করতে দেখে তালহা থতমত খেয়ে যায়।এখানে কান্না করার কি হলো বুঝলো না। সব সময় রণমুর্তি ধারন করে থাকা মেয়ে কিনা ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে কান্না করছে।
কান্না করছো কেন তুমি? এখানে কান্না করার কি আছে?
— আপনি বুঝবেন না।কখনোই বুঝবেন না। আমাকেই বুঝলেন না সেখানে আমি কেন কান্না করছি তা কি করে বুঝবেন?
উফফ ইসরাত ট্রাস্ট মি,,আমার সবকিছু আওলিয়ে যাচ্ছে। এতো কনফিউজড কেন করছো আমাকে? আমি এখানে এসেছি কিছু বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলতে তোমার সাথে।
ইসরাত কোনো উত্তর দেয় না।
তালহা এবার একটু কাতর স্বরে বলে,, প্লিজ ইসু বেশি সময় লাগবে না।
ভয়েসটায় কি ছিলো ইসরাত জানে না। কিন্তু তালহার এমন করে প্লিজ বলায় মন কে আর ধরে রাখতে পারে না। চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক আছে চলেন। কোথায় যেতে হবে?
ভার্সিটির পাশের রেস্টুরেন্টায় চলো।(তালহা)
আচ্ছা চলুন বলে ইসরাত আগে আগে হাঁটতে থাকে।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুইজন মুখোমুখি বসে। তালহা জিজ্ঞেস করে কি খাবে?
আমি এখানে খেতে আসিনি।আমার মনে এতো আনন্দ নেই। আপনার মনে আনন্দ আপনি খান,বেশি করে খান।
ফরমালিটির জন্য হলেও কিছু নিতে হবে তাই না? আমরা তো আর রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার না দিয়ে বসতে পারি না। ব্যাপারটা কেমন দেখায় বলো।
স্যার আপনি এখন বেশি কথা বলা শুরু করেছেন।আজাইরা পেঁচাল বাদ দিয়ে কফি অর্ডার দেন।আর কি বলবেন বলেন আমার ক্লাস আছে।
“যার কথা বলা প্রিয় গানের মতো কানে বাজতো।যার চেহারা চোখে শান্তি দিতো তা যদি হুট করে বদলে যায়, তাহলে কেমন ফিল হয় তুমি কি করে বুঝবে ভাঙা রেডিও?”
মানে? কিসব কথা বলছেন আপনি? আর ভাঙা রেডিও টা কে? এই এক মিনিট এক মিনিট আপনি আমায় বলছেন ভাঙা রেডিও? আর এসব কাব্যিক বাক্য আমার সামনে কেন বলছেন? আপনার কতো লোকই আছে বলার জন্য।
তালহা বিরবির করে বলে,,এইতো আসল ফর্মে ফিরছে।
ইসরাত তালহার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে বলে,, কিছু বলছেন আপনি?
বলার জন্যই ডেকেছি।তালহা এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলে,,যে জন্য ডেকেছি তোমাকে,, এটা কি ঠিক করছো তুমি?
কোনটা?
ঐযে ঐ ব্যাপারটা।(তালহা)
কোন ব্যাপারটা স্যার? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি বলছেন আপনি।
তোমার বিয়ের ব্যাপারটা। এখন কি বিয়ে করাটা খুব জরুরি ইসরাত? সামনে তোমার ব্রাইট ফিউচার পরে আছে। পড়াশোনায় ফোকাস করো,,বিয়ে তো পরেও করতে পারবে। তোমার মা বাবা কে একটু বোঝাও।দেখো ছেলে পক্ষ যতোই বলুক পড়াশোনা করাবে বিয়ের পর সবার মেন্টালিটি তো এক থাকে না। যদি তোমার বিয়ের পর তোমার পড়াশোনায় ক্ষতি হয়ে যায় তখন? আর,,,আর তুমি কেন অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাবে? তোমার মা বলেছে তোমার নাকি আপত্তি নেই কোনো।
তালহা কি বলছে সব ইসরাতের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছু বুঝতে পারছে না।
আপনি কি বলছেন স্যার আমি কিছু বুঝতে পারছি না কিসের বিয়ে, কিসের কি?
তোমার বিয়ে। তোমার মা যে বলল।
মা বলেছে মানে কি বলেছে মা?
তালহা সব খুলে বলে,, ইসরাত শুনে বেশ অবাক হয়। তালহা কেমন চিন্তিত মুখে ইসরাতের দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো ইসরাত বিয়ে করলে সে কত কষ্ট পাবে।
ইসরাত কিছু বলতে নিবে তার আগেই টেবিলে রাখা তালহার ফোনটা বেজে উঠে। ইসরাত তাকিয়ে দেখে তূর নামটা জ্বল জ্বল করছে। ইসরাতের বুকের ভিতর ও জ্বলুনি উঠে যায়। ইচ্ছে করছে এক আছাড় দিয়ে মোবাইল টা ভেঙে ফেলতে। তালহার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ফোনের দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে।এতো সময়ের চিন্তিত ভাবটা সরে গেছে। মনে হচ্ছে অমাবস্যার আঁধার কেটে পূর্ণিমার আলো ধরা দিয়েছে।
ইসরাত কিছু ভাবতে পারছে না, বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,আমার বিয়ে নিয়ে আপনার এতো মাথা ঘামাতে হবে না। নিজের জীবন নিয়ে খুশি থাকুন আপনি। আর আমি বিয়ে করবো অবশ্যই।আপনাকেই দাওয়াত দিবো সবার আগে। আসবেন কিন্তু সাথে আপনার স্পেশাল গেস্ট নিয়ে।কথাগুলো বলে ইসরাত বের হয়ে যায় রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর চোখের পানি মুচ্ছে। জীবন টা এমন কেন? কিছু মানুষ বুঝি কষ্ট আর যন্ত্রনা দিতেই আমাদের জীবনে আসে। আসেনা তো আমরা ইনভাইট করে নিয়ে আসি কষ্ট পাওয়ার জন্য।
ইসরাত রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কারো সাথে ধাক্কা খায়। ইসরাত লোকটার দিকে না তাকিয়েই সরি বলে চলে যেতে নেয়।
” এক্সকিউজ মি মিস! ”
ইসরাত পিছনে না তাকিয়েই থামে।লোকটা হাত বাড়িয়ে ইসরাতের দিকে একটা টিস্যু ধরে বলে,,
“সুন্দর চোখে কাজল শোভা পায়, চোখের পানি না।যে এই চোখে পানি এনেছে সে বড্ড বোকা,।” বলে হাতে টিস্যু ধরিয়ে দেয়।
ইসরাত ঘুরে লোকটা কে দেখার জন্য কিন্তু মুখ দেখার আগেই লোকটা অনেক দূর চলে যায়। শুধু পিছনটা দেখতে পায় ইসরাত।
************
নূর জীবনের প্রথম মনে হয় আজ একটা সাহসীকতার কাজ করতে যাচ্ছে। একা একা আজ শ্বশুর বাড়িতে পা দিতে চলেছে। এতো বড় একটা কাজ করতে যাচ্ছে অথচ নূরের মনের ভিতর একটুও ভয় বা দ্বিধা কাজ করছে না। এসব কিছু মন থেকে বের হয়ে গেছে। এখন একটা কথাই মনে বাজতেছে সৌন্দর্য তাকে ভুল বুঝেছে,রাগ করে কথা না বলে চলে এসেছে। নূর এসব সহ্য করতে পারছে না।
গেইটের দারোয়ান কে গেইট খুলতে বলায় দারোয়ান আপত্তি জানায়।অপরিচিত কাউকে বিনা অনুমতিতে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ। আর নূর কে তিনি চিনেন ও না যে ঢুকতে দিবে। নূর নিজের পরিচয় দিলেও কোনো কাজ হয় না। লোকটা কিছুতেই বিশ্বাস করে না। আজ কাল এসব বলে মানুষ ধা’ন্ধাবাজি করে। নূর যে বাড়ির বউ তার প্রমান কি?
নূরের এবার কান্না করে দিতে ইচ্ছে করছে। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না।কাউকে কল দিবে সেটাও করতে পারছে না কে জানে কি ভাববে ওরা।আর সৌন্দর্য কে কয়েকবার কল দিয়ে ও পায় নি। পরোক্ষনে একটা বুদ্ধি মাথায় আসে।ঘুরতে গিয়ে সৌন্দর্য আর ফাতিহার সাথে অনেক ছবি তোলা হয়েছে। সেই ছবি বের করে দেখায়।দারোয়ান ছবিগুলো দেখে একঝলক নূরের দিকে তাকায় তারপর সরি ম্যাম বলে গেইট খুলে দেয়। নূর স্বস্তির নিশ্বাস নেয় ফাতিহা কে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। ঘুরতে গিয়ে সেই বায়না করেছিলো এক সাথে ছবি তোলার। ফাতিহার বায়নার জন্য কাজে লেগে গেছে আজ।
এই বাড়িতে নূরের প্রথম আসা সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে এদিকে ওদিকে তাকাতে থাকে। কিন্তু কাউকেই চোখে পরছে না তার। সৌন্দর্যের রুম কোনটা সেটাও জানা নেই। কিছু না ভেবে তো এসে গেলো এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। কাউকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে তাও পারছে না খুব লজ্জা লাগছে। নূর এদিক ওদিক তাকানোর মাঝেই একটা মহিলা এসে সামনে দাঁড়ায়। নূর বুঝতে পারলো না কে এই মহিলা। সৌন্দর্যের বাড়ির সকলকে এখনও সে চিনে না। মহিলা টা নূরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করতে থাকে। তারপর সামনে এসে জানতে চায় কাকে চাই? কে আপনি?
নূর নিঃসংকোচে বলে,,জ্বি আমি ফাতিহার মাম্মা।
মহিলা টা মুহূর্তের মধ্যে নিজের খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ওও ম্যাডাম আপনি? দুঃখিত আপনাকে চিনতে পারি নি আমি। আসলে আমি ছুটিতে ছিলাম তাই আর আপনাকে দেখা হয় নি। এই দেখুন আমার পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি, আমি ফাতিহার দেখাশোনা করি।আমার নাম রুবি।
মহিলাটার কথায় নূর কি বলবে খুঁজে পায় না শুধু একটু হাসে।
আসুন আসুন ম্যাডাম বসুন।কিন্তু বাড়িতে তো বড় ম্যাডাম মানে সৌন্দর্য স্যারের দাদি আর সৌন্দর্য স্যার ছাড়া কেউ নেই। আর বড় ম্যাডাম ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে।
আমার অন্য কাউকে লাগবে না এখন। তোমার সৌন্দর্য স্যারের রুমটা আপাতত দেখিয়ে দাও তাহলেই চলবে।
রুবি নূরের কথা শুনে নূরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে। তারপর বলে,,উপরতলার ডান সাইডে একটা বিরাট বড় রুম আছে ঐটাই স্যারের।
আমি রুমে না ঢুকে কি করে বুঝবো ঐটা বিরাট রুম? নূর জিজ্ঞেস করে।
আরে ম্যাডাম ঐ সাইডে একটাই রুম তাও স্যারের আর কতো কিছু যে স্যার করেছে ডান সাইডে শুনবেন?
নূর যেতে যেতে বলল পরে শুনবো বলেই এখান থেকে কেটে পরে।
ডান সাইডে আসতে প্রথমেই রুম টা পেয়ে যায়। কোনো কিছু না ভেবে রুমে ঢুকে ও পরে। সৌন্দর্য মাত্র বাথরুম থেকে গোসল করে বের হয়েছে। মাথা ব্যথার জন্য লম্বা একটা শাওয়ার নিয়েছে। মাথা মুছতে মুছতে সামনের দিকে তাকিয়ে নূর কে দেখে অবাক হয়ে যায়।
নূর কোনো কিছু না বলে দৌড়ে এসে সৌন্দর্য কে ঝাপটে ধরে কেঁদে দেয়।
আপনি আমায় এভাবে ইগনোর কেন করছেন স্যার? আমার সাথে কথা কেন বলছেন না? বিশ্বাস করুন ঐটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিলো, আমি পরে যাচ্ছিলাম দেখে নাহিদ স্যার ধরেছে আর কিছু না।
নূর তুমি এখানে? সৌন্দর্য নিজের বুক থেকে নূরের মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে।
আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। (নূর)
কিসের ভুল আর কি বলছো তুমি?
আপনি জানেন না কিছু? ঐ সময় নাহিদ স্যার আমাকে ধরেছে বলে আপনি আমায় ভুল বুঝেন নি?
নাহ তো।(সৌন্দর্য)
— তাহলে আমার সাথে কথা কেন বলেন নি? আমাকে ইগনোর কেন করছেন?
কোথায় ইগনোর করলাম? শরীরটা ভালো না আমার। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।ঐসময় কথা ও বলতে পারছিলাম না এতোটাই কষ্ট হচ্ছিল।তাই চলে এসেছি।
বলেন কি এইজন্য আপনাকে এমন দেখাচ্ছে?
হয়তো।বলেই সৌন্দর্য বিছানায় বসে। বায় দা ওয়ে,, আমার ইগনোরে তোমার কিছু যায় আসে? আমি ভুল বুঝলেও তোমার কিছু যায় আসে নূর?
নূর মাথা নিচের দিকে দিয়ে রাখে।
অবশ্য তোমাকে আর বলতে হবে না। যেই মেয়ে বরযাত্রী ছাড়া শ্বশুর বাড়ি চলে আসে স্বামীর ভুল ভাঙানোর জন্য তার অবশ্যই অল্প হলেও কিছু যায় আসে।
নূর মনে মনে বলে,,অল্প কিছু না সুন্দর মানুষ অনেকটাই যায় আসে।
“পরাণ তোমার হাতের ছোঁয়ায় আমার ব্যাথা ভ্যানিশ করে দাও না।” কি নিঃসংকোচ আবদার। নূর এক মুহূর্ত ও দেরি করে না প্রায় দৌড়ে এসে খাটে বসে।নূর বসার সাথে সাথে সৌন্দর্য নূরের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে।
#চলবে,,,,?