#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৩
ইশান হাঁচি দিতে দিতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। গতকাল রাতে ছাদে অনেকটা সময় হিমের মধ্যে থাকার কারণে ঠান্ডা লেগে গেছে বেচারার। নাক, মুখ লাল হয়ে গেছে ঠান্ডা লাগার কারণে। তার মধ্যে রাত তিনটে পর্যন্ত জেঁগে সকল কাজ শেষ করতে হয়েছে অফিসের। রাত পর্যন্ত ইশান ঠিকেই ছিলো। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই শুরু হলো হাঁচি, কাশি আর নাক টানাটানি।
নেহা বেগম ব্রেকফাস্ট টেবিল গোছাচ্ছেন। ছোট ছেলের এমন করুন অবস্থা দেখে ছেলের কাছে এসে বলেন।
–ইশান! কি হয়েছে বাবা তোর?
ইশান সোফার উপরে অফিসের ব্যাগ আর কোর্টটা রাখতে রাখতে বলে।
–কিছু হয় নি মা! ওই একটু ঠান্ডা লেগেছে।
কথাটা বলতে বলতে দিলো একটা হাঁচি। নেহা বেগম চিন্তিত স্বরে বলেন।
–কিছু হয় নি বলছিস। আমি তো স্পষ্ট দেখতে পারছি তোর মারাত্মকভাবে ঠান্ডা লেগেছে।
–মা এতো টেনশন করো না তো ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
–ঠিক আছে নাস্তা করে ঔষধটা খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।
–হুমম।
ইশান ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসার কিছুক্ষণ পরেই ইহান আর সোহেল ফরাজী এসে বসে। ইশানের এমন নাক টানাটানি দেখে ইহান প্রশ্ন করে।
–কি রে তোর কি ঠান্ডা লেগেছে নাকি।
–হুমম।
–কিভাবে?
ইশান মনে মনে বলল।
–আর কিভাবে নিজে যদি ছাদের দরজাটা লক না করে যেতে তাহলে আমার আছে এই বেহাল অবস্থা হতো না। এতো পরিমাণ নাক মুখ কামড়াচ্ছে। উফফ!
ইশানকে অন্যমনস্ক দেখে ইহান জোরে বলে।
–কি রে কোথায় হারিয়ে গেলি?
–এমনি.. এমনি ঠান্ডা লেগে গেছে।
–এমনি এমনি কি করে ঠান্ডা লেগে যায়।
–সিজন চেইন্জ হচ্ছে তাই ঠান্ডা লেগেছে।
–ওও আচ্ছা তাহলে ঔষধ খা ঠিক হয়ে যাবে।
–হুমম। আর ভাইয়া তুমি গতকাল একটা কাজ একদম ঠিক করো নি।
নাক টানতে টানতে কথাটা বলে আর অন্য দিকে ভাইয়ের কথা শুনে ইহানের ভ্রু কুচ করে বলে।
–আমি আবার কোন কাজটা ঠিক করেনি?
–ভাবো তাহলেই বুঝতে পারবে কোন কজাটা ঠিক করো নি তুমি।
ইহান ভাবতে শুরু করে ও কোন কাজটা ঠিক করে নি গতকাল।এর মাঝে সোহেল ফরাজী বলেন।
–ইশান তুমি কি আজকে অফিসে যাবে।
–হুম বাবা আজকে থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করব। অনেক কাজ পেন্ডিং হয়ে পড়ে আছে যেগুলা আজকের মধ্যে কমপ্লিট করতে হবে।
–তোমার এই অবস্থায় কিভাবে?
–কিছু হবে না বাবা। আই উইল ম্যানেজ!
–ঠিক আছে যেটা ভালো মনে হয় তোমার।
এর মাঝে ইশা বাড়িতে আসে। ইশাকে দেখে নেহা বেগম বলেন।
–কি রে তদের দুই বান্ধবীর মিটিং সম্পূর্ণ হলো।
ইশা ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে ইশানের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে বলে।
–হে মা খুব ভালো ভাবেই মিটিংটা সম্পূর্ণ হল। আসলে রাতের অনেকগুলা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হয়েছে আমাদের। জানো মা রাতে কি হয়েছে…?
ইশান চকিতে বোনের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায়। আসলে চোরের মন তো তাই পুলিশ পুলিশ করছে আর এই মেয়ের পেট যেই পাতলা না জানি কখন কি বলতে বলে দেয় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। ইশা কিছু বলছে না দেখে নেহা বেগম বলেন।
–কি হলো তুই চুপ করে গেলি কেন? আর তোরা দু ভাই বোন চোখে চোখে কি কথা বলছিস?
ইশান মায়ের কথা শুনে সাথে সাথে ইশার দিকে থেকে নজর ফিঁরিয়ে নেয়। ইশা ভাইয়ের এমন চাহনি দেখে মাথা নেঁড়ে মেকি হাসি দিয়ে বলে।
–না মা কিছু হয় নি আমি তো মজা করছিলাম।
—ঠিক আছে মজা করা শেষ হয়ে থাকলে তাহলে খেতে বস।
–না না মা আমি খাবো না। আমি খেয়ে এসেছি আন্টি না খাইয়ে ছাড়বেনা। তাই বাধ্য হয়ে খেতে হলো।
এর মাঝে ভাবুক ইহান ইশানকে বলে।
–এই ইশান এতো হেয়ালি না করে সরাসরি বলতো কোন কাজটা ঠিক করে নি আমি।
ইশান আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। ইশান খুব ভালো করেই জানে ইশা যে তার সাথে ফাজলামি করছে। এই মেয়েকে ও রগে রগে চিনে। এই মেয়ে সুযোগ পেলেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা শুরু করে দেয়। এমন অনেক সিচুয়েশনে ফেলেছে দু ভাইকে ইশা। তাই বোনকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে।
–ভাইয়া তুমি ভাবতে থাকো বসে বসে আমি অফিসে গেলাম। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নেহা বেগম ছেলের কথা শুনে বলেন।
–কিন্তু তুই তো কিছু খেলি না। আর ঔষধটাও তো খেতে হবে নাকি।
–আমি অফিসের যাওয়ার পথে ঔষধ কিনে খেয়ে নিবো এখন আমি আসি।
ইশান ঝড়ের বেগে অফিসের ব্যাগ আর কোর্ট হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। পার্কিং লট থেকে নিজের গাড়ি বের করতে নিলে কিছু একটা মনে করে প্রেয়সীর বেলকনির দিকে তাকায় প্রেয়সীকে এক নজর দেখার জন্য। মন বলছিলো তীর হয়তো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু না বেলকনি পুরাই ফাঁকা। ইশানের মনটা নিমিষেই কালো মেঘে ছেয়ে গেল। মনটা ছটপট করছে প্রেয়সীর মায়বী মুখটা এক পলক দেখার জন্য কিন্তু চাইলেই তো আর সব কিছু পাওয়া যায় না। ইশান দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
ইশান চলে যাওয়ার পরপরেই তীর পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। তীর এতক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সকালের মিষ্টি রোদ সারা গায়ে মাখছিলো। এর কিছুক্ষণ পরেই ইশানের দেখা পেতেই পর্দার আড়ালে চলে যায়। তীর ইশানের সামনে পড়তে চাইছে না। ইশানের চোখের সামনে পড়লে হয়তো লজ্জায় মরেই যাবেই। কিন্তু এক বার না এক বার তো তাকে ইশানের সামনে পড়তেই হবে। তীরের রাতের ঘটনা মনে পড়তে বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠে। মনের অজান্তে নিজের কপালে হাতটা চলে যায়। এই কপালের মাঝখানটায় ইশানের নরম অধর জোড়া ছুঁয়ে ছিলো এটা ভেবেই তীরের সারা গায়ে শিহরণ বয়ে যায়। আনমনে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি।
________
ইশান আর রিফাত মুখোমুখি বসে আছে কাচ যুক্ত দু তলার বিশাল বড় এক রেস্টুরেন্ট। ইশানের দৃষ্টি দুর আকাশের টুকরো টুকরো তুলোর মতো সাদা মেঘের পানে। যে মেঘগুলো বাতাসের দ্বারা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে আর অন্য মেঘ গুলা জায়গা করে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে খোলা আকাশে কয়েকটা নাম না জানা পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে।
রিফাতের মুখে সারা রাজ্যের বিরক্তের চাপ প্রকাশ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রায় এক ঘন্টা যাবত বসে আছে এই রেস্টুরেন্টে ওরা। ইশানের কল পেয়ে রিফাত অফিস থেকে চলে আসে প্রাণ প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু প্রাণ প্রিয় বন্ধু যে স্তব্ধ হয়ে বসা দিয়েছে তো দিয়েছেই একটা কথাও মুখ ফুটে বলছে না। আজব বোবা টোবা হয়ে গেলো নাকি এই ছেলে। কোমড় ধরে গেছে রিফাতের বসে বসে থাকতে থাকতে তাই আর সহ্য করতে না পেরে ইশানকে রেগে বলে।
–ওই তুই কি আমাকে তোর মনব্রত পালন করা দেখার জন্য ডেকেছিস। এক ঘন্টা যাবত তুই তোর মনব্রত পালন করচ্ছিস। সেটা আর কতক্ষণ পালন করবি আমাকে একটু কাইন্ডলি বলবি প্লিজ?
ইশান রিফাতের দিকে ফিরে তাকায়। ইশানের চোখে, মুখে চিন্তার চাপ স্পষ্ট ফুঁটে উঠছে। ইশানের এমন রুপে থেকে রিফাত মেকি হাসি দিয়ে বলে।
–না মানে বললে আমার একটু সুবিধা হতো এই আর কি। অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে তো। তাই তোর মনব্রত শেষ হলে আমি আবার তোর সাথে এই জায়গাতে দেখা করতাম।
ইশান কালো কাচ যুক্ত টেবিলের উপর দু হাত রেখে নিজের প্রতিবিম্বর দিকে দৃষ্টিপাত করে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছাড়ে। ইশানের এমন অবস্থা দেখে রিফাতের একটু সন্দেহ হতে শুরু করে তার বন্ধুর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে যেটা নিয়ে খুব চিন্তিত। রিফাত গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলে।
–কি হয়েছে ইশান?
ইশান নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে।
–আমি কোনো ভুল করছি না তো।
রিফাতের ভ্রু-কুচকে আসে ইশানের কথা শুনে। ভুল করছি না তো মানে কি ভুলের কথা বলছে ছেলেটা।
–কি ভুলের কথা বলছিস তুই ইশান খুলে বল আমাকে।
ইশান রিফাতকে গতকাল রাতের সবটা ঘটনা খুলে বলে। রিফাত খুশি হয়ে বলে।
–এট লাস্ট তাহলে আমার বন্ধু তার প্রেয়সীকে তার মনের কথা বলতে পারলো। তাও আবার প্রেয়সীর ফাঁদে পা দিয়ে। না শুধু প্রেয়সীর না সাথে ছোট বোনও আছে। মানে এই দুটো পুচঁকের মাথায় এমন ভাবনা আসতে পারে তা আমার কল্পনার বাহিরে।
রিফাত কথার মাঝেই ইশানের মুখ পানের দিকে তাকায়। ইশানকে দেখে বুঝা যাচ্ছে না ওর ভেতরে ঠিক কি চলছে। ও কি খুশি নয় নিজের মনের কথাটা প্রেয়সীকে বলতে পেরে। রিফাত ইশানের হাত ধরে বলে।
–এই ইশান কি হয়েছে তোর? তোকে এতো চিন্তিত দেখা যাচ্ছে কেন?
–আমাদের সম্পর্কটা যদি কেউ মেনে না নেয় তাহলে।
–কি বলচ্ছিস এসব? কেন মেনে নিবে না অব্যশই মেনে নিবে সবাই। তোর বাড়ির লোকজন তো নিশ্চয়ই মেনে নিবে এটা সিউর আর রইলো তীরের বাড়ির লোকজন ওরা নিশ্চয়ই তোকে মেনে নিবে। তোর মতো ভালো একটা ছেলেকে নিশ্চয়ই ওরা হাত ছাড়া করবে না।
রিফাতের কথা শুনে ইশানের ঠোঁটের কোণে হঠাৎ করেই তাচ্ছিল্য পূর্ণ এক হাসির রেখা ফুটে উঠে আর বলে।
–জানি না ভবিষ্যতে কি হবে? কি লেখা আছে আমার ভাগ্যে।
–সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেঁড়ে দিবি কেন তুই? নিজেও চেষ্টা করবি ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে।
–আমি জানি আমার পরিবার তীরকে খুব ভালোবাসে। ওরা তীরকে হাসিমুখে মেনে নিবে কিন্তু তীরের পরিবার ওরা যদি আমাদের এই সম্পর্কটা মেনে না নেয়। তাহলে আমি ওদের ওমতে তীরকে নিজের করতে পারবো না। আমি চাই সবার দোয়াতে একটা নতুন সম্পর্কের সূচনা করতে।
–তুই অযথাই চিন্তা করছিস তীরের পরিবারও তোকে মেনে নিবে দেখিস। আর যদি মেনে নাও নেয় তাহলে তাদের অমতেই তীরকে বিয়ে করে নিবে।
–আমি চাইলেই এমনটা করতে পারবো কিন্তু এমনটা করবো না কারণ এতে তীরের প্রতি অবিচার করা হবে। আমি চাই না ও আমার জন্য ওর পরিবারের কাছ থেকে দুরে সরে যাক।
–বুঝলাম। আর এতো টেনশন করিস না তো সব কিছু ঠিকেই হবে ভবিষতে দেখে নিস।
–কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে তীরের মা আমাকে মেনে নিবেন না কোনো ভাবে।
–তোর এমনটা মনে হচ্ছেই বা কেন?
–জানি না। কিন্তু সামনের দিনগুলা হয়তো খুব একটা সুখকর হতে যাচ্ছে না আমার জন্য।
#চলবে_____